যুগসন্ধির কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
- প্রকাশ: ০৯:৪৪:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
- / ২১২২৫ বার পড়া হয়েছে
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) ছিলেন একজন কবি ও সাংবাদিক। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলা হয়। এখানে কবি ও সাংবাদিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে; পাঠক চাইলে একে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী বলতে পারেন।
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জন্ম ও পরিচয়
১২১৮ বঙ্গাব্দের ২৫ ফাল্গুন (মার্চ ১৮১২)) পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী বা কাঁচড়াপাড়া গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পিতার নাম হরিনারায়ণ গুপ্ত প্রথমদিকে কবিরাজি চিকিৎসা করতেন; পরে শেয়ালডাঙ্গার কুঠিবাড়িতে চাকরি করেন।
শৈশব ও শিক্ষাজীবনে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
দশ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর মাকে হারান। মাকে হারানোর পর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে জোড়াসাঁকোয় মাতুলালয়ে রাখা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন লেখাপড়ায় খুবই অমনোযোগী, এই কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব বেশি দূর না এগুতে পারলেও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ছিলেন অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী।
অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির কারণে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নিজ চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন; পাশাপাশি তিনি বেদান্তদর্শনে পারদর্শিতা লাভ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে ১৮৩১ সালের ২৮ জানুয়ারি সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা প্রকাশ করেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত।
অর্থসংকটের কারণে মাঝে চার বছর বন্ধ রাখতে হয় তাঁকে। ১৮৩৬ সালের ১০ আগস্ট সপ্তাহে তিন সংখ্যা হিসেবে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে।
সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর সুযোগ্য সম্পাদনার মাধ্যমে পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে সমর্থ হন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় ১৮৩৯ সালের ১৪ জুন থেকে সংবাদ প্রভাকর সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।
সমাজ গঠনে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
আধুনিক বাংলার সমাজ গঠনে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের পক্ষভুক্ত ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষাপদ্ধতিরও বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু নবপর্যায়ে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনার সময় থেকে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি দেশের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। হিন্দু থিয়ফিলানথ্রফিক সভা এবং তত্ত্ববোধিনী সভায় তিনি বক্তৃতাও করতেন। প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এ বিষয়ে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অক্ষতযোনি বিধবার বিবাহেও আর আপত্তি করেননি।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে কেন যুগসন্ধির বা যুগসন্ধিক্ষণের কবি বলা হয়?
ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত, কারণ তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন লুপ্ত হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে খন্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই ছিল তাঁর রচনার বিশেষত্ব। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের এ ভঙ্গি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের নিকট থেকে। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয়ও তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ
স্বদেশ ও স্বসমাজের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন করেছেন তা আজ স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি সবসময় ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। ভাষা ও ছন্দের ওপর তাঁর বিস্ময়কর অধিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) নাটকে।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কীর্তি, সম্পাদিত পত্রিকা ও সাহিতকর্ম
ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করা। পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্বও তাঁর। যদিও ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যরীতি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর অনুসৃত হয়নি, তথাপি এ কথা স্বীকার্য যে, ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের জন্য তাঁর গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ঈশ্বচন্দ্র গুপ্ত ছোটোবেলা থেকেই মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন এবং কবিয়ালদের গান বেঁধে দিতেন। সমসাময়িক ঘটনাকে ব্যঙ্গ করে তিনি অসংখ্য খন্ডকবিতা সংবাদ প্রভাকরে প্রকাশ করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগের এ কবি স্বদেশমূলক যেসব কবিতা রচনা করেছেন তার জন্যও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
উপরে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র সংবাদ প্রভাকর ছাড়াও সংবাদ রত্নাবলী, পাষন্ডপীড়ন ও সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, রামপ্রসাদ সেন রচিত কালীকীর্তন (১৮৩৩) ও প্রবোধ প্রভাকর (১৮৫৮) সম্পাদনা করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর রচিত হিতপ্রভাকর (১৮৬১) ও বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) প্রকাশিত হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ (১৮৮৫) এবং সত্যনারায়ণ ব্রতকথা (১৯১৩)।
১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১০ মাঘ (২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯) ঈশ্বরচন্দ্র মৃত্যুবরণ করেন।
[বাংলাপিডিয়া থেকে সংগৃহিত অনিরুদ্ধ কাহালি কর্তৃক রচিত নিবন্ধকে সংযোজন ও সম্পাদনার মাধ্যমে নতুন রূপ প্রদান করেছে বিশ্লেষণ সংকলন টিম]