মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কি আসলেই মেয়াদোত্তীর্ণ এবং কী হয়
- প্রকাশ: ০১:০০:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
- / ২৫৫৮ বার পড়া হয়েছে
সারা দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সংরক্ষণ, বিক্রি বন্ধ এবং ওষুধ প্রত্যাহার-ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
জনস্বার্থে করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার রুলসহ এ আদেশ দেন বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
১০ মে, ২০১৯ তারিখ এক অনুষ্ঠানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ঢাকা শহরের ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখা হয়। এ বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে ১৭ জুন, ২০১৯ রিট করেন জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের পক্ষে নির্বাহী পরিচালক সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলন।
মাহফুজুর রহমান মিলন বলেন, রুলে ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি ও সংরক্ষণ বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়েছেন।
এ ছাড়া আদালত স্বাস্থ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, বাণিজ্য সচিব, শিল্প সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ও উপপরিচালক, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি ও মহাসচিবকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত বাজার তদারকির গেল ৬ মাসের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে।’
এদিকে দেশের ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির তথ্য সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ২০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল ক্যাম্পেইন বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এ দাবি জানান।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথা যদি সত্য হয়, তাহলে তো এখানেই কিসসা খতম। আর কারও কিছু বলার থাকে না। তারপরও বিষয়টি যেহেতু লাইমলাইটে চলে এসেছে, এ নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
ওষুধের এক্সপায়ার ডেট বা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বলতে কী বোঝায়?
কোনো ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কীভাবে নির্ধারণ করা হয় বা তা কতটুকু সততা ও বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়? আর আসলে কি ওষুধের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর নষ্ট হয়ে যায়?
ধরুন আপনি প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভুগছেন।
আপনি খুঁজতে গিয়ে ড্রয়ারে দেখলেন প্যারাসিটামল রয়েছে যার মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এক বছর আগে পার হয়ে গেছে। আপনি এখন কী করবেন? আপনি কি এই ওষুধ খাবেন, না খাবেন না।
খেলে কি তা ভুল সিদ্ধান্ত হবে এবং তার কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হবেন; আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন, আপনি মারা যাবেন বা নিদেনপক্ষে আপনার মাথাব্যথা সারবে না? এ ধরনের প্রশ্ন প্রায় সব মানুষের মনে উদয় হয় এবং এর ফলে মানুষের মনে নানা ধরনের সংশয়ের উদয় হয়, বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
এবার বলি, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে এত বিভ্রান্তির কারণ নেই, আতঙ্কেরও কারণ নেই। কারণ নাইট্রোগ্লিসারিন, ইনসুলিন, তরল অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কিছু সংবেদনশীল ওষুধ ছাড়া বেশিরভাগ ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পরও কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা অনেকদিন ঠিক থাকে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে চমৎকার কিছু তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। ১৯৭৯ সালের এক আইন মোতাবেক ওষুধ কোম্পানিগুলো অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওষুধের ওপর মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখপূর্বক একটি সিল দিয়ে থাকে, যার মাধ্যমে বলা বা নিশ্চয়তা দেয়া হয়- এ সময়ের মধ্যে ওষুধটি গ্রহণ করা হলে ওষুধের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত থাকবে এবং এ সময়ের পর গ্রহণ করলে কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা শতভাগ নাও পাওয়া যেতে পারে।
মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ সম্পর্কে একটি চমৎকার ঘটনা বলি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অনুরোধে এফডিএ একটি গবেষণা চালায়। সেনাবাহিনীকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ খুব দামি ওষুধ সংরক্ষণ করতে হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের পর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের এ ওষুধ ধ্বংস করে ফেলতে হয়।
এ বিশাল অঙ্কের অর্থ সাশ্রয়ে কিছু করা যায় কিনা, তা দেখা ছিল এ গবেষণার উদ্দেশ্য। গবেষণায় দেখা যায়, ১০০টিরও বেশি ওটিসি (ওভার দ্য কাউন্টার) ও প্রেসক্রিপশন ড্রাগের ৯০ শতাংশ ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার ১৫ বছর পরও কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা ঠিক পাওয়া গিয়েছিল।
এরকম আরও বেশকিছু গবেষণায় ঠিক এ ধরনের ফলাফল পাওয়া যায়। ১৯৮৬ সালে বিপুল অর্থ সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে বিমানবাহিনী এফডিএ’কে মান ঠিক থাকা ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ বাড়ানো যায় কিনা তা খতিয়ে দেখতে বলে; ফলে এফডিএ ও প্রতিরক্ষা বিভাগ শেলফ লাইফ এক্সটেনশন প্রোগ্রাম (Shelf Life Extension Program) চালু করে। এ প্রোগ্রামের আওতায় করা গবেষণার ফলাফল নিয়ে পরে একসময় লেখার ইচ্ছা রাখি।
মার্শাল অ্যালেন ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই প্রোপাব্লিকায় দ্য মিথ অব ড্রাগ এক্সপাইরেশন নামে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধটি তিনি শুরু করেন এভাবে- এফডিএ বছরের পর বছর ধরে কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার দিক থেকে বেশিরভাগ ওষুধ একদম ঠিক থাকার তথ্য জানা সত্ত্বেও হাসপাতাল ও ফার্মেসিগুলোকে প্রতিবছর মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করে ফেলতে হয়; এটা বিবেচনা না করে যে, এসব ওষুধ কত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয়বহুল।
আরও একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা বলি। একটি কালো আলমারিতে ১৪ পদের প্রেসক্রিপশন ড্রাগের একটি বাক্স ভুলে ফেলে রাখা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের দিকে। এর মধ্যে আরও ছিল অ্যানটিহিস্টামিন, ব্যথানাশক, উদ্দীপক জাতীয় ওষুধ। মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার প্রায় ৩০ বছর পর এ ওষুধ খুঁজে পাওয়া যায়।
ভাবা হয়েছিল, ওষুধগুলো নষ্ট বা বিষাক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু লী কানট্রেল ও রয় গেরনা নামের দুই গবেষক ৩০ বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া এ ওষুধ পরীক্ষা করে দেখতে পান- এসব ওষুধের সক্রিয় উপাদান পারফেক্টলি ঠিক আছে এবং কার্যকারিতাও নষ্ট হয়নি। ওষুধগুলো ছিল মূল বা আসল সিল দেয়া পাত্রে। পরীক্ষার ফলাফলে তারা হতবাক হয়ে যান।
ঠাণ্ডা জায়গা যেমন রেফ্রিজারেটরে ও নির্দেশিত পরিবেশে রাখা হলে ওষুধের কার্যকারিতা মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পরও বহু বছর অক্ষুণ্ণ থাকে। এর মানে কি এই যে, ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ বলতে আমরা যা বুঝি বা যা বোঝানো হয়, তা প্রকৃত সত্যটি প্রকাশ করছে না?
এখানে কোথাও না কোথাও গলদ বা ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে এবং আমরা এও কি ধরে নিতে পারি, কোনো কোনো ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর গ্রহণ কার্যকারিতা বা নিরাপত্তার দিক থেকে ভয়ের কিছু নেই?
তবে উল্লিখিত সংবেদনশীল ওষুধগুলো এবং অ্যান্টিবায়োটিকসহ আরও কিছু ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পর গ্রহণ করা হলে, কার্যকারিতা না পেলে সংক্রামক রোগসহ কিছু জটিল রোগ না সারার ব্যাপারে কারও মনে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাই মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করাই উত্তম।
ওপরের ঘটনাগুলো ও তার ফলাফল আমাদের কী বলে? মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ পার হওয়ার ৩০ বছর বা ১৫ বছর পর ওষুধ ঠিক থাকে কীভাবে? ওপরের গবেষণা সত্য ও বিজ্ঞানসম্মত- এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে অধিকাংশ ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এত কম হয় কেন?
আরও প্রশ্ন হল- কোম্পানিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংসের পরিবর্তে এফডিএ ও প্রতিরক্ষা বিভাগ কর্তৃক গৃহীত শেলফ লাইফ এক্সটেনশন প্রোগ্রাম (Shelf Life Extension Program) মোতাবেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অক্ষুণ্ণ গুণগত মানের ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ বর্ধিত করে বিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারে কিনা?
নাকি তারা ইচ্ছে করেই ওষুধের মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কম রেখে ওষুধের কাটতি ও মুনাফা বাড়াতে চায়? এ নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার সময় এসেছে। সম্ভবত এফডিএ থেকে এ ব্যাপারে নতুন করে পর্যাপ্ত তথ্য ও সমাধান পাওয়া যাবে।