রিভিউ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাস
- প্রকাশ: ১২:৩২:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ মার্চ ২০২২
- / ১২৮৭৩ বার পড়া হয়েছে
‘গোরা’ একটি কালজয়ী উপন্যাস, যেটি লিখেছেন সাহিত্যের একমাত্র মহাকাব্য ছাড়া প্রতিটি শাখায় দাপিয়ে বেড়ানো সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানে ‘গোরা’ উপন্যাসের রিভিউ বা পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো।
এখানে যা আছে
‘গোরা’ পরিচিতি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা ও জনপ্রিয় একটি উপন্যাস হলো গোরা। অনেকেই বলে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা শ্রেষ্ঠতম উপন্যাস গোরা।
গোরা উপন্যাসটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য, অপূর্ব সংযোজন বলে মেনে নিয়েছেন সাহিত্য সমালোচকরা। এটি সমাজ, ধর্ম, দর্শন, সংস্কার-কুসংস্কার, দেশপ্রেম, রাষ্ট্রনীতি, নতুন ধারার যৌক্তিক আহ্বান, তৎকালীন সর্বভারতীয় আধ্যাত্ম চেতনার এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। গোরা উপন্যাসটি মুক্তি, সর্বজনীনতা, ভ্রাতৃত্ব, লিঙ্গ, নারীবাদ, বর্ণ, শ্রেণি, ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা, নগর অভিজাত বনাম গ্রামীণ কৃষক, ঐপনিবেশিক শাসন, জাতীয়তাবাদ এবং ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে লেখা রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গোরা উপন্যাসের ব্যাপক চিন্তাকে স্বল্প পরিসরে বেঁধে বিশ্লেষণ করা বেশ কঠিনতম কাজের মধ্যে একটি।
গোরা উপন্যাসের শেষ বাক্য— তখন আনন্দময়ী অশ্রব্যাকুলকণ্ঠে মৃদুস্বরে গোরার কানের কাছে কহিলেন, “গোরা, এইবার একবার বিনয়কে ডেকে পাঠাই।”
কবে প্রকাশিত হয় ‘গোরা’ উপন্যাস?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা উপন্যাস প্রথমে প্রবাসী পত্রিকায় ১৯০৭ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, পুস্তক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। গোরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা পঞ্চম উপন্যাস। উল্লেখ্য, রবি ঠাকুর মোট ১৩ টি উপন্যাস লিখেছেন।
বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত গোরা উপন্যাসের মূল কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, “গোরা প্রবাসী পত্রিকায় ১৩১৪ ভাদ্র হইতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হইয়া ১৩১৬ সালের ফাল্গুনে সমাপ্ত এবং ঐ বৎসরেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রবাসীতে-প্রকাশিত পাঠের বহুলাংশ মুদ্রিত গ্রন্থে পরিত্যক্ত হয়। ১৩৩৪ সালে গোরার বিশ্বভারতী-সংস্করণে অনেক অংশ পুনরায় গৃহীত হয়। ১৩৪৭ সালে রবীন্দ্র-রচনাবলী-সংস্করণে প্রবাসী হইতে আরও কিছু অংশ সংকলিত হইয়াছে; বর্তমান গ্রন্থ উহারই পুনর্মুদ্রণ।”
গোরা উপন্যাসের সাথে সম্পর্কিত কিছু কথা
উনিশ শতকের শেষে বিশ শতকের প্রথম দশক উপমহাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ কালপর্ব, বিশেষ করে বাংলা বা আরও ভালো করে বললে ব্রিটিশ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জন্য। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং ঔপনিবেশিক শাসনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় অবিভক্ত বাংলার জনজীবন উত্তপ্ত, ক্ষত-বিক্ষত এবং প্রায়ই বিপর্যস্ত। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ স্বদেশী আন্দোলনের অভ্যুদয় যা অনেকটা প্রাচীন সনাতন ধর্মের নবসংস্করণ। বিস্ময়কর হলেও সত্য কবি কখনও এই বঙ্গভঙ্গকে মানতে পারেননি। এরই প্রেক্ষাপটে বিশ্বকবি লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ কবিতা, যেটি পরবর্তীতে গান হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং একটা সময় এসে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়।
তৎকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাচরণ, সৃষ্টিশীল দ্যোতনা এবং চিন্তাশীল ভাবনায় যা স্পষ্ট হয়ে আছে। কবির সিংহভাগ দেশাত্ববোধক সঙ্গীত এই বিক্ষুব্ধ সময়েই রচিত। অবিভক্ত বাংলাও বাঙালীর মূল শেকড় থেকে তুলে আনা দেশপ্রেমের এই অনবদ্য সঙ্গীত সম্ভারের সঙ্গে মিলে মিশে একীভূত হয়ে আছে চিরায়ত বাউল সুরের এক সার্বজনীন ঐক্যতান।
অবিভক্ত বাংলার এই সংঘাতময় দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে মহামিলনের সুর ঝঙ্কৃত করলেন সেখান থেকেই তার আদর্শনিষ্ঠ চৈতন্য সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে সবার সামনে মূর্ত হয়। সেই চেতনালব্ধ মননে তিনি লিখেছেন গোরা-এর মতো মহাকাব্যিক উপন্যাস। ফলে সর্বভারতীয় চিরায়ত চেতনা, ব্রাহ্মণবাদের কঠোর শৃঙ্খল, নবজাগৃতির অনিবার্য আবহ, নতুন ধারায় নারী জাতির যৌক্তিক বোধ সব মিলিয়ে গোরা লেখকের বিচিত্র সৃষ্টিশীলতার গভীর অভিব্যক্তি।
আসলে কী আছে ‘গোরা’ উপন্যাসে বা ‘গোরা’ উপন্যাসের মূল বক্তব্য কী?
রক্ষণশীলতা ও সীমাবদ্ধতা
ব্রাহ্ম ধর্মের মুক্ত সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুভবের সঙ্গে দেশমাতৃকার নিবিড় বন্ধন সর্বোপরি দেশ-কালের সীমানায় নতুন ও পুরাকালের এক অপূর্ব অভিযোজন ঘটেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গোরা উপন্যাসে, যেখানে ব্রাহ্মণ্যবাদের শক্ত ভিত্তিকে জোরালোভাবে হাজির করা হয়।
গোরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হলো গোরা। হিন্দুত্বের কঠোর অনুশাসনের পাশাপাশি ব্রাহ্ম ধর্মের রক্ষণশীলতা এমনকি সীমাবদ্ধতাও নানাভাবে প্রকাশ পায় গোরার বক্তব্যে। রবি ঠাকুর ছিলেন এমন একজন সাহিত্যিক যিনি ঐতিহ্য এবং নতুন সময়কে মেলানোর পক্ষপাতি ছিলেন। গোরা চরিত্রের চিত্রায়ণের বেলায়ও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। মূল চরিত্র গোরাকে যেভাবে হিন্দুত্বের প্রতীক হিসেবে নির্ণয় করেন একই সঙ্গে আনন্দময়ী, সুচরিতা, ললিতা এবং বিনয়ের মতো আধুনিক চেতনা সম্পন্ন ব্যক্তিও কবির সৃজনসৌধে উপন্যাসের গতি নির্ণয়ে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।
সামাজিক বলয়
সামাজিক বলয়ের দুই বিপরীত ধারা পুরনো (হিন্দুত্ব) ও আধুনিক (ব্রাহ্ম) পাশ্চাত্য মননের হরেক রকম যুক্তিতর্কের অবতারণা ঘটে বৃহৎ এই উপন্যাসের সর্বাংশ জুড়ে। গোরা তার পরিচয় জানার আগ মুহূর্ত অবধি দুর্ভেদ্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আবরণ থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অন্যদিকে আনন্দময়ী, সুচরিতা এবং ললিতা মঙ্গল আর মাধুরীর মিলিত সৌরভে নব্য ধারার সময়ের প্রতিনিধি। তবে মাত্র এক কথায় চরিত্রগুলোর বিশ্লেষণ উপন্যাসের মূল বার্তাকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসে না। এর গভীর তাৎপর্য এবং সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ বিচিত্র চরিত্র বিন্যাসে লেখকের অন্তর্দৃষ্টি আর প্রাজ্ঞ মননবোধকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় সেটা শুধুই অনুভব আর মুগ্ধতার বিষয় ছাড়া অন্য কিছু নয়।
রবীন্দ্রনাথের সযত্ন শৈল্পিক সুষমায় গড়া গোরা বৃহদাকার এই উপন্যাসজুড়ে
ব্রাহ্মণ্যবাদের ঐতিহ্য রক্ষায় শুধু লড়াই করেই গেলেন না নিজেকে সেই দুর্ভেদ্য সংস্কৃতির বলয় থেকে মুক্ত করতেও ব্যর্থ হলেন যতক্ষণ না জানতে পারলেন তার আসল পরিচয়। অথচ মা আনন্দময়ী এক সময় শাস্ত্রিক আচারনিষ্ঠ হিন্দু রমণীই শুধু ছিলেন না সব ধরনের নিয়মবিধি মেনে চলাই ছিল তার প্রতিদিনের কর্মযজ্ঞ। অতি বাল্যকাল থেকেই আনন্দময়ী শিব পূজায় অভ্যস্ত ছিলেন। বিয়ের পরও স্বামীগৃহে তার এই প্রথাসিদ্ধ বিধির কোন ধরনের ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু একদিন তিনি তাঁর সমস্ত ধর্মীয় কঠিন আবরণকে ছিন্ন করে বেরিয়ে আসলেন। আইরিশ বংশোদ্ভূত গোরাকে কোলে নিয়ে তিনি ভুলে গেলেন তার ধর্ম, বংশ আর জাত-পাত। গোরার সঙ্গে মহামিলনের শুভক্ষণে তিনি শুধুই হয়ে গেলেন মা। স্নেহের দানে, মাতৃত্বের গৌরবে তার এতদিনের গড়া সামাজিক শৃঙ্খলের বাঁধনকে আলগা করে দিলেন। যে গোরার জন্য আনন্দময়ী তার সমস্ত সংস্কার বিসর্জন দিলেন সেই স্নেহাস্পদ সন্তানের ব্রাহ্মণ্যবাদের রক্ষণশীলতা তাকে সব চাইতে বেশি আঘাত দেয়, বিমর্ষ করে।
রক্ষণশীল সমাজ ও গোরা
গোরা উপন্যাসের সর্বাংশ জুড়ে আনন্দময়ীর যে আধুনিক মনন বৃহদায়তন এই ঘটনাস্রোতের গোরার হিন্দুত্ববাদের জোরালো প্রতিনিধি হয়ে ওঠা যেমন বিস্ময়ের একইভাবে অনভিপ্রেতও। পিছিয়ে পড়া নারী সমাজকে টেনে তোলেন সামাজিক অভিশাপের সমস্ত মোহজাল থেকে। অথচ আধুনিক ভাব সম্পদে গড়াই শুধু নয় লেখকের আজন্মলালিত সৌন্দর্য আর মাধুরী মেশানো সযত্ন ভালোবাসায় সৃষ্ট গোরা কোন অদৃশ্যের টানে পেছনের দিকে হাঁটতে থাকে বলা মুশকিল।
রক্ষণশীল সমাজের জোরালো প্রতিনিধি গোরাকে এক সময় জেলেও যেতে হয়। কারাগার থেকে ফিরে এসে সে প্রায়শ্চিত্ত করার আয়োজন শুরু করলে পিতা কৃষ্ণদয়াল তাতে অত্যন্ত আপত্তি তোলেন। এই কৃষ্ণদয়াল এক সময় ধর্মীয় আচরণবিধি নিষেধের কোন তোয়াক্কাই করতেন না। কিন্তু গোরাকে নিজ গৃহে স্থান দেয়ার পর থেকে তিনিও হয়ে গেলেন আচারনিষ্ঠ শুদ্ধ ব্রাহ্মণ। শুধু তাই নয় তার ঘরেও গোরার প্রবেশের কোন অনুমতিই ছিল না। ঠিক এই ঘরে ঢুকতে না দেয়ার ব্যাপারটি গোরাকে আহত করলেও তার চেয়ে বেশি কিছু কখনও গড়ায়নি।
‘গোরা’ উপন্যাসে নারী চরিত্র
সমস্ত নারী চরিত্র বিশ্লেষণ করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না তারা সকলেই কম-বেশি আধুনিক যুগের সময়ের প্রতিনিধি। সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার করে চিরায়ত মাতৃশৌর্যের অহঙ্কারে শৈল্পিক নৈপুণ্যে গড়া আনন্দময়ী কবির এক অনবদ্য সৃষ্টি।
গোরা উপন্যাসের যত্রতত্র আনন্দময়ীর আধুনিক মনন, পুরনো সংস্কার বর্জন সর্বোপরি যুগের প্রয়োজনের সময়ের দাবি মেনে নেয়ার যে দীপ্ত প্রত্যয় তা রবীন্দ্রনাথের পরিবর্তিত মননের বিবর্তিত নারীর এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। সুচরিতাকেও কবি বের করে আনেন বিদ্যমান সমাজের বিভিন্ন অপসংস্কার থেকে। ব্রাহ্মসমাজভুক্ত পরেশ বাবুর বন্ধু কন্যা সুশিক্ষিতা, গৃহকর্মের নিপুণ এবং সংসারের লক্ষ্মীপ্রতিমার এক অনির্বাণ দীপ্তি। ব্রাহ্ম পরিবারে বেড়ে ওঠা সুচরিতা গোরার মধ্যে হিন্দুত্বের যে শক্ত বাঁধন প্রত্যক্ষ করে সেটা সাময়িকভাবে তাকে আহত করলেও ধর্মীয় গোঁড়ামির ভেতরে প্রচ্ছন্ন থাকা গোরার গভীর দেশপ্রেম তাকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করে। দেশাত্মবোধের অপূর্ব জ্যোতি গোরার হৃদয়কে যে মাত্রায় উদ্দীপ্ত করে তা যেন রবীন্দ্রনাথের মাতৃভূমির প্রতি অনমনীয় নিষ্ঠাকেই জোরালোভাবে তুলে ধরে। গোরার ভেতরের অদম্য শক্তি আর বাইরের তেজ ও জেদ মিশ্রিত যৌক্তিক তর্ক সুচিরতাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। স্বদেশ প্রেম আর ভারতীয় ঐতিহ্যের অনেক মূল্যবান বাণী তার সঙ্গে ভক্তি ও বেদনার আর্তিতে গোরার সর্বজনীন রূপসুষমায় শ্রদ্ধায় নিবেদনে, সম্মানে সুচরিতার মাথা নত হয়ে আসে। সেই অকৃত্রিম বোধ থেকেই নায়কের প্রতি নায়িকার অপ্রতিরোধ টান, হৃদয়ের নিবিড় ছোঁয়া। গোরাকে চিনতে পারার মধ্যেই সুচরিতার স্রষ্টা তার চরিত্রের মাহাত্ম্য ফুটিয়ে তোলেন। লাবণ্য আর কল্যাণের শুভমূর্তি সুচরিতা গোরার দৃষ্টিতে দেশমাতৃকার মঙ্গলশ্রী, দেশ, সমাজ এবং সুচরিতা গোরার কাছে প্রায়ই সমার্থক।
গোরা উপন্যাসের বিশিষ্ট চরিত্র ললিতা ও বিনময়। ললিতা শক্ত ধাঁচের, বিদ্রোহী চেতনায় তৈরি হওয়া এক বিপ্লবী নারী। সুচরিতার যুক্তি নিষ্ঠ ভাবনা, বস্তুনির্ভর বোধের বিপরীতে ললিতা এক প্রচ- ঝড়ো হাওয়া। বিনয়ের বিনয়ীভাব কিংবা উদ্ধৃত গোরার ধর্ম ভক্তির আরাধ্য অভিব্যক্তি অথবা সুচরিতা শান্ত স্নিগ্ধ মাঙ্গলিক প্রবৃত্তি কোনটাই আমলে নিতে চায় না কবির আধুনিক চৈতন্যে গড়া এই ললিতা। তার পরেও গোরার তুলনায় অপেক্ষাকৃত নমনীয়, উদারচিত্ত, নিরীহ, নির্বিরোধী বিনয়কেই ললিতা তার হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করে বসে। সমাজ-সংস্কারের বন্ধনজাল থেকে বেরিয়ে আসার দৃপ্ত প্রেরণা ললিতার মধ্যে বরাবরই প্রচ্ছন্ন ছিল। সময়ে তা প্রকাশও হয়। বিনয়ের সঙ্গে স্টিমারে রাতযাপন তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার আলোকে এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। ভালোবাসার মহিমাই নয়, অন্তরের গভীর বোধ থেকেজই ললিতার এই বিদ্রোহী সত্তা, নতুন দীপ্তি। গতানুগতিক সামাজিক বলয়ে এমন জেদী, তেজোদ্দীপ্ত নারী চরিত্র ঔপন্যাসিককের দুর্জয় সাহসের পরিচয়। গোরার অপ্রতিরোধ্য গোঁড়ামির বিপক্ষে ললিতার নবচিন্তার অজেয় মনোবল উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য দীপ্তি।
অম্লান ‘গোরা’
গোরা উপন্যাসে সমাজ বাস্তবতার বহুমাত্রিক অভিযোজনে ঘটনার পরিণতি যতই নাটকীয় হোক না কেন আনন্দময়ী, সুচরিতাও ললিতা নতুন কিরণে উদ্ভাসিত, আপন আলোয় দীপ্ত, ঘটনা পরম্পরায় স্বাভাবিক পরিণতিতে অম্লান। কাহিনির অপরিহার্য প্রাসঙ্গিকতায় গোরার গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল দর্শন উপন্যাসের গতি আরও সুদৃঢ় হয় মানুষে মানুষে বিভাজনের চিত্র তাকে আহত করে।
হতদরিদ্র পল্লীবাসীর সঙ্গে নির্মম সামাজিক অবয়ব গোরাকে এক অভূতপূর্ব কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে নৈসর্গিক সম্পদে সমৃদ্ধ গ্রাম সমাজ গোরার প্রত্যক্ষ নজরে না আসলে জীবনের অনেক কঠিন চিত্রই ঢাকা পড়ে যেত।
শেষকথা
বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক বলয়ে এর প্রভাব যুগান্তকারী। সর্বভারতীয় আধ্যাত্মচেতনা, রাজনৈতিক অভিঘাত, ঔপনিবেশিক প্রশাসনের রদবদল, সাম্প্রদায়িক সঙ্কট এবং হিন্দুত্বের আচারবিধির সংমিশ্রণে উপন্যাসটির গভীরে সমকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়।
ডাউনলোড করুন ‘গোরা’ উপন্যাস
রবীন্দ্রনাথা ঠাকুরের ‘গোরা’ উপন্যাসটির পিডিএফ ডাউনলোড করে পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।