জীবনী: গোবর গুহ কে এবং কেন বিখ্যাত?
- প্রকাশ: ১২:২৭:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ এপ্রিল ২০২২
- / ১২৯৫ বার পড়া হয়েছে
গোবর গুহ ছিলেন এক বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় কুস্তিগীর ও পালোয়ান। ব্রিটিশরা তার নামের শেষাংশ উচ্চারণ করত ‘গোহ’, এতে তার নাম হয়ে যায় ‘গোবর গোহ’। গোবর গুহ-এর আসল নাম যতীন্দ্রচরণ গুহ।
গোবর গুহ প্রথম এশীয় কুস্তিগির যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্ব লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন, এটি ১৯২১ সালের ঘটনা।
গোবর গুহর জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
গোবর গুহ ছিলেন এক কুস্তিগীর বংশের সন্তান। কলকাতার গুহ পরিবার শরীরচর্চা ও শরীরচর্চার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য পরিচিত ছিলেন। গোবর গুহর পিতামহের পিতামহ শিবচরণ গুহ আধুনিক বঙ্গের প্রথম আখড়াটি স্থাপন করেন কলকাতার হোগোলকুঁড়িয়ায়, বর্তমান শোভাবাজার মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে। পিতামহ অম্বিকাচরণ গুহ বা অম্বু গোহ ছিলেন ভারতবিখ্যাত কুস্তিগীর। তিনি ছিলেন বাংলার আখড়া সংস্কৃতির প্রচলনের পথিকৃৎ। স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও বাঘাযতীন আসতেন তাঁর আখড়ায় কুস্তি শিখতে। পিতা রামচরণ গুহও ছিলেন কুস্তিগীর। গোবর গুহর জ্যাঠা ক্ষেত্রচরণ গুহ ওরফে খেতু গোহ ছিলেন ভারতবিখ্যাত কুস্তিগির।
গোবর গোহে জন্ম ১৮৯২ সালের ১৩ মার্চ কলকাতার মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের এই বিখ্যাত কুস্তিগির পরিবারে। ছোটবেলায় তাঁর নাদুসনুদুস চেহারা দেখে পিতামহ অম্বুবাবু তাঁকে রসিকতা করে ‘গোবরের ড্যালা’ বলতেন। সেই থেকে তাঁর ডাকনাম হয় গোবর। পিতামহের রসিকতায় গোবরের জেদ চেপে যায়। তিনি পিতামহের কাছেই প্রথমিক অনুশীলন শুরু করেন। তাঁর পিতা ও খুল্লতাত চেতুবাবুর কাছেও তিনি কুস্তির শিক্ষা নেন। তারপর কঠোর অনুশীলন শুরু করেন গুহ পরিবাবের আখড়াতেই কর্মরত নামকরা কুস্তিগীর খোলসা চৌবে ও রহমানি পালোয়ানের নিকট।
১৯১০ সালে মেট্রোপলিটন স্কুল থেকে গোবর থেকে এন্ট্রান্স পাশ করলেন ও ডাকযোগে সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। আঠারো বছরের গোবর গুহর উচ্চতা তখন ছয় ফুট এক ইঞ্চি ও ওজন ২৯০ পাউন্ড। তাঁর স্ফীত ছাতি হয় ৪৮ ইঞ্চি। সেই বয়সেই তিনি শুরু করলেন পেশাদার কুস্তিগিরের জীবন।
পেশাদার কুস্তির মাধ্যমে যেভাবে বিখ্যাত হলেন গোবর গুহ
১৯১০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে গোবর গুহ পেশাদার কুস্তিগীর হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তার প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বী ত্রিপুরার মহারাজার সভা পালোয়ান নবরঙ সিংহ, যদিও এর জন্য তিনি কোনো অর্থ পাননি।
১৯১০ সালেই লন্ডনের জন বুল সোসাইটি কুস্তির এক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করে। সেখানে বিশ্বের সমস্ত নামকরা কুস্তিগীরদের আমণ্ত্রন করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন গামা পালোয়ান ও গোবর গুহ। সেবারের ইউরোপ যাত্রাকালে গোবর ইংল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও ইতালিতে বিভিন্ন কুস্তিগীরদের সাথে লড়েন।
গোবর গুহ দ্বিতীয়বার ইউরোপ যাত্রা করেন ১৯১২ সালে। এই যাত্রায় গোবর প্যারিসে একটি কুস্তি প্রতিযোগিতায় বিশ্বের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হেভিওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়নের বিরুদ্ধে লড়েন। এর পরে তিনি স্কটল্যান্ডের সেরা কুস্তিগীর ক্যাম্পবেলকে পরাস্ত করেন। তার পর তিনি লড়েন স্কটল্যান্ডের আর এক বিখ্যাত কুস্তিগীর জিমি এসনের বিরুদ্ধে। কুস্তির পালাতে এসন সর্বক্ষণ বেআইনিভাবে মুষ্টি চালনা করা সত্ত্বেও গোবর গুহ এসনকে ভুপতিত করতে সমর্থ হন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ১৯১৫ সালে দেশে ফিরে আসেন।
যুদ্ধের পর ১৯২০ সালে গোবর ইউরোপ ও আমেরিকা যাত্রা করেন। আমেরিকায় তিনি বিশ্ব পেশাদার কুস্তি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেন। সান ফ্রান্সিস্কোর কলিসিয়ামে অনুষ্ঠিত উক্ত প্রতিযোগিতায় তদানীন্তন লাইট হেভিওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অ্যাড সান্তেলকে পরাস্ত করেন এবং প্রথম এশীয় হিসেবে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব পান। এর পর তিনি এড লুইসের বিরুদ্ধে লড়েন, যাকে সর্বকালের সেরা পেশাদার কুস্তিগীর মানা হয়। লুইস গোবরের উপর বারংবার হেডলক পদ্ধতি ব্যবহার করে অকৃতকার্য হন। কয়েক রাউন্ড পর লুইস একবার গোবর গুহকে ভূপতিত করেন এবং গোবর গুহও একবার লুইসকে ভূপতিত করেন। এর পর লুইস বেআইনিভাবে মুষ্টি চালনা করলেও বিচারকরা তা উপেক্ষা করেন। গোবর বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে লুইস অতর্কিতে তাকে আক্রমণ করে ভূপতিত করলে গোবর অচৈতন্য হয়ে পড়েন। এর পর গোবর গুহ ইউরোপ ও আমেরিকার নানা স্থানে কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি সফর শেষ করে দেশে ফেরেন।
১৯২৯ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে গোবর এবং ছোটো গামার মধ্যে এক স্মরণীয় লড়াই হয়। লড়াইয়ে দুই কুস্তিগীরই ভারতীয় কুস্তির সমস্ত কৌশলের প্রদর্শন করেন। লড়াই অমীমাংসিতভাবে শেষ হলেও টেকনিকাল কারণে ছোটো গামাকে জয়ী ঘোষণা করা হয়।
কুস্তির পাশাপাশি গোবর গুহ তাদের পারিবারিক আখড়ার পরিচালনাও করতেন। ১৯৩৬ সালে তিনি মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের আখাড়াকে উঠিয়ে নিয়ে এসে হেদুয়ার কাছে গোয়াবাগান স্ট্রীটে স্থাপন করেন। ১৯৪৪ সালে গোবর পেশাদার কুস্তি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রভাব
গোবর গুহ ভারতীয় কুস্তিকে বিশ্বের দরবারে এক উচ্চ স্থানে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভারতীয় কুস্তির রীতিতে বহু নতুন প্যাঁচের উদ্ভাবন করেন। তার উদ্ভাবিত ধোঁকা, টিব্বি, গাধানেট, ঢাক, টাং, পাট, ধোবা পাট, কুল্লা, রদ্দা, নেলসান ইত্যাদি ভারতীয় কুস্তি রীতিতে সংযোজিত হয়। তার সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি হল রদ্দা।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই কলকাতায় আখড়া সংস্কৃতি ও কুস্তির প্রচলন হয়। কিন্তু তা মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেনি। তখনও পর্যন্ত কুস্তিকে পঞ্জাবী মুসলমানদের একচেটিয়া বলে মনে করা হত। বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে প্রধানতঃ গোবর গুহর সফল্যেই মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু সমাজের মধ্যে কুস্তির প্রচলন হয়। গোবর গুহর আখড়ায় কুস্তি করতে আসতেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মান্না দে প্রমুখ। ব্যায়ামবীরদের মধ্যে নীলমণি দাস, বিষ্ণুচরণ ঘোষ, মনোহর আইচ, মনতোষ রায় প্রত্যকেই আসতেন তার আখড়ায়। ১৯৫২ অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী কুস্তিগীর খাশাবা দাদাসাহেব যাদব গোবর গুহর আখড়াতেই কুস্তির পাঠ নিয়েছিলেন। গোবর গুহর ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বনমালী ঘোষ, জ্যোতিষচরণ ঘোষ ও বিশ্বনাথ দত্ত।
মৃত্যু
১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন গোবক্র গুহ।
স্মৃতিতে গোবর গুহ
১৯৯২ সালে গোবর গুহর অনুগামীরা তার আখড়ায় তার জন্মশতবার্ষিকী পালন করেন। ১৯৯৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল রঘুনাথ রেড্ডি কলকাতার আজাদ হিন্দ বাগে গোবর গুহর আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করেন। পরবর্তীকালে গোয়াবাগান স্ট্রিটের নাম পাল্টে ‘গোবর গুহ সরণি’ রাখা হয়।