ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব কি এখনো প্রাসঙ্গিক?
- প্রকাশ: ০৮:৪৪:৪৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
- / ৩৭১০ বার পড়া হয়েছে
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছিলেন, কোনো তত্ত্বই সময়ের প্রেক্ষিত ছাড়া বিচার করা যায় না। মনুষ্যসৃষ্ট যে কোনো তত্ত্বই সর্বকালীন বা চিরস্থায়ী নয়। সময়ের প্রেক্ষিতে যুগের চাহিদা পূরণকল্পে যে কোনো তত্ত্বই পরিবর্তিত হতে পারে। তার এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অনুসরণযোগ্য। কারণ, নানা সময় যুগের চাহিদা পূরণের জন্য বিভিন্ন তত্ত্ব প্রণীত হয়।
আবার সময়ের প্রয়োজন শেষ হলে সেই তত্ত্বের উপযোগিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব একসময় সারা বিশ্বব্যাপী প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। অনেকেই মনে করতেন, ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সর্বকালীন এবং এটা কখনোই ভুল প্রমাণিত হবে না। কিন্তু এখন অনেকেই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব নিয়ে প্রশ্ন উৎথাপন করতে শুরু করেছেন। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের আবশ্যকতা কি শেষ হয়ে যাচ্ছে?
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব কি নতুন কোনো থিউরি দ্বারা পুনঃস্হাপিত হতে যাচ্ছে? সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সে রকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে মূল উপজীব্য হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে অর্থাৎ ১, ২, ৪, ৮, ১৬— এইভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫— এইভাবে ক্রমান্বয়ে।
আর শিল্প উৎপাদনও অনেকটা জনসংখ্যার মতো জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। কাজেই কৃষি নয়, বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা পূরণের জন্য কৃষি নয় শিল্পের ওপর জোর দিতে হবে।
কোনো দেশ যদি শিল্প উৎপাদনে সাফল্য প্রদর্শন করতে পারে, তাহলে সেই দেশের সাধারণ মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। ম্যালথাস আরো বলেছিলেন, একটি দেশের জনসংখ্যা প্রতি ২৫ বছর পরপর দ্বিগুণ হবে। মানুষ যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে প্রকৃতি ঝড়-ঝাঞ্ঝাসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে জনসংখ্যা কমিয়ে আনার ব্যবস্হা করবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উৎথাপিত হতে শুরু করেছে। অনেক দেশই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করেছে।
আমরা যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব, এই তত্ত্ব অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখন আর প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছে। এই বক্তব্য কিছুটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, কিন্তু এটাই সত্যি এবং বাস্তবতা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা অর্জন করে তখন বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৮৬ লাখের মতো। অর্থাৎ বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ দশমিক ২৪ গুণ। অর্থাৎ ম্যালথাসের তত্ত্ব অনুযায়ী, ২৫ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়নি। জনসংখ্যা প্রায় সোয়া দুই গুণ বেড়েছে ৫০ বছরে। অন্যদিকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক দ্রুত গতিতে।
১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের খাদ্য শস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২০ লাখ টন। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এসে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ কোটি ২৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। বর্ণিত সময়ে দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। দেশের মোট জমির পরিমাণ ১৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ। মোট জমির মধ্যে উঁচু জমি ২০ শতাংশ, মাঝারি ধরনের উঁচু জমি ৩৯ শতাংশ, মাঝারি ধরনের নিম্নভূমি ১৫ শতাংশ এবং নিম্নভূমি ২ শতাংশ।
প্রতি বছর বাড়িঘর নির্মাণ, রাস্তা তৈরি, বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি কাজে ব্যবহারের জন্য জমির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। আশির দশকে গ্রামের ১৫ শতাংশ জমি বাড়িঘর ও অন্যান্য কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হতো। এখন এর পরিমাণ অনেক বেড়েছে। দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কীভাবে হ্রাস পাচ্ছে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৯৮৩-১৯৮৪ অর্থবছরে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার একর। ১৯৯৬ সালে এসে তা ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার একরে হ্রাস প্রাপ্ত হয়। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতি বছর গড়ে ১ শতাংশ আবাদি জমির চাষের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
১৯৭৩ সালে দেশে দরিদ্র মানুষের হার ছিল ৮৯ শতাংশ। বর্তমানে তা ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্হানে রয়েছে। স্বাদু পানিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্হানীয় পাঁচটি দেশের একটি। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে মোট শিল্প-কারখানার সংখ্যা ছিল ৩১৩টি। বর্তমানে শিল্প-কারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ২৯১টিতে।
১৯৭২-১৯৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয়েছিল ৩৪ দশমিক ৮৪ কোটি মার্কিন ডলার, গত অর্থবছরে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৭৫ দশমিক ৮৩ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ শিল্প উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছে কিন্তু কোনোভাবেই কৃষি খাতের মতো এত ব্যাপক নয়। অথচ অপরিকল্পিতভাবে জমি ব্যবহারের ফলে কৃষি খাতের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্হা এখনো সেকেলে ধরনের। পুরোপুরি কৃষি যান্ত্রিকায়ন করা গেলে কৃষি খাতের উৎপাদন অনেক গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এছাড়া গ্রামীণ এলাকায় আবাসন খাতের জন্য যেভাবে অপরিকল্পিত উপায়ে বাড়িঘর নির্মাণ করা হচ্ছে তা এখনই বন্ধ করা দরকার। গ্রাম এলাকাতেও শহরের মতো বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে বিত্তবান পরিবারগুলো বাড়ি নির্মাণের সময় অনেকটা জায়গা জুড়ে নির্মাণ করে। এতে জমির অপচয় হয়।
কোনো পরিবারে তিন ভাই থাকলে তারা পৃথক হয়ে যাবার পর ভিন্ন ভিন্ন জমিতে বড় আকারের বাড়ি বা ভবন নির্মাণ করে থাকেন। এতে প্রচুর জমির অপচয় হয়। এটা রোধ করার জন্য সরকারি উদ্যোগে আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। কৃষি খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতির পেছনে কোনো কোনো ব্যক্তির বিশেষ অবদান রয়েছে। বিশেষ করে, টিভি চ্যানেলে নিয়মিত কৃষিবিষয়ক যেসব অনুষ্ঠান হয় তা এ খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। তারা যে কোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে। তাই কৃষি খাতের এই উন্নয়ন কোনোভাবেই অলৌকিক বা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বাংলাদেশের কৃষক এবং কৃষি খাত ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছে। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব বাংলাদেশে কোনোভাবেই প্রযোজ্য হয়নি। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ম্যালথাস তার জনসংখ্যা তত্ত্ব প্রণয়নকালে কৃষি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি তেমন একটা বিবেচনায় রাখেননি। তিনি সাধারণ কিছু অনুমিত ধারণার ওপর ভিত্তি করে তার জনসংখ্যা তত্ত্ব প্রণয়ন করেছিলেন।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কীভাবে কৃষিব্যবস্হাকে পালটে দিতে পারে, তার প্রমাণ আমরা অনেকভাবেই পেয়েছি। এখন এক ফসলি জমিকে সহজেই দুই ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করা যায়। দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি এবং তিন ফসলি জমিকে চার ফসলি জমিতে পরিণত করাও সম্ভব। ফসলের পরিপক্বতার সময়ও কমানো হয়েছে। আগে যে ফসলের তোলার জন্য ১২০ দিন সময় প্রয়োজন হতো, এখন তা ৮০ থেকে ৯০ দিনেই পরিপক্ব হয়। পানির ওপর ভাসমান সবজি চাষ, এমনকি ধান চাষ করাও সম্ভব। নদীতে ভাসমান ঘের দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আগে বাংলাদেশের মানুষ ভাতের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। এখন তারা ভাতের পাশাপাশি অন্যান্য সহায়ক খাদ্য গ্রহণ করছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। তখন মানুষ না খেয়ে থাকত। কিন্তু এখন জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৮৬ লাখ। কিন্তু মানুষ না খেয়ে মরছে না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল খাদ্যঘাটতি অঞ্চল। আমদানির মাধ্যমে খাদ্যচাহিদা পূরণ করতে হতো। এখন বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ম্যালথাস তার তত্ত্বে বলেছিলেন, মানুষ যদি স্বাভাবিকভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করে, তাহলে প্রকৃতি নানা ধরনের দুর্যোগের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করবে। তার এই বক্তব্যও সঠিক নয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ ঠিকই, কিন্তু তাই বলে এসব দুর্যোগের কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে না।
ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই যে মিথ্যে প্রতীয়মান হয়েছে তা নয়, বিশ্বের অনেক দেশই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেছে। এমনকি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করলেও ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের কোনো বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে চিরসত্য বলে মেনে নেওয়ার কোনো মানে থাকতে পারে না।