০১:৩৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার প্রভাব

আশিকুল আলম বিশ্বাস
  • প্রকাশ: ১২:০৩:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ মার্চ ২০২২
  • / ২৭১৫ বার পড়া হয়েছে

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব কী হতে পারে?


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বুধবার ২৩ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন, দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আলোচনায় সমস্যার সমাধান খুঁজতে রাজী তিনি। কিন্তু তিনি নিজেই সেই বক্তব্য রক্ষা করলেন না! বৃহস্পতিবার সকালে সরাসরি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল রাশিয়া। রাষ্ট্রসংঘকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই নিজের জায়গাতে অনড় রইল রাশিয়া। ভারতীয় সময় সকাল ৮টা থেকেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে পরপর মিসাইল-বোমা নিক্ষেপ শুরু করেছে রাশিয়া।

ইতোমধ্যেই রাশিয়া কিয়েভ বিমানবন্দরের দখল নিয়েছে। কিয়েভের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রায় ২০০টি হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে এবং ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনীর ২০০-র বেশি সৈন্য হত্যা করার পর সেই দেশের সেনাঘাঁটি দখলে নিয়েছে বলে দাবি করেছে মস্কো। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে বিবাদের প্রকৃত কারণ হল, ইউক্রেনের নেটো-তে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ। আমেরিকাও চায়- ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হোক। কিন্তু ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হোক- এটা রাশিয়া কোনওভাবেই চায় না। ইউক্রেন জানে যে, তারা নিজেদের শক্তিতে রাশিয়ার সঙ্গে লড়তে পারবে না। কারণ, ইউক্রেনের কাছে না আছে রাশিয়ার মতো সেনা, অত্যাধুনিক হাতিয়ার বা অর্থবল। ইউক্রেনের ভয়, তারা যদি নিজেদের শক্তি না বাড়ায় তাহলে রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের মতো ফের তাদের এলাকা দখল করবে।

রাশিয়ার চিন্তা হলো, যদি ইউক্রেন নেটোর সদস্য হয়, তাহলে রাশিয়াকে এই ন্যাটো কিন্তু চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে। ফলে আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশের রাশিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়ে যাবে। ইউক্রেন সামনে থাকলেও এই দ্বন্দµ মূলত আমেরিকা ও রাশিয়ার। এই দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক ভাল। সামরিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর ভারত অনেকটাই নির্ভরশীল। এখনও প্রায় ৫৫ শতাংশ হাতিয়ার রাশিয়ার থেকে কেনে ভারত।

আবার গত ১০ বছরে আমেরিকার সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। ইউক্রেনের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ভাল। অর্থাৎ ভারত এই তিন দেশের মধ্যে কারও সঙ্গেই নিজের সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না। ইউক্রেনে সংকট বাড়লে, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, তার উপর প্রভাব পড়তে পারে। ট্রেডিং ইকোনমিক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ইউক্রেন ও ভারতের মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার। দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৭২০.২১ মিলিয়ন ডলার আমদানিও হয়েছে। একই সময়ে, ভারত রাশিয়া থেকে ৫.৯৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানানো হয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “সৎ ও আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমেই রাশিয়া ও নেটোর মতপার্থক্য দূর করা সম্ভব।” প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আরও জানানো হয়েছে, এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ভারত ও রাশিয়ার সরকারি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের মতোই থাকবে। দুই দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একসঙ্গেই কাজ করবে।

আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইউক্রেন থেকে শনিবার ২১৯ জন ডাক্তারি পড়ুয়া এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে মুম্বই বিমানবন্দরে নেমেছেন। বুখারেস্ট থেকে দিল্লির পথে আরও একটি বিমানে ২৫০ জন ভারতীয় ডাক্তারি পড়ুয়া আসছেন। রাজ্য সরকারও চেষ্টা করছেন ইউক্রেনে আটকে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ১৯৯ জন ডাক্তারি পড়ুয়াকে ফিরিয়ে আনতে। এখন মিসাইল হানায় কেঁপে উঠছে রাজধানী শহর। চলছে গুলির লড়াই। ক্রমেই সাধারণ মানুষ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে পালাচ্ছেন অন্যত্র। অনেকেই আবার আটকে পড়েছেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে মানুষেরা প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে চলে যাবার চেষ্টা করলে ওই দেশগুলোতে বর্ণবিদ্বেষমূলক আচরণ করা হচ্ছে বলে সূত্রের খবর। সাদা চামড়ার মানুষদের কোনো প্রশ্ন না করে সরাসরি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের সাদা চামড়ার মানুষেরা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাগরিক। কিন্তু আফ্রিকা ও ভারতের কালো চামড়ার মানুষদের ঐসব দেশে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং বর্ডার থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এই আবহে ইউক্রেনবাসীকে উদ্ধার করার প্রস্তাব দিয়েছিল আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাহায্য ফিরিয়ে দিলেও গোলাবারুদ পাঠাতে আমেরিকাকে অনুরোধ করেছে ইউক্রেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সাফ জানিয়েছেন, “তিনি ময়দান ছেড়ে পালানোর মানুষ নন। বরং দেশ এবং দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক আছে। সেই কারণে যুদ্ধ থামাতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে ভারত।” এটা মনে করছে ইউক্রেন।

রাশিয়ার ডেপুটি চিফ অব মিশন রোমান বাবুস্কিন বলেন, “বিশ্বের শক্তিধর ও দায়িত্ববান দেশ হিসেবে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারত স্বাধীন ও ভারসাম্যযুক্ত অবস্থান নিয়েছে।” বৃহস্পতিবারই এই প্রসঙ্গে একটি বিবৃতি দিয়েছেন ক্রেডাই-এর সভাপতি হর্ষবর্ধন পাটোদিয়া। তিনি বলেছেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ফলে তেলের দাম বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী বিপর্যস্ত হয়েছে স্টক মার্কেট। সংকটের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহের মাধ্যমে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যা চিন্তা বাড়িয়েছে বিশ্বের। গত কয়েক মাস ধরেই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়েই চলেছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাপ্লাই চেইনের ওপর। এটি ভারতীয় সিমেন্ট নির্মাতাদের ওপর আরও প্রভাব ফেলবে। কারণ, তারা ইতিমধ্যেই কাঁচামাল ও পাওয়ারের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের চাপের মধ্যে ভুগছে।’ 

ক্রেডাই-এর মতে, বর্তমানে সিমেন্ট নির্মাতাদের এই যুদ্ধের বোঝা বহন করতে হবে। কারণ, তাদের ব্যবসার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপরিশোধিত তেলের দামের সাথে যুক্ত। যার প্রভাব রিয়েল এস্টেট শিল্পেও নেমে আসতে বাধ্য। নির্মাণের কাঁচামালের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে ডেভেলপাররা প্রকল্পের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সেক্টরের সূচক বলছে, আগামী ত্রৈমাসিকে এই যুদ্ধের ফলে দামের প্রভাব সিমেন্ট তথা রিয়েল এস্টেট খাতে পড়তে পারে। একইভাবে রাশিয়া অফুরন্ত তেলের ভাণ্ডার। সেই ক্ষেত্রে যুদ্ধের কারণে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়বে রং শিল্পে। রাতারাতি বৃদ্ধি পাবে রঙের দাম। অন্তত তেমনই মত বাজার বিশেষজ্ঞদের। সেই কারণে শেয়ার বাজারেও রঙের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলির স্টক বেশি তলানিতে নামতে পারে।

সবথেকে বড় বিষয়, আগামী ত্রৈমাসিকে কোম্পানির আর্থিক রিপোর্টে বড় ধাক্কা দেবে রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতি। যার ফলে রঙের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে কোম্পানিগুলি। কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় এই পথে হাঁটতে হবে রং কোম্পানিগুলিকে। রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যার মধ্যেই মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা। ইউক্রেনের সেনাকে অস্ত্র ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাতে আরও বেড়েছে জটিলতা। এদিকে, এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই অনেক দেশ সরাসরি রাশিয়ার সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, আরও অনেক দেশকেই সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখা গিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়। 

বর্তমান পরিস্থিতি যা তাতে সহজেই বলা যায়, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রায় ৮০ বছর পর ফের দু’ভাগে বিভক্ত বিশ্ব। একদিকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। অন্যদিকে রাশিয়াকে সমর্থন করছে চিন। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্যে দিয়ে চিনও যুদ্ধের দামামা বাজাতে মরিয়া। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট চাইছেন পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরিয়ে আনতে। মওকা বুঝে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও চাইছেন মূল চিনা ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেশগুলোকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে। সূত্রের দাবি, যেকোনো মুহূর্তে তাইওয়ানে হামলা চালাতে পারে চিন। লক্ষ্য একটাই, তাইওয়ান দখল করা।

রাশিয়া ও চীন এই দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রের আগ্রাসন নীতি কার্যকর করার পথে প্রধান বাধা আমেরিকা। কোভিডে বিধ্বস্ত অর্থনীতি আমেরিকাকে বাধ্য করেছে কিছুটা চুপচাপ থাকতে। এই ফাঁকেই রাশিয়া ও চিন তাদের আগ্রাসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিকে অনেকেই ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’র প্রাক মুহূর্ত বলেই তুলে ধরছেন। কিন্তু এই সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে ভারত কী ভাবছে? 

সহজভাবে দেখতে গেলে, ইউক্রেন-রাশিয়া সঙ্কটকে রীতিমতো গুরুত্ব সহকারেই দেখছে ভারত। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তবে এখনও পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন জটিলতা নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার কথাই বলেছে নয়াদিল্লি।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

আশিকুল আলম বিশ্বাস

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তার প্রভাব

প্রকাশ: ১২:০৩:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ মার্চ ২০২২

বুধবার ২৩ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন, দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখে আলোচনায় সমস্যার সমাধান খুঁজতে রাজী তিনি। কিন্তু তিনি নিজেই সেই বক্তব্য রক্ষা করলেন না! বৃহস্পতিবার সকালে সরাসরি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল রাশিয়া। রাষ্ট্রসংঘকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই নিজের জায়গাতে অনড় রইল রাশিয়া। ভারতীয় সময় সকাল ৮টা থেকেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে পরপর মিসাইল-বোমা নিক্ষেপ শুরু করেছে রাশিয়া।

ইতোমধ্যেই রাশিয়া কিয়েভ বিমানবন্দরের দখল নিয়েছে। কিয়েভের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রায় ২০০টি হেলিকপ্টার ব্যবহার করেছে এবং ইউক্রেনের বিশেষ বাহিনীর ২০০-র বেশি সৈন্য হত্যা করার পর সেই দেশের সেনাঘাঁটি দখলে নিয়েছে বলে দাবি করেছে মস্কো। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে বিবাদের প্রকৃত কারণ হল, ইউক্রেনের নেটো-তে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ। আমেরিকাও চায়- ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হোক। কিন্তু ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হোক- এটা রাশিয়া কোনওভাবেই চায় না। ইউক্রেন জানে যে, তারা নিজেদের শক্তিতে রাশিয়ার সঙ্গে লড়তে পারবে না। কারণ, ইউক্রেনের কাছে না আছে রাশিয়ার মতো সেনা, অত্যাধুনিক হাতিয়ার বা অর্থবল। ইউক্রেনের ভয়, তারা যদি নিজেদের শক্তি না বাড়ায় তাহলে রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের মতো ফের তাদের এলাকা দখল করবে।

রাশিয়ার চিন্তা হলো, যদি ইউক্রেন নেটোর সদস্য হয়, তাহলে রাশিয়াকে এই ন্যাটো কিন্তু চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে। ফলে আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশের রাশিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়ে যাবে। ইউক্রেন সামনে থাকলেও এই দ্বন্দµ মূলত আমেরিকা ও রাশিয়ার। এই দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক ভাল। সামরিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর ভারত অনেকটাই নির্ভরশীল। এখনও প্রায় ৫৫ শতাংশ হাতিয়ার রাশিয়ার থেকে কেনে ভারত।

আবার গত ১০ বছরে আমেরিকার সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। ইউক্রেনের সঙ্গেও ভারতের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ভাল। অর্থাৎ ভারত এই তিন দেশের মধ্যে কারও সঙ্গেই নিজের সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না। ইউক্রেনে সংকট বাড়লে, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, তার উপর প্রভাব পড়তে পারে। ট্রেডিং ইকোনমিক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ইউক্রেন ও ভারতের মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার। দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৭২০.২১ মিলিয়ন ডলার আমদানিও হয়েছে। একই সময়ে, ভারত রাশিয়া থেকে ৫.৯৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানানো হয়েছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “সৎ ও আন্তরিক আলোচনার মাধ্যমেই রাশিয়া ও নেটোর মতপার্থক্য দূর করা সম্ভব।” প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আরও জানানো হয়েছে, এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ভারত ও রাশিয়ার সরকারি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের মতোই থাকবে। দুই দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে একসঙ্গেই কাজ করবে।

আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিয়ে ইউক্রেন থেকে শনিবার ২১৯ জন ডাক্তারি পড়ুয়া এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে মুম্বই বিমানবন্দরে নেমেছেন। বুখারেস্ট থেকে দিল্লির পথে আরও একটি বিমানে ২৫০ জন ভারতীয় ডাক্তারি পড়ুয়া আসছেন। রাজ্য সরকারও চেষ্টা করছেন ইউক্রেনে আটকে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ১৯৯ জন ডাক্তারি পড়ুয়াকে ফিরিয়ে আনতে। এখন মিসাইল হানায় কেঁপে উঠছে রাজধানী শহর। চলছে গুলির লড়াই। ক্রমেই সাধারণ মানুষ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে পালাচ্ছেন অন্যত্র। অনেকেই আবার আটকে পড়েছেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে মানুষেরা প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরিতে চলে যাবার চেষ্টা করলে ওই দেশগুলোতে বর্ণবিদ্বেষমূলক আচরণ করা হচ্ছে বলে সূত্রের খবর। সাদা চামড়ার মানুষদের কোনো প্রশ্ন না করে সরাসরি ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের সাদা চামড়ার মানুষেরা তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাগরিক। কিন্তু আফ্রিকা ও ভারতের কালো চামড়ার মানুষদের ঐসব দেশে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং বর্ডার থেকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এই আবহে ইউক্রেনবাসীকে উদ্ধার করার প্রস্তাব দিয়েছিল আমেরিকা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সাহায্য ফিরিয়ে দিলেও গোলাবারুদ পাঠাতে আমেরিকাকে অনুরোধ করেছে ইউক্রেন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সাফ জানিয়েছেন, “তিনি ময়দান ছেড়ে পালানোর মানুষ নন। বরং দেশ এবং দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বিশেষ সম্পর্ক আছে। সেই কারণে যুদ্ধ থামাতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে ভারত।” এটা মনে করছে ইউক্রেন।

রাশিয়ার ডেপুটি চিফ অব মিশন রোমান বাবুস্কিন বলেন, “বিশ্বের শক্তিধর ও দায়িত্ববান দেশ হিসেবে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারত স্বাধীন ও ভারসাম্যযুক্ত অবস্থান নিয়েছে।” বৃহস্পতিবারই এই প্রসঙ্গে একটি বিবৃতি দিয়েছেন ক্রেডাই-এর সভাপতি হর্ষবর্ধন পাটোদিয়া। তিনি বলেছেন, ‘ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ফলে তেলের দাম বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী বিপর্যস্ত হয়েছে স্টক মার্কেট। সংকটের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহের মাধ্যমে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যা চিন্তা বাড়িয়েছে বিশ্বের। গত কয়েক মাস ধরেই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়েই চলেছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাপ্লাই চেইনের ওপর। এটি ভারতীয় সিমেন্ট নির্মাতাদের ওপর আরও প্রভাব ফেলবে। কারণ, তারা ইতিমধ্যেই কাঁচামাল ও পাওয়ারের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের চাপের মধ্যে ভুগছে।’ 

ক্রেডাই-এর মতে, বর্তমানে সিমেন্ট নির্মাতাদের এই যুদ্ধের বোঝা বহন করতে হবে। কারণ, তাদের ব্যবসার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপরিশোধিত তেলের দামের সাথে যুক্ত। যার প্রভাব রিয়েল এস্টেট শিল্পেও নেমে আসতে বাধ্য। নির্মাণের কাঁচামালের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির কারণে ডেভেলপাররা প্রকল্পের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সেক্টরের সূচক বলছে, আগামী ত্রৈমাসিকে এই যুদ্ধের ফলে দামের প্রভাব সিমেন্ট তথা রিয়েল এস্টেট খাতে পড়তে পারে। একইভাবে রাশিয়া অফুরন্ত তেলের ভাণ্ডার। সেই ক্ষেত্রে যুদ্ধের কারণে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়বে রং শিল্পে। রাতারাতি বৃদ্ধি পাবে রঙের দাম। অন্তত তেমনই মত বাজার বিশেষজ্ঞদের। সেই কারণে শেয়ার বাজারেও রঙের সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলির স্টক বেশি তলানিতে নামতে পারে।

সবথেকে বড় বিষয়, আগামী ত্রৈমাসিকে কোম্পানির আর্থিক রিপোর্টে বড় ধাক্কা দেবে রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতি। যার ফলে রঙের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে কোম্পানিগুলি। কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় এই পথে হাঁটতে হবে রং কোম্পানিগুলিকে। রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যার মধ্যেই মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা। ইউক্রেনের সেনাকে অস্ত্র ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাতে আরও বেড়েছে জটিলতা। এদিকে, এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইতিমধ্যেই অনেক দেশ সরাসরি রাশিয়ার সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, আরও অনেক দেশকেই সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করতে দেখা গিয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেস্ক এবং লুহানস্ককে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত হয়। 

বর্তমান পরিস্থিতি যা তাতে সহজেই বলা যায়, ঠান্ডা যুদ্ধের প্রায় ৮০ বছর পর ফের দু’ভাগে বিভক্ত বিশ্ব। একদিকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। অন্যদিকে রাশিয়াকে সমর্থন করছে চিন। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মধ্যে দিয়ে চিনও যুদ্ধের দামামা বাজাতে মরিয়া। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট চাইছেন পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরিয়ে আনতে। মওকা বুঝে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও চাইছেন মূল চিনা ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেশগুলোকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে। সূত্রের দাবি, যেকোনো মুহূর্তে তাইওয়ানে হামলা চালাতে পারে চিন। লক্ষ্য একটাই, তাইওয়ান দখল করা।

রাশিয়া ও চীন এই দুই শক্তিশালী রাষ্ট্রের আগ্রাসন নীতি কার্যকর করার পথে প্রধান বাধা আমেরিকা। কোভিডে বিধ্বস্ত অর্থনীতি আমেরিকাকে বাধ্য করেছে কিছুটা চুপচাপ থাকতে। এই ফাঁকেই রাশিয়া ও চিন তাদের আগ্রাসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতিকে অনেকেই ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’র প্রাক মুহূর্ত বলেই তুলে ধরছেন। কিন্তু এই সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে ভারত কী ভাবছে? 

সহজভাবে দেখতে গেলে, ইউক্রেন-রাশিয়া সঙ্কটকে রীতিমতো গুরুত্ব সহকারেই দেখছে ভারত। এমনকী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তবে এখনও পর্যন্ত রাশিয়া-ইউক্রেন জটিলতা নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার কথাই বলেছে নয়াদিল্লি।