০৩:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাঙালির চেতনার ইতিহাস

আবদুল মাতিন
  • প্রকাশ: ১১:৫৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
  • / ৪৫৯৬ বার পড়া হয়েছে

২১শে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে ঢাকায় নির্মিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’! একুশে ফেব্রুয়ারি ভোলার নয়, কিছুতেই ভোলা যায় না। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ এক অনন্য গৌরবময় অধ্যায়। আমরা বাঙালিরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি, বদলে পেয়েছি ‘মা’ বলে ডাকার অধিকার। পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে একমাত্র বাঙালি জাতির। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির চেতনার প্রতীক। একুশের শহিদদের স্থান বাঙালির হৃদয়ের মর্মমূলে। অমর একুশে তাই আত্মত্যাগের অহংকারে ভাস্বর একটি দিন; জেগে ওঠার প্রেরণা। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শুধু একবার নয়, বারবার আসে। প্রতিবছর তার উজ্জ্বল আলোক সম্পাতে আমরা স্নাত হই। প্রতিবারই একুশ আমাদের শক্তি ও সাহস জোগায়, দেশপ্রেম ও ভাষা চেতনাকে শাণিত করে। আমাদের সৃজন-মেধায় যোগ করে নতুন মাত্রা। এক কথায়- একুশ আমাদের অহংকার, গৌরব, জাতিসত্তা ও প্রেরণার স্থান।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেসব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর, জব্বাররা। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। শহিদ ভাইয়ের আত্মার ডাকে বাঙালির কোটি প্রাণ আজ ভাই হারানোর শোকে মুহ্যমান। একই সঙ্গে দ্রোহের আগুনেও বলীয়ান। সেদিন ফাল্গুনের সোনাঝরা রোদ্দুরে নিজ ভাষায় কথা বলার দাবিতে, মায়ের মুখের ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, প্রকাশ্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানরা। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতিবহ মহান শহিদ দিবস, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। জাতির শোকাবহ, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর দিন। এদিন আবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। তাই শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা, অস্তিত্ব রক্ষা, ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে এই ‘অমর একুশ’।

১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন আমাদের জীবনে দিগন্তবিস্তারী প্লাবন ডেকে এনেছিল। বাংলা ভাষাকে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও নির্মমতার আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য এক দেবদূত হিসেবে এসেছিল অমর একুশ। তাই ভাষার দাবি অর্থাৎ বাঁচার দাবি, ভাষার আন্দোলন অর্থাৎ বাঁচার আন্দোলন। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি। একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার লড়াই নয়, তা আমাদের জাতীয় চেতনার উর্বর উৎসব। বাঙালি জাতির জীবনে তাই ভাষা আন্দোলন দুর্জয় সংগ্রামী চেতনার প্রসূতি। অমর একুশ বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে রাখার শক্তি-সাহস আর প্রেরণা জোগায়। তাই একুশ মানে নিজেকে চেনা। একুশের চেতনার মূল জায়গায় শুধু ভাষার দাবি ছিল না। এ দাবি ছিল গণতান্ত্রিক দাবি।

মাতৃভাষা মানুষের একান্ত আপন ও কাছের। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার সেরা উপহার। মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া ও মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোনো ভাষা ভালোভাবে শেখা যায় না। মানুষ যদি তার মাতৃভাষাকে যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন না করতে পারে তবে তাকে চিরদিন আত্মগ্লানিতে ডুবে থাকতে হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। যারা মাতৃভাষার মর্যাদা দেয় না তারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করে না। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষামাত্রই সামাজিক। সমাজ পিছনে পড়ে থাকলে ভাষা এগোতে পারে না। তাই সমাজের দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিরক্ষরতা দূর করে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে হবে।

আমরা বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করেছি কিন্তু কোথাও যেন মনে হয় সেভাবে আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। দুঃখের বিষয় হলো— ভাষার কারণে এত প্রাণের বিসর্জনের পরেও মাতৃভাষা বাংলা যেন অনেকটা উপেক্ষিত! ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা আর ভাষাকে সমৃদ্ধ করা এক নয়। তা বলে ইংরেজি চর্চা বর্জন করতে হবে তা কিন্তু নয়, বরং ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রেও ইংরেজি জানা যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলা জানা। বলাবাহুল্য নিজ অস্তিত্ব নিজ অবস্থান ছাড়া কখনোই আমরা পৃথিবীর বুকে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না, তা আমরা যতই স্মার্ট হই না কেন, মা’কে পরিত্যাগ করে মাসিমনির কাছে বড় হওয়া ছেলে যেমন সমাজের চোখে পালক-পুত্র হয়ে থাকে, তেমনি করে নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করে অন্যের ভাষায় পারদর্শী হওয়াটা একই ব্যাপার। তাই বলি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা যেন একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক না হয়। সুতরাং মাতৃভাষা মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নিতে হবে।

একুশ আবার অসাম্প্রদায়িকতারও প্রতীক। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম একুশ। তাই তো মুসলিম প্রধান হয়েও সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন মেনে নেননি। মায়ের ভাষার ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। অত্যাচারীর গোলাবারুদও তাদের থামাতে পারেনি। ছিনিয়ে এনেছিলেন মায়ের ভাষার সম্মান-মর্যাদা। বন্দুকের নলও মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল সালাম-জব্বারদের সামনে।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিল নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা ও সমুন্নত রাখা। সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ মানে নিজের অস্তিত্বের ওপর আক্রমণ। আর যখন নিজের সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হয় তখন কী করণীয় তা বাঙালির বীর সন্তান রফিক জব্বাররা শিখিয়ে গেছেন। তাঁরা দেখিয়ে গেছেন সংস্কৃতি রক্ষার্থে কোনো রকম আপস নয়, নয় কাপুরুষের মতো নতি স্বীকার করা। অমর একুশ তাই আত্মত্যাগের অহংকারে ভাস্বর মহান একটি দিন, আত্মপ্রত্যয়ের দিন, আত্মপরিচয় দেওয়া ও নেওয়ার দিন, জেগে ওঠার প্রেরণা। দেশমাতৃকারও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের মহান দিন এটি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আবদুল মাতিন

লেখক ভারতের আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাঙালির চেতনার ইতিহাস

প্রকাশ: ১১:৫৯:৫৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’! একুশে ফেব্রুয়ারি ভোলার নয়, কিছুতেই ভোলা যায় না। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ এক অনন্য গৌরবময় অধ্যায়। আমরা বাঙালিরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি, বদলে পেয়েছি ‘মা’ বলে ডাকার অধিকার। পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে, অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার ইতিহাস রয়েছে একমাত্র বাঙালি জাতির। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির চেতনার প্রতীক। একুশের শহিদদের স্থান বাঙালির হৃদয়ের মর্মমূলে। অমর একুশে তাই আত্মত্যাগের অহংকারে ভাস্বর একটি দিন; জেগে ওঠার প্রেরণা। দেশমাতৃকার প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে শুধু একবার নয়, বারবার আসে। প্রতিবছর তার উজ্জ্বল আলোক সম্পাতে আমরা স্নাত হই। প্রতিবারই একুশ আমাদের শক্তি ও সাহস জোগায়, দেশপ্রেম ও ভাষা চেতনাকে শাণিত করে। আমাদের সৃজন-মেধায় যোগ করে নতুন মাত্রা। এক কথায়- একুশ আমাদের অহংকার, গৌরব, জাতিসত্তা ও প্রেরণার স্থান।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেসব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর, জব্বাররা। তাদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, আমাদের মায়ের ভাষা বাংলা। শহিদ ভাইয়ের আত্মার ডাকে বাঙালির কোটি প্রাণ আজ ভাই হারানোর শোকে মুহ্যমান। একই সঙ্গে দ্রোহের আগুনেও বলীয়ান। সেদিন ফাল্গুনের সোনাঝরা রোদ্দুরে নিজ ভাষায় কথা বলার দাবিতে, মায়ের মুখের ভাষার সম্মান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, প্রকাশ্য রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন বাংলার বীর সন্তানরা। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতিবহ মহান শহিদ দিবস, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। জাতির শোকাবহ, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর দিন। এদিন আবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। তাই শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের প্রতিটি জাতির মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধিকার, স্বাধীনতা, অস্তিত্ব রক্ষা, ও মানুষের মতো বাঁচার দাবির সংগ্রামের দুর্জয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টির চির অনির্বাণ শিখার দীপ্তিতে দিগন্ত উদ্ভাসিত করেছে এই ‘অমর একুশ’।

১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন আমাদের জীবনে দিগন্তবিস্তারী প্লাবন ডেকে এনেছিল। বাংলা ভাষাকে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও নির্মমতার আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য এক দেবদূত হিসেবে এসেছিল অমর একুশ। তাই ভাষার দাবি অর্থাৎ বাঁচার দাবি, ভাষার আন্দোলন অর্থাৎ বাঁচার আন্দোলন। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের চেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি। একুশে ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার লড়াই নয়, তা আমাদের জাতীয় চেতনার উর্বর উৎসব। বাঙালি জাতির জীবনে তাই ভাষা আন্দোলন দুর্জয় সংগ্রামী চেতনার প্রসূতি। অমর একুশ বাঙালি জাতিকে মাথা উঁচু করে রাখার শক্তি-সাহস আর প্রেরণা জোগায়। তাই একুশ মানে নিজেকে চেনা। একুশের চেতনার মূল জায়গায় শুধু ভাষার দাবি ছিল না। এ দাবি ছিল গণতান্ত্রিক দাবি।

মাতৃভাষা মানুষের একান্ত আপন ও কাছের। মাতৃভাষা সৃষ্টিকর্তার সেরা উপহার। মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া ও মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কোনো ভাষা ভালোভাবে শেখা যায় না। মানুষ যদি তার মাতৃভাষাকে যথাযথ সম্মান ও মূল্যায়ন না করতে পারে তবে তাকে চিরদিন আত্মগ্লানিতে ডুবে থাকতে হয়। মাতৃভাষার মর্যাদা জাতির আত্মমর্যাদার প্রতীক। যারা মাতৃভাষার মর্যাদা দেয় না তারা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে বিশ্বাস করে না। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষামাত্রই সামাজিক। সমাজ পিছনে পড়ে থাকলে ভাষা এগোতে পারে না। তাই সমাজের দারিদ্র্য, বৈষম্য, নিরক্ষরতা দূর করে মাতৃভাষা বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটাতে হবে।

আমরা বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করেছি কিন্তু কোথাও যেন মনে হয় সেভাবে আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারিনি। দুঃখের বিষয় হলো— ভাষার কারণে এত প্রাণের বিসর্জনের পরেও মাতৃভাষা বাংলা যেন অনেকটা উপেক্ষিত! ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা আর ভাষাকে সমৃদ্ধ করা এক নয়। তা বলে ইংরেজি চর্চা বর্জন করতে হবে তা কিন্তু নয়, বরং ইংরেজি শেখার ক্ষেত্রেও ইংরেজি জানা যতটা না প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বাংলা জানা। বলাবাহুল্য নিজ অস্তিত্ব নিজ অবস্থান ছাড়া কখনোই আমরা পৃথিবীর বুকে শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না, তা আমরা যতই স্মার্ট হই না কেন, মা’কে পরিত্যাগ করে মাসিমনির কাছে বড় হওয়া ছেলে যেমন সমাজের চোখে পালক-পুত্র হয়ে থাকে, তেমনি করে নিজ ভাষাকে অবজ্ঞা করে অন্যের ভাষায় পারদর্শী হওয়াটা একই ব্যাপার। তাই বলি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও মর্যাদা যেন একুশে ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রিক কিংবা ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক না হয়। সুতরাং মাতৃভাষা মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ নিতে হবে।

একুশ আবার অসাম্প্রদায়িকতারও প্রতীক। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নাম একুশ। তাই তো মুসলিম প্রধান হয়েও সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন মেনে নেননি। মায়ের ভাষার ওপর আক্রমণের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। অত্যাচারীর গোলাবারুদও তাদের থামাতে পারেনি। ছিনিয়ে এনেছিলেন মায়ের ভাষার সম্মান-মর্যাদা। বন্দুকের নলও মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল সালাম-জব্বারদের সামনে।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্যই ছিল নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা ও সমুন্নত রাখা। সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ মানে নিজের অস্তিত্বের ওপর আক্রমণ। আর যখন নিজের সংস্কৃতি ও অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হয় তখন কী করণীয় তা বাঙালির বীর সন্তান রফিক জব্বাররা শিখিয়ে গেছেন। তাঁরা দেখিয়ে গেছেন সংস্কৃতি রক্ষার্থে কোনো রকম আপস নয়, নয় কাপুরুষের মতো নতি স্বীকার করা। অমর একুশ তাই আত্মত্যাগের অহংকারে ভাস্বর মহান একটি দিন, আত্মপ্রত্যয়ের দিন, আত্মপরিচয় দেওয়া ও নেওয়ার দিন, জেগে ওঠার প্রেরণা। দেশমাতৃকারও অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে আত্মোৎসর্গ করার শপথ গ্রহণের মহান দিন এটি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের শিখিয়েছে আত্মত্যাগের মন্ত্র, বাঙালিকে করেছে মহীয়ান।