১০:৪৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

আহমেদ মিন্টো
  • প্রকাশ: ০৭:২৫:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ৩১৭২৮ বার পড়া হয়েছে

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ছিলেন উনবিংশ শতকের একজন  সংস্কৃত পণ্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী। বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করেন। এখানে বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো।

এখানে যা আছে

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ও পরিচয়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল ভগবতী দেবী। তাঁর পারিবারিক পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়, সে হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বাক্ষর করতেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা’ নামে।

জন্মপরিচয় সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখেছেন,

এই বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার স্বরচিত জীবনচরিতে লিখেছেন-

“বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হইয়াছে; কিন্তু, এই গ্রাম আমার পিতৃপক্ষীয় অথবা মাতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বাসস্থান নহে। জাহানাবাদের (অধুনা আরামবাগ) ঈশান কোণে, তথা হইতে প্রায় তিন ক্রোশ উত্তরে, বনমালীপুর নামে যে গ্রাম আছে, উহাই আমার পিতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বহুকালের বাসস্থান। …”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাজীবন

১৮২৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখম পাঁচ বছর তখন তাকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়।

বিদ্যাসাগর উপাধী লাভ

জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।

নিচে হিন্দু ল কমিটির সেই প্রসংসাপত্র উল্লেখ করা হলো:

HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION

We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd Twenty-second April 1839 by the Committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Hindoo Law officer in any of the Established Courts of Judicature.
H.T. Prinsep
President
J.W.J. Ousely

Member of the Committee of Examination

This Certificate has been granted to the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of the committee. This 16th Sixteenth day of May in the year 1839 Corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.
J.C.C. Sutherland
Secy To the Committee
(বানান অপরিবর্তিত)

হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তখন অনেকেই বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মা “বিদ্যাসাগর”-এর নাম।

সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর ঈশ্বরচন্দ্র অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রাপ্ত ১৮৪১ সালের ১০ ডিসেম্বর ডিসেম্বর তারিখে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করেন।

এখানে স্পষ্ট যে, ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দে হিন্দু ল কমিটি (হিন্দু আইন পর্ষদ) এবং এই উপাধী সংস্কৃত কলেজের প্রশংসাপত্রে ব্যবহার করা হয়।

সংস্কৃত কলেজের প্রশংসাপত্র:

অস্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলকাতায়াং শ্রীযুত কোম্পানী সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২ দ্বাদশ বৎসরান্ ৫ পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিত শাস্ত্রাণ্য ধীতবান্

ব্যাকরণম্… শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ
কাম্যশাস্ত্রম্… শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ
অলঙ্কারশাস্ত্রম্… শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
বেদান্তশাস্ত্রম্… শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
ন্যায়শাস্ত্রম্… শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ
জ্যোতিঃশাস্ত্রম্… শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভিঃ
ধর্মশাস্ত্রম্… শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ

সুশীলতয়োপস্থিতস্বৈত স্বৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট।
১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতি দিবসীয়ম্।
রসময় দত্ত, সচিব।
১০ ডিসেম্বর ১৮৪১।

‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রাপ্ত হবার সময় ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স ছিল মাত্র উনিশ বছর।

যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, কেন ঈশ্বরচন্দ্রকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে উত্তর হবে, ‘১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল মাসে হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে, ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।’

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বিদ্যাসাগর

১৮৪১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করার অল্প পরেই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান পণ্ডিতের পদ লাভ করেন। এর পরে কিছু সময়ের জন্য পুনরায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি পদে যোগদান করলেও পরবর্তীতে আবার ফিরে আসেন।

১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অবশ্য এবারেও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিজের ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে চাননি ভবিষ্যৎ ভেবে। ১৯৫০ সালে পুনরায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন।

সংস্কৃত কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে এসে ১৮৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

বিদ্যাসাগর ছিলেন উদার মনোভাবের; আর তাই সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন শিক্ষকগণের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন। ১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর

১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর ও শিক্ষার উন্নয়ন

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিদ্যাসাগর শিক্ষার উন্নয়নে ব্যপক ভূমিকা রাখেন। অধ্যক্ষ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অনেক সংস্কার করেন।

সকল শ্রেণির হিন্দুদের সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেন

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে এই কলেজে পড়ার অধিকার ছিল কেবল হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য ছাত্রদের, কিন্তু তিনি সব শ্রেণির হিন্দুদের জন্যে কলেজে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে দেন। প্রথমবারের মতো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সকলেত জন্য সংস্কৃত কলজের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন।

বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার জন্যে নামেমাত্র বেতন চালু করেন এবং প্রতিপদ ও অষ্টমীর বদলে রবিবার সপ্তাহিক ছুটি চালু করেন। কলেজের ডিগ্রি নিয়ে যাতে ছাত্ররা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ লাভ করতে পারে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি সে প্রতিশ্রুতিও আদায় করেন। 

কলেজের পাঠ্যক্রম সংস্কারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন কলেজের পাঠ্যক্রমে। পূর্বে ব্যাকরণ এবং বীজগণিত ও গণিত শেখানো হতো সংস্কৃতে, কিন্তু তিনি সংস্কৃতের বদলে ব্যাকরণ বাংলার মাধ্যমে এবং গণিত ইংরেজির মাধ্যমে পড়ানোর নিয়ম চালু করেন।

ইংরেজি ভাষা শেখাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেন এবং ইংরেজি বিভাগকে উন্নত করেন। বাংলা শিক্ষার ওপরও তিনি জোর দেন। তবে তারচেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করেন দর্শন পাঠ্যক্রমে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সাংখ্য এবং বেদান্ত দর্শনকে ভ্রান্ত এবং প্রাচীনপন্থী বলে বিবেচনা করতেন। সে জন্যে, তিনি বার্কলের দর্শন এবং অনুরূপ পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষাদানের বিরোধিতা করেন এবং তার পরিবর্তে বেকনের দর্শন এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের তর্কশাস্ত্র পড়ানোর সুপারিশ করেন।

অনেকে তাঁর সমালোচনা করলেও, তাঁর এ সংস্কার ছিল সুদূরপ্রসারী এবং শিক্ষা পরিষদ তাঁর এ সংস্কারের প্রশংসা করে এবং পুরস্কারস্বরূপ ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর বেতন বৃদ্ধি করে।

শিক্ষা সম্প্রসারণে বিদ্যাসাগর

গ্রামে শিক্ষা সম্প্রসারণে বিদ্যাসাগর

১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ বা উডের ডেসপ্যাচ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া সরকার তৎকালীন শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব প্রদান করে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

১৯৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দুই বছরের মধ্যে বিদ্যাসাগর মোট বিশটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি এসব স্কুলে পড়ানোর জন্যে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। তিনি নিজ গ্রামে নিজ খরচে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

স্ত্রীশিক্ষা বা নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

বাংলা মডেল স্কুল ছাড়াও সরকার বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করতো যে, স্ত্রীশিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ। সমাজের তীব্র বিরোধিতার মুখে এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কিনা— সরকার সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না।

অন্যদিকে, বিদ্যাসাগর ছিলেন স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ সমর্থক। সরকার সেজন্যে এ কাজের দায়িত্ব দেয় তাঁর ওপর। তিনি বালিকা বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে স্থানীয় লোকদের সমর্থনে বর্ধমানে একটি স্কুল স্থাপন করেন। পরে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে আরও পঁয়ত্রিশটি স্কুল স্থাপন করতে সমর্থ হন।

সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রস্থান ও বেথুন সোসাইটিতে যোগদান

শিক্ষা কর্তৃপক্ষের পরিচালকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কারণে তিনি এ কাজ বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি। তাই তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ এবং স্কুল পরিদর্শকের পদ-উভয় ত্যাগ করেন। এ রকমের উচ্চপদে বাঙালিদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই অধিষ্ঠিত ছিলেন।

পরে শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজে, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার কাজ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এ সময়ে তিনি বেথুন সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। এই সোসাইটির কাজ ছিল স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার এবং পরিবার ও সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধির। তিনি স্কুল স্থাপনের জন্যে ধনী জমিদারদেরও উৎসাহ প্রদান করেন।

কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও বিদ্যাসাগর

ধনী পরিবারের ছেলেদের ইংরেজি শেখানোর উদ্দেশে ১৮৫৯ সালে কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয়। কিন্তু দুবছরের মধ্যে এ স্কুল বন্ধের উপক্রম হলে বিদ্যাসাগর এ স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৮৬৪ সালে তিনি এর নাম রাখেন হিন্দু মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে তিনি এ স্কুলে এন্ট্রেন্স পরীক্ষার জন্য ছাত্রদের শিক্ষা দিতে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে সাফল্য লাভ করেন। ১৮৭২ সালের গোড়ার দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিদ্যালয়কে কলেজ এবং ১৮৭৯ সালে ডিগ্রি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

পাঠ্যপুস্তক রচনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা। বর্ণপরিচয় (১৮৫১) প্রকাশের আগ পর্যন্ত প্রথম শিক্ষার্থীদের জন্যে এ রকমের কোনো আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তাঁর বর্ণপরিচয়ের মান এতো উন্নত ছিল যে, প্রকাশের পর থেকে অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত এই গ্রন্থ বঙ্গদেশের সবার জন্যে পাঠ্য ছিলো। দেড়শো বছর পরেও এখনও এ গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। বর্ণপরিচয়ের মতো সমান সাফল্য লাভ করেছিল বোধোদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী (১৮৫৬) এবং জীবনচরিত (১৮৫৯)। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও (১৮৫১) বর্ণপরিচয়ের মতো অভিনব— এর আগে বাংলা ভাষায় কোনো সংস্কৃত ব্যাকরণ ছিল না।

চার খণ্ডে লেখা ব্যাকরণ-কৌমুদী (১৮৫৩-৬৩) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবদান।

তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল লেখাপড়া শেখানোর কৌশল হিসেবে এগুলি লেখেননি, বরং ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানও তাঁর লক্ষ্য ছিল। যেমন চরিতমালায় তিনি প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের জীবনী লেখেননি, বরং ইউরোপের ষোলোজন বিখ্যাত ব্যক্তির পরিচিতি দিয়েছেন। তেমনি জীবনচরিতে তিনি কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং হার্শেলের মতো বিজ্ঞানীদের এবং উইলিয়াম জোনসের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি লিখেছেন। নীতিবোধেও একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। এতে তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম এবং আচার-অনুষ্ঠানের কোনো উল্লেখ করেননি, বরং যেসব নীতিবোধ সকল মানুষের থাকা উচিত, তার কথা লিখেছেন।

কথামালায় তিনি নীতিমূলক গল্প সংগ্রহ করেছেন। আর তিন খন্ড আখ্যানমঞ্জরীতে সংগ্রহ করেছেন ইউরোপ-অ্যামেরিকার (এবং চারটি আরব দেশ ও পারস্যের) সত্যিকার এবং জনপ্রিয় গল্প। এসব গল্পের শিরোনাম— মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃস্নেহ, গুরুভক্তি, আতিথেয়তা, পরোপকার এবং সাধুতার পুরস্কার— থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করতে চাননি, সেই সঙ্গে চেয়েছিলেন তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে। তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের সর্বত্র পাঠ্য ছিল। এগুলোর মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে প্রামাণ্য ভাষা ও বানান যেমন শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন, তেমনি পেরেছিলেন নীতিবোধ উন্নত করতে।

শিক্ষামূলক গ্রন্থ

  • বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫)
  • ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২)
  • সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
  • ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)

(বিদ্যাসাগরের গ্রন্থের তালিকা নিচে দেখুন: ‘সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ অংশে)

সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবল পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয়, বরং তাঁর অন্যান্য রচনা দিয়েও বাংলা গদ্যের সংস্কার এবং তার মান উন্নত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ এবং রামমোহন রায় যে বাংলা গদ্যরীতি নির্মাণ করেছিলেন, তা ছিল আড়ষ্ট, কৃত্রিম এবং কোনোমতে ভাব প্রকাশের উপযোগী। তাঁর আগেকার গদ্যে তথ্য প্রকাশের মতো শব্দাবলী ছিল কিন্তু তাতে এমন সৌন্দর্য, সাবলীলতা এবং গতির স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, যাকে সাহিত্যিক গদ্য বলা যায় বা যা দিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায়।

বেতালপঞ্চবিংশতি

১৮৪৭ সালে ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর তা পাল্টে দিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের শব্দ-সাযুজ্য আবিষ্কার, বাক্য-কাঠামো সংস্কার, কর্তা ও ক্রিয়াপদ এবং ক্রিয়া ও কর্মের মধ্যে যথাযথ অন্বয় স্থাপন করে বাংলা গদ্যকে মাধুর্য দান করেন। তাছাড়া, শ্বাস-যতি ও অর্থ-যতির সমন্বয় ঘটান এবং পাঠক যাতে তা সহজেই দেখতে পান, তার জন্যে ইংরেজি রীতির যতিচিহ্ন, বিশেষ করে কমা, ব্যবহার করেন। তাঁর আগে একমাত্র অক্ষয়কুমার দত্তই ইংরেজি যতিচিহ্ন সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার ও আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার মনে করা হয়। তবে বলে নেওয়া ভালো যে, তিনি তত্ত্বগত ভাবে তিনি বাংলা গদ্যের জনক। কারণ বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তার আগমনের বহুপূর্বেই গদ্যরচনার সূত্রপাত ঘটেছিল।

তাহলে কেন বলা হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পূর্বে যে সকল গদ্য রচিত হয়েছিল, সেইসব গদ্য ছিল শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মান্য ধ্রুবক নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কল্পনা ও স্বকীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দোময় ও গতিশীল।

উপর্যুক্ত কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার বলা হয় এবং একই কারণে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা আধুনিক গদ‍্যের জনক।

মান্য সাধু বাংলা গদ্য এবপং শকুন্তলা ও সীতার বনবাস

মান্য সাধু বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কি রকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনাগুলিতে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ সালে রচনা করে ‘শকুন্তলা’ ও ১৮৬০ সালে রচনা করেন ‘সীতার বনবাস’; তাঁর এই দুই গ্রন্থে সেই বিশিষ্ট গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যাবে :

“শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে। (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ)”

“লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে। (সীতার বনবাস, প্রথম পরিচ্ছেদ, আলেখ্যদর্শন)”

এই চিত্ররূপময়, কাব্যিক ও অলংকার বহুল গদ্যভাষার পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে বিদ্যাসাগরকে লৌকিক ভাষার আদর্শে দ্রুতগামী ও শ্লেষাত্মক গদ্যরচনা করতেও দেখা যায়। জীবনের শেষ পর্বে রচিত ব্রজবিলাস তার একটি উদাহরণ:

“এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় খুড় মহাশয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও গুঁতোগুঁতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর পাইলে, হাঙ্গাম ও ফেসাৎ উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে উত্তর না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া, চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া, বসিয়া থাকিলে আমি ছাড়িব না। (ব্রজবিলাস)”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত ভাষা আলালি ভাষার মতো ফারসি শব্দবহুল নয়, আবার হুতোমি ভাষার অশ্লীলতা দোষ থেকেও মুক্ত। বরং স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর্যবান অথচ সরস বাংলা চলিত গদ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, তারই পূর্বসূরী।

গ্রহণ-বর্জনে বিদ্যাসাগর

সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অসামান্য দখল ছিল; আবার নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সেই ভাষার সাহিত্যের সঙ্গেও সম্যক পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত শব্দ ও পদবিন্যাসের শ্রুতিমাধুর্য ও গাম্ভীর্যকেই তিনি স্থান দিয়েছিলেন বাংলা গদ্যে; দুর্বোধ্যতা বা দুরুহতাকে নয়। অন্যদিকে কাব্যিক ছন্দোময়তায় গদ্যকে দিয়েছিলেন এক ললিত সুডৌল রূপ। 

গ্রহণ-বর্জনের যে অসামান্য ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল, তার মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক গদ্যের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারিক গদ্য ও সমকালীন সংবাদপত্রগুলির নিকৃষ্ট গদ্যনমুনা সব থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সাহিত্যগুণ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম যতিচিহ্নের ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে কালান্তর সূচনা করতেও পিছপা হননি তিনি।

নিছক ব্যবহারিক বাংলা গদ্যকে তিনি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক গদ্যে বিবর্তিত করতে তার প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।”

শুধু গদ্যরীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একই গদ্যরীতিতে তাঁর সব রচনা লেখেননি; তিনি পাঠ্যপুস্তক যে, রীতিতে লিখেছেন, সাহিত্য রচনা করেছেন তা থেকে ভিন্ন ভঙ্গিতে; আবার তাঁর বেনামী পুস্তকগুলির রীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতির— তা পরিপূর্ণ হাস্যরস এবং ব্যঙ্গবিদ্রূপে।

তাঁর প্রথম সাহিত্যগ্রন্থ বেতালপঞ্চবিংশতিতেই বিদ্যাসাগর প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি কেবল বেতালের গল্পগুলিকেই নতুন করে বলেছেন, অনুবাদ করেননি। গল্পগুলি বলতে গিয়ে তিনি তাদের সংস্কার এবং পরিবর্তন করেছেন এবং মূল বেতাল’র স্থূল রুচি ত্যাগ করে তাদের আধুনিক পাঠকদের কাছে পরিবেশনের উপযোগী করে তুলেছেন।

একই কথা বলা যায় কালিদাসের রচনা অবলম্বনে রচিত শকুন্তলা (১৮৫৪) সম্পর্কে। তাছাড়া এ গ্রন্থে তিনি শকুন্তলা এবং তার দুই সখীকে রীতিমতো বাঙালি নারীর মতো করে নির্মাণ করেছেন। সীতার বনবাস গ্রন্থের (১৮৬০) সীতাও নিতান্ত বাঙালি নারী হয়ে উঠেছেন।

এমন কি বিদ্যাসাগর যখন ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) নাম দিয়ে উইলিয়াম শেক্সপীয়রের কমেডি অব এরর্স অনুবাদ করেছেন, তখন তাকে বাঙালি পরিবেশের উপযুক্ত করে রচনা করেছেন। তদুপরি তাঁর ভ্রান্তিবিলাস মূলত গল্প, নাটক নয়।

তাঁর ভাষাভঙ্গি, সূক্ষ্ম হাস্যরস এবং শব্দের মারপ্যাঁচে এই দুটি গ্রন্থকেই অনুবাদ নয়, বরং মৌলিক গ্রন্থ বলে মনে হয়। তাঁর গদ্যে তিনি অনুপ্রাসসহ সঙ্গীতময় এবং বিষয়ের উপযোগী শব্দ ব্যবহার করেছেন। শ্বাসযতি ও অর্থযতির সমন্বয় ঘটানোর ফলে তাঁর গদ্যে এমন সৌন্দর্য এসেছে যা তাঁর পূর্ববতী লেখকরা আবিষ্কার করতে পারেননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচিত গ্রন্থের তালিকা

শিক্ষামূলক গ্রন্থ

  • বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫)
  • ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২)
  • সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
  • ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)

অনুবাদ গ্রন্থ

হিন্দি থেকে বাংলা
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে)
সংস্কৃত থেকে বাংলা
  • শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে)
  • সীতার বনবাস (১৮৬০) – ভবভূতির উত্তররামচরিতম্‌ নাটকের আখ্যানবস্তু।
  • মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে)
  • বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)
ইংরেজি থেকে বাংলা
  • বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত)
  • জীবনচরিত (১৮৪৯; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত)
  • নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব– ১৮৫১; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত)
  • বোধোদয় (১৮৫১; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত)
  • কথামালা (১৮৫৬; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত)
  • চরিতাবলী (১৮৫৭; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত)
  • ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত। ভ্রান্তিবিলাস অবলম্বনে ১৯৬৩ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মনু সেন)
ইংরেজি গ্রন্থ
  • পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্
  • সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ
  • সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার
মৌলিক গ্রন্থ
  • সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩)
  • বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
  • বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (প্রথম খন্ড ১৮৭১, ২য় খন্ড ১৮৭৩)
  • অতি অল্প হইল এবং ”আবার অতি অল্প হইল দুখানা পুস্তক (১৮৭৩, বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে।)
  • ব্রজবিলাস, যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব্ব মহাকাব্য (নভেম্বর, ১৮৮৪) – “কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য” ছদ্মনামে রচিত। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের রচনার প্রত্যুত্তরে লিখিত হয়।
  • রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)
  • প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ভবত ১৮৬৩)
  • জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
  • শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪)
  • নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮)
  • ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
সম্পাদিত গ্রন্থ
  • অন্নদামঙ্গল (১৮৪৭)
  • কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ (১৮৫৩)
  • সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮)
  • শিশুপালবধ (১৮৫৩)
  • কুমারসম্ভবম্ (১৮৬২)
  • কাদম্বরী (১৮৬২)
  • বাল্মীকি রামায়ণ (১৮৬২)
  • রঘুবংশম্ (১৮৫৩)
  • মেঘদূতম্ (১৮৬৯)
  • উত্তরচরিতম্ (১৮৭২)
  • অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ (১৮৭১)
  • হর্ষচরিতম্ (১৮৮৩)
  • পদ্যসংগ্রহ প্রথম ভাগ (১৮৮৮; কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে সংকলিত)
  • পদ্যসংগ্রহ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯০; রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল থেকে সংকলিত)
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

নারীশিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যসাগসর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতি উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

(আরও পড়ুন উপরের ‘শিক্ষা সম্প্রসারণে বিদ্যাসাগর’ অংশে)

বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক মনোভাবাপন্ন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, পুরোনো মূল্যবোধ এবং পরিবারের ভেতর থেকে পরিবর্তন আনতে না পারলে সমাজ এবং দেশের কখনো প্রকৃত উন্নতি হবে না। এ জন্যে তিনি বিধবা-বিবাহ চালু করা, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজ থেকে পদত্যাগ করেন, তার কয়েক মাস পরে বালবিধবাদের পুনর্বিবাহের পক্ষে তাঁর প্রথম বেনামী লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালের এপ্রিল মাসে ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ পত্রিকায়। আর এ বিধবাবিবাহের বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে, দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয় একই বছরের অক্টোবর মাসে। 

এভাবে বিধবাবিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ দেওয়া ছাড়াও, বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের পক্ষে একটি আইন প্রণয়নের জন্যে তিনি সামাজিক আন্দোলন আরম্ভ করেন।, ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে বহু স্বাক্ষরসংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। পরে এরকমের আরও ২৪টি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। অনেকগুলি আবেদনপত্র আসে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। এসব আবেদনপত্রে প্রায় পঁচিশ হাজার স্বাক্ষর ছিল। 

অপরপক্ষে, রক্ষণশীল সমাজ আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে সরকারের কাছে আঠাশটি আবেদনপত্র পাঠান। তাঁদের যুক্তি ছিল যে, এ রকমের আইন পাস করে দেশবাসীর ধর্মে হস্তক্ষেপ করা সরকারের পক্ষে উচিত হবে না। এতে স্বাক্ষর ছিল পঞ্চান্ন হাজারেরও বেশি। বিরোধীদের পক্ষেই পাল্লা ভারী ছিল, তা সত্ত্বেও ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে বিধবাবিবাহ আইন প্রণীত হয়।

বিদ্যাসাগর এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচন্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তাছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে সাফল্য লাভ করায় পরে কুলীনদের বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ আইন পাস করার পক্ষে সরকারের কাছে আবেদন জানান।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন করুণাসাগর ও দয়াসাগর

ঈঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিতি পান (তাঁকে এ বিশেষণ প্রথমে দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত)। নিজের চরম অর্থসঙ্কটের সময়ও বিদ্যাসাগর ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন‌। তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে এ নিয়ে খুব সুন্দর একটি গল্প আছে।

মাইকেল মধুসূদন যখন বিদেশে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন তখন দেশ থেকে বিদ্যাসাগর তাকে অর্থ পাঠিয়েছিলেন। এ নিয়ে ২০২০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ তম জন্মবার্ষিকিতে ভারতের গীতিকার, সুরকার সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পি অনুপম রায় ‘মাইকেল বিদ্যাসাগর সংবাদ’ নামে একটি গান রচনা করেন। অনুপম রায়ের ‘মাইকেল বিদ্যাসাগর গানটি তিনি নিজেই সুর দেন ও সংগীতায়োজন করেন। অসাধারণ এই গানটিতে কণ্ঠ দেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও অনুপম রায় নিজে। গানটতে মাইকেল মধুসূদনের ভূমিকায় ছিলেন অনুপম রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা পালন করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

‘মাইকেল বিদ্যাসাগর সংবাদ’ গানের কথা:

সুদূর বিদেশে পড়ে আছি আমি, জীবন কি তবে ব্যর্থ
সুদূর বিদেশে পড়ে আছি আমি, জীবন কি তবে ব্যর্থ
বিদ্যাসাগর, বাঁচাও আমায়, পাঠাও আমাকে অর্থ
তুমি বলেছিলে আমার লেখাতে পেয়েছিলে great merit
অমিত্রাক্ষরে ভালোবাসা নিও, সহ্য হয় না দেরীকথা দিয়ে ওরা কথা রাখবে না মানুষেরই অভ্যাসে
কথা দিয়ে ওরা কথা রাখবে না মানুষেরই অভ্যাসে
বন্ধু তোমায় বলেছি যখন, থাকবো তোমার পাশে
এই নাও কিছু হাজার পাঠাই, আরও প্রয়োজনে জানাও
এই নাও কিছু হাজার পাঠাই, আরও প্রয়োজনে জানাও
পড়া শেষ করে ব্যারিস্টারি, নতুন কাব্য শোনাওওরা দু'জনে ছিলো বন্ধু
ওরা দু'জনে ছিলো বন্ধুধন্যবাদের ভাষা খুঁজি আমি নিজের মাতৃভাষায়
ধন্যবাদের ভাষা খুঁজি আমি নিজের মাতৃভাষায়
দেশে ফিরে আমি এলাম বন্ধু তোমাদের ভালোবাসায়
অভাব আমার স্বভাবে যে ভিড, হোটেল নিয়েছি ভাড়া
আয় ভালো তবে ব্যয় আরও বেশি, আমি আবার সর্বহারাতোমাকে বাঁচাবে এমন ক্ষমতা ক'জনার বলো আছে
তোমাকে বাঁচাবে এমন ক্ষমতা ক'জনার বলো আছে
ধার-দেনা শুধু বাড়তেই থাকে, আর ভালো লাগে না যে
আমার বাক্যে নির্ভর করে সাহায্য করে কেবল
আমার বাক্যে নির্ভর করে সাহায্য করে কেবল
তাদেরকে যেন ঠকাতে না হয়, আমার কথাও ভেবোওরা দু'জনে ছিলো বন্ধু
ওরা দু'জনে ছিলো বন্ধুকরুণাসিন্ধু ভাগ্য আমার, তোমাকে চিনেছি আমি
স্নেহ-মমতায় ভরা যে তোমার মনটা সবচেয়ে দামী
করুণাসিন্ধু ভাগ্য আমার, তোমাকে চিনেছি আমি
স্নেহ-মমতায় ভরা যে তোমার মনটা সবচেয়ে দামী
বন্ধু আমার, আমাকে দিয়েছো কত না সুখের দিন
সব বেচে দিয়ে শোধ করে যাবো আমার যা আছে ঋণযা আছে ঋণ
যা আছে ঋণ

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘জ্ঞান ও মনীষার জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি তিনি তাঁর শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সাধারণ দেশবাসী তাঁকে আরেকটি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘দয়ার সাগর’ নামেই পরিচিত।’ এই উপাধি যে নিছকই শুধু উপাধি নয়, সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুনীতিকুমার জানিয়েছিলেন, ‘এই একটি উপাধির মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রের মস্ত বড় একটি দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে। একদিকে তিনি সুপণ্ডিত ও শিক্ষাব্রতী, তাঁর যুক্তিবাদী মননের ঔজ্জ্বল্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রত্যেকটি আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর হৃদয় দুঃস্থ মানবতার জন্য করুণায় বিগলিত।’ সেইসঙ্গে বিদ্যাসাগরের অবদানের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তাঁর দেশবাসীর জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সমাজের উন্নতির জন্য বিশেষত এদেশের নারীদের জন্য তিনি যা করেছিলেন, তার তুলনা নেই।’ শুধু এইটুকুনই বলে ক্ষান্ত হননি সুনীতিবাবু। সেইসঙ্গে এটিও যোগ করে তাঁকে বলতে হয়েছে – ‘বিদ্যাসাগরের একটি মহৎ হৃদয় ছিল, যা আত্মমর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল; কখনও কোনো অন্যায়, দম্ভ বা ঔদ্ধত্যের কাছে সে মাথা নমিত  হয়নি। এমনকি শাসক ব্রিটিশ রাজপুরুষও তাঁকে অবহেলা করতে পারেনি।’ 

বিদ্যাসাগর ছিলেন ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান!

বিদ্যাসাগর  জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে; কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের।

ঈশ্বরচন্দ্র বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে। পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের, যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্রবিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ। পরে এ গ্রন্থে তিনি যা কিছু দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়, অনুভব করা যায়, তেমন সব বিষয়ের সংজ্ঞা দিয়েছেন; কিন্তু ঈশ্বর বা কোনো অতিলৌকিক শক্তির নামও উল্লেখ করেননি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বইটি পড়ার স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন,

‘কেবল মনে পড়ে; “জল পড়ে পাতা নড়ে।” তখন “কর, খল” প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি, “জল পড়ে পাতা নড়ে।” আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আদিকবির সম্মানে ভূষিত করেছেন বিদ্যাসাগরের জীবন অবসানের (২৯ জুলাই ১৮৯১) ২১ বছর পর প্রকাশিত বই জীবনস্মৃতিতে।

চারিত্রপূজায় মুদ্রিত ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ নামের বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাসাগরকে পরিচিত করিয়েছেন ‘যথার্থ সম্পূর্ণ মানুষ’ বলে। তাঁর ভাষায়:

‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, "বিদ্যাসাগর স্বভাবতই সম্পূর্ণ স্বাধীনতন্ত্রের লোক ছিলেন।"
রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয়ভরা লেখনীতে আরও জানা যায়, বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আধার বলে আমরা প্রচার করি। কিন্তু সেটা ঠিক না। তাঁর প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব।

রবীন্দ্রনাথ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহ আন্দোলন, বাল্যবিবাহ বন্ধ, পণপ্রথা রোধের সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল সাহিত্যে, সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনে। পাশাপাশি এটি গুরুত্ব পেয়েছিল রামমোহন-পরবর্তী সমাজ-অগ্রগতির জন্য নারী আন্দোলনেও।

এবং আরও কিছু

সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন। বিদ্যাসাগরকে বলা হয় বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করেছেন।

সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার সময় ১৮৫৫ সালে সরকার তাঁকে হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও নদীয়া জেলার বিশেষ স্কুল পরিদর্শকের (Special Inspector of Schools) অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করে। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন।

১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ইম্পেরিয়াল অ্যাসেমব্লিজ-এ সম্মাননা-সনদ লাভ করেন এবং ১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে সি. আই. ই. (CIE) হন। 

এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।

বিদ্যাসাগরের মৃত্যু

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য) কলকাতা শহরে ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় বিদ্যাসাগরের বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

এক নজরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

নামজন্ম নাম: ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মাউপাধি: বিদ্যাসাগরস্বাক্ষর: ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা
জন্ম২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ;বীরসিংহ গ্রাম, হুগলি জেলা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়)
মৃত্যু২৯ জুলাই ১৮৯১ (বয়স ৭০);কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে)
ছদ্মনামকস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্যকস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য
পেশালেখকদার্শনিকপণ্ডিতশিক্ষাবিদঅনুবাদকপ্রকাশকসংস্কারকমানবহিতৈষী
ভাষাবাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি
দাম্পত্য সঙ্গীদীনময়ী দেবী
সন্তাননারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহিত্য আন্দোলনবাংলার নবজাগরণ
আত্মীয়ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (বাবা)ভগবতী দেবী (মা)শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন (সেজ ভ্রাতা)
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থবর্ণপরিচয় , কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী ব্যাকরণ কৌমুদী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (২ খণ্ডে), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (২ খণ্ডে)[১], অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস(১৮৮৪),
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংস্কৃত কলেজ
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়

রেফারেন্স

বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আপনারা আরও পড়তে পারেন

  • অঞ্জলি বসু (সম্পাদিত) ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৭৬
  • অমরেন্দ্রকুমার ঘোষ ; যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর : তুলিকলম, কলকাতা, ১৯৭৩
  • অমূল্যকৃষ্ণ ঘোষ ; বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, এম সি সরকার, কলকাতা, ১৯১৭
  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ; বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর : মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৭০
  • ইন্দ্রমিত্র ; করুণাসাগর বিদ্যাসাগর : আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৬৬
  • গোপাল হালদার (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর রচনা সম্ভার (তিন খণ্ডে) : পশ্চিমবঙ্গ নিরুক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, কলকাতা, ১৯৭৪-৭৬
  • বদরুদ্দীন উমর ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ : দ্বিতীয় সংস্করণ, চিরায়ত, কলকাতা, ১৯৮২
  • বিনয় ঘোষ ; বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ : বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ
  • বিনয় ঘোষ ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : অনুবাদক অনিতা বসু, তথ্য ও বেতার মন্ত্রক, নয়াদিল্লি, ১৯৭৫
  • ব্রজেন্দ্রকুমার দে ; করুণাসিন্ধু বিদ্যাসাগর : মণ্ডল অ্যান্ড সন্স, কলকাতা, ১৯৭০
  • মহম্মদ আবুল হায় আনিসুজ্জামন ; বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ : স্টুডেন্টস ওয়েজ, ঢাকা, ১৯৬৮
  • যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ; বিদ্যাসাগর : পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৪১
  • যোগীন্দ্রনাথ সরকার ; বিদ্যাসাগর : ১৯০৪
  • রজনীকান্ত গুপ্ত ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ১৮৯৩
  • রমাকান্ত চক্রবর্তী (সম্পাদিত) ; শতবর্ষ স্মরণিকা : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৮৭২-১৯৭২ : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৯৭২
  • রমেশচন্দ্র মজুমদার ; বিদ্যাসাগর : বাংলা গদ্যের সূচনা ও ভারতের নারী প্রগতি : জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ; বিদ্যাসাগর-চরিত : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা
  • রাধারমণ মিত্র ; কলিকাতায় বিদ্যাসাগর : জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, ১৯৪২
  • রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ; চরিত্র কথা : কলকাতা, ১৯১৩
  • শঙ্করীপ্রসাদ বসু ; রসসাগর বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯২
  • শঙ্খ ঘোষ ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর : ওরিয়েন্ট, কলকাতা
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর চরিত : কলকাতা, ১২৯৪ বঙ্গাব্দ
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর জীবনচরিত : কলকাতা
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর চরিত ও ভ্রমণিরাস : চিরায়ত, কলকাতা, ১৯৯২
  • শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : জীবনীকোষ, ভারতীয় ঐতিহাসিক, কলকাতা, ১৯৩৬
  • শামসুজ্জামান মান ও সেলিম হোসেন ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : চরিতাভিধান : বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫
  • সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী (তিন খণ্ডে) : বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতি, কলকাতা, ১৩৪৪-৪৬ বঙ্গাব্দ
  • সন্তোষকুমার অধিকারী ; বিদ্যাসাগর জীবনপঞ্জি : সাহিত্যিকা, কলকাতা, ১৯৯২
  • সন্তোষকুমার অধিকারী ; আধুনিক মানসিকতা ও বিদ্যাসাগর : বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার, কলকাতা, ১৯৮৪
  • হরিসাধন গোস্বামী ; মার্কসীয় দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর : ভারতী বুক স্টল, কলকাতা, ১৯৮৮

শেয়ার করুন

One thought on “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আহমেদ মিন্টো

মিন্টো একজন ফ্রিল্যান্স লেখক এবং বিশ্লেষণ'র কন্ট্রিবিউটর।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর: শিক্ষা, সমাজ সংস্কার ও সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

প্রকাশ: ০৭:২৫:০৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ছিলেন উনবিংশ শতকের একজন  সংস্কৃত পণ্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী। বিবিসির জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করেন। এখানে বিদ্যাসাগর (Ishwar Chandra Vidyasagar) সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো।

এখানে যা আছে

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ও পরিচয়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতার নাম ছিল ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতার নাম ছিল ভগবতী দেবী। তাঁর পারিবারিক পদবি বন্দ্যোপাধ্যায়, সে হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আসল নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বাক্ষর করতেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা’ নামে।

জন্মপরিচয় সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখেছেন,

এই বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার স্বরচিত জীবনচরিতে লিখেছেন-

“বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হইয়াছে; কিন্তু, এই গ্রাম আমার পিতৃপক্ষীয় অথবা মাতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বাসস্থান নহে। জাহানাবাদের (অধুনা আরামবাগ) ঈশান কোণে, তথা হইতে প্রায় তিন ক্রোশ উত্তরে, বনমালীপুর নামে যে গ্রাম আছে, উহাই আমার পিতৃপক্ষীয় পূর্ব্ব পুরুষদিগের বহুকালের বাসস্থান। …”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাজীবন

১৮২৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স যখম পাঁচ বছর তখন তাকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়।

বিদ্যাসাগর উপাধী লাভ

জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।

নিচে হিন্দু ল কমিটির সেই প্রসংসাপত্র উল্লেখ করা হলো:

HINDOO LAW COMMITTEE OF EXAMINATION

We hereby certify that at an Examination held at the Presidency of Fort William on the 22nd Twenty-second April 1839 by the Committee appointed under the provisions of Regulation XI 1826 Issur Chandra Vidyasagar was found and declared to be qualified by his eminent knowledge of the Hindoo Law to hold the office of Hindoo Law officer in any of the Established Courts of Judicature.
H.T. Prinsep
President
J.W.J. Ousely

Member of the Committee of Examination

This Certificate has been granted to the said Issur Chandra Vidyasagar under the seal of the committee. This 16th Sixteenth day of May in the year 1839 Corresponding with the 3rd Third Joistha 1761 Shukavda.
J.C.C. Sutherland
Secy To the Committee
(বানান অপরিবর্তিত)

হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তখন অনেকেই বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন কিন্তু ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মা “বিদ্যাসাগর”-এর নাম।

সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর ঈশ্বরচন্দ্র অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রাপ্ত ১৮৪১ সালের ১০ ডিসেম্বর ডিসেম্বর তারিখে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করেন।

এখানে স্পষ্ট যে, ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দে হিন্দু ল কমিটি (হিন্দু আইন পর্ষদ) এবং এই উপাধী সংস্কৃত কলেজের প্রশংসাপত্রে ব্যবহার করা হয়।

সংস্কৃত কলেজের প্রশংসাপত্র:

অস্মাভিঃ শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরায় প্রশংসাপত্রং দীয়তে। অসৌ কলকাতায়াং শ্রীযুত কোম্পানী সংস্থাপিত বিদ্যামন্দিরে ১২ দ্বাদশ বৎসরান্ ৫ পঞ্চমাসাংশ্চোপস্থায়াধোলিখিত শাস্ত্রাণ্য ধীতবান্

ব্যাকরণম্… শ্রীগঙ্গাধর শর্ম্মভিঃ
কাম্যশাস্ত্রম্… শ্রীজয়গোপাল শর্ম্মভিঃ
অলঙ্কারশাস্ত্রম্… শ্রীপ্রেমচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
বেদান্তশাস্ত্রম্… শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ
ন্যায়শাস্ত্রম্… শ্রীজয়নারায়ণ শর্ম্মভিঃ
জ্যোতিঃশাস্ত্রম্… শ্রীযোগধ্যান শর্ম্মভিঃ
ধর্মশাস্ত্রম্… শ্রীশম্ভুচন্দ্র শর্ম্মভিঃ

সুশীলতয়োপস্থিতস্বৈত স্বৈতেষু শাস্ত্রেষু সমীচীনা ব্যুৎপত্তিরজনিষ্ট।
১৭৬৩ এতচ্ছকাব্দীয় সৌরমার্গশীর্ষস্য বিংশতি দিবসীয়ম্।
রসময় দত্ত, সচিব।
১০ ডিসেম্বর ১৮৪১।

‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রাপ্ত হবার সময় ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স ছিল মাত্র উনিশ বছর।

যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, কেন ঈশ্বরচন্দ্রকে বিদ্যাসাগর উপাধি দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে উত্তর হবে, ‘১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ এপ্রিল মাসে হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে, ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়।’

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বিদ্যাসাগর

১৮৪১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করার অল্প পরেই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান পণ্ডিতের পদ লাভ করেন। এর পরে কিছু সময়ের জন্য পুনরায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি পদে যোগদান করলেও পরবর্তীতে আবার ফিরে আসেন।

১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অবশ্য এবারেও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে নিজের ক্যারিয়ার দীর্ঘ করতে চাননি ভবিষ্যৎ ভেবে। ১৯৫০ সালে পুনরায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন।

সংস্কৃত কলেজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছেড়ে এসে ১৮৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

বিদ্যাসাগর ছিলেন উদার মনোভাবের; আর তাই সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন শিক্ষকগণের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন। ১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর

১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর ও শিক্ষার উন্নয়ন

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বিদ্যাসাগর শিক্ষার উন্নয়নে ব্যপক ভূমিকা রাখেন। অধ্যক্ষ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অনেক সংস্কার করেন।

সকল শ্রেণির হিন্দুদের সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করেন

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে এই কলেজে পড়ার অধিকার ছিল কেবল হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য ছাত্রদের, কিন্তু তিনি সব শ্রেণির হিন্দুদের জন্যে কলেজে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে দেন। প্রথমবারের মতো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সকলেত জন্য সংস্কৃত কলজের দ্বার উন্মুক্ত করে দিলেন।

বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার জন্যে নামেমাত্র বেতন চালু করেন এবং প্রতিপদ ও অষ্টমীর বদলে রবিবার সপ্তাহিক ছুটি চালু করেন। কলেজের ডিগ্রি নিয়ে যাতে ছাত্ররা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ লাভ করতে পারে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি সে প্রতিশ্রুতিও আদায় করেন। 

কলেজের পাঠ্যক্রম সংস্কারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন কলেজের পাঠ্যক্রমে। পূর্বে ব্যাকরণ এবং বীজগণিত ও গণিত শেখানো হতো সংস্কৃতে, কিন্তু তিনি সংস্কৃতের বদলে ব্যাকরণ বাংলার মাধ্যমে এবং গণিত ইংরেজির মাধ্যমে পড়ানোর নিয়ম চালু করেন।

ইংরেজি ভাষা শেখাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেন এবং ইংরেজি বিভাগকে উন্নত করেন। বাংলা শিক্ষার ওপরও তিনি জোর দেন। তবে তারচেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করেন দর্শন পাঠ্যক্রমে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সাংখ্য এবং বেদান্ত দর্শনকে ভ্রান্ত এবং প্রাচীনপন্থী বলে বিবেচনা করতেন। সে জন্যে, তিনি বার্কলের দর্শন এবং অনুরূপ পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষাদানের বিরোধিতা করেন এবং তার পরিবর্তে বেকনের দর্শন এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের তর্কশাস্ত্র পড়ানোর সুপারিশ করেন।

অনেকে তাঁর সমালোচনা করলেও, তাঁর এ সংস্কার ছিল সুদূরপ্রসারী এবং শিক্ষা পরিষদ তাঁর এ সংস্কারের প্রশংসা করে এবং পুরস্কারস্বরূপ ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর বেতন বৃদ্ধি করে।

শিক্ষা সম্প্রসারণে বিদ্যাসাগর

গ্রামে শিক্ষা সম্প্রসারণে বিদ্যাসাগর

১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ বা উডের ডেসপ্যাচ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া সরকার তৎকালীন শিক্ষা কর্তৃপক্ষের সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব প্রদান করে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

১৯৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দুই বছরের মধ্যে বিদ্যাসাগর মোট বিশটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি এসব স্কুলে পড়ানোর জন্যে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। তিনি নিজ গ্রামে নিজ খরচে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

স্ত্রীশিক্ষা বা নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

বাংলা মডেল স্কুল ছাড়াও সরকার বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করতো যে, স্ত্রীশিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ। সমাজের তীব্র বিরোধিতার মুখে এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কিনা— সরকার সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না।

অন্যদিকে, বিদ্যাসাগর ছিলেন স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ সমর্থক। সরকার সেজন্যে এ কাজের দায়িত্ব দেয় তাঁর ওপর। তিনি বালিকা বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে স্থানীয় লোকদের সমর্থনে বর্ধমানে একটি স্কুল স্থাপন করেন। পরে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে আরও পঁয়ত্রিশটি স্কুল স্থাপন করতে সমর্থ হন।

সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রস্থান ও বেথুন সোসাইটিতে যোগদান

শিক্ষা কর্তৃপক্ষের পরিচালকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কারণে তিনি এ কাজ বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি। তাই তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ এবং স্কুল পরিদর্শকের পদ-উভয় ত্যাগ করেন। এ রকমের উচ্চপদে বাঙালিদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই অধিষ্ঠিত ছিলেন।

পরে শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজে, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার কাজ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এ সময়ে তিনি বেথুন সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। এই সোসাইটির কাজ ছিল স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার এবং পরিবার ও সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধির। তিনি স্কুল স্থাপনের জন্যে ধনী জমিদারদেরও উৎসাহ প্রদান করেন।

কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও বিদ্যাসাগর

ধনী পরিবারের ছেলেদের ইংরেজি শেখানোর উদ্দেশে ১৮৫৯ সালে কলকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয়। কিন্তু দুবছরের মধ্যে এ স্কুল বন্ধের উপক্রম হলে বিদ্যাসাগর এ স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৮৬৪ সালে তিনি এর নাম রাখেন হিন্দু মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি নিয়ে তিনি এ স্কুলে এন্ট্রেন্স পরীক্ষার জন্য ছাত্রদের শিক্ষা দিতে থাকেন এবং ক্রমান্বয়ে সাফল্য লাভ করেন। ১৮৭২ সালের গোড়ার দিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিদ্যালয়কে কলেজ এবং ১৮৭৯ সালে ডিগ্রি কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

পাঠ্যপুস্তক রচনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকীকরণ এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশ করা। বর্ণপরিচয় (১৮৫১) প্রকাশের আগ পর্যন্ত প্রথম শিক্ষার্থীদের জন্যে এ রকমের কোনো আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তাঁর বর্ণপরিচয়ের মান এতো উন্নত ছিল যে, প্রকাশের পর থেকে অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত এই গ্রন্থ বঙ্গদেশের সবার জন্যে পাঠ্য ছিলো। দেড়শো বছর পরেও এখনও এ গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। বর্ণপরিচয়ের মতো সমান সাফল্য লাভ করেছিল বোধোদয় (১৮৫১), কথামালা (১৮৫৬), চরিতাবলী (১৮৫৬) এবং জীবনচরিত (১৮৫৯)। সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও (১৮৫১) বর্ণপরিচয়ের মতো অভিনব— এর আগে বাংলা ভাষায় কোনো সংস্কৃত ব্যাকরণ ছিল না।

চার খণ্ডে লেখা ব্যাকরণ-কৌমুদী (১৮৫৩-৬৩) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যাকরণ রচনার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক অবদান।

তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল লেখাপড়া শেখানোর কৌশল হিসেবে এগুলি লেখেননি, বরং ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করা এবং আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদানও তাঁর লক্ষ্য ছিল। যেমন চরিতমালায় তিনি প্রাচীন ভারতের মুনি-ঋষিদের জীবনী লেখেননি, বরং ইউরোপের ষোলোজন বিখ্যাত ব্যক্তির পরিচিতি দিয়েছেন। তেমনি জীবনচরিতে তিনি কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন এবং হার্শেলের মতো বিজ্ঞানীদের এবং উইলিয়াম জোনসের মতো পণ্ডিত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি লিখেছেন। নীতিবোধেও একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। এতে তিনি আনুষ্ঠানিক ধর্ম এবং আচার-অনুষ্ঠানের কোনো উল্লেখ করেননি, বরং যেসব নীতিবোধ সকল মানুষের থাকা উচিত, তার কথা লিখেছেন।

কথামালায় তিনি নীতিমূলক গল্প সংগ্রহ করেছেন। আর তিন খন্ড আখ্যানমঞ্জরীতে সংগ্রহ করেছেন ইউরোপ-অ্যামেরিকার (এবং চারটি আরব দেশ ও পারস্যের) সত্যিকার এবং জনপ্রিয় গল্প। এসব গল্পের শিরোনাম— মাতৃভক্তি, পিতৃভক্তি, ভ্রাতৃস্নেহ, গুরুভক্তি, আতিথেয়তা, পরোপকার এবং সাধুতার পুরস্কার— থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ছাত্রদের নীতিবোধ উন্নত করতে চাননি, সেই সঙ্গে চেয়েছিলেন তাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে। তাঁর পাঠ্যপুস্তকগুলি দীর্ঘদিন বঙ্গদেশের সর্বত্র পাঠ্য ছিল। এগুলোর মাধ্যমে তিনি একই সঙ্গে প্রামাণ্য ভাষা ও বানান যেমন শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন, তেমনি পেরেছিলেন নীতিবোধ উন্নত করতে।

শিক্ষামূলক গ্রন্থ

  • বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫)
  • ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২)
  • সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
  • ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)

(বিদ্যাসাগরের গ্রন্থের তালিকা নিচে দেখুন: ‘সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ অংশে)

সাহিত্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবল পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে নয়, বরং তাঁর অন্যান্য রচনা দিয়েও বাংলা গদ্যের সংস্কার এবং তার মান উন্নত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতগণ এবং রামমোহন রায় যে বাংলা গদ্যরীতি নির্মাণ করেছিলেন, তা ছিল আড়ষ্ট, কৃত্রিম এবং কোনোমতে ভাব প্রকাশের উপযোগী। তাঁর আগেকার গদ্যে তথ্য প্রকাশের মতো শব্দাবলী ছিল কিন্তু তাতে এমন সৌন্দর্য, সাবলীলতা এবং গতির স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না, যাকে সাহিত্যিক গদ্য বলা যায় বা যা দিয়ে সাহিত্য রচনা করা যায়।

বেতালপঞ্চবিংশতি

১৮৪৭ সালে ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ প্রকাশের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর তা পাল্টে দিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের শব্দ-সাযুজ্য আবিষ্কার, বাক্য-কাঠামো সংস্কার, কর্তা ও ক্রিয়াপদ এবং ক্রিয়া ও কর্মের মধ্যে যথাযথ অন্বয় স্থাপন করে বাংলা গদ্যকে মাধুর্য দান করেন। তাছাড়া, শ্বাস-যতি ও অর্থ-যতির সমন্বয় ঘটান এবং পাঠক যাতে তা সহজেই দেখতে পান, তার জন্যে ইংরেজি রীতির যতিচিহ্ন, বিশেষ করে কমা, ব্যবহার করেন। তাঁর আগে একমাত্র অক্ষয়কুমার দত্তই ইংরেজি যতিচিহ্ন সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার ও আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার মনে করা হয়। তবে বলে নেওয়া ভালো যে, তিনি তত্ত্বগত ভাবে তিনি বাংলা গদ্যের জনক। কারণ বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় তার আগমনের বহুপূর্বেই গদ্যরচনার সূত্রপাত ঘটেছিল।

তাহলে কেন বলা হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পূর্বে যে সকল গদ্য রচিত হয়েছিল, সেইসব গদ্য ছিল শিল্পগুণবিবর্জিত নীরস এবং অনেক ক্ষেত্রেই অসংলগ্ন বাক্যসমষ্টি। বিদ্যাসাগর সর্বপ্রথম বাংলা সাধু গদ্যের একটি মান্য ধ্রুবক নির্দেশনা করেন। প্রয়োজনবোধে সেই গদ্যে চলিত ভাষার গতিশীলতাও যুক্ত করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কল্পনা ও স্বকীয় পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে যে গদ্যভাষার জন্ম দেন, তা ছিল সরস, সুমধুর, সুশ্রাব্য, ছন্দোময় ও গতিশীল।

উপর্যুক্ত কারণেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক গদ্যকার বলা হয় এবং একই কারণে তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের নব জন্মদাতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা আধুনিক গদ‍্যের জনক।

মান্য সাধু বাংলা গদ্য এবপং শকুন্তলা ও সীতার বনবাস

মান্য সাধু বাংলা গদ্যের শিল্পরূপটি ঠিক কি রকম হতে পারে, তার প্রথম আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অনূদিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনাগুলিতে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ সালে রচনা করে ‘শকুন্তলা’ ও ১৮৬০ সালে রচনা করেন ‘সীতার বনবাস’; তাঁর এই দুই গ্রন্থে সেই বিশিষ্ট গদ্যশৈলীর পরিচয় পাওয়া যাবে :

“শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার সম্পূর্ণ আবির্ভাব; বাহুযুগল কোমল বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত; আর, নব যৌবন, বিকশিত কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া রহিয়াছে। (শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ)”

“লক্ষ্মণ বলিলেন, আর্য্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলংকৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গবিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে। (সীতার বনবাস, প্রথম পরিচ্ছেদ, আলেখ্যদর্শন)”

এই চিত্ররূপময়, কাব্যিক ও অলংকার বহুল গদ্যভাষার পাশাপাশি প্রয়োজন বোধে বিদ্যাসাগরকে লৌকিক ভাষার আদর্শে দ্রুতগামী ও শ্লেষাত্মক গদ্যরচনা করতেও দেখা যায়। জীবনের শেষ পর্বে রচিত ব্রজবিলাস তার একটি উদাহরণ:

“এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই, বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় খুড় মহাশয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও গুঁতোগুঁতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর পাইলে, হাঙ্গাম ও ফেসাৎ উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে উত্তর না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া, চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া, বসিয়া থাকিলে আমি ছাড়িব না। (ব্রজবিলাস)”

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যবহৃত ভাষা আলালি ভাষার মতো ফারসি শব্দবহুল নয়, আবার হুতোমি ভাষার অশ্লীলতা দোষ থেকেও মুক্ত। বরং স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর্যবান অথচ সরস বাংলা চলিত গদ্যের সূত্রপাত করেছিলেন, তারই পূর্বসূরী।

গ্রহণ-বর্জনে বিদ্যাসাগর

সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে বিদ্যাসাগরের অসামান্য দখল ছিল; আবার নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখে সেই ভাষার সাহিত্যের সঙ্গেও সম্যক পরিচিত হয়েছিলেন তিনি। সংস্কৃত শব্দ ও পদবিন্যাসের শ্রুতিমাধুর্য ও গাম্ভীর্যকেই তিনি স্থান দিয়েছিলেন বাংলা গদ্যে; দুর্বোধ্যতা বা দুরুহতাকে নয়। অন্যদিকে কাব্যিক ছন্দোময়তায় গদ্যকে দিয়েছিলেন এক ললিত সুডৌল রূপ। 

গ্রহণ-বর্জনের যে অসামান্য ক্ষমতা তার মধ্যে ছিল, তার মাধ্যমে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক গদ্যের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারিক গদ্য ও সমকালীন সংবাদপত্রগুলির নিকৃষ্ট গদ্যনমুনা সব থেকেই ছেঁকে নিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় সাহিত্যগুণ। আবার ইংরেজি সাহিত্যের আদর্শে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম যতিচিহ্নের ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যে কালান্তর সূচনা করতেও পিছপা হননি তিনি।

নিছক ব্যবহারিক বাংলা গদ্যকে তিনি উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক গদ্যে বিবর্তিত করতে তার প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন ও সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজ গতি ও কর্মকুশলতা দান করিয়াছিলেন।”

শুধু গদ্যরীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একই গদ্যরীতিতে তাঁর সব রচনা লেখেননি; তিনি পাঠ্যপুস্তক যে, রীতিতে লিখেছেন, সাহিত্য রচনা করেছেন তা থেকে ভিন্ন ভঙ্গিতে; আবার তাঁর বেনামী পুস্তকগুলির রীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রীতির— তা পরিপূর্ণ হাস্যরস এবং ব্যঙ্গবিদ্রূপে।

তাঁর প্রথম সাহিত্যগ্রন্থ বেতালপঞ্চবিংশতিতেই বিদ্যাসাগর প্রমাণ দিয়েছেন, তিনি কেবল বেতালের গল্পগুলিকেই নতুন করে বলেছেন, অনুবাদ করেননি। গল্পগুলি বলতে গিয়ে তিনি তাদের সংস্কার এবং পরিবর্তন করেছেন এবং মূল বেতাল’র স্থূল রুচি ত্যাগ করে তাদের আধুনিক পাঠকদের কাছে পরিবেশনের উপযোগী করে তুলেছেন।

একই কথা বলা যায় কালিদাসের রচনা অবলম্বনে রচিত শকুন্তলা (১৮৫৪) সম্পর্কে। তাছাড়া এ গ্রন্থে তিনি শকুন্তলা এবং তার দুই সখীকে রীতিমতো বাঙালি নারীর মতো করে নির্মাণ করেছেন। সীতার বনবাস গ্রন্থের (১৮৬০) সীতাও নিতান্ত বাঙালি নারী হয়ে উঠেছেন।

এমন কি বিদ্যাসাগর যখন ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) নাম দিয়ে উইলিয়াম শেক্সপীয়রের কমেডি অব এরর্স অনুবাদ করেছেন, তখন তাকে বাঙালি পরিবেশের উপযুক্ত করে রচনা করেছেন। তদুপরি তাঁর ভ্রান্তিবিলাস মূলত গল্প, নাটক নয়।

তাঁর ভাষাভঙ্গি, সূক্ষ্ম হাস্যরস এবং শব্দের মারপ্যাঁচে এই দুটি গ্রন্থকেই অনুবাদ নয়, বরং মৌলিক গ্রন্থ বলে মনে হয়। তাঁর গদ্যে তিনি অনুপ্রাসসহ সঙ্গীতময় এবং বিষয়ের উপযোগী শব্দ ব্যবহার করেছেন। শ্বাসযতি ও অর্থযতির সমন্বয় ঘটানোর ফলে তাঁর গদ্যে এমন সৌন্দর্য এসেছে যা তাঁর পূর্ববতী লেখকরা আবিষ্কার করতে পারেননি।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচিত গ্রন্থের তালিকা

শিক্ষামূলক গ্রন্থ

  • বর্ণপরিচয় (১ম ও ২য় ভাগ ; ১৮৫৫)
  • ঋজুপাঠ (১ম, ২য় ও ৩য় ভাগ ; ১৮৫১-৫২)
  • সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
  • ব্যাকরণ কৌমুদী (১৮৫৩)

অনুবাদ গ্রন্থ

হিন্দি থেকে বাংলা
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭; লল্লুলাল কৃত বেতাল পচ্চীসী অবলম্বনে)
সংস্কৃত থেকে বাংলা
  • শকুন্তলা (ডিসেম্বর, ১৮৫৪; কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ অবলম্বনে)
  • সীতার বনবাস (১৮৬০) – ভবভূতির উত্তররামচরিতম্‌ নাটকের আখ্যানবস্তু।
  • মহাভারতের উপক্রমণিকা (১৮৬০; ব্যাসদেব মূল মহাভারত-এর উপক্রমণিকা অংশ অবলম্বনে)
  • বামনাখ্যানম্ (১৮৭৩; মধুসূদন তর্কপঞ্চানন রচিত ১১৭টি শ্লোকের অনুবাদ)
ইংরেজি থেকে বাংলা
  • বাঙ্গালার ইতিহাস (১৮৪৮; মার্শম্যান কৃত হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত)
  • জীবনচরিত (১৮৪৯; চেম্বার্সের বায়োগ্রাফিজ অবলম্বনে রচিত)
  • নীতিবোধ (প্রথম সাতটি প্রস্তাব– ১৮৫১; রবার্ট ও উইলিয়াম চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত)
  • বোধোদয় (১৮৫১; চেম্বার্সের রুডিমেন্টস অফ নলেজ অবলম্বনে রচিত)
  • কথামালা (১৮৫৬; ঈশপস ফেবলস অবলম্বনে রচিত)
  • চরিতাবলী (১৮৫৭; বিভিন্ন ইংরেজি গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা অবলম্বনে রচিত)
  • ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯; শেক্সপিয়রের কমেডি অফ এররস অবলম্বনে রচিত। ভ্রান্তিবিলাস অবলম্বনে ১৯৬৩ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মনু সেন)
ইংরেজি গ্রন্থ
  • পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস্
  • সিলেকশনস্ ফ্রম গোল্ডস্মিথ
  • সিলেকশনস্ ফ্রম ইংলিশ লিটারেচার
মৌলিক গ্রন্থ
  • সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩)
  • বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৫)
  • বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (প্রথম খন্ড ১৮৭১, ২য় খন্ড ১৮৭৩)
  • অতি অল্প হইল এবং ”আবার অতি অল্প হইল দুখানা পুস্তক (১৮৭৩, বিধবা বিবাহ বিরোধী পণ্ডিতদের প্রতিবাদের উত্তরে ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে।)
  • ব্রজবিলাস, যৎকিঞ্চিৎ অপূর্ব্ব মহাকাব্য (নভেম্বর, ১৮৮৪) – “কবিকুলতিলকস্য কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য” ছদ্মনামে রচিত। বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের রচনার প্রত্যুত্তরে লিখিত হয়।
  • রত্নপরীক্ষা (১৮৮৬)
  • প্রভাবতী সম্ভাষণ (সম্ভবত ১৮৬৩)
  • জীবন-চরিত (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
  • শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪)
  • নিষ্কৃতি লাভের প্রয়াস (১৮৮৮)
  • ভূগোল খগোল বর্ণনম্ (১৮৯১ ; মরণোত্তর প্রকাশিত)
সম্পাদিত গ্রন্থ
  • অন্নদামঙ্গল (১৮৪৭)
  • কিরাতার্জ্জুনীয়ম্ (১৮৫৩)
  • সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮)
  • শিশুপালবধ (১৮৫৩)
  • কুমারসম্ভবম্ (১৮৬২)
  • কাদম্বরী (১৮৬২)
  • বাল্মীকি রামায়ণ (১৮৬২)
  • রঘুবংশম্ (১৮৫৩)
  • মেঘদূতম্ (১৮৬৯)
  • উত্তরচরিতম্ (১৮৭২)
  • অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ (১৮৭১)
  • হর্ষচরিতম্ (১৮৮৩)
  • পদ্যসংগ্রহ প্রথম ভাগ (১৮৮৮; কৃত্তিবাসি রামায়ণ থেকে সংকলিত)
  • পদ্যসংগ্রহ দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯০; রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল থেকে সংকলিত)
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

নারীশিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যসাগসর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতি উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

(আরও পড়ুন উপরের ‘শিক্ষা সম্প্রসারণে বিদ্যাসাগর’ অংশে)

বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক মনোভাবাপন্ন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, পুরোনো মূল্যবোধ এবং পরিবারের ভেতর থেকে পরিবর্তন আনতে না পারলে সমাজ এবং দেশের কখনো প্রকৃত উন্নতি হবে না। এ জন্যে তিনি বিধবা-বিবাহ চালু করা, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের জন্যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজ থেকে পদত্যাগ করেন, তার কয়েক মাস পরে বালবিধবাদের পুনর্বিবাহের পক্ষে তাঁর প্রথম বেনামী লেখা প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালের এপ্রিল মাসে ‘বেঙ্গল স্পেক্টেটর’ পত্রিকায়। আর এ বিধবাবিবাহের বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালের জানুয়ারি মাসে, দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয় একই বছরের অক্টোবর মাসে। 

এভাবে বিধবাবিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় প্রমাণ দেওয়া ছাড়াও, বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রবর্তনের পক্ষে একটি আইন প্রণয়নের জন্যে তিনি সামাজিক আন্দোলন আরম্ভ করেন।, ১৮৫৫ সালের অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে তিনি বিধবা বিবাহের পক্ষে বহু স্বাক্ষরসংবলিত একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান। পরে এরকমের আরও ২৪টি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। অনেকগুলি আবেদনপত্র আসে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। এসব আবেদনপত্রে প্রায় পঁচিশ হাজার স্বাক্ষর ছিল। 

অপরপক্ষে, রক্ষণশীল সমাজ আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে সরকারের কাছে আঠাশটি আবেদনপত্র পাঠান। তাঁদের যুক্তি ছিল যে, এ রকমের আইন পাস করে দেশবাসীর ধর্মে হস্তক্ষেপ করা সরকারের পক্ষে উচিত হবে না। এতে স্বাক্ষর ছিল পঞ্চান্ন হাজারেরও বেশি। বিরোধীদের পক্ষেই পাল্লা ভারী ছিল, তা সত্ত্বেও ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে বিধবাবিবাহ আইন প্রণীত হয়।

বিদ্যাসাগর এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে ১৮৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রক্ষণশীল সমাজের বিক্ষোভ এবং প্রচন্ড বাধার মুখে ঘটা করে এক বিধবার বিবাহ দেন। পাত্র ছিল সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগরের একজন সহকর্মী। তাছাড়া নিজের একমাত্র পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ দিতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নে সাফল্য লাভ করায় পরে কুলীনদের বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ আইন পাস করার পক্ষে সরকারের কাছে আবেদন জানান।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন করুণাসাগর ও দয়াসাগর

ঈঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দয়া এবং মানবিকতার জন্যে তিনি করুণাসাগর নামে পরিচিতি পান (তাঁকে এ বিশেষণ প্রথমে দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত)। নিজের চরম অর্থসঙ্কটের সময়ও বিদ্যাসাগর ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন‌। তিনি তাঁর দান এবং দয়ার জন্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে এ নিয়ে খুব সুন্দর একটি গল্প আছে।

মাইকেল মধুসূদন যখন বিদেশে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন তখন দেশ থেকে বিদ্যাসাগর তাকে অর্থ পাঠিয়েছিলেন। এ নিয়ে ২০২০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ তম জন্মবার্ষিকিতে ভারতের গীতিকার, সুরকার সংগীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পি অনুপম রায় ‘মাইকেল বিদ্যাসাগর সংবাদ’ নামে একটি গান রচনা করেন। অনুপম রায়ের ‘মাইকেল বিদ্যাসাগর গানটি তিনি নিজেই সুর দেন ও সংগীতায়োজন করেন। অসাধারণ এই গানটিতে কণ্ঠ দেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও অনুপম রায় নিজে। গানটতে মাইকেল মধুসূদনের ভূমিকায় ছিলেন অনুপম রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা পালন করেছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

‘মাইকেল বিদ্যাসাগর সংবাদ’ গানের কথা:

সুদূর বিদেশে পড়ে আছি আমি, জীবন কি তবে ব্যর্থ
সুদূর বিদেশে পড়ে আছি আমি, জীবন কি তবে ব্যর্থ
বিদ্যাসাগর, বাঁচাও আমায়, পাঠাও আমাকে অর্থ
তুমি বলেছিলে আমার লেখাতে পেয়েছিলে great merit
অমিত্রাক্ষরে ভালোবাসা নিও, সহ্য হয় না দেরীকথা দিয়ে ওরা কথা রাখবে না মানুষেরই অভ্যাসে
কথা দিয়ে ওরা কথা রাখবে না মানুষেরই অভ্যাসে
বন্ধু তোমায় বলেছি যখন, থাকবো তোমার পাশে
এই নাও কিছু হাজার পাঠাই, আরও প্রয়োজনে জানাও
এই নাও কিছু হাজার পাঠাই, আরও প্রয়োজনে জানাও
পড়া শেষ করে ব্যারিস্টারি, নতুন কাব্য শোনাওওরা দু'জনে ছিলো বন্ধু
ওরা দু'জনে ছিলো বন্ধুধন্যবাদের ভাষা খুঁজি আমি নিজের মাতৃভাষায়
ধন্যবাদের ভাষা খুঁজি আমি নিজের মাতৃভাষায়
দেশে ফিরে আমি এলাম বন্ধু তোমাদের ভালোবাসায়
অভাব আমার স্বভাবে যে ভিড, হোটেল নিয়েছি ভাড়া
আয় ভালো তবে ব্যয় আরও বেশি, আমি আবার সর্বহারাতোমাকে বাঁচাবে এমন ক্ষমতা ক'জনার বলো আছে
তোমাকে বাঁচাবে এমন ক্ষমতা ক'জনার বলো আছে
ধার-দেনা শুধু বাড়তেই থাকে, আর ভালো লাগে না যে
আমার বাক্যে নির্ভর করে সাহায্য করে কেবল
আমার বাক্যে নির্ভর করে সাহায্য করে কেবল
তাদেরকে যেন ঠকাতে না হয়, আমার কথাও ভেবোওরা দু'জনে ছিলো বন্ধু
ওরা দু'জনে ছিলো বন্ধুকরুণাসিন্ধু ভাগ্য আমার, তোমাকে চিনেছি আমি
স্নেহ-মমতায় ভরা যে তোমার মনটা সবচেয়ে দামী
করুণাসিন্ধু ভাগ্য আমার, তোমাকে চিনেছি আমি
স্নেহ-মমতায় ভরা যে তোমার মনটা সবচেয়ে দামী
বন্ধু আমার, আমাকে দিয়েছো কত না সুখের দিন
সব বেচে দিয়ে শোধ করে যাবো আমার যা আছে ঋণযা আছে ঋণ
যা আছে ঋণ

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘জ্ঞান ও মনীষার জন্য ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি তিনি তাঁর শিক্ষকদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সাধারণ দেশবাসী তাঁকে আরেকটি উপাধিতে ভূষিত করেছিল। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘দয়ার সাগর’ নামেই পরিচিত।’ এই উপাধি যে নিছকই শুধু উপাধি নয়, সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুনীতিকুমার জানিয়েছিলেন, ‘এই একটি উপাধির মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রের মস্ত বড় একটি দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে। একদিকে তিনি সুপণ্ডিত ও শিক্ষাব্রতী, তাঁর যুক্তিবাদী মননের ঔজ্জ্বল্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রত্যেকটি আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর হৃদয় দুঃস্থ মানবতার জন্য করুণায় বিগলিত।’ সেইসঙ্গে বিদ্যাসাগরের অবদানের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তাঁর দেশবাসীর জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং সমাজের উন্নতির জন্য বিশেষত এদেশের নারীদের জন্য তিনি যা করেছিলেন, তার তুলনা নেই।’ শুধু এইটুকুনই বলে ক্ষান্ত হননি সুনীতিবাবু। সেইসঙ্গে এটিও যোগ করে তাঁকে বলতে হয়েছে – ‘বিদ্যাসাগরের একটি মহৎ হৃদয় ছিল, যা আত্মমর্যাদায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল; কখনও কোনো অন্যায়, দম্ভ বা ঔদ্ধত্যের কাছে সে মাথা নমিত  হয়নি। এমনকি শাসক ব্রিটিশ রাজপুরুষও তাঁকে অবহেলা করতে পারেনি।’ 

বিদ্যাসাগর ছিলেন ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান!

বিদ্যাসাগর  জন্মগ্রহণ করেছিলেন একটি ঐতিহ্যিক এবং রক্ষণশীল পরিবারে এবং সমাজ সংস্কারের জন্যে তিনি যুক্তিও দিতেন হিন্দু শাস্ত্র থেকে; কিন্তু তিনি ছিলেন ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কে সন্দিহান মনের।

ঈশ্বরচন্দ্র বোধোদয় গ্রন্থ যেমন তিনি শুরু করেছেন পদার্থের সংজ্ঞা দিয়ে। পরে সংজ্ঞা দিয়েছেন ঈশ্বরের, যাঁকে তিনি বলেছেন সর্বশক্তিমান, সর্বত্রবিরাজমান চৈতন্যস্বরূপ। পরে এ গ্রন্থে তিনি যা কিছু দেখা যায়, স্পর্শ করা যায়, অনুভব করা যায়, তেমন সব বিষয়ের সংজ্ঞা দিয়েছেন; কিন্তু ঈশ্বর বা কোনো অতিলৌকিক শক্তির নামও উল্লেখ করেননি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বইটি পড়ার স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন,

‘কেবল মনে পড়ে; “জল পড়ে পাতা নড়ে।” তখন “কর, খল” প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কূল পাইয়াছি। সেদিন পড়িতেছি, “জল পড়ে পাতা নড়ে।” আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আদিকবির সম্মানে ভূষিত করেছেন বিদ্যাসাগরের জীবন অবসানের (২৯ জুলাই ১৮৯১) ২১ বছর পর প্রকাশিত বই জীবনস্মৃতিতে।

চারিত্রপূজায় মুদ্রিত ‘বিদ্যাসাগরচরিত’ নামের বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাসাগরকে পরিচিত করিয়েছেন ‘যথার্থ সম্পূর্ণ মানুষ’ বলে। তাঁর ভাষায়:

‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিয়া দেখিলে এই কথাটি বারবার মনে উদয় হয় যে, তিনি যে বাঙালি বড়লোক ছিলেন তাহা নহে, তিনি যে রীতিমত হিন্দু ছিলেন তাহাও নহে—তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বেশি বড়ো ছিলেন, তিনি যথার্থ মানুষ ছিলেন।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, "বিদ্যাসাগর স্বভাবতই সম্পূর্ণ স্বাধীনতন্ত্রের লোক ছিলেন।"
রবীন্দ্রনাথের প্রত্যয়ভরা লেখনীতে আরও জানা যায়, বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আধার বলে আমরা প্রচার করি। কিন্তু সেটা ঠিক না। তাঁর প্রধান গৌরব তাঁর অজেয় পৌরুষ ও মনুষ্যত্ব।

রবীন্দ্রনাথ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহ আন্দোলন, বাল্যবিবাহ বন্ধ, পণপ্রথা রোধের সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল সাহিত্যে, সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনে। পাশাপাশি এটি গুরুত্ব পেয়েছিল রামমোহন-পরবর্তী সমাজ-অগ্রগতির জন্য নারী আন্দোলনেও।

এবং আরও কিছু

সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রথম বাংলা লিপি সংস্কার করে তাকে যুক্তিবহ ও সহজপাঠ্য করে তোলেন। বিদ্যাসাগরকে বলা হয় বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের প্রথম শিল্পী বলে অভিহিত করেছেন।

সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার সময় ১৮৫৫ সালে সরকার তাঁকে হুগলি, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও নদীয়া জেলার বিশেষ স্কুল পরিদর্শকের (Special Inspector of Schools) অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করে। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন।

১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ইম্পেরিয়াল অ্যাসেমব্লিজ-এ সম্মাননা-সনদ লাভ করেন এবং ১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে সি. আই. ই. (CIE) হন। 

এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।

বিদ্যাসাগরের মৃত্যু

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য) কলকাতা শহরে ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় বিদ্যাসাগরের বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

এক নজরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

নামজন্ম নাম: ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় শর্মাউপাধি: বিদ্যাসাগরস্বাক্ষর: ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা
জন্ম২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দ;বীরসিংহ গ্রাম, হুগলি জেলা, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়)
মৃত্যু২৯ জুলাই ১৮৯১ (বয়স ৭০);কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত(অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে)
ছদ্মনামকস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্যকস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য
পেশালেখকদার্শনিকপণ্ডিতশিক্ষাবিদঅনুবাদকপ্রকাশকসংস্কারকমানবহিতৈষী
ভাষাবাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি
দাম্পত্য সঙ্গীদীনময়ী দেবী
সন্তাননারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
সাহিত্য আন্দোলনবাংলার নবজাগরণ
আত্মীয়ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (বাবা)ভগবতী দেবী (মা)শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন (সেজ ভ্রাতা)
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থবর্ণপরিচয় , কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী ব্যাকরণ কৌমুদী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (২ খণ্ডে), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (২ খণ্ডে)[১], অতি অল্প হইল (১৮৭৩), আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩), ব্রজবিলাস(১৮৮৪),
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংস্কৃত কলেজ
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়

রেফারেন্স

বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আপনারা আরও পড়তে পারেন

  • অঞ্জলি বসু (সম্পাদিত) ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৭৬
  • অমরেন্দ্রকুমার ঘোষ ; যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর : তুলিকলম, কলকাতা, ১৯৭৩
  • অমূল্যকৃষ্ণ ঘোষ ; বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, এম সি সরকার, কলকাতা, ১৯১৭
  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ; বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর : মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৭০
  • ইন্দ্রমিত্র ; করুণাসাগর বিদ্যাসাগর : আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৬৬
  • গোপাল হালদার (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর রচনা সম্ভার (তিন খণ্ডে) : পশ্চিমবঙ্গ নিরুক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, কলকাতা, ১৯৭৪-৭৬
  • বদরুদ্দীন উমর ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ : দ্বিতীয় সংস্করণ, চিরায়ত, কলকাতা, ১৯৮২
  • বিনয় ঘোষ ; বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ : বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ
  • বিনয় ঘোষ ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : অনুবাদক অনিতা বসু, তথ্য ও বেতার মন্ত্রক, নয়াদিল্লি, ১৯৭৫
  • ব্রজেন্দ্রকুমার দে ; করুণাসিন্ধু বিদ্যাসাগর : মণ্ডল অ্যান্ড সন্স, কলকাতা, ১৯৭০
  • মহম্মদ আবুল হায় আনিসুজ্জামন ; বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ : স্টুডেন্টস ওয়েজ, ঢাকা, ১৯৬৮
  • যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ; বিদ্যাসাগর : পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৪১
  • যোগীন্দ্রনাথ সরকার ; বিদ্যাসাগর : ১৯০৪
  • রজনীকান্ত গুপ্ত ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : ১৮৯৩
  • রমাকান্ত চক্রবর্তী (সম্পাদিত) ; শতবর্ষ স্মরণিকা : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৮৭২-১৯৭২ : বিদ্যাসাগর কলেজ, ১৯৭২
  • রমেশচন্দ্র মজুমদার ; বিদ্যাসাগর : বাংলা গদ্যের সূচনা ও ভারতের নারী প্রগতি : জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৭৬ বঙ্গাব্দ
  • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ; বিদ্যাসাগর-চরিত : বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা
  • রাধারমণ মিত্র ; কলিকাতায় বিদ্যাসাগর : জিজ্ঞাসা, কলিকাতা, ১৯৪২
  • রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ; চরিত্র কথা : কলকাতা, ১৯১৩
  • শঙ্করীপ্রসাদ বসু ; রসসাগর বিদ্যাসাগর : দ্বিতীয় সংস্করণ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৯২
  • শঙ্খ ঘোষ ও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর : ওরিয়েন্ট, কলকাতা
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর চরিত : কলকাতা, ১২৯৪ বঙ্গাব্দ
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর জীবনচরিত : কলকাতা
  • শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন ; বিদ্যাসাগর চরিত ও ভ্রমণিরাস : চিরায়ত, কলকাতা, ১৯৯২
  • শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : জীবনীকোষ, ভারতীয় ঐতিহাসিক, কলকাতা, ১৯৩৬
  • শামসুজ্জামান মান ও সেলিম হোসেন ; ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : চরিতাভিধান : বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫
  • সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (সম্পাদিত) ; বিদ্যাসাগর গ্রন্থাবলী (তিন খণ্ডে) : বিদ্যাসাগর স্মৃতি সংরক্ষণ সমিতি, কলকাতা, ১৩৪৪-৪৬ বঙ্গাব্দ
  • সন্তোষকুমার অধিকারী ; বিদ্যাসাগর জীবনপঞ্জি : সাহিত্যিকা, কলকাতা, ১৯৯২
  • সন্তোষকুমার অধিকারী ; আধুনিক মানসিকতা ও বিদ্যাসাগর : বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার, কলকাতা, ১৯৮৪
  • হরিসাধন গোস্বামী ; মার্কসীয় দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর : ভারতী বুক স্টল, কলকাতা, ১৯৮৮