মগধের রাজা অজাতশত্রু
- প্রকাশ: ০৬:৫৭:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ মার্চ ২০২২
- / ১৭৪০ বার পড়া হয়েছে
অজাতশত্রু বা অজাতসত্তু ছিলেন হর্য্যঙ্ক রাজবংশের রাজা ছিলেন, তাঁর অপর নাম কূনিত। অজাতশত্রু ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মগধ শাসন করেন, তাঁর শাসনকালে হর্য্যঙ্ক রাজবংশের শাসন সর্বাধিক বিস্তৃত হয়।
পিতার মৃত্যু ও সিংহাসনারোহ
অজাতশত্রু ছিলেন হর্য্যঙ্ক রাজবংশের রাজা বিম্বিসার ও কোশল রাজকন্যা চেলেনার পুত্র ছিলেন। ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ বৌদ্ধ ভিক্ষু দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক বিম্বিসারকে হত্যার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী বিম্বিসার এই ঘটনায় তাঁর পুত্রকে ক্ষমা করে দেন।
কিন্তু পুনরায় দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু বিম্বিসার ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৃহবন্দী অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে।
কথিত আছে অজাতশত্রু তাঁর পিতা বিম্বিসারকে কারাগারে প্রেরণ করেন। পরে তিনি পিতার হাত-পা কেটে তাতে নুন এবং অম্ল মাখিয়ে কষ্ট দেন। এরপর তাঁকে কয়লার আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। এই শোকে তাঁর মা কোশলদেবী মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
এই সময় দেবদত্তের প্ররোচনায় গৌতম বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেন অজাতশত্রু। পিতার মৃত্যুর পর অনুশোচনায় দগ্ধ অজাতশত্রু শান্তিলাভের আশায় বিভিন্ন ধর্ম উপদেষ্টা ও দার্শনিকের শরণাপন্ন হন। কিন্তু তাঁদের উপদেশে শান্তিলাভে ব্যর্থ হয়ে রাজবৈদ্য জীবকের উপদেশে গৌতম বুদ্ধের শরণাপন্ন হলে বুদ্ধ তাঁকে সামঞ্ঞফলসুত্ত ব্যাখ্যা করেন।
ইতিহাসে অজাতশত্রু পিতার হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত।
কোশলের সঙ্গে যুদ্ধ
বিম্বিসারের বন্দীত্ব ও মৃত্যুর ঘটনায় ক্রুদ্ধ কোশল রাজ প্রসেনজিৎ একদা উপহার হিসেবে প্রদত্ত কাশী রাজ্য পুনরায় নিজের অধীনে নিয়ে নিলে অজাতশত্রু কোশল রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রথম যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হলেও পরের যুদ্ধে পরাজিত হন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী প্রসেনজিৎ তাঁকে মুক্ত করে তাঁর কন্যা বজিরাকে তাঁর সাথে বিবাহ দিয়ে যৌতুক হিসেবে কাশী রাজ্য ফিরিয়ে দেন।
বৃজি অধিকার
বুদ্ধঘোষের বর্ণনা অনুযায়ী, গঙ্গা নদীর তীরবর্তী একটি বন্দর এলাকার অর্ধেক অংশ অজাতশত্রুর অধিকারে এবং অর্ধেক অংশ বৃজি মহজনপদের অধিকারে ছিল। এই বন্দরের নিকটবর্তী একটি পাহাড়ে প্রাপ্ত গন্ধভাণ্ড নামক এক ধরনের সুগন্ধী দ্রব্যের অধিকার নিয়ে মগধ ও বৃজি মহজনপদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়।
বেশ কয়েক বার অজাতশত্রুর পূর্বেই লিচ্ছবিরা সম্পূর্ণ গন্ধভাণ্ড অধিকার করে নিজের দেশে চলে গেলে অজাতশত্রু প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করেন। দীঘনিকায়ের মহাপরিনিব্বানসুত্ত অনুসারে, তিনি তাঁর মন্ত্রী বস্সকারকে গৌতম বুদ্ধের নিকট প্রেরণ করে লিচ্ছবিদের পরাজিত করার উপায়ের সন্ধান করতে বলেন।
গৌতম বুদ্ধ মত দেন যে, যতদিন লিচ্ছবিরা যতদিন সম্মিলিত ভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করে একত্রিত ভাবে মতগ্রহণ করবেন, নিজের দেশের আইন ও জৈষ্ঠ্যদের উপদেশ মেনে চলবেন, নারীদের বিরুদ্ধে কোন হিংসামূলক অপরাধে জড়িত থাকবেন না, ধর্মস্থান ও অর্হতদের সম্মান করবেন, ততদিন কোন বৈদেশিক শক্তি তাঁদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এই উপদেশের ফলে অজাতশত্রু এরপর সামরিক শক্তির বদলে লিচ্ছবিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে সফল হন এবং মগধের সেনা বৃজি মহজনপদ অধিকার করতে সক্ষম হয়।
অজাতশত্রু কোন ধর্মে বিশ্বাস করতেন?
অবদান-শতক’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর পিতা বিম্বিসার ছিলেন গৌতম বুদ্ধের ভক্ত। তিনি তাঁর অন্তঃপুরে বুদ্ধের পায়ের নখ ও চুলের উপর একটি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। অজাতশত্রু বিম্বিসার মৃত্যুর পর এই স্তূপে পূজা বন্ধ করে দেন। এক দাসী গোপনে পূজা দিতে গেলে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর তিনি প্রজাদের গৌতম বুদ্ধের কাছে যাওয়া নিষেধ করে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পিতাকে হত্যা করার জন্য দারুন মনোকষ্টে ভুগতেন। এই পরিতাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি বুদ্ধের সাথে দেখা করেন। ত্রিপিটকের সূত্রপিটকের দীর্ঘনিকায় অংশের ‘সামঞ্ঞ ফল সূত্রে’ দেখা যায়, তিনি গৌতম বুদ্ধের সাথে দেখা করে দীর্ঘ আলাপ করেছেন। পরিশেষে তিনি বুদ্ধের কাছে পিতৃহত্যার কথা স্বীকার করে তার প্রতিকার প্রার্থনা করেছেন।
গৌতম বুদ্ধ নির্বাণলাভের পর, অল্প দিনের ভিতরে মতাদর্শগত বিভেদ প্রকট হয়ে উঠে। তা ছাড়া এই সময়ের ভিতরে বুদ্ধের যোগ্য শিষ্যদের অনেকে মৃত্যুবরণও করেন। বুদ্ধের বাণী এবং তার ব্যাখ্যা বিলীন হওয়া বা বিকৃত হওয়ার আশংকা তীব্রতর হয়ে উঠে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য, ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মগধের মহারাজ অজাতশত্রুর সহায়তায় মহাকাশ্যপ এক বৌদ্ধসভার আয়োজন করেন। কথিত আছে রাজগৃহের সপ্তপর্ণী নামক গুহায় এই সভায় যোগদান করেছিলেন। এই সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে বুদ্ধের অন্যতম শিষ্য আনন্দের নেতৃত্বে সংগৃহীত হয়েছিল ধর্মাংশ এবং আর বুদ্ধের অপর শিষ্য উপালি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিনায়ংশ। পরে এই দুই সংগ্রহকে বিষায়ানুসারে ভাগ করে, তৈরি করা হয়েছিল বিনয়পিটক ও সূত্রপিটক। পরে সূত্রপিটকের একটি অংশ পৃথক করে অভিধম্মপিটক নামক তৃতীয় পিটক তৈরি করা হয়। এই তিনটি পিটকের সংকলনই হলো ত্রিপিটক।
একই সাথে তিনি জৈন ধর্মকে বিশ্বাস করতেন। তিনি বহুবার সপরিবারে জৈনগুরু মহাবীরের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন।
উৎস: অনুশীলন, উইকিপিডিয়া