০৩:৫০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

স্বামী বিবেকানন্দ এবং তাঁর শিক্ষাভাবনা বা শিক্ষাদর্শন

নির্মল চন্দ্র শর্মা
  • প্রকাশ: ১০:৩১:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ ২০২২
  • / ২৭৯০৫ বার পড়া হয়েছে

স্বামী বিবেকানন্দ


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ভূমিকা

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যে কয়েকজন মহান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) তাঁদের অন্যতম। পরাধীন ভারতবাসীকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা-সামাজিক সংস্কার-ধর্মবোধ বা আধ্যাত্মিকতার দীপ্তিময় গৌরবোজ্জ্বল জীবনের পথ প্রদর্শনে যে কয়জন মনীষী আজও ভারতবর্ষে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন- তাঁদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান এক বাক্যে স্বীকার্য।  এ কথা সর্বজন বিদিত যে, স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, একজন বেদান্তপন্থী মুক্তিসাধক। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, সংসারকে একদিকে ত্যাগ করে অন্যদিকে তিনি গ্রহণ করেছেন। সংসারকে মায়া বা অলীক বলে অবহেলা নয় বরং তার মলিনতা, কলুষ দূর করা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের কর্মবহুল স্বল্পস্থায়ী জীবনের প্রধান অভীপ্সা। তাই তো দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত শিক্ষিত বাঙালির কাছে শিক্ষা যখন কেরানী সৃষ্টির নামান্তর তখন স্বামীজি শিক্ষা চিন্তায় এক নতুন আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। খ্রিস্টান মিশনারী ও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যখন একযোগে ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্ম তথা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত, ভারতবর্ষে শিক্ষা প্রসারের জন্য যখন তারা ‘নিম্নগামী পরিস্রাবণ নীতি (Downward filtration theory)’, উডের ডেসপ্যাচ, হান্টার কমিশন প্রভৃতি  নিয়ে ‘পরীক্ষণে’ ব্যস্ত এমনই এক সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ অধ্যাত্ম শিক্ষাকে হাতিয়ার করে বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আমূল পরিবর্তন সাধনের মূলমন্ত্র শুনিয়েছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিকাশ সাধনের জন্য তিনি শিক্ষা সংস্কারের কথা বলেন।  শিক্ষার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি কি হবে, শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠক্রম ও শিক্ষার বাহন কি হওয়া উচিত এবং স্ত্রীশিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেও তিনি বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেন।

পশ্চাৎপট

স্বামী বিবেকানন্দ তখন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, ১৮৮৪ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তিনি অর্থকষ্টে ভোগেন। এ সময় তিনি অনুবাদ কার্যের দ্বারা আয়ের চেষ্টা করেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০ – ১৯০৩) এর ‘Education: Intellectual, Moral and Physical’ পুস্তকটি ‘শিক্ষা’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন। এছাড়া ১৮৮৬ সালে কিছুদিন শিক্ষকতাকার্যে ব্রতী হন। তিনি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের চাঁপাতলা শাখায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমরা অনুমান করতে পারি যে, সে সময় শিক্ষার দর্শন ও শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্বন্ধে তাঁর বিরাট মনীষা আলোড়িত হয়। ছাত্রজীবনে তিনি কিছুকালের জন্য হার্বার্ট স্পেন্সারের মতো অজ্ঞেয়বাদে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। স্পেন্সারের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল এবং ঐসব পত্রে স্পেন্সারের কোনো কোনো মতের সমালোচনাও তিনি করেছিলেন। এক কথায়, স্বামী বিবেকানন্দ কিছু কালের জন্য হার্বার্ট স্পেন্সারের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সংস্পর্শে এসে তিনি পাশ্চাত্যদর্শন ও হার্বার্ট স্পেন্সার থেকে বহুদূরে সরে এসেছিলেন। পরিণতিতে শিক্ষাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বেদান্তদর্শনের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর, যে দর্শন শেখাচ্ছে— মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার প্রকাশই শিক্ষা। এই পূর্ণতা লাভ করতে হলে বহির্জগৎ হতে কিছু বিষয় আহরণ করলেই চলবে না, যে জ্ঞান মনের ভেতরে আগে থেকেই রয়েছে, তার উপরের আবরণগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে। তার জন্য চাই ভাবের আন্তরীকরণ, চাই সদগুরুর সান্নিধ্য, চাই ব্রহ্মচর্য ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ।

স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষা সম্বন্ধে আর কোনো গ্রন্থ অনুবাদ কিংবা রচনা করেননি, কিন্তু তাঁর সর্বব্যাপী মনীষাবলে এ-সম্বন্ধে বহু অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এই শিক্ষাবিষয়ক চিন্তারাশি তাঁর গ্রন্থাবলীতে ছড়িয়ে আছে।

স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন

স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন মুখ্যতঃ মানবকেন্দ্রিক। উপনিষদ থেকেই তিনি এ শিক্ষা নিয়েছিলেন। মানুষকে নানা স্তরে বিশ্লেষণ করে, প্রত্যেক স্তরের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে অবশেষে মানুষের নিগূঢ়তম সত্যের পরিচয় প্রদানই উপনিষদের লক্ষ্য। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে উপনিষদের দৃষ্টি দিয়েই দেখতেন। মানুষের দেহ-মন আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনটাই অবহেলা করার নয়- কিন্তু তার অন্তরতম সত্য সর্বাপেক্ষা আদরণীয়। মানুষ যদি এই সত্যকে ভুলে তার বাহিরের সত্যগুলোকেই বড় করে তুলতে চায় তা হলে সে শ্রেয়ের পথ থেকে বিচ্যুত। সে নিজের ব্যক্তিগত কল্যাণকে সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ করতে তো পারবেই না উপরন্তু সমাজকল্যাণকেও সে পদে পদে ব্যাহত করবে। কেননা, মানুষের দৈবসত্তাকে বাদ দিলে মানুষ স্বার্থপর হতে বাধ্য। হিংসা, ঘৃণা, লোভ, দম্ভ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন মানুষের দেবত্ব-উপলব্ধি ব্যাপকভাবে অভ্যাস করার সময় এসেছে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সত্য তার জীবনের সর্বস্তরে প্রয়োগ করা যায় এবং করতে হবে। নতুবা মানবসভ্যতার সমূহ সঙ্কট। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে এই প্রয়োগের নাম ‘কর্ম-পরিণত বেদান্ত’ (Practical Vedanta) । এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে ‘অভয়’ একটি প্রকৃষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তাঁর মতে, সাহস ও শক্তিমত্তা সর্বস্তরেই মানুষকে অগ্রগতিতে সাহায্য করে। সেজন্য তিনি কি ব্যক্তিগত, পরিবারগত অথবা সমাজগত, শিক্ষাগত কিংবা ধর্মগত সকল ক্ষেত্রেই উদ্যম, সাহস এবং নির্ভিকতার অনুশীলনের কথা বলতেন। তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম প্রতিজ্ঞা—সকল মানুষের অন্তরশায়ী আত্মা যিনি সর্বশক্তির আকর, চিরমুক্ত, চিরস্বচ্ছ, তাঁর জাগরণই মানুষের সকল কল্যাণের নিদান। বলেছেন তিনি, “উপায় শিক্ষার প্রচার। প্রথমত আত্মবিদ্যা—ঐ কথা বললেই যে জটাজূট, দণ্ড, কমণ্ডলু ও গিরিগুহা মনে আসে, আমার বক্তব্য তা নয়। তবে কি? যে জ্ঞানে ভববন্দন হতে মুক্তি পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাতে আর সামান্য বৈষয়িক উন্নতি হয় না? অবশ্যই হয়। মুক্তি, বৈরাগ্য, ত্যাগ এসকল তো মহাশ্রেষ্ঠ আদর্শ; কিন্তু ‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’। এই আত্মবিদ্যার সামান্য অনুষ্ঠানেও মানুষ মহাভয়ের হাত হইতে বাঁচিয়া যায়। মানুষের অন্তরে যে শক্তি রহিয়াছে, তাহা উদ্বুদ্ধ হইলে মানুষ অন্নবস্ত্রের সংস্থান হইতে আরম্ভ করিয়া সব কিছুই অনায়াসে করিতে পারি।” “এই শক্তির উদ্বোধন করিতে হইবে দ্বারে দ্বারে যাইয়া। দ্বিতীয়ত সেই সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা দিতে হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষাদর্শন

স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে পূর্ণতা প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ।’ শিক্ষার এই অতি-ধারণা (super-concept) জনসাধারণ যাতে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে তাই তিনি শিক্ষার একটি সংজ্ঞাই নির্দেশ করেন, ‘যে অনুশীলন দ্বারা ইচ্ছাশক্তির প্রবাহ ও অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে এবং ফলপ্রসূ হয় তাকেই বলা হয় শিক্ষা।’

সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়:

প্রথমত, শিক্ষা দ্বারা ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছাশক্তির উদ্বোধন করে তার প্রবাহ সংঘটিত করতে হবে। ব্যক্তি কোনো স্বয়ংচল যন্ত্র নয়; শুধু প্রতিবন্ধকাধীন বলে সে যন্ত্রবৎ আচরণ করে। অতএব শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষ গড়া (man-making) অর্থাৎ মানুষ তৈরি করা।

দ্বিতীয়ত, ইচ্ছাশক্তির প্রবাহ ও অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। এর উদ্দেশ্য কী? নিশ্চয়ই এর উদ্দেশ্য সমাজের কল্যাণ সাধন। কারণ সমাজবহির্ভূত ব্যক্তির অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না।

তৃতীয়ত, শিক্ষা হল অনুশীলন; যার দ্বারা মানুষের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী—উভয় প্রকৃতিরই সমন্বয় করা সম্ভব। সুতরাং শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজ— উভয়েরই উন্নয়নমার্গ।

ধারণাটির সংক্ষিপ্তসার পাওয়া যায় স্বামী বিবেকানন্দেরই একটি প্রশ্নাকার উক্তিতে। উক্তিটি হল, ‘যে বিদ্যার উন্মেষে ইতর-সাধারণকে জীবনসংগ্রামে সমর্থ করতে পারা যায় না, যাতে মানুষের চরিত্রবল, পরার্থতৎপরতা, সিংহসাহসিকতা এনে দেয় না, সে কি আবার শিক্ষা?’

স্বামী বিবেকানন্দ একখানি পত্রে লিখেছিলেন, ‘যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যাবুদ্ধির যত পরিমাণে প্রচারিত, সে জাতি তত পরিমাণে উন্নত। ভারতবর্ষের যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ঐটি— রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া।’ এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, স্বামী বিবেকানন্দ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল জনগণের জন্য এমন ধরনের শিক্ষা চেয়েছিলেন যা কোনো কিছু মহৎ বা কল্যাণকর সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। যে শিক্ষার মধ্যে থাকবে মনের বলিষ্ঠতা গঠন ও আত্মার উদ্বোধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। এই শিক্ষাই হল মানুষ গড়ার শিক্ষা। মানুষ এইভাবে গড়ে উঠলে তার মধ্যে সমাজচেতনা দানা বাঁধতে বাধ্য। যা সমাজ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিবে তাই স্বামী বিবেকানন্দের মতে প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষ গড়া।  

স্বামী বিবেকানন্দের মতে শিক্ষাপদ্ধতি

মানুষ গড়ার জন্য বিশেষ কার্যকর বলে গুরুগৃহে বাস করে গুরুর সাক্ষাৎ সংস্পর্শে থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্বামী বিবেকানন্দ মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ব্যতীত প্রকৃত শিক্ষা সম্ভব নয়।”  স্বামী বিবেকানন্দের মতে, কেউ কাউকে কিছু শেখাতে পারে না। শিক্ষা উপলব্ধি বা জাগরণ ছাড়া আর কিছু নয়। গাছের চারা যেমন সৃষ্টি করা যায় না, তেমনি কাউকে কিছু শেখানোও যায় না। যা করা যায় তা হল উপলব্ধির পথে সহায়তা করা। সেজন্য স্বামী বিবেকানন্দের ইচ্ছা ছিল যাতে আমাদের দেশে আবার প্রাচীন গুরুকুলপ্রথার আদর্শে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে উঠে। সেখানে সংযমী, সেবাপরায়ণ, স্নেহশীল ঋষিদের সান্নিধ্য ও শিক্ষাগুণে শিক্ষার্থীরা পরা ও অপরা বিদ্যায় পারদর্শী হত; বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ে জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা অর্জন করে অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা লাভ করত, আবার সেসঙ্গে লোককল্যাণে ইচ্ছাসমুজ্জ্বল, বজ্রদৃঢ়, দেবোপম চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠত। আদর্শ শিক্ষকদের এইরূপ ঋষিতুল্য হতে হবে। তা হলেই তাঁদের শিক্ষায় ও জীবনের স্পর্শে শিক্ষার্থীরা নিজেদের, সমাজের, দেশের ও জগতের যথার্থ কল্যাণকারী মানুষ হয়ে উঠতে পারবে।

শিশুদের শিক্ষাদান বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “ প্রত্যেক শিশুই অনন্ত ঈশ্বরীয় শক্তির আধারস্বরূপ, আর আমাদিগকে তাহার মধ্যে অবস্থিত সেই নিদ্রিত ব্রহ্মকে জাগ্রত করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। শিশুদের শিক্ষা দিবার সময় আর একটি বিষয় আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে— তাহারাও যাহাতে নিজেরা চিন্তা করিতে শিখে, সেই বিষয়ে উৎসাহ দিতে হইবে। এই মৌলিক চিন্তার অভাবই ভারতের বর্তমান হীনাবস্থার কারণ। যদি এভাবে ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে তাহারা মানুষ হইবে এবং জীবন সংগ্রামে নিজেদের সমস্যা সমাধান করিতে সমর্থ হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দের মতে শিক্ষার পাঠক্রম ও শিক্ষার বাহন

স্বামী বিবেকানন্দের মানুষ-গড়া শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রম বিশেষ ব্যাপক—দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত উন্নয়নের জন্য যা-কিছু প্রয়োজন সবই এর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য এর মধ্যে তিনি শরীরচর্চা, ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, কান্তিবিদ্যা (Aesthetics), যুগোত্তীর্ণ প্রাচীন সাহিত্য (Classics) এবং ভাষা। এদের মধ্যে অনুপাত অবশ্যই বিশেষ সমাজের প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারিত হবে।

মাতৃভাষা হবে জনশিক্ষার বাহন, তবে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার জন্য একাধিক ভাষা আয়ত্ত থাকা প্রয়োজন। এই ব্যবস্থা ছাড়া ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এবং কালোত্তীর্ণ প্রাচীন সাহিত্যের চর্চা কি করে করা সম্ভব? দৃষ্টান্তস্বরূপ, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সার্থক অনুশীলন কোনো পাশ্চাত্য ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। এই কারণেই স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে ইংরেজি ভাষা চর্চার সুপারিশ করেছিলেন। যদিও তাঁর অভিমত ছিল যে, আমাদের প্রাচীন গ্রন্থভুক্ত মহান ধ্যান-ধারণা সমূহকে জনগণের ভাষাতেই জনসমক্ষে উপস্থাপিত করা উচিত, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্কৃত শিক্ষারও নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ সংস্কৃত শব্দের ঝঙ্কারই জাতিকে মর্যাদা ও শক্তিসামর্থ্য প্রদান করবে।

শিক্ষা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমত

শিক্ষা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমতসমূহকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায়। যথা-

শারীরিক শিক্ষা

কোনো বিষয়বস্তু যথাযথ অনুধাবনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সবলতা আবশ্যক। সুস্থ দেহেই সুস্থ মন থাকে। শারীরিক শিক্ষার জ্ঞান ব্যতীত শারীরিক ও মানসিক সবলতা লাভ করা যায় না। তাই স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষাক্রমে শারীরিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “তোমাদের প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। হে আমার বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও— ইহাই তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের অধিকতর নিকটবর্তী হইবে। শরীর শক্ত হইলে তোমরা গীতা অপেক্ষাকৃত ভাল বুঝিবে।”

ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে শিক্ষাপ্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন যে, ধর্মকে বাদ দিলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। তবে ধর্ম বলতে ‘অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশ’-এর কথাই বলেছেন তিনি। “উপায় শিক্ষার প্রচার।” স্বামী বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষার অর্থ অন্তরের বিকাশ। স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে শিক্ষা ও ধর্ম সম্পূর্ণ অভিন্ন—উভয়েরই লক্ষ্য মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার উপলব্ধি। শিক্ষা বলতে তিনি বুঝেন মন্যুষ্যত্বের উদ্বোধন এবং তার সহিত ধর্মের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তো থাকবেই। তবে সে ধর্ম কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়। “যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশালী এবং পরহিতরত হয়, এইপ্রকার শিক্ষা দিবে। ইহারই নাম ধর্ম—জটিল দার্শনিক তত্ত্ব এখন শিকেয় তুলে রাখো। ধর্মের যে সর্বজনীন সাধারণ ভাব, তা-ই শিখাইবে।”

মানুষ গড়া বা মানুষ তৈরির শিক্ষা (Man making education)

স্বামী বিবেকানন্দের মতে প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষ তৈরি করা। বুদ্ধিতে যা গ্রহণ করলাম, বাস্তব প্রয়োজনে জীবনে তা কাজে লাগাবার নামই শিক্ষা। “মাথায় কতকগুলি ভাব ঢুকাইয়া সারাজীবন হজম হইল না, অসম্বদ্ধভাবে মাথায় ঘুরিতে লাগিল, ইহাকে শিক্ষা বলে না। …বিভিন্ন ভাবগুলিকে এমনভাবে হজম করিয়া লইতে হইবে, যাহাতে আমাদের জীবন গঠিত হয়, যাহাতে মানুষ তৈয়ারী হয়, চরিত্র গঠিত হয়। যদি তোমরা পাঁচটি ভাব হজম করিয়া জীবন ও চরিত্র গঠন করিতে পার, তবে যে ব্যক্তি একখানা গোটা লাইব্রেরি মুখস্থ করিয়াছে, তাহার অপেক্ষাও তোমার অধিক শিক্ষা হইয়াছে বলিতে হইবে।” “সকল শিক্ষা-প্রণালীর লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষ তৈয়ারী করা।” “যাহা জনসাধারণকে জীবনসংগ্রামের উপকরণ জোগাইতে সহায়তা করে না, তাহাদের মধ্যে চরিত্রবল, লোকহিতৈষণা এবং সিংহের মত সাহস উদ্বুদ্ধ করিতে সহায়তা করে না, তাহা কি শিক্ষা নামের যোগ্য?”

নারী শিক্ষা (Women Education)

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই ব্যাপকভাবে শিক্ষার প্রসার সর্ববিধ উন্নতির ও সর্ববিধ সমস্যা-সমাধানের প্রশস্ততম উপায়। পুরুষদের মতো স্ত্রীলোকের ভিতরেও শিক্ষার প্রসারের কথা স্বামী বিবেকানন্দ বারে বারে বলেছেন। “এক পক্ষে পক্ষী উড়িতে পারে না।” “সাধারণের মধ্যে আর মেয়েদের ভেতর শিক্ষাবিস্তার না হলে কিছু হবার জো নাই।” “যাদের মা শিক্ষিতা ও নীতিপরায়ণা হন, তাদের ঘরেই মহৎ লোক জন্মায়। …মেয়েদের আগে তুলতে হবে, আপামর জনসাধারণকে জাগাতে হবে, তবে তো দেশের কল্যাণ!” “ জননীগণ উন্নত হইলে তাঁহাদের কৃতী সন্তানবর্গের মহৎ কীর্তি দেশের মুখ উজ্জ্বল করিতে পারিবে, এবং তখনই ঘটিবে দেশে সংস্কৃতি, পরাক্রম, জ্ঞান ও ভক্তির পুনরুজ্জীবন।” “যথার্থ সুশিক্ষা পাইলে আমাদের মেয়েরা জগতের আদর্শ নারী হইয়া উঠিতে পারে।” স্বামী বিবেকানন্দের মতে ‘স্বাবলম্বন ও পারস্পরিক সহায়তা’র (self help and mutual aid) মাধ্যমে নারীদের বিশেষ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন নারীকে নারী করে গড়ে তোলার শিক্ষা, যে শিক্ষা তাদের মধ্যে নির্ভিকতা এবং স্বাবলম্বনের ভাব গড়ে তুলবে। ফলে স্ত্রীশিক্ষার পাঠক্রমে থাকবে ধর্মশাস্ত্র, সাহিত্য, সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং কিছু ইংরেজি।  তা ছাড়া এই শিক্ষাসূচির তালিকায় তিনি আরও যোগ করেছেন রন্ধনবিদ্যা, সূচীশিল্প, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশ ছিল এক শতাব্দীর বেশি আগে, যখন গার্হস্থ্যবিজ্ঞান প্রভৃতি স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ পাঠ্যক্রমভুক্ত হয়নি।

সমাজের সুবিধা বঞ্চিতের শিক্ষা (Education for the weaker section of society)

স্বামী বিবেকানন্দ সমাজের সুবিধা বঞ্চিত জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনীয়তার কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, “প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যা-বুদ্ধির যত বেশি প্রসার, সে জাতি তত বেশি উন্নত। ভারতবর্ষে যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ওইটি—রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া।” “সমস্ত ত্রুটির মূলই এইখানে যে, সত্যিকার জাতি—যাহারা কুটিরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে।…তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ববোধ আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে; তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দ জনসাধারণকে সাধারণ জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার আবশ্যকতাই বিশেষভাবে অনুভব করেছিলেন। জনসাধারণের সুবিধা মত সময়ে তাদের নিকট গিয়ে মুখের কথায় গল্পের ছলে জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূগোল প্রভৃতি তাদের বুদ্ধির উপযোগী করে সহজ সরল ভাষায় শেখাতে বলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের উপদেশ

‘জনসাধারণকে প্রচলিত ভাষায় শিক্ষা দাও।’ স্বামী বিবেকানন্দ আরও বলেন, এসব শেখাবার জন্য ছোটখাটো আধুনিক যন্ত্রপাতি সাজ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। গ্লোব, ম্যাপ, বিবিধ চিত্র, ম্যাজিক লণ্ঠন, কিছু কিছু রাসায়নিক দ্রব্য— এসব সংগ্রহ করতে হবে। “… গ্রামে গ্রামে গরীবদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন, তথাপি তাহাতে কোনো উপকার হইবে না, কারণ ভারতে দারিদ্য এত অধিক যে, দরিদ্র বালকেরা বিদ্যালয়ে না গিয়া বরং মাঠে গিয়া পিতাকে তাহার কৃষিকার্যে সহায়তা করিবে, অথবা অন্য কোনরূপে জীবিকা-অর্জনের চেষ্টা করিবে; সুতরাং যেমন পর্বত মহম্মদের নিকট না যাওয়াতে মহম্মদই পর্বতের নিকট গিয়াছিলেন, সেইরূপ দরিদ্র বালক যদি শিক্ষালয়ে আসিতে না পারে, তবে তাহাদের নিকট শিক্ষা পৌঁছাইয়া দিতে হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, শিক্ষাকে সফল করার জন্য কয়েকটি গুণ বিশেষ সহায়ক, সে বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই সজাগ থাকা একান্ত প্রয়োজন— শ্রদ্ধা বা আত্মবিশ্বাস, একাগ্রতা, ইচ্ছাশক্তির বর্ধন এবং ব্রহ্মচর্যনিষ্ঠা।

প্রথমত, শ্রদ্ধা বা আত্মবিশ্বাস। “নিজের প্রতি শ্রদ্ধা জাগলে যেমন হৃদয়ে মহাতেজের বিকাশ হয়, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনেও তেমনি তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে উঠে, প্রাণোচ্ছল হয়ে মহাবীর্যবান হয়ে সে মাথা তুলে দাঁড়ায়। সে জন্য ‘ইহার দ্বারা কিছু হইবে না’, ‘ও একেবারে অপদার্থ’— এই জাতীয় কথাগুলি উচ্চারণও করতে নেই; সশ্রদ্ধভাবে অপরকে নিজশক্তিতে বিশ্বাসী হতে বলতে হয়, মানুষ যে ইচ্ছা করলে সবকিছুই কতে পারে, এই সত্যটি শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে দিতে হয় । শিক্ষাকে সফল করবার মহামন্ত্র এটি।”

দ্বিতীয়ত, একাগ্রতা। ‘মন যত একাগ্র হয়, ততই অল্প সময়ে ও অল্প পরিশ্রমে বিদ্যা আয়ত্ত হয়; শক্তি ও সময়ের অপচয় কম হয়।’ “আমার মতে শিক্ষার সারাংশ মনঃসংযোগ, ঘটনা-সংগ্রহ নহে।”

তৃতীয়ত, ইচ্ছাশক্তি। “পুনঃ পুনঃ ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করিলেই জীবনের ঊর্ধ্বায়ন ঘটে। ইচ্ছাশক্তির প্রভাব অপরিসীম।” ‘চেষ্টা করলে পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলা যায়। মন যখনই বিপথে চলতে চাইবে, তখনই জোর করে তাকে টেনে রাখতে হয়। ছোটখাট ঘটনাকে উপেক্ষা না করে তা করতে হয়। যতবার এরূপ করা যায়, ততবারই আত্মবিশ্বাস পূর্বাপেক্ষা বেড়ে যায়, ইচ্ছাশক্তি ততই সবলতর হয়।…চরিত্রগঠনের ইহাই একমাত্র উপায়—পুনঃ পুনঃ অভ্যাস। হাজার বার অকৃতকার্য হলেও চেষ্টা ছাড়তে নেই, উদ্যম হারাতে নেই; তা হলে সফলতা আসবেই আসবে। নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টার নামই মনুষ্যত্বের সাধনা।’

চতুর্থত, ব্রহ্মচর্য। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “প্রত্যেক বালককে পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করিতে শিক্ষা দেওয়া উচিত; তবেই তাহার অন্তরের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস জাগ্রত হইবে। পূর্ণ ব্রহ্মচর্যের অর্থ চিন্তায়, বাক্যে ও কর্মে সর্বদা সর্বাবস্থায় শুচিতা রক্ষা করা।” ব্রহ্মচর্য পালন জ্ঞান আহরণের জন্য অত্যাবশ্যক। এর অভাবে আধ্যাত্মিক ভাব, চরিত্রবল ও মানসিক তেজ— সবই চলে যায়।

উপসংহার

স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন ও শিক্ষাবিষয়ক যাবতীয় চিন্তারাশি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এসবের মধ্যমণি ‘মানুষ’। আর মানুষের সমস্ত দুর্দশার মূলে শিক্ষার অভাবকেই তিনি দেখতে পেয়েছেন। শিক্ষার অভাবেই সাধারণ মানুষ নিজের উন্নতির পথ বুঝতে পারে না। নিজের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলে যায়। এর ফলে নিম্নমানের জীবনযাত্রা, একতা ও উচ্চ আদর্শের প্রতি উদাসীনতা ইত্যাদি তাদের সহজেই এসে পড়ে। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারই সমস্ত উন্নতির মূল। এ শিক্ষা পরীক্ষা-পাসের জন্য যান্ত্রিক শিক্ষা নয়, মানুষের ভিতরে যে অপার সম্ভাবনা আছে, অনন্ত শক্তি আছে সে সম্বন্ধে বিশ্বাস জাগানোর শিক্ষা, নিজের পায়ে দাঁড়াবার শিক্ষা, নিজের ব্যক্তিত্ব ফিরে পাবার শিক্ষা। বেদান্তের ধারণানুসারে মানুষ গড়া। ‘আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠঃ’, সেই মানুষকে তিনি চেয়েছেন, যার শরীর হবে ‘বিচর্ষণ’, জিহ্বা হবে ‘মধুমত্তমা’, যার কাছে ‘ইয়ং পৃথিবী সর্বা বিত্তস্য পূর্ণা স্যাৎ’, অর্থাৎ সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধ জীবন যার। যে মানুষ হবে সব দিক দিয়ে ‘অভীঃ’, ভয়শূন্য।  তাই তো স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বান, “মানুষ হও, এবং অপরকে মানুষ হইতে সহায়তা কর।”

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

  • বিবেকানন্দ, স্বামী, শিক্ষা প্রসঙ্গ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯১।
  • বিশ্বাশ্রয়ানন্দ, স্বামী, স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা, ২০১৩।
  • লোকেশ্বরানন্দ, স্বামী, সম্পাদক, চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা, ১৯৯৫।
  • স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (সঙ্কলন), রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা, ২০০৩।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

নির্মল চন্দ্র শর্মা

সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট, প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, কিশোরগঞ্জ

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

স্বামী বিবেকানন্দ এবং তাঁর শিক্ষাভাবনা বা শিক্ষাদর্শন

প্রকাশ: ১০:৩১:২৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ ২০২২

ভূমিকা

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে যে কয়েকজন মহান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) তাঁদের অন্যতম। পরাধীন ভারতবাসীকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা-সামাজিক সংস্কার-ধর্মবোধ বা আধ্যাত্মিকতার দীপ্তিময় গৌরবোজ্জ্বল জীবনের পথ প্রদর্শনে যে কয়জন মনীষী আজও ভারতবর্ষে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন- তাঁদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান এক বাক্যে স্বীকার্য।  এ কথা সর্বজন বিদিত যে, স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, একজন বেদান্তপন্থী মুক্তিসাধক। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, সংসারকে একদিকে ত্যাগ করে অন্যদিকে তিনি গ্রহণ করেছেন। সংসারকে মায়া বা অলীক বলে অবহেলা নয় বরং তার মলিনতা, কলুষ দূর করা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের কর্মবহুল স্বল্পস্থায়ী জীবনের প্রধান অভীপ্সা। তাই তো দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে জর্জরিত শিক্ষিত বাঙালির কাছে শিক্ষা যখন কেরানী সৃষ্টির নামান্তর তখন স্বামীজি শিক্ষা চিন্তায় এক নতুন আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। খ্রিস্টান মিশনারী ও ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী যখন একযোগে ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান-ধর্ম তথা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে অপপ্রচারে লিপ্ত, ভারতবর্ষে শিক্ষা প্রসারের জন্য যখন তারা ‘নিম্নগামী পরিস্রাবণ নীতি (Downward filtration theory)’, উডের ডেসপ্যাচ, হান্টার কমিশন প্রভৃতি  নিয়ে ‘পরীক্ষণে’ ব্যস্ত এমনই এক সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ অধ্যাত্ম শিক্ষাকে হাতিয়ার করে বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আমূল পরিবর্তন সাধনের মূলমন্ত্র শুনিয়েছেন। শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিকাশ সাধনের জন্য তিনি শিক্ষা সংস্কারের কথা বলেন।  শিক্ষার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি কি হবে, শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠক্রম ও শিক্ষার বাহন কি হওয়া উচিত এবং স্ত্রীশিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেও তিনি বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেন।

পশ্চাৎপট

স্বামী বিবেকানন্দ তখন নরেন্দ্রনাথ দত্ত, ১৮৮৪ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তিনি অর্থকষ্টে ভোগেন। এ সময় তিনি অনুবাদ কার্যের দ্বারা আয়ের চেষ্টা করেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০ – ১৯০৩) এর ‘Education: Intellectual, Moral and Physical’ পুস্তকটি ‘শিক্ষা’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন। এছাড়া ১৮৮৬ সালে কিছুদিন শিক্ষকতাকার্যে ব্রতী হন। তিনি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের চাঁপাতলা শাখায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমরা অনুমান করতে পারি যে, সে সময় শিক্ষার দর্শন ও শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্বন্ধে তাঁর বিরাট মনীষা আলোড়িত হয়। ছাত্রজীবনে তিনি কিছুকালের জন্য হার্বার্ট স্পেন্সারের মতো অজ্ঞেয়বাদে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। স্পেন্সারের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ ছিল এবং ঐসব পত্রে স্পেন্সারের কোনো কোনো মতের সমালোচনাও তিনি করেছিলেন। এক কথায়, স্বামী বিবেকানন্দ কিছু কালের জন্য হার্বার্ট স্পেন্সারের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সংস্পর্শে এসে তিনি পাশ্চাত্যদর্শন ও হার্বার্ট স্পেন্সার থেকে বহুদূরে সরে এসেছিলেন। পরিণতিতে শিক্ষাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বেদান্তদর্শনের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর, যে দর্শন শেখাচ্ছে— মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার প্রকাশই শিক্ষা। এই পূর্ণতা লাভ করতে হলে বহির্জগৎ হতে কিছু বিষয় আহরণ করলেই চলবে না, যে জ্ঞান মনের ভেতরে আগে থেকেই রয়েছে, তার উপরের আবরণগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে। তার জন্য চাই ভাবের আন্তরীকরণ, চাই সদগুরুর সান্নিধ্য, চাই ব্রহ্মচর্য ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ।

স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষা সম্বন্ধে আর কোনো গ্রন্থ অনুবাদ কিংবা রচনা করেননি, কিন্তু তাঁর সর্বব্যাপী মনীষাবলে এ-সম্বন্ধে বহু অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এই শিক্ষাবিষয়ক চিন্তারাশি তাঁর গ্রন্থাবলীতে ছড়িয়ে আছে।

স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন

স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন মুখ্যতঃ মানবকেন্দ্রিক। উপনিষদ থেকেই তিনি এ শিক্ষা নিয়েছিলেন। মানুষকে নানা স্তরে বিশ্লেষণ করে, প্রত্যেক স্তরের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে অবশেষে মানুষের নিগূঢ়তম সত্যের পরিচয় প্রদানই উপনিষদের লক্ষ্য। স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে উপনিষদের দৃষ্টি দিয়েই দেখতেন। মানুষের দেহ-মন আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনটাই অবহেলা করার নয়- কিন্তু তার অন্তরতম সত্য সর্বাপেক্ষা আদরণীয়। মানুষ যদি এই সত্যকে ভুলে তার বাহিরের সত্যগুলোকেই বড় করে তুলতে চায় তা হলে সে শ্রেয়ের পথ থেকে বিচ্যুত। সে নিজের ব্যক্তিগত কল্যাণকে সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ করতে তো পারবেই না উপরন্তু সমাজকল্যাণকেও সে পদে পদে ব্যাহত করবে। কেননা, মানুষের দৈবসত্তাকে বাদ দিলে মানুষ স্বার্থপর হতে বাধ্য। হিংসা, ঘৃণা, লোভ, দম্ভ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া তার পক্ষে স্বাভাবিক। স্বামী বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন মানুষের দেবত্ব-উপলব্ধি ব্যাপকভাবে অভ্যাস করার সময় এসেছে। মানুষের শ্রেষ্ঠ সত্য তার জীবনের সর্বস্তরে প্রয়োগ করা যায় এবং করতে হবে। নতুবা মানবসভ্যতার সমূহ সঙ্কট। স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে এই প্রয়োগের নাম ‘কর্ম-পরিণত বেদান্ত’ (Practical Vedanta) । এছাড়া স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনে ‘অভয়’ একটি প্রকৃষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। তাঁর মতে, সাহস ও শক্তিমত্তা সর্বস্তরেই মানুষকে অগ্রগতিতে সাহায্য করে। সেজন্য তিনি কি ব্যক্তিগত, পরিবারগত অথবা সমাজগত, শিক্ষাগত কিংবা ধর্মগত সকল ক্ষেত্রেই উদ্যম, সাহস এবং নির্ভিকতার অনুশীলনের কথা বলতেন। তাঁর জীবনদর্শনের অন্যতম প্রতিজ্ঞা—সকল মানুষের অন্তরশায়ী আত্মা যিনি সর্বশক্তির আকর, চিরমুক্ত, চিরস্বচ্ছ, তাঁর জাগরণই মানুষের সকল কল্যাণের নিদান। বলেছেন তিনি, “উপায় শিক্ষার প্রচার। প্রথমত আত্মবিদ্যা—ঐ কথা বললেই যে জটাজূট, দণ্ড, কমণ্ডলু ও গিরিগুহা মনে আসে, আমার বক্তব্য তা নয়। তবে কি? যে জ্ঞানে ভববন্দন হতে মুক্তি পর্যন্ত পাওয়া যায়, তাতে আর সামান্য বৈষয়িক উন্নতি হয় না? অবশ্যই হয়। মুক্তি, বৈরাগ্য, ত্যাগ এসকল তো মহাশ্রেষ্ঠ আদর্শ; কিন্তু ‘স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’। এই আত্মবিদ্যার সামান্য অনুষ্ঠানেও মানুষ মহাভয়ের হাত হইতে বাঁচিয়া যায়। মানুষের অন্তরে যে শক্তি রহিয়াছে, তাহা উদ্বুদ্ধ হইলে মানুষ অন্নবস্ত্রের সংস্থান হইতে আরম্ভ করিয়া সব কিছুই অনায়াসে করিতে পারি।” “এই শক্তির উদ্বোধন করিতে হইবে দ্বারে দ্বারে যাইয়া। দ্বিতীয়ত সেই সঙ্গে বিদ্যাশিক্ষা দিতে হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষাদর্শন

স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষা সম্পর্কে বলেছেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে পূর্ণতা প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ।’ শিক্ষার এই অতি-ধারণা (super-concept) জনসাধারণ যাতে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারে তাই তিনি শিক্ষার একটি সংজ্ঞাই নির্দেশ করেন, ‘যে অনুশীলন দ্বারা ইচ্ছাশক্তির প্রবাহ ও অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে এবং ফলপ্রসূ হয় তাকেই বলা হয় শিক্ষা।’

সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়:

প্রথমত, শিক্ষা দ্বারা ব্যক্তির মধ্যে সুপ্ত ইচ্ছাশক্তির উদ্বোধন করে তার প্রবাহ সংঘটিত করতে হবে। ব্যক্তি কোনো স্বয়ংচল যন্ত্র নয়; শুধু প্রতিবন্ধকাধীন বলে সে যন্ত্রবৎ আচরণ করে। অতএব শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষ গড়া (man-making) অর্থাৎ মানুষ তৈরি করা।

দ্বিতীয়ত, ইচ্ছাশক্তির প্রবাহ ও অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। এর উদ্দেশ্য কী? নিশ্চয়ই এর উদ্দেশ্য সমাজের কল্যাণ সাধন। কারণ সমাজবহির্ভূত ব্যক্তির অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না।

তৃতীয়ত, শিক্ষা হল অনুশীলন; যার দ্বারা মানুষের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী—উভয় প্রকৃতিরই সমন্বয় করা সম্ভব। সুতরাং শিক্ষা ব্যক্তি ও সমাজ— উভয়েরই উন্নয়নমার্গ।

ধারণাটির সংক্ষিপ্তসার পাওয়া যায় স্বামী বিবেকানন্দেরই একটি প্রশ্নাকার উক্তিতে। উক্তিটি হল, ‘যে বিদ্যার উন্মেষে ইতর-সাধারণকে জীবনসংগ্রামে সমর্থ করতে পারা যায় না, যাতে মানুষের চরিত্রবল, পরার্থতৎপরতা, সিংহসাহসিকতা এনে দেয় না, সে কি আবার শিক্ষা?’

স্বামী বিবেকানন্দ একখানি পত্রে লিখেছিলেন, ‘যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যাবুদ্ধির যত পরিমাণে প্রচারিত, সে জাতি তত পরিমাণে উন্নত। ভারতবর্ষের যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ঐটি— রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া।’ এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, স্বামী বিবেকানন্দ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল জনগণের জন্য এমন ধরনের শিক্ষা চেয়েছিলেন যা কোনো কিছু মহৎ বা কল্যাণকর সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। যে শিক্ষার মধ্যে থাকবে মনের বলিষ্ঠতা গঠন ও আত্মার উদ্বোধনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। এই শিক্ষাই হল মানুষ গড়ার শিক্ষা। মানুষ এইভাবে গড়ে উঠলে তার মধ্যে সমাজচেতনা দানা বাঁধতে বাধ্য। যা সমাজ ও জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিবে তাই স্বামী বিবেকানন্দের মতে প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষ গড়া।  

স্বামী বিবেকানন্দের মতে শিক্ষাপদ্ধতি

মানুষ গড়ার জন্য বিশেষ কার্যকর বলে গুরুগৃহে বাস করে গুরুর সাক্ষাৎ সংস্পর্শে থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্বামী বিবেকানন্দ মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “শিক্ষকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ব্যতীত প্রকৃত শিক্ষা সম্ভব নয়।”  স্বামী বিবেকানন্দের মতে, কেউ কাউকে কিছু শেখাতে পারে না। শিক্ষা উপলব্ধি বা জাগরণ ছাড়া আর কিছু নয়। গাছের চারা যেমন সৃষ্টি করা যায় না, তেমনি কাউকে কিছু শেখানোও যায় না। যা করা যায় তা হল উপলব্ধির পথে সহায়তা করা। সেজন্য স্বামী বিবেকানন্দের ইচ্ছা ছিল যাতে আমাদের দেশে আবার প্রাচীন গুরুকুলপ্রথার আদর্শে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলি গড়ে উঠে। সেখানে সংযমী, সেবাপরায়ণ, স্নেহশীল ঋষিদের সান্নিধ্য ও শিক্ষাগুণে শিক্ষার্থীরা পরা ও অপরা বিদ্যায় পারদর্শী হত; বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ে জ্ঞান ও কর্মদক্ষতা অর্জন করে অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা লাভ করত, আবার সেসঙ্গে লোককল্যাণে ইচ্ছাসমুজ্জ্বল, বজ্রদৃঢ়, দেবোপম চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠত। আদর্শ শিক্ষকদের এইরূপ ঋষিতুল্য হতে হবে। তা হলেই তাঁদের শিক্ষায় ও জীবনের স্পর্শে শিক্ষার্থীরা নিজেদের, সমাজের, দেশের ও জগতের যথার্থ কল্যাণকারী মানুষ হয়ে উঠতে পারবে।

শিশুদের শিক্ষাদান বিষয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “ প্রত্যেক শিশুই অনন্ত ঈশ্বরীয় শক্তির আধারস্বরূপ, আর আমাদিগকে তাহার মধ্যে অবস্থিত সেই নিদ্রিত ব্রহ্মকে জাগ্রত করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। শিশুদের শিক্ষা দিবার সময় আর একটি বিষয় আমাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে— তাহারাও যাহাতে নিজেরা চিন্তা করিতে শিখে, সেই বিষয়ে উৎসাহ দিতে হইবে। এই মৌলিক চিন্তার অভাবই ভারতের বর্তমান হীনাবস্থার কারণ। যদি এভাবে ছেলেদের শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে তাহারা মানুষ হইবে এবং জীবন সংগ্রামে নিজেদের সমস্যা সমাধান করিতে সমর্থ হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দের মতে শিক্ষার পাঠক্রম ও শিক্ষার বাহন

স্বামী বিবেকানন্দের মানুষ-গড়া শিক্ষাব্যবস্থার পাঠক্রম বিশেষ ব্যাপক—দেহ, মন ও আত্মার সমন্বিত উন্নয়নের জন্য যা-কিছু প্রয়োজন সবই এর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য এর মধ্যে তিনি শরীরচর্চা, ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, কান্তিবিদ্যা (Aesthetics), যুগোত্তীর্ণ প্রাচীন সাহিত্য (Classics) এবং ভাষা। এদের মধ্যে অনুপাত অবশ্যই বিশেষ সমাজের প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারিত হবে।

মাতৃভাষা হবে জনশিক্ষার বাহন, তবে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার জন্য একাধিক ভাষা আয়ত্ত থাকা প্রয়োজন। এই ব্যবস্থা ছাড়া ধর্ম, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এবং কালোত্তীর্ণ প্রাচীন সাহিত্যের চর্চা কি করে করা সম্ভব? দৃষ্টান্তস্বরূপ, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার সার্থক অনুশীলন কোনো পাশ্চাত্য ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব। এই কারণেই স্বামী বিবেকানন্দ ভারতে ইংরেজি ভাষা চর্চার সুপারিশ করেছিলেন। যদিও তাঁর অভিমত ছিল যে, আমাদের প্রাচীন গ্রন্থভুক্ত মহান ধ্যান-ধারণা সমূহকে জনগণের ভাষাতেই জনসমক্ষে উপস্থাপিত করা উচিত, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্কৃত শিক্ষারও নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ সংস্কৃত শব্দের ঝঙ্কারই জাতিকে মর্যাদা ও শক্তিসামর্থ্য প্রদান করবে।

শিক্ষা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমত

শিক্ষা সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের অভিমতসমূহকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা যায়। যথা-

শারীরিক শিক্ষা

কোনো বিষয়বস্তু যথাযথ অনুধাবনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সবলতা আবশ্যক। সুস্থ দেহেই সুস্থ মন থাকে। শারীরিক শিক্ষার জ্ঞান ব্যতীত শারীরিক ও মানসিক সবলতা লাভ করা যায় না। তাই স্বামী বিবেকানন্দ শিক্ষাক্রমে শারীরিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, “তোমাদের প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। হে আমার বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও— ইহাই তোমাদের প্রতি আমার উপদেশ। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের অধিকতর নিকটবর্তী হইবে। শরীর শক্ত হইলে তোমরা গীতা অপেক্ষাকৃত ভাল বুঝিবে।”

ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে শিক্ষাপ্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন যে, ধর্মকে বাদ দিলে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। তবে ধর্ম বলতে ‘অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশ’-এর কথাই বলেছেন তিনি। “উপায় শিক্ষার প্রচার।” স্বামী বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষার অর্থ অন্তরের বিকাশ। স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে শিক্ষা ও ধর্ম সম্পূর্ণ অভিন্ন—উভয়েরই লক্ষ্য মানুষের অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার উপলব্ধি। শিক্ষা বলতে তিনি বুঝেন মন্যুষ্যত্বের উদ্বোধন এবং তার সহিত ধর্মের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তো থাকবেই। তবে সে ধর্ম কোনো আনুষ্ঠানিক ধর্ম নয়। “যাহাতে তাহারা নীতিপরায়ণ, মনুষ্যত্বশালী এবং পরহিতরত হয়, এইপ্রকার শিক্ষা দিবে। ইহারই নাম ধর্ম—জটিল দার্শনিক তত্ত্ব এখন শিকেয় তুলে রাখো। ধর্মের যে সর্বজনীন সাধারণ ভাব, তা-ই শিখাইবে।”

মানুষ গড়া বা মানুষ তৈরির শিক্ষা (Man making education)

স্বামী বিবেকানন্দের মতে প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হল মানুষ তৈরি করা। বুদ্ধিতে যা গ্রহণ করলাম, বাস্তব প্রয়োজনে জীবনে তা কাজে লাগাবার নামই শিক্ষা। “মাথায় কতকগুলি ভাব ঢুকাইয়া সারাজীবন হজম হইল না, অসম্বদ্ধভাবে মাথায় ঘুরিতে লাগিল, ইহাকে শিক্ষা বলে না। …বিভিন্ন ভাবগুলিকে এমনভাবে হজম করিয়া লইতে হইবে, যাহাতে আমাদের জীবন গঠিত হয়, যাহাতে মানুষ তৈয়ারী হয়, চরিত্র গঠিত হয়। যদি তোমরা পাঁচটি ভাব হজম করিয়া জীবন ও চরিত্র গঠন করিতে পার, তবে যে ব্যক্তি একখানা গোটা লাইব্রেরি মুখস্থ করিয়াছে, তাহার অপেক্ষাও তোমার অধিক শিক্ষা হইয়াছে বলিতে হইবে।” “সকল শিক্ষা-প্রণালীর লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষ তৈয়ারী করা।” “যাহা জনসাধারণকে জীবনসংগ্রামের উপকরণ জোগাইতে সহায়তা করে না, তাহাদের মধ্যে চরিত্রবল, লোকহিতৈষণা এবং সিংহের মত সাহস উদ্বুদ্ধ করিতে সহায়তা করে না, তাহা কি শিক্ষা নামের যোগ্য?”

নারী শিক্ষা (Women Education)

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই ব্যাপকভাবে শিক্ষার প্রসার সর্ববিধ উন্নতির ও সর্ববিধ সমস্যা-সমাধানের প্রশস্ততম উপায়। পুরুষদের মতো স্ত্রীলোকের ভিতরেও শিক্ষার প্রসারের কথা স্বামী বিবেকানন্দ বারে বারে বলেছেন। “এক পক্ষে পক্ষী উড়িতে পারে না।” “সাধারণের মধ্যে আর মেয়েদের ভেতর শিক্ষাবিস্তার না হলে কিছু হবার জো নাই।” “যাদের মা শিক্ষিতা ও নীতিপরায়ণা হন, তাদের ঘরেই মহৎ লোক জন্মায়। …মেয়েদের আগে তুলতে হবে, আপামর জনসাধারণকে জাগাতে হবে, তবে তো দেশের কল্যাণ!” “ জননীগণ উন্নত হইলে তাঁহাদের কৃতী সন্তানবর্গের মহৎ কীর্তি দেশের মুখ উজ্জ্বল করিতে পারিবে, এবং তখনই ঘটিবে দেশে সংস্কৃতি, পরাক্রম, জ্ঞান ও ভক্তির পুনরুজ্জীবন।” “যথার্থ সুশিক্ষা পাইলে আমাদের মেয়েরা জগতের আদর্শ নারী হইয়া উঠিতে পারে।” স্বামী বিবেকানন্দের মতে ‘স্বাবলম্বন ও পারস্পরিক সহায়তা’র (self help and mutual aid) মাধ্যমে নারীদের বিশেষ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন নারীকে নারী করে গড়ে তোলার শিক্ষা, যে শিক্ষা তাদের মধ্যে নির্ভিকতা এবং স্বাবলম্বনের ভাব গড়ে তুলবে। ফলে স্ত্রীশিক্ষার পাঠক্রমে থাকবে ধর্মশাস্ত্র, সাহিত্য, সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং কিছু ইংরেজি।  তা ছাড়া এই শিক্ষাসূচির তালিকায় তিনি আরও যোগ করেছেন রন্ধনবিদ্যা, সূচীশিল্প, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশ ছিল এক শতাব্দীর বেশি আগে, যখন গার্হস্থ্যবিজ্ঞান প্রভৃতি স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ পাঠ্যক্রমভুক্ত হয়নি।

সমাজের সুবিধা বঞ্চিতের শিক্ষা (Education for the weaker section of society)

স্বামী বিবেকানন্দ সমাজের সুবিধা বঞ্চিত জনগণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের প্রয়োজনীয়তার কথা বারংবার উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, “প্রত্যক্ষ দেখিতেছি, যে জাতির মধ্যে জনসাধারণের ভিতর বিদ্যা-বুদ্ধির যত বেশি প্রসার, সে জাতি তত বেশি উন্নত। ভারতবর্ষে যে সর্বনাশ হইয়াছে, তাহার মূল কারণ ওইটি—রাজশাসন ও দম্ভবলে দেশের সমগ্র বিদ্যাবুদ্ধি এক মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে আবদ্ধ করা। যদি পুনরায় আমাদিগকে উঠিতে হয়, তাহা হইলে ঐ পথ ধরিয়া অর্থাৎ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিদ্যার প্রচার করিয়া।” “সমস্ত ত্রুটির মূলই এইখানে যে, সত্যিকার জাতি—যাহারা কুটিরে বাস করে, তাহারা তাহাদের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলিয়া গিয়াছে।…তাহাদের লুপ্ত ব্যক্তিত্ববোধ আবার ফিরাইয়া দিতে হইবে; তাহাদিগকে শিক্ষিত করিতে হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দ জনসাধারণকে সাধারণ জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার আবশ্যকতাই বিশেষভাবে অনুভব করেছিলেন। জনসাধারণের সুবিধা মত সময়ে তাদের নিকট গিয়ে মুখের কথায় গল্পের ছলে জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূগোল প্রভৃতি তাদের বুদ্ধির উপযোগী করে সহজ সরল ভাষায় শেখাতে বলেন।

স্বামী বিবেকানন্দের উপদেশ

‘জনসাধারণকে প্রচলিত ভাষায় শিক্ষা দাও।’ স্বামী বিবেকানন্দ আরও বলেন, এসব শেখাবার জন্য ছোটখাটো আধুনিক যন্ত্রপাতি সাজ সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। গ্লোব, ম্যাপ, বিবিধ চিত্র, ম্যাজিক লণ্ঠন, কিছু কিছু রাসায়নিক দ্রব্য— এসব সংগ্রহ করতে হবে। “… গ্রামে গ্রামে গরীবদের জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন, তথাপি তাহাতে কোনো উপকার হইবে না, কারণ ভারতে দারিদ্য এত অধিক যে, দরিদ্র বালকেরা বিদ্যালয়ে না গিয়া বরং মাঠে গিয়া পিতাকে তাহার কৃষিকার্যে সহায়তা করিবে, অথবা অন্য কোনরূপে জীবিকা-অর্জনের চেষ্টা করিবে; সুতরাং যেমন পর্বত মহম্মদের নিকট না যাওয়াতে মহম্মদই পর্বতের নিকট গিয়াছিলেন, সেইরূপ দরিদ্র বালক যদি শিক্ষালয়ে আসিতে না পারে, তবে তাহাদের নিকট শিক্ষা পৌঁছাইয়া দিতে হইবে।”

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, শিক্ষাকে সফল করার জন্য কয়েকটি গুণ বিশেষ সহায়ক, সে বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়েরই সজাগ থাকা একান্ত প্রয়োজন— শ্রদ্ধা বা আত্মবিশ্বাস, একাগ্রতা, ইচ্ছাশক্তির বর্ধন এবং ব্রহ্মচর্যনিষ্ঠা।

প্রথমত, শ্রদ্ধা বা আত্মবিশ্বাস। “নিজের প্রতি শ্রদ্ধা জাগলে যেমন হৃদয়ে মহাতেজের বিকাশ হয়, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনেও তেমনি তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জেগে উঠে, প্রাণোচ্ছল হয়ে মহাবীর্যবান হয়ে সে মাথা তুলে দাঁড়ায়। সে জন্য ‘ইহার দ্বারা কিছু হইবে না’, ‘ও একেবারে অপদার্থ’— এই জাতীয় কথাগুলি উচ্চারণও করতে নেই; সশ্রদ্ধভাবে অপরকে নিজশক্তিতে বিশ্বাসী হতে বলতে হয়, মানুষ যে ইচ্ছা করলে সবকিছুই কতে পারে, এই সত্যটি শিক্ষার্থীর মনে গেঁথে দিতে হয় । শিক্ষাকে সফল করবার মহামন্ত্র এটি।”

দ্বিতীয়ত, একাগ্রতা। ‘মন যত একাগ্র হয়, ততই অল্প সময়ে ও অল্প পরিশ্রমে বিদ্যা আয়ত্ত হয়; শক্তি ও সময়ের অপচয় কম হয়।’ “আমার মতে শিক্ষার সারাংশ মনঃসংযোগ, ঘটনা-সংগ্রহ নহে।”

তৃতীয়ত, ইচ্ছাশক্তি। “পুনঃ পুনঃ ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করিলেই জীবনের ঊর্ধ্বায়ন ঘটে। ইচ্ছাশক্তির প্রভাব অপরিসীম।” ‘চেষ্টা করলে পুনঃ পুনঃ অভ্যাসের দ্বারা ইচ্ছাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলা যায়। মন যখনই বিপথে চলতে চাইবে, তখনই জোর করে তাকে টেনে রাখতে হয়। ছোটখাট ঘটনাকে উপেক্ষা না করে তা করতে হয়। যতবার এরূপ করা যায়, ততবারই আত্মবিশ্বাস পূর্বাপেক্ষা বেড়ে যায়, ইচ্ছাশক্তি ততই সবলতর হয়।…চরিত্রগঠনের ইহাই একমাত্র উপায়—পুনঃ পুনঃ অভ্যাস। হাজার বার অকৃতকার্য হলেও চেষ্টা ছাড়তে নেই, উদ্যম হারাতে নেই; তা হলে সফলতা আসবেই আসবে। নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টার নামই মনুষ্যত্বের সাধনা।’

চতুর্থত, ব্রহ্মচর্য। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, “প্রত্যেক বালককে পূর্ণ ব্রহ্মচর্য পালন করিতে শিক্ষা দেওয়া উচিত; তবেই তাহার অন্তরের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস জাগ্রত হইবে। পূর্ণ ব্রহ্মচর্যের অর্থ চিন্তায়, বাক্যে ও কর্মে সর্বদা সর্বাবস্থায় শুচিতা রক্ষা করা।” ব্রহ্মচর্য পালন জ্ঞান আহরণের জন্য অত্যাবশ্যক। এর অভাবে আধ্যাত্মিক ভাব, চরিত্রবল ও মানসিক তেজ— সবই চলে যায়।

উপসংহার

স্বামী বিবেকানন্দের দর্শন ও শিক্ষাবিষয়ক যাবতীয় চিন্তারাশি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এসবের মধ্যমণি ‘মানুষ’। আর মানুষের সমস্ত দুর্দশার মূলে শিক্ষার অভাবকেই তিনি দেখতে পেয়েছেন। শিক্ষার অভাবেই সাধারণ মানুষ নিজের উন্নতির পথ বুঝতে পারে না। নিজের ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্ব ভুলে যায়। এর ফলে নিম্নমানের জীবনযাত্রা, একতা ও উচ্চ আদর্শের প্রতি উদাসীনতা ইত্যাদি তাদের সহজেই এসে পড়ে। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারই সমস্ত উন্নতির মূল। এ শিক্ষা পরীক্ষা-পাসের জন্য যান্ত্রিক শিক্ষা নয়, মানুষের ভিতরে যে অপার সম্ভাবনা আছে, অনন্ত শক্তি আছে সে সম্বন্ধে বিশ্বাস জাগানোর শিক্ষা, নিজের পায়ে দাঁড়াবার শিক্ষা, নিজের ব্যক্তিত্ব ফিরে পাবার শিক্ষা। বেদান্তের ধারণানুসারে মানুষ গড়া। ‘আশিষ্ঠো দ্রঢ়িষ্ঠো বলিষ্ঠঃ’, সেই মানুষকে তিনি চেয়েছেন, যার শরীর হবে ‘বিচর্ষণ’, জিহ্বা হবে ‘মধুমত্তমা’, যার কাছে ‘ইয়ং পৃথিবী সর্বা বিত্তস্য পূর্ণা স্যাৎ’, অর্থাৎ সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধ জীবন যার। যে মানুষ হবে সব দিক দিয়ে ‘অভীঃ’, ভয়শূন্য।  তাই তো স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বান, “মানুষ হও, এবং অপরকে মানুষ হইতে সহায়তা কর।”

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

  • বিবেকানন্দ, স্বামী, শিক্ষা প্রসঙ্গ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯১।
  • বিশ্বাশ্রয়ানন্দ, স্বামী, স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা, ২০১৩।
  • লোকেশ্বরানন্দ, স্বামী, সম্পাদক, চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা, ১৯৯৫।
  • স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (সঙ্কলন), রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা, ২০০৩।