০৭:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  • প্রকাশ: ০৭:২০:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০২২
  • / ১০০০ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের পতাকা


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। যে মহানায়কের জন্ম না হলে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় কখনো ঘটত না এবং বাঙালি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না, তিনিই শেখ মুজিবুর রহমান।

বাঙালিরা তাকে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু অভিধায় ভূষিত করেছে। দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেল। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিমিয়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। রমনা রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মুক্তিপাগল বাঙালিকে লক্ষ করে বঙ্গবন্ধু সে দিন ঘোষণা করেছিলেন – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ওই ভাষণে তিনি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে বাংলাদেশ অর্জনের জন্য ‘যার যা আছে, তাই নিয়ে’ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন।

লক্ষণীয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক হরতালের ফলে খেটে খাওয়া গরিব মানুষের যাতে রুজি রোজগার বন্ধ না হয় সে জন্য বঙ্গবন্ধু হরতালের মধ্যেও রিকশা ও ঠেলাগাড়ি চলার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ থেকে গরিবদের জন্য জাতির পিতার আন্তরিক সমবেদনার প্রমাণ মিলেছে। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

একাত্তরের হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে অন্যতম গবেষক রবার্ট পাইন তার ম্যাসাকার গ্রন্থে বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ৯ মাসে এক কোটি মানুষ ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যায়। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ভাষ্যমতে, ‘বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, এই গণহত্যার মূল টার্গেট কারা ছিল। টার্গেট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা, পুলিশ, প্যারামিলিটারি, আনসার ও মুজাহিদ। এ ছাড়া বাঙালি হিন্দু, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক, তরুণ ছাত্রছাত্রী বিশেষত যারা প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নিতে পারে। টার্গেট আরো ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যেমন – অধ্যাপক ও শিক্ষক।’ আর জে রোমেল তার ডেথ বাই গভর্নমেন্ট গ্রন্থে লিখেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা বেছে বেছে কেবল ওই সব যুবা তরুণদেরই টার্গেট করেছে, যারা যেকোনো সময় প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এসব তরুণকে বন্দী করে বা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যেত না। এসব ছেলেদের এবং দৈহিক অত্যাচার করা তরুণীদের দেহ কখনো পাওয়া যেত মাঠে, নদীর স্রোতে, অথবা কোনো আর্মি ক্যাম্পের পাশে।’

স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা অকস্মাৎ সৃষ্ট কোনো আবেগময় ঘোষণা নয়। এর পেছনে রয়েছে বাঙালির আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জন ও আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত পথ। এই অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে এই দিনে বাঙালি জাতি আরেক রক্তাক্ত পথে চলতে শুরু করল। অতঃপর দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ, সংগ্রাম, মৃত্যু, লাঞ্ছনা ও চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা লাভ করি কাঙ্ক্ষিত বিজয়। হাতে পাই সবুজ-লালের মিশ্রণে তৈরি একটি পতাকা, একটি গর্বিত স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ড। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর সাধারণ নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয়ছট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান – এ রকম অগণিত আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি যে প্রত্যাশা লালন করে অগ্রসর হয়েছিল, তারপর একাত্তরের রক্তাক্ত মার্চের অসহযোগ আন্দোলন পেরিয়ে ২৬ মার্চে সেই প্রত্যাশা, সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায়।

স্বাধীনতার দৃপ্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেদিন নিপীড়িত ও বঞ্চিত বাঙালি জনগণের শোষণমুক্তির প্রত্যাশা অর্জন করেছিল এক নতুন দিকনির্দেশনা, নতুন মাত্রা। সে দিন স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সমগ্র জাতি একাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামে। বাঙালি ছিল শোষিত, অত্যাচারিত ও সব ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। দেশের অর্থসম্পদ, চাকরির সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসাবাণিজ্য সবই একচেটিয়া করত পাকিস্তানিরা। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি ব্রিটিশ শাসনামলের মতোই পশ্চিম পাকিস্তানের কৃপার পাত্র হয়ে পড়েছিল। এমনকি বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের চিরদিনের মতো দাস করে দেয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয় উর্দুকে। কিন্তু বীর বাঙালি তা সহ্য করেনি – প্রতিবাদে, সংগ্রামে, আন্দোলনে নস্যাৎ করে দিয়েছিল তাদের সে ষড়যন্ত্র। অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়ে শঙ্কিত পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে যে টালবাহানা শুরু করেছিল তাতেই বাঙালি বুঝতে সক্ষম হয় যে, এরা বাঙালিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তখনই ছিঁড়ে যায় দুর্বল ঐক্যের রশিটা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য মানসিক ও বাস্তব প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। ২৬ মার্চ আসে সেই সুযোগ, স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা এবং বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরোধ। তাই এ দিন আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহালগ্ন। 

ইতিহাসের আলোকেই জানা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, সেই দেশটির নাম বাংলাদেশ। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথাটি মনে পড়ে, তা হলো— এই দেশের অসংখ্য ‘দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মদান’। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার সমস্ত মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের গ্লানি থেকেই মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। লাখ লাখ শহীদের রক্তে রাঙানো স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচেয়ে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। সুতরাং ২৬ মার্চ, আমাদের ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’।

১৯৭২ সাল থেকেই এ দেশে স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের একটি বিশেষ দিন। এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মূল্যায়ন করে চিত্রশিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, কবিতায়, নিবন্ধ বা গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমেই যেন গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তুলেছে। এমন দিন উপলক্ষেই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারেও স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের নানা আয়োজন হয়। তা ছাড়াও দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজসহ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশের প্রধান সড়কগুলো জাতীয় পতাকা দিয়েও সাজিয়ে থাকে। এই দিনে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয়া স্বাধীন-সার্বভৌম এদেশ আজ গর্বের দেশ। বলতেই হয়, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করার এ গৌরবময় দিনটিই যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবেই সমাদৃত।

বঙ্গবন্ধুর কীর্তি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। অনেক তুচ্ছ ও অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক বাস্তবতা ও সত্যকে আড়াল করতে চাইলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। ইতিহাসের সব মহানায়কই স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু সে মহাপুরুষ, মহাকর্মীদের একজন। বাঙালির মধ্যে জাতি গঠনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি যে জাতীয় ঐক্যের ও রাষ্ট্রের রাজপথ তৈরি করে গেছেন সেটিই তার অক্ষয় কীর্তি এবং সেখানেই তার অমরত্ব। তার এই দেশপ্রেম ও ঐতিহাসিক কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় অনুপ্রাণিত ও মনোযোগী হয়ে দেশের জন্য কাজ করা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কে কিভাবে লিখবেন, বলা সম্ভব নয়। তবে ইতিহাসে অবশ্যই এ অনুপস্থিত সেনানায়ক তার প্রাপ্য মর্যাদা পাবেন তাতে সন্দেহ নেই।

একাত্তরের এই ৯ মাসে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অগণিত মানুষ, যাদের নিজেদের নিরাপত্তা ছিল না, যারা প্রতিদিন প্রতি রাতে দেখেছে চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা বন্দী বাঙালি যুবকের নিশ্চিত মৃত্যুর পথে চলে যাওয়া। প্রতিটি গেরিলা যুবক, কৃষকের সন্তান, জীবন পণ করে যারা লড়েছে বাংলার গ্রামে, জঙ্গলে; তারা জেনেছে কে তাদের প্রেরণা। কার মন্ত্রধ্বনি তাদের এই যুদ্ধে নামতে উৎসাহিত করেছে। এ সত্যকে কোনো ইতিহাসবিদ অস্বীকার করতে পারবে না। নতুন শতাব্দীতে আমরা নিশ্চয়ই হিসাবের খাতা এবং জমাখরচের খাতা খুলেছি। আমরা কোথায় লাভবান হয়েছি আর কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তার একটি প্রাথমিক খতিয়ান আমরা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন দুর্জয় নেতৃত্বের জন্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র যাই থাকুক না কেন – বাংলাদেশের জনগণের হৃদয় থেকে শেখ মুজিবকে মুছে ফেলার সাধ্য কারো নেই। বাংলাদেশ যতকাল থাকবে শেখ মুজিবও ততকাল স্বাধীনতার মহান স্থপতি হিসেবে জনগণের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম। আমাদের জাতীয় দিবস হিসেবে যতগুলো দিন রয়েছে, স্বাধীনতা দিবস তার মধ্যে অন্যতম। এ দিনটি শুধু ঐতিহাসিক তাৎপর্যেই অসাধারণ নয়, নবীন জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার শপথে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করার দিন হিসেবেও অনন্য। দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি একটি মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ওপর প্রায় দুই যুগব্যাপী যে নিপীড়ন ও শোষণের সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে বাঙালি একত্র হয়েছিল এই দিনে। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলো। দীর্ঘ এই ৫০ বছরে ইতিহাসের পাতায় আছে পাওয়া-না-পাওয়ার শত কথা। অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে আগামীর দিনে নতুন প্রত্যাশায় এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের প্রত্যেক মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে যেতে হবে। কেননা, এই দেশ বঙ্গবন্ধুর, এ দেশ বাঙালির, এ দেশ আমার আপনার সবার। তাই দেশের উন্নয়নে সবাইকে দেশপ্রেমী হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সাবেক উপমহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশ: ০৭:২০:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ মার্চ ২০২২

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। যে মহানায়কের জন্ম না হলে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় কখনো ঘটত না এবং বাঙালি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না, তিনিই শেখ মুজিবুর রহমান।

বাঙালিরা তাকে ভালোবেসে বঙ্গবন্ধু অভিধায় ভূষিত করেছে। দেখতে দেখতে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেল। লাখো শহীদের প্রাণের বিনিমিয়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। রমনা রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মুক্তিপাগল বাঙালিকে লক্ষ করে বঙ্গবন্ধু সে দিন ঘোষণা করেছিলেন – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ওই ভাষণে তিনি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের নাগপাশ ছিন্ন করে বাংলাদেশ অর্জনের জন্য ‘যার যা আছে, তাই নিয়ে’ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন।

লক্ষণীয় যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক হরতালের ফলে খেটে খাওয়া গরিব মানুষের যাতে রুজি রোজগার বন্ধ না হয় সে জন্য বঙ্গবন্ধু হরতালের মধ্যেও রিকশা ও ঠেলাগাড়ি চলার অনুমতি দিয়েছিলেন। এ থেকে গরিবদের জন্য জাতির পিতার আন্তরিক সমবেদনার প্রমাণ মিলেছে। ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ গভীর রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

একাত্তরের হত্যাযজ্ঞ বিষয়ে অন্যতম গবেষক রবার্ট পাইন তার ম্যাসাকার গ্রন্থে বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ৯ মাসে এক কোটি মানুষ ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যায়। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ভাষ্যমতে, ‘বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, এই গণহত্যার মূল টার্গেট কারা ছিল। টার্গেট ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা, পুলিশ, প্যারামিলিটারি, আনসার ও মুজাহিদ। এ ছাড়া বাঙালি হিন্দু, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক, তরুণ ছাত্রছাত্রী বিশেষত যারা প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নিতে পারে। টার্গেট আরো ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবী, যেমন – অধ্যাপক ও শিক্ষক।’ আর জে রোমেল তার ডেথ বাই গভর্নমেন্ট গ্রন্থে লিখেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা বেছে বেছে কেবল ওই সব যুবা তরুণদেরই টার্গেট করেছে, যারা যেকোনো সময় প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এসব তরুণকে বন্দী করে বা তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যেত না। এসব ছেলেদের এবং দৈহিক অত্যাচার করা তরুণীদের দেহ কখনো পাওয়া যেত মাঠে, নদীর স্রোতে, অথবা কোনো আর্মি ক্যাম্পের পাশে।’

স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা অকস্মাৎ সৃষ্ট কোনো আবেগময় ঘোষণা নয়। এর পেছনে রয়েছে বাঙালির আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জন ও আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত পথ। এই অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে এই দিনে বাঙালি জাতি আরেক রক্তাক্ত পথে চলতে শুরু করল। অতঃপর দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ, সংগ্রাম, মৃত্যু, লাঞ্ছনা ও চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা লাভ করি কাঙ্ক্ষিত বিজয়। হাতে পাই সবুজ-লালের মিশ্রণে তৈরি একটি পতাকা, একটি গর্বিত স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ড। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর সাধারণ নির্বাচন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয়ছট্টির ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান – এ রকম অগণিত আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি যে প্রত্যাশা লালন করে অগ্রসর হয়েছিল, তারপর একাত্তরের রক্তাক্ত মার্চের অসহযোগ আন্দোলন পেরিয়ে ২৬ মার্চে সেই প্রত্যাশা, সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায়।

স্বাধীনতার দৃপ্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেদিন নিপীড়িত ও বঞ্চিত বাঙালি জনগণের শোষণমুক্তির প্রত্যাশা অর্জন করেছিল এক নতুন দিকনির্দেশনা, নতুন মাত্রা। সে দিন স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সমগ্র জাতি একাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামে। বাঙালি ছিল শোষিত, অত্যাচারিত ও সব ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। দেশের অর্থসম্পদ, চাকরির সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসাবাণিজ্য সবই একচেটিয়া করত পাকিস্তানিরা। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি ব্রিটিশ শাসনামলের মতোই পশ্চিম পাকিস্তানের কৃপার পাত্র হয়ে পড়েছিল। এমনকি বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের চিরদিনের মতো দাস করে দেয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয় উর্দুকে। কিন্তু বীর বাঙালি তা সহ্য করেনি – প্রতিবাদে, সংগ্রামে, আন্দোলনে নস্যাৎ করে দিয়েছিল তাদের সে ষড়যন্ত্র। অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়ে শঙ্কিত পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে যে টালবাহানা শুরু করেছিল তাতেই বাঙালি বুঝতে সক্ষম হয় যে, এরা বাঙালিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তখনই ছিঁড়ে যায় দুর্বল ঐক্যের রশিটা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য মানসিক ও বাস্তব প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। ২৬ মার্চ আসে সেই সুযোগ, স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা এবং বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরোধ। তাই এ দিন আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহালগ্ন। 

ইতিহাসের আলোকেই জানা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়, সেই দেশটির নাম বাংলাদেশ। এ স্বাধীনতা দিবসের আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তের মধ্যে প্রথমেই যে কথাটি মনে পড়ে, তা হলো— এই দেশের অসংখ্য ‘দেশপ্রেমিক শহীদের আত্মদান’। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলার সমস্ত মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের গ্লানি থেকেই মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। লাখ লাখ শহীদের রক্তে রাঙানো স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। তাই এ দেশের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবস সবচেয়ে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। সুতরাং ২৬ মার্চ, আমাদের ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’।

১৯৭২ সাল থেকেই এ দেশে স্বাধীনতা দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের একটি বিশেষ দিন। এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মূল্যায়ন করে চিত্রশিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, কবিতায়, নিবন্ধ বা গণমাধ্যমসহ নানা মাধ্যমেই যেন গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তুলেছে। এমন দিন উপলক্ষেই বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জাতীয় প্যারেড স্কোয়ারেও স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের নানা আয়োজন হয়। তা ছাড়াও দেশের প্রতিটি উপজেলায় স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজসহ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেশের প্রধান সড়কগুলো জাতীয় পতাকা দিয়েও সাজিয়ে থাকে। এই দিনে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয়া স্বাধীন-সার্বভৌম এদেশ আজ গর্বের দেশ। বলতেই হয়, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করার এ গৌরবময় দিনটিই যেন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবেই সমাদৃত।

বঙ্গবন্ধুর কীর্তি সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। অনেক তুচ্ছ ও অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক বাস্তবতা ও সত্যকে আড়াল করতে চাইলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। ইতিহাসের সব মহানায়কই স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে গেছেন। বঙ্গবন্ধু সে মহাপুরুষ, মহাকর্মীদের একজন। বাঙালির মধ্যে জাতি গঠনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে তিনি যে জাতীয় ঐক্যের ও রাষ্ট্রের রাজপথ তৈরি করে গেছেন সেটিই তার অক্ষয় কীর্তি এবং সেখানেই তার অমরত্ব। তার এই দেশপ্রেম ও ঐতিহাসিক কর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনায় অনুপ্রাণিত ও মনোযোগী হয়ে দেশের জন্য কাজ করা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কে কিভাবে লিখবেন, বলা সম্ভব নয়। তবে ইতিহাসে অবশ্যই এ অনুপস্থিত সেনানায়ক তার প্রাপ্য মর্যাদা পাবেন তাতে সন্দেহ নেই।

একাত্তরের এই ৯ মাসে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অগণিত মানুষ, যাদের নিজেদের নিরাপত্তা ছিল না, যারা প্রতিদিন প্রতি রাতে দেখেছে চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা বন্দী বাঙালি যুবকের নিশ্চিত মৃত্যুর পথে চলে যাওয়া। প্রতিটি গেরিলা যুবক, কৃষকের সন্তান, জীবন পণ করে যারা লড়েছে বাংলার গ্রামে, জঙ্গলে; তারা জেনেছে কে তাদের প্রেরণা। কার মন্ত্রধ্বনি তাদের এই যুদ্ধে নামতে উৎসাহিত করেছে। এ সত্যকে কোনো ইতিহাসবিদ অস্বীকার করতে পারবে না। নতুন শতাব্দীতে আমরা নিশ্চয়ই হিসাবের খাতা এবং জমাখরচের খাতা খুলেছি। আমরা কোথায় লাভবান হয়েছি আর কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তার একটি প্রাথমিক খতিয়ান আমরা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন দুর্জয় নেতৃত্বের জন্যই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র যাই থাকুক না কেন – বাংলাদেশের জনগণের হৃদয় থেকে শেখ মুজিবকে মুছে ফেলার সাধ্য কারো নেই। বাংলাদেশ যতকাল থাকবে শেখ মুজিবও ততকাল স্বাধীনতার মহান স্থপতি হিসেবে জনগণের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম। আমাদের জাতীয় দিবস হিসেবে যতগুলো দিন রয়েছে, স্বাধীনতা দিবস তার মধ্যে অন্যতম। এ দিনটি শুধু ঐতিহাসিক তাৎপর্যেই অসাধারণ নয়, নবীন জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার শপথে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করার দিন হিসেবেও অনন্য। দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি একটি মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ওপর প্রায় দুই যুগব্যাপী যে নিপীড়ন ও শোষণের সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে বাঙালি একত্র হয়েছিল এই দিনে। আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হলো। দীর্ঘ এই ৫০ বছরে ইতিহাসের পাতায় আছে পাওয়া-না-পাওয়ার শত কথা। অতীতের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে আগামীর দিনে নতুন প্রত্যাশায় এগিয়ে যেতে হবে আমাদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শকে ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশের প্রত্যেক মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে যেতে হবে। কেননা, এই দেশ বঙ্গবন্ধুর, এ দেশ বাঙালির, এ দেশ আমার আপনার সবার। তাই দেশের উন্নয়নে সবাইকে দেশপ্রেমী হয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।