১০:০৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

মুভি রিভিউ: সোনাদা সিরিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ০৮:০৫:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মার্চ ২০২১
  • / ১২০৭ বার পড়া হয়েছে

দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন অনলাইন স্ট্রিমিং পাবলিসিটি


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

যদি কেউ কোনো ভুল করে এবং ওই ভুলটি যদি সে ধরতে পারে আর সেই ভুলের পুনরাবৃতি যদি সচেতনভাবে করা যায় তাহলে পূর্বভুল আর ভুল থাকে না। ঠিক এটিই করেছেন সোনাদা সিরিজের পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। সোনাদা সিরিজের প্রথম কিস্তি অর্থাৎ ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ মুভির রিভিউতে বলেছিলাম সুবর্ণ সেনের করা তাঁর পিএইচডি ছাত্রীর বানান ভুল বিষয়ক মন্তব্যটি অপ্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু পরিচালক নিজেই যখন নিজের ভুল ধরতে পেরেছেন এবং সেটি ভুলের খাতা থেকে কিভাবে বাদ দিতে হয় সেটি ভালো করে সম্পাদন করেছেন শুভেন্দু দাশমুন্সি নিয়ে। শুধু নিজের ভুলকেই শুদ্ধ বলে চালিয়ে দেননি বরং সে ভুল থেকে খুঁজে নিয়েছেন গল্পের নতুন মাত্রা যা সামনের কিস্তিতে দেখা যাবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তো ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’চলচ্চিত্রটি কেমন ছিল?

পরিচালক ধ্রুব ব্যানার্জি এসভিএফ এর ব্যানারেই নির্মান করেছেন গুপ্তধনের সন্ধানে’র সিক্যুয়েল ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’। প্রথম পর্বে দেখিয়েছেন সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার বাংলায় রেখে যাওয়া গুপ্তধন খোঁজার কল্পচিত্র এবং দ্বিতীয় পর্বে দেখালেন পলাশীর যুদ্ধে যে জগৎশেঠ বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন সিরাজউদ্দৌলার পতনের জন্য, সেই বিশ্বাসঘাতকতার অন্যতম সঙ্গী মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে জগৎশেঠ যে উপহার দিয়েছিলেন খুশি হয়ে সেই কল্পিত ধন খোঁজার কল্পিত গল্প।

এ গল্পে এক বনেদী যৌথ পরিবারের দেখা মেলে। দেবরায় পরিবার। দুর্গাগতি ছিলেন এ পরিবারের পূর্বপুরুষ যে কিনা সেই কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আর সেই বন্ধুত্বের সুবাধেই নিজের ধনসম্পদ গচ্ছিত রেখে যান তিনি বাংলায় কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গাপূজার নিজস্ব চলনও এখানে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যান।

এখানেও যথারীতি সুবর্ণ সেন ওরফে সোনাদা চরিত্রে রয়েছেন আবীর চট্টোপাধ্যায়, আবীরলাল রায় চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তি এবং ঝিনুক চরিত্রে রয়েছেন ইশা সাহা।

সোনাদা গুপ্তধন খোঁজে কখনো এই পরিবারে যুগযুগ ধরে চলে আসা দূর্গাগতির সেই গানের সুত্র ধরে, কখনো দুর্গেশগড়ের প্রাসাদের এমলেম দেখে, কখনো চিত্রকর্ম দেখে যাকে বলা হয়েছে ‘চালচিত্র থেকে মানচিত্র’, কখনো বা তাঁদের ধর্মের দূর্গাদেবির বিশেষ বৈশিষ্ট্য থেকে। সোনাদার বিচক্ষণতা ও তার সাগরেদ আবির-ঝিনুক জুটি এখানেও প্রাণবন্ত করে রেখেছে পুরো পর্দা। সোনাদাতো তার অভিযান নিয়েই ব্যস্ত বা কখনো সাগরেদ বা অন্যদের সাথে ঠাট্টায় জড়ায়, যেটি হয়ে থাকে একজন প্রেম-সংসার না হওয়া একজন ভারিক্কী অথচ মিশুক লোকের ক্ষেত্রে। আবীর ও ঝিনুকের প্রেম, খুনসুটি, ও দায়িত্বজ্ঞান দারুণ ছিল। এইম যেমন একটি সিকুয়েন্সের কথা বলা যেতে পারে- আবীর ঝিনুককে মজা করে জিজ্ঞেস করেছে “কলাবউর লজ্জাটা দেখেছিস?” ঝিনুকও পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, “গণেশের ভুঁড়িটা দেখেছিস?” এখানে বিশ্বাস করি আমাকে আলাদা করে এক্সপ্রেশন দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে না ঘটনা কি ঘটেছে তখন বা তাঁদের মধ্যে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ডাম্বল ও সোনাদার ছাত্র চরিত্রে আর্যান ভৌমিকও ভালো অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছে।

অভিযান ও রহস্য রোমাঞ্ছকর সোনাদা সিরিজের এ সিনেমায় আবীরলাল রায় চরিত্রকে যেমন একটু উন্নত করা হয়েছে তেমনি আবীর হিসেবে থাকা অর্জুনও তাঁর অভিনয়ে উন্নতি করেছে। ইশাকে এখানেও ভালো লেগেছে। সোনাদা চরিত্রে আবীর চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আমি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম এখানে।

হিন্দুদের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্লট সাজানো, যৌথ পরিবার, বাড়ির ছেলের বিদেশ যাত্রায় তার মধ্যে নিজের শিকড় নিয়ে অবহেলা, গোপন শত্রু ইত্যাদি মিলে যেমন দর্শককে বিশেষ রকম স্বাদ দিবে তেমনি বলার অপেক্ষা রাখেনা তাঁদেরকে সেই সিরাজউদ্দৌলা কিংবা গোপাল ভাড়ের যুগে নিয়ে যাবে। সাথে বোনাস হিসাবে পাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এক মধুর সম্পর্ক ও বাঙালির আতিথেয়তার স্বাদ।

দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন ফিল্মে চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য চ্যাটার্জী চমৎকার অভিনয় করেছেন বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে। দেবরায় পরিবারের মেঝছেলে হিসাবে ছিলেন ত্রিশুলপানি দেবরায় চরিত্র নিয়ে কৌশিক সেন। গল্পের লেখক এখানে একটি গতানুগতিক একটি ভাব রেখেছেন ভাইদের চরিত্র নিয়ে। অর্থাৎ বাড়ির বড় ছেলে হবে খুবই সহজ সরল এবং মেঝছেলে হবে একটু বদ বা বাঁকা স্বভাবের। যা ছিল ভালোই ছিল তবে মনে হয়েছে কৌশিক সেনের চরিত্রটি নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। আবার একে বাড়াবাড়ি না বলে একটা সাসপেন্স বা মিস্ট্রি বলে ধরে নিতে পারি।

“জীবনের ধন কিছুই যাবেনা ফেলা” উক্তি নিয়ে হঠাৎ করে খরাজ মুখার্জির ফ্রেমে ঢুকে পড়া একদমই ভালো লাগেনি। দর্শকরা এখানে একটি ধাক্কা খেয়েছেন বা খাবেন। এ আগমন গল্পের প্রয়োজনে হলেও ক্যমেরার কারসাজি বা সম্পাদনা এখানে ঠিক ছিলোনা বলে এই অবস্থা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এই একই রকম ঘটনা বেশ কিছু জায়গায় ঘটেছে। তবে দু’চারটে ত্রুটি বাদ দিলে চিত্রগ্রহন, চিত্রসম্পাদনা বা এসংক্রান্ত যা কিছু আছে তা কিন্তু খুবই ভালো ছিল।

ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় সিনেমাটিতে একটি বিশেষ বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমরা আমাদের আশেপাশে অনেক সময় এমন কিছু শিল্পকর্ম দেখি যা নিয়ে গবেষণা করে অনেক চমকপ্রদ বিষয়াদি তুলে নিয়ে আসা যায়। গবেষণা করে এ যাবত অনেকেই অনেক কিছু তুলে এনেছেন যার দ্বারা ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উপকারও হয়েছে। কিন্তু এসব স্বত্তেও যারা এসব শিল্পকর্ম ধারণ করে আছেন, যাদের আঁকড়ে ধরে শিল্পকর্মস্মূহ বেঁচে থাকে যুগান্তরে, তাঁরাই বঞ্চিত হন প্রাপ্য সুযোগসুবিধা থেকে। এরকমই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে এক শিল্পির সংলাপের মধ্য দিয়ে- “আমরা কল্পনা করব আর তোমরা পরিকল্পনা করবে। কী লাভ আমাদের?”

সিনেমার শেষটাতে ছিল চেনা নাটকীয়তা। যেকোনো ভাষার সিনেমাতেই থ্রিলারগুলোতে বিভিন্ন চরিত্র উল্টে যেতে দেখা যায়। এখানেও তেমন হয়েছে। মনে হয়েছে শেষের দিকে আরেকটু রোমাঞ্চকর হলে ভালো লাগতো। তাই বলে পরিচালক যা করেছেন তা কম নয় মোটেই, তবে তা অনুমিত ছিল। তবে আশঙ্কা করছি বাংলার থ্রিলারগুলোও এখন একটি ছকের মধ্যে আটকে যায় কিনা।

‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি একটি গান ছিল বা তাকে স্মরণ করা হয়েছে, এখানেও তেমন স্মরণ করা হয়েছে। তবে এ সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত না থাকলেও বোঝা গিয়েছে ধ্রুব এবং শুভেন্দু রবি ঠাকুরের বড় দুজন ভক্ত।

‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’এ বিক্রম ঘোষের কণ্ঠ ও ডিরেকশনে হিস্ট্রি র‍্যাপ ভলিউম ২ নামে আরেকটি র‍্যাপ রাখা হয়েছে যা আগের মতোই পুরো সিনেমাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এহাড়াও ছয়টি গান রয়েছে যা ডিভোশোনাল, তবে তা বার্তা ও ধাঁধা হসেবেই ধরা দেয় সোনাদার কাছে। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ও বাকি সাউন্ডট্রাকগুলো দারুণ; আসলে বিক্রম ঘোষ বলে কথা। গানগুলোর লিরিক্স লিখেছেন শুভেন্দু দাশমুন্সি।

আমি মনে করিনা আর কোনো চমকপ্রদ উপসংহার টানা উচিৎ এই দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন মুভি রিভিউয়ের জন্য। আপনি, যিনি এই মুহুর্তে রিভিউটি পড়ে শেষ করেছেন তিনি এ সিনেমাটি কেমন চোখে দেখবেন জানি না; আমার ভালো লেগেছে। আশা করি সোনাদা সিরিজের সামনের কিস্তিগুলোও ভালো হবে এবং সোনাদার জীবনে প্রেম আসবে।

চলচ্চিত্রদুর্গেশগড়ের গুপ্তধন
পরিচালনাধ্রুব বন্দোপাধ্যায়
অভিনয়আবীর চট্টোপাধ্যায়, ইশা সাহা, অর্জুন চক্রবর্তী, কমলেস্বর মুখার্জী, রজতাভ দত্ত ও আরও অনেকে
প্রযোজনাএসভিএফ
মুক্তিমে ২৪, ২০১৯
সংগীতবিক্রম ঘোষ
চিত্রধারণসৌমিক হালদার
সম্পাদনাসঞ্জীব কুমার দত্ত

‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ মুভি রিভিউ পড়ুন এখানে

অনলাইনে দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন দেখুন: অ্যামাজন হইচই প্ল্যাটফর্মে

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

মুভি রিভিউ: সোনাদা সিরিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’

প্রকাশ: ০৮:০৫:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ মার্চ ২০২১

যদি কেউ কোনো ভুল করে এবং ওই ভুলটি যদি সে ধরতে পারে আর সেই ভুলের পুনরাবৃতি যদি সচেতনভাবে করা যায় তাহলে পূর্বভুল আর ভুল থাকে না। ঠিক এটিই করেছেন সোনাদা সিরিজের পরিচালক ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়। সোনাদা সিরিজের প্রথম কিস্তি অর্থাৎ ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ মুভির রিভিউতে বলেছিলাম সুবর্ণ সেনের করা তাঁর পিএইচডি ছাত্রীর বানান ভুল বিষয়ক মন্তব্যটি অপ্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু পরিচালক নিজেই যখন নিজের ভুল ধরতে পেরেছেন এবং সেটি ভুলের খাতা থেকে কিভাবে বাদ দিতে হয় সেটি ভালো করে সম্পাদন করেছেন শুভেন্দু দাশমুন্সি নিয়ে। শুধু নিজের ভুলকেই শুদ্ধ বলে চালিয়ে দেননি বরং সে ভুল থেকে খুঁজে নিয়েছেন গল্পের নতুন মাত্রা যা সামনের কিস্তিতে দেখা যাবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তো ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’চলচ্চিত্রটি কেমন ছিল?

পরিচালক ধ্রুব ব্যানার্জি এসভিএফ এর ব্যানারেই নির্মান করেছেন গুপ্তধনের সন্ধানে’র সিক্যুয়েল ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’। প্রথম পর্বে দেখিয়েছেন সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার বাংলায় রেখে যাওয়া গুপ্তধন খোঁজার কল্পচিত্র এবং দ্বিতীয় পর্বে দেখালেন পলাশীর যুদ্ধে যে জগৎশেঠ বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন সিরাজউদ্দৌলার পতনের জন্য, সেই বিশ্বাসঘাতকতার অন্যতম সঙ্গী মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে জগৎশেঠ যে উপহার দিয়েছিলেন খুশি হয়ে সেই কল্পিত ধন খোঁজার কল্পিত গল্প।

এ গল্পে এক বনেদী যৌথ পরিবারের দেখা মেলে। দেবরায় পরিবার। দুর্গাগতি ছিলেন এ পরিবারের পূর্বপুরুষ যে কিনা সেই কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আর সেই বন্ধুত্বের সুবাধেই নিজের ধনসম্পদ গচ্ছিত রেখে যান তিনি বাংলায় কৃষ্ণচন্দ্রের দুর্গাপূজার নিজস্ব চলনও এখানে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যান।

এখানেও যথারীতি সুবর্ণ সেন ওরফে সোনাদা চরিত্রে রয়েছেন আবীর চট্টোপাধ্যায়, আবীরলাল রায় চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তি এবং ঝিনুক চরিত্রে রয়েছেন ইশা সাহা।

সোনাদা গুপ্তধন খোঁজে কখনো এই পরিবারে যুগযুগ ধরে চলে আসা দূর্গাগতির সেই গানের সুত্র ধরে, কখনো দুর্গেশগড়ের প্রাসাদের এমলেম দেখে, কখনো চিত্রকর্ম দেখে যাকে বলা হয়েছে ‘চালচিত্র থেকে মানচিত্র’, কখনো বা তাঁদের ধর্মের দূর্গাদেবির বিশেষ বৈশিষ্ট্য থেকে। সোনাদার বিচক্ষণতা ও তার সাগরেদ আবির-ঝিনুক জুটি এখানেও প্রাণবন্ত করে রেখেছে পুরো পর্দা। সোনাদাতো তার অভিযান নিয়েই ব্যস্ত বা কখনো সাগরেদ বা অন্যদের সাথে ঠাট্টায় জড়ায়, যেটি হয়ে থাকে একজন প্রেম-সংসার না হওয়া একজন ভারিক্কী অথচ মিশুক লোকের ক্ষেত্রে। আবীর ও ঝিনুকের প্রেম, খুনসুটি, ও দায়িত্বজ্ঞান দারুণ ছিল। এইম যেমন একটি সিকুয়েন্সের কথা বলা যেতে পারে- আবীর ঝিনুককে মজা করে জিজ্ঞেস করেছে “কলাবউর লজ্জাটা দেখেছিস?” ঝিনুকও পাল্টা প্রশ্ন করে বসে, “গণেশের ভুঁড়িটা দেখেছিস?” এখানে বিশ্বাস করি আমাকে আলাদা করে এক্সপ্রেশন দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে না ঘটনা কি ঘটেছে তখন বা তাঁদের মধ্যে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ডাম্বল ও সোনাদার ছাত্র চরিত্রে আর্যান ভৌমিকও ভালো অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছে।

অভিযান ও রহস্য রোমাঞ্ছকর সোনাদা সিরিজের এ সিনেমায় আবীরলাল রায় চরিত্রকে যেমন একটু উন্নত করা হয়েছে তেমনি আবীর হিসেবে থাকা অর্জুনও তাঁর অভিনয়ে উন্নতি করেছে। ইশাকে এখানেও ভালো লেগেছে। সোনাদা চরিত্রে আবীর চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আমি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম এখানে।

হিন্দুদের দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্লট সাজানো, যৌথ পরিবার, বাড়ির ছেলের বিদেশ যাত্রায় তার মধ্যে নিজের শিকড় নিয়ে অবহেলা, গোপন শত্রু ইত্যাদি মিলে যেমন দর্শককে বিশেষ রকম স্বাদ দিবে তেমনি বলার অপেক্ষা রাখেনা তাঁদেরকে সেই সিরাজউদ্দৌলা কিংবা গোপাল ভাড়ের যুগে নিয়ে যাবে। সাথে বোনাস হিসাবে পাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর এক মধুর সম্পর্ক ও বাঙালির আতিথেয়তার স্বাদ।

দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন ফিল্মে চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য চ্যাটার্জী চমৎকার অভিনয় করেছেন বাড়ির বড় ছেলে হিসাবে। দেবরায় পরিবারের মেঝছেলে হিসাবে ছিলেন ত্রিশুলপানি দেবরায় চরিত্র নিয়ে কৌশিক সেন। গল্পের লেখক এখানে একটি গতানুগতিক একটি ভাব রেখেছেন ভাইদের চরিত্র নিয়ে। অর্থাৎ বাড়ির বড় ছেলে হবে খুবই সহজ সরল এবং মেঝছেলে হবে একটু বদ বা বাঁকা স্বভাবের। যা ছিল ভালোই ছিল তবে মনে হয়েছে কৌশিক সেনের চরিত্রটি নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। আবার একে বাড়াবাড়ি না বলে একটা সাসপেন্স বা মিস্ট্রি বলে ধরে নিতে পারি।

“জীবনের ধন কিছুই যাবেনা ফেলা” উক্তি নিয়ে হঠাৎ করে খরাজ মুখার্জির ফ্রেমে ঢুকে পড়া একদমই ভালো লাগেনি। দর্শকরা এখানে একটি ধাক্কা খেয়েছেন বা খাবেন। এ আগমন গল্পের প্রয়োজনে হলেও ক্যমেরার কারসাজি বা সম্পাদনা এখানে ঠিক ছিলোনা বলে এই অবস্থা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এই একই রকম ঘটনা বেশ কিছু জায়গায় ঘটেছে। তবে দু’চারটে ত্রুটি বাদ দিলে চিত্রগ্রহন, চিত্রসম্পাদনা বা এসংক্রান্ত যা কিছু আছে তা কিন্তু খুবই ভালো ছিল।

ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায় সিনেমাটিতে একটি বিশেষ বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আমরা আমাদের আশেপাশে অনেক সময় এমন কিছু শিল্পকর্ম দেখি যা নিয়ে গবেষণা করে অনেক চমকপ্রদ বিষয়াদি তুলে নিয়ে আসা যায়। গবেষণা করে এ যাবত অনেকেই অনেক কিছু তুলে এনেছেন যার দ্বারা ব্যাক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা দেশের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উপকারও হয়েছে। কিন্তু এসব স্বত্তেও যারা এসব শিল্পকর্ম ধারণ করে আছেন, যাদের আঁকড়ে ধরে শিল্পকর্মস্মূহ বেঁচে থাকে যুগান্তরে, তাঁরাই বঞ্চিত হন প্রাপ্য সুযোগসুবিধা থেকে। এরকমই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে এক শিল্পির সংলাপের মধ্য দিয়ে- “আমরা কল্পনা করব আর তোমরা পরিকল্পনা করবে। কী লাভ আমাদের?”

সিনেমার শেষটাতে ছিল চেনা নাটকীয়তা। যেকোনো ভাষার সিনেমাতেই থ্রিলারগুলোতে বিভিন্ন চরিত্র উল্টে যেতে দেখা যায়। এখানেও তেমন হয়েছে। মনে হয়েছে শেষের দিকে আরেকটু রোমাঞ্চকর হলে ভালো লাগতো। তাই বলে পরিচালক যা করেছেন তা কম নয় মোটেই, তবে তা অনুমিত ছিল। তবে আশঙ্কা করছি বাংলার থ্রিলারগুলোও এখন একটি ছকের মধ্যে আটকে যায় কিনা।

‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি একটি গান ছিল বা তাকে স্মরণ করা হয়েছে, এখানেও তেমন স্মরণ করা হয়েছে। তবে এ সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত না থাকলেও বোঝা গিয়েছে ধ্রুব এবং শুভেন্দু রবি ঠাকুরের বড় দুজন ভক্ত।

‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’এ বিক্রম ঘোষের কণ্ঠ ও ডিরেকশনে হিস্ট্রি র‍্যাপ ভলিউম ২ নামে আরেকটি র‍্যাপ রাখা হয়েছে যা আগের মতোই পুরো সিনেমাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এহাড়াও ছয়টি গান রয়েছে যা ডিভোশোনাল, তবে তা বার্তা ও ধাঁধা হসেবেই ধরা দেয় সোনাদার কাছে। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর ও বাকি সাউন্ডট্রাকগুলো দারুণ; আসলে বিক্রম ঘোষ বলে কথা। গানগুলোর লিরিক্স লিখেছেন শুভেন্দু দাশমুন্সি।

আমি মনে করিনা আর কোনো চমকপ্রদ উপসংহার টানা উচিৎ এই দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন মুভি রিভিউয়ের জন্য। আপনি, যিনি এই মুহুর্তে রিভিউটি পড়ে শেষ করেছেন তিনি এ সিনেমাটি কেমন চোখে দেখবেন জানি না; আমার ভালো লেগেছে। আশা করি সোনাদা সিরিজের সামনের কিস্তিগুলোও ভালো হবে এবং সোনাদার জীবনে প্রেম আসবে।

চলচ্চিত্রদুর্গেশগড়ের গুপ্তধন
পরিচালনাধ্রুব বন্দোপাধ্যায়
অভিনয়আবীর চট্টোপাধ্যায়, ইশা সাহা, অর্জুন চক্রবর্তী, কমলেস্বর মুখার্জী, রজতাভ দত্ত ও আরও অনেকে
প্রযোজনাএসভিএফ
মুক্তিমে ২৪, ২০১৯
সংগীতবিক্রম ঘোষ
চিত্রধারণসৌমিক হালদার
সম্পাদনাসঞ্জীব কুমার দত্ত

‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ মুভি রিভিউ পড়ুন এখানে

অনলাইনে দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন দেখুন: অ্যামাজন হইচই প্ল্যাটফর্মে