০১:৩৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিক্ষকের মর্যাদা ও নিরাপত্তা কোথায়

মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশ: ০৩:৪৪:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ এপ্রিল ২০২২
  • / ২৪৪৯ বার পড়া হয়েছে

শিক্ষক


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হোক তা সচেতন সবাই চাই। আবার শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ হওয়াশ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে একজন শিক্ষককে সে ধরনের ভূমিকায় সমাজ দেখতে চায়। কিন্তু ইদানীং সব ঘটনাকে ছাপিয়ে একটি বিষয় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখছি। দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকগণ কমিটির সদস্যদের হাতে, কিংবা রাজনৈতিক কোনো নেতার হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতেও নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।

এটা কেমন কথা? একজন শিক্ষক তা সে যেকোনো পর্যায়েরই হোক, যেকোনো বিষয়েরই হোক তিনি শিক্ষকই। তার গায়ে মানুষ কীভাবে হাত তোলে? আর সমাজ ও রাষ্ট্র সেসব নিয়ে রাজনীতি করে, বিচার না করে কালক্ষেপণ করে? শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শন করাই ছিল যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ রীতি। আজকের পশ্চিমা দুনিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান অনেক বেড়েছে। আর শিক্ষকের গায়ে হাত দেওয়া তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাহলে আমাদের সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে শেখাই কীভাবে তারা একটি শ্রেণিকক্ষকে, বিদ্যালয়ের পরিবেশকে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপাদ রাখবেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। একটি শ্রেণিকক্ষ কীভাবে সকল ধরনের শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ করা যায়, সকল শিক্ষার্থী যাতে নির্ভয়ে, কোনো ধরনের ইতস্তত না করে শ্রেণিকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে সে ধরনের একটি পরিবেশ একজন শিক্ষককে তৈরি করতে হয়। এ ধরনের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে সাহস জোগাবে, কোনো কিছু না বুঝলে সত্যিকারভাবে বোঝার জন্য শিক্ষকের শরণাপন্ন হবে, শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দেবে না, ক্লাসে আসার জন্য উদগ্রীব থাকবে, শিক্ষা হবে আনন্দময়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেখে নিজের দুঃখের কথা ভুলে যাবেন। শিক্ষার্থীদের সাথে যে বন্ধুত্বপূর্ণ, হৃদ্য সম্পর্ক এবং বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে সেটি শ্রেণিকার্যক্রম থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে, আপনি শ্রেণিকক্ষে কিংবা বিদ্যালয়ে আছেন শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদের সহায়তা করার জন্য, তাদের কথা শোনার জন্য এবং তাদের গল্প জানার জন্য। তাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে। তাদের পছন্দ-অপছন্দ জানতে হবে, কীসে তারা মজা পায়, কীসে তারা ভয় পায় এগুলো জানা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে এবং শ্রেণিকক্ষেই প্র্যাকটিস করাতে হবে যে, একে অপরকে কীভাবে সম্মান করতে হয়। একজন শিক্ষার্থী যদি কোনো ভুল উত্তরও দেয়, তাহলে কেউ যাতে তাকে হাসি-ঠাট্টার পাত্র না বানায়, তাকে ক্লাসে লজ্জা না দেয়। বোঝাতে হবে যে আমরা সবাই এখানে একে অপরের কাছ থেকে শেখার জন্য এসেছি। আমরা ভুল করে করে শিখি। সহনশীলতার অভ্যাস শ্রেণিকক্ষ থেকেই অনুশীলন করাতে হবে। তাহলে দুর্বল ছেলেটি, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী, লাজুক শিক্ষার্থীও শ্রেণিকক্ষকে নিরাপদ মনে করবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতি যতটা হাসিখুশি রাখতে পারব তাদের কাছ থেকে তার চেয়েও বেশি হাসিখুশি প্রফুল্ল মন আমরা দেখতে পাব।   শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সবসময়ই অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেওয়া ঠিক হবে না। যখন টেনশন কাজ করে, পরীক্ষার আগে, হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটে গেলেও দুঃখ ভুলে হাসতে পারার অভ্যাসটা করতে হবে। তাহলে পরিবেশ হালকা হয় যা শিখন-শেখানো পরিবেশ ফিরিয়ে আনে। কিছু কিছু বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিকট কারাগারের মতো মনে হয়। শিক্ষার্থীরা সেখানে  কথা বলতে পারে না, আনন্দ করতে পারে না। কঠিন শাসন, পান থেকে চুন খসলে ধমক, তিরস্কার, লজ্জা দেওয়া ও শারীরিক শাস্তি প্রদান করা হয়। আবার কিছু কিছু বিদ্যালয় আছে যেখানে নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই। শিক্ষকদের কথা শিক্ষার্থীরা শোনে না, শিক্ষার্থীরা যা ইচ্ছে তাই করে। শিক্ষকদের কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন করে না। এ দুটো পরিস্থিতিই কিন্তু চরম। এই চরম অবস্থা যেসব বিদ্যালয়ে বিরাজ করে সেখানে পড়াশোনা হয় না, শিখন-শেখানো পরিবেশ বিরাজ করে না।

উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আমরা এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আলোচনা করি। কিন্তু শিক্ষক নিজেই যদি শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন; তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। কথাটি বারবার মনে আসছে। বিদ্যালয় তো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের অংশগ্রহণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমাদের শিক্ষকসমাজের কর্মপরিবেশ এবং কর্মসন্তুষ্টির মাত্রার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তটস্থ থাকেন শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতায়, যা তাদের কর্মস্পৃহাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।

অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কী হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের? কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সভ্যতাকে, জাতিকে টিকিয়ে রাখবে; যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের পদে পদে অপদস্থ হতে হচ্ছে সমাজের বখাটেদের কাছে? গত ১৩ এপ্রিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জোহরের নামাজ শেষে কলেজ মসজিদ থেকে বের হয়ে কয়েকজন যুবককে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালানোরত দেখতে পান। ফলে স্বীয় দায়িত্ববোধ থেকেই অধ্যক্ষ মহোদয় যুবকদের থামিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে এভাবে বাইক চালাতে নিষেধ করেন। এতেই যুবকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। এরা কাদের সন্তান? বুঝতে কষ্ট হয় না। এরা জানে যে, এদের কিছু হবে না। এরা এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটিয়েছে। একজন শিক্ষক তো শুধু ক্যাম্পাসের নয়, সমাজের নেতা, সমাজের অভিভাবক। তিনি সমাজে যেকোনো ধরনের অঘটন ঘটতে দেখলে বাধা দেবেন, এটিই তার ধর্ম, এটিই তার কর্ম, এজন্যই তিনি শিক্ষক। কিন্তু কী হয়েছে আমাদের সমাজের? 

গত ৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগত অন্য কলেজের কয়েক শিক্ষক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সম্মানে বিভাগের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে খাবারের আয়োজন করা হয়। ওই খাবার অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায়, একটি ছাত্র সংগঠনের কলেজ শাখার সভাপতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ২০-২৫ জন কর্মীসহ বাংলা বিভাগে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বাকবিত-ায় লিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। এরপরও পুলিশ এই ঘটনায় মামলা নেয়নি।

আর পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেওয়ার  অপরাধে সারা দেশেই হেনস্তা করা হচ্ছে বহু শিক্ষককে। এসব ঘটনায় ছুরিকাঘাতও করা হয়েছে শিক্ষকদের। এসব ক্ষেত্রে মামলা নেওয়া হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনেছে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণে বিষয়টি। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ইতিমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গেছে।

হৃদয় মন্ডল নামে একজন শিক্ষক টানা ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর ১০ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এটা এমন স্পর্শকাতর বিষয় যাতে সবাইকে দ্রুত ক্ষেপানো যায়। তিনি আসলে কি করেছিলেন সেটি ভাবার আগেই যেহেতু ধর্ম নিয়ে কথা তাই সবাই ক্ষেপে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেছে। তার ওপর আক্রমণ মানে গোটা শিক্ষক সমাজের ওপর আক্রমণ।   একজন শিক্ষক যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, যেকোনো ধর্মেরই হোক না কেন তিনি কখনই অন্য ধর্মের অবমাননা করবেন না। ঘটনা ঘটার পরপরই আমরা তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু যারা পানি ঘোলাটে করে মাছ শিকার করতে চায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাদের বিষয়ে চিন্তা করে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, লাগামহীনভাবে ঘটনাগুলো ঘটতে দেয়। হৃদয় ম-লকে যথাসময়ে উদ্ধার করে পুলিশ একটি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পুলিশ তো সর্বত্র ও সবসময় শিক্ষকদের এভাবে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকেই কাজটি করতে হবে। ১৯ দিন কারাবাসের পর কারাগারের ছোট ফটক দিয়ে যখন হৃদয় ম-ল বের হলেন তার মাথা নিচু করে, সেটি কিন্তু গোটা শিক্ষক সমাজেরই মাথা নিচু হওয়ার ইঙ্গিত বা প্রতীক। এটি কোনো সমাজে হতে দেওয়া ঠিক নয়।  

আমাদের সংসদে অনেক কিছুই আলোচনা হয়, আমি অনুরোধ করব একটি আইন যাতে পাস করা হয় যে, কোনো পর্যায়ের কোনো শিক্ষকের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ করার চেষ্টাও করে সেটি হবে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সর্বাগ্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে যে পচন ধরেছে এ সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই পচন দূর করতে হলে শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)। সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর- ভাব বাংলাদেশ এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞ -ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। ইমেইল: [email protected]

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শিক্ষকের মর্যাদা ও নিরাপত্তা কোথায়

প্রকাশ: ০৩:৪৪:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ এপ্রিল ২০২২

শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হোক তা সচেতন সবাই চাই। আবার শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ হওয়াশ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে একজন শিক্ষককে সে ধরনের ভূমিকায় সমাজ দেখতে চায়। কিন্তু ইদানীং সব ঘটনাকে ছাপিয়ে একটি বিষয় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় দেখছি। দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকগণ কমিটির সদস্যদের হাতে, কিংবা রাজনৈতিক কোনো নেতার হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতেও নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।

এটা কেমন কথা? একজন শিক্ষক তা সে যেকোনো পর্যায়েরই হোক, যেকোনো বিষয়েরই হোক তিনি শিক্ষকই। তার গায়ে মানুষ কীভাবে হাত তোলে? আর সমাজ ও রাষ্ট্র সেসব নিয়ে রাজনীতি করে, বিচার না করে কালক্ষেপণ করে? শিক্ষকদের সম্মান প্রদর্শন করাই ছিল যুগ যুগ ধরে আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ রীতি। আজকের পশ্চিমা দুনিয়ায় শিক্ষকদের সম্মান অনেক বেড়েছে। আর শিক্ষকের গায়ে হাত দেওয়া তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাহলে আমাদের সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে শেখাই কীভাবে তারা একটি শ্রেণিকক্ষকে, বিদ্যালয়ের পরিবেশকে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপাদ রাখবেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। একটি শ্রেণিকক্ষ কীভাবে সকল ধরনের শিক্ষার্থীর জন্য নিরাপদ করা যায়, সকল শিক্ষার্থী যাতে নির্ভয়ে, কোনো ধরনের ইতস্তত না করে শ্রেণিকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে সে ধরনের একটি পরিবেশ একজন শিক্ষককে তৈরি করতে হয়। এ ধরনের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে সাহস জোগাবে, কোনো কিছু না বুঝলে সত্যিকারভাবে বোঝার জন্য শিক্ষকের শরণাপন্ন হবে, শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দেবে না, ক্লাসে আসার জন্য উদগ্রীব থাকবে, শিক্ষা হবে আনন্দময়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেখে নিজের দুঃখের কথা ভুলে যাবেন। শিক্ষার্থীদের সাথে যে বন্ধুত্বপূর্ণ, হৃদ্য সম্পর্ক এবং বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে সেটি শ্রেণিকার্যক্রম থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে, আপনি শ্রেণিকক্ষে কিংবা বিদ্যালয়ে আছেন শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদের সহায়তা করার জন্য, তাদের কথা শোনার জন্য এবং তাদের গল্প জানার জন্য। তাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে। তাদের পছন্দ-অপছন্দ জানতে হবে, কীসে তারা মজা পায়, কীসে তারা ভয় পায় এগুলো জানা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে এবং শ্রেণিকক্ষেই প্র্যাকটিস করাতে হবে যে, একে অপরকে কীভাবে সম্মান করতে হয়। একজন শিক্ষার্থী যদি কোনো ভুল উত্তরও দেয়, তাহলে কেউ যাতে তাকে হাসি-ঠাট্টার পাত্র না বানায়, তাকে ক্লাসে লজ্জা না দেয়। বোঝাতে হবে যে আমরা সবাই এখানে একে অপরের কাছ থেকে শেখার জন্য এসেছি। আমরা ভুল করে করে শিখি। সহনশীলতার অভ্যাস শ্রেণিকক্ষ থেকেই অনুশীলন করাতে হবে। তাহলে দুর্বল ছেলেটি, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী, লাজুক শিক্ষার্থীও শ্রেণিকক্ষকে নিরাপদ মনে করবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা শিক্ষার্থীদের প্রতি যতটা হাসিখুশি রাখতে পারব তাদের কাছ থেকে তার চেয়েও বেশি হাসিখুশি প্রফুল্ল মন আমরা দেখতে পাব।   শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সবসময়ই অত্যন্ত সিরিয়াসলি নেওয়া ঠিক হবে না। যখন টেনশন কাজ করে, পরীক্ষার আগে, হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটে গেলেও দুঃখ ভুলে হাসতে পারার অভ্যাসটা করতে হবে। তাহলে পরিবেশ হালকা হয় যা শিখন-শেখানো পরিবেশ ফিরিয়ে আনে। কিছু কিছু বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিকট কারাগারের মতো মনে হয়। শিক্ষার্থীরা সেখানে  কথা বলতে পারে না, আনন্দ করতে পারে না। কঠিন শাসন, পান থেকে চুন খসলে ধমক, তিরস্কার, লজ্জা দেওয়া ও শারীরিক শাস্তি প্রদান করা হয়। আবার কিছু কিছু বিদ্যালয় আছে যেখানে নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই। শিক্ষকদের কথা শিক্ষার্থীরা শোনে না, শিক্ষার্থীরা যা ইচ্ছে তাই করে। শিক্ষকদের কোনো ধরনের সম্মান প্রদর্শন করে না। এ দুটো পরিস্থিতিই কিন্তু চরম। এই চরম অবস্থা যেসব বিদ্যালয়ে বিরাজ করে সেখানে পড়াশোনা হয় না, শিখন-শেখানো পরিবেশ বিরাজ করে না।

উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আমরা এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আলোচনা করি। কিন্তু শিক্ষক নিজেই যদি শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন; তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। কথাটি বারবার মনে আসছে। বিদ্যালয় তো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের অংশগ্রহণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর আমাদের শিক্ষকসমাজের কর্মপরিবেশ এবং কর্মসন্তুষ্টির মাত্রার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তটস্থ থাকেন শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতায়, যা তাদের কর্মস্পৃহাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।

অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কী হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের? কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সভ্যতাকে, জাতিকে টিকিয়ে রাখবে; যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের পদে পদে অপদস্থ হতে হচ্ছে সমাজের বখাটেদের কাছে? গত ১৩ এপ্রিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জোহরের নামাজ শেষে কলেজ মসজিদ থেকে বের হয়ে কয়েকজন যুবককে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালানোরত দেখতে পান। ফলে স্বীয় দায়িত্ববোধ থেকেই অধ্যক্ষ মহোদয় যুবকদের থামিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে এভাবে বাইক চালাতে নিষেধ করেন। এতেই যুবকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। এরা কাদের সন্তান? বুঝতে কষ্ট হয় না। এরা জানে যে, এদের কিছু হবে না। এরা এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটিয়েছে। একজন শিক্ষক তো শুধু ক্যাম্পাসের নয়, সমাজের নেতা, সমাজের অভিভাবক। তিনি সমাজে যেকোনো ধরনের অঘটন ঘটতে দেখলে বাধা দেবেন, এটিই তার ধর্ম, এটিই তার কর্ম, এজন্যই তিনি শিক্ষক। কিন্তু কী হয়েছে আমাদের সমাজের? 

গত ৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগত অন্য কলেজের কয়েক শিক্ষক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সম্মানে বিভাগের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে খাবারের আয়োজন করা হয়। ওই খাবার অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেওয়ায়, একটি ছাত্র সংগঠনের কলেজ শাখার সভাপতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ২০-২৫ জন কর্মীসহ বাংলা বিভাগে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে বাকবিত-ায় লিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। এরপরও পুলিশ এই ঘটনায় মামলা নেয়নি।

আর পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেওয়ার  অপরাধে সারা দেশেই হেনস্তা করা হচ্ছে বহু শিক্ষককে। এসব ঘটনায় ছুরিকাঘাতও করা হয়েছে শিক্ষকদের। এসব ক্ষেত্রে মামলা নেওয়া হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনেছে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণে বিষয়টি। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ইতিমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গেছে।

হৃদয় মন্ডল নামে একজন শিক্ষক টানা ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর ১০ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এটা এমন স্পর্শকাতর বিষয় যাতে সবাইকে দ্রুত ক্ষেপানো যায়। তিনি আসলে কি করেছিলেন সেটি ভাবার আগেই যেহেতু ধর্ম নিয়ে কথা তাই সবাই ক্ষেপে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেছে। তার ওপর আক্রমণ মানে গোটা শিক্ষক সমাজের ওপর আক্রমণ।   একজন শিক্ষক যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, যেকোনো ধর্মেরই হোক না কেন তিনি কখনই অন্য ধর্মের অবমাননা করবেন না। ঘটনা ঘটার পরপরই আমরা তা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু যারা পানি ঘোলাটে করে মাছ শিকার করতে চায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাদের বিষয়ে চিন্তা করে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, লাগামহীনভাবে ঘটনাগুলো ঘটতে দেয়। হৃদয় ম-লকে যথাসময়ে উদ্ধার করে পুলিশ একটি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পুলিশ তো সর্বত্র ও সবসময় শিক্ষকদের এভাবে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকেই কাজটি করতে হবে। ১৯ দিন কারাবাসের পর কারাগারের ছোট ফটক দিয়ে যখন হৃদয় ম-ল বের হলেন তার মাথা নিচু করে, সেটি কিন্তু গোটা শিক্ষক সমাজেরই মাথা নিচু হওয়ার ইঙ্গিত বা প্রতীক। এটি কোনো সমাজে হতে দেওয়া ঠিক নয়।  

আমাদের সংসদে অনেক কিছুই আলোচনা হয়, আমি অনুরোধ করব একটি আইন যাতে পাস করা হয় যে, কোনো পর্যায়ের কোনো শিক্ষকের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ করার চেষ্টাও করে সেটি হবে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সর্বাগ্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে যে পচন ধরেছে এ সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। এই পচন দূর করতে হলে শিক্ষকের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক।