ইদ-উল-ফিতর: শব্দ হিসেবে ইদ এবং ইদের নামাজ, প্রস্ততি, উৎসব ও ইতিহাস
- প্রকাশ: ০৩:৩৩:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২২
- / ১০০৬ বার পড়া হয়েছে
ইদ-উল-ফিতর বা ইদুল ফিতর হলো ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দুটো সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসবের একটি। দ্বিতীয়টি হলো ইদ-উল-আজহা। ধর্মীয় পরিভাষায় একে ইয়াওমুল জায়েজ বলা হয়। ‘ইয়াওমুল জায়েজ’-এর অর্থ হলো পুরস্কারের দিবস। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখা বা সিয়াম সাধনার পর মুসলমানেরা এই দিনটি ধর্মীয় কর্তব্যপালনসহ খুব আনন্দের সাথে পালন করে থাকে।
কোন ভাষায় ‘ইদ’ শব্দের প্রতিশব্দ কী?
বিভিন্ন ভাষায় ইদ—
- আচে ভাষায় ইদ: Uroë Raya Puasa Rojar Eid (রোজা ভাঙ্গার উৎসব)
- আলবেনীয়ভাষায় ইদ: Fitër Bajrami, Bajrami i madh (“বড়ো উৎসব”)
- আরবি ভাষায় ইদ: عيد الفطر ইদুল ফিতর
- বাংলা ভাষায় ইদ:রোজার ইদ, ইদুল ফিতর
- চীনা বা মান্দারিন ভাষায় ইদ: ঐতিহ্যগত: 開齋節; সরলীকৃত: 开斋节 / Kāi zhāi jié (উপবাস উৎসবের শেষ)
- গ্রিক ভাষায় ইদ: Σεκέρ Μπαϊράμ
- হিব্রু ভাষায় ইদ: עיד אל-פיטר
- হিন্দি ভাষায় ইদ: ईद उल-फ़ित्र (“ইদুল ফিতর”)
- সিলেটি ভাষায় ইদ: রোজার ইদ
- তামিল ভাষায় ইদ: நோன்பு பெருநாள் / Nōṉpu perunāḷ
ইদ কবে বা কত তারিখ?
হিজরি বর্ষপঞ্জী অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ইদ-উলফিতর উৎসব পালন করা হয়। তবে এই পঞ্জিকা অনুসারে কোনও অবস্থাতে রমজান মাস ৩০ দিনের বেশি দীর্ঘ হবে না। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তিতে শাওয়ালের প্রারম্ভ গণনা করা হয়। ইদের আগের রাতটিকে ইসলামি পরিভাষায় লাইলাতুল জায়জা (পুরস্কার রজনী) এবং চলতি ভাষায় “চাঁদ রাত” বলা হয়। শাওয়াল মাসের চাঁদ অর্থাৎ সূর্যাস্তে একফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিন ইদ হয়, এই কথা থেকেই চাঁদ রাত কথাটির উদ্ভব। ইদের চাঁদ স্বচক্ষে দেখে তবেই ইদের ঘোষণা দেয়া ইসলামী বিধান। আধুনিক কালে অনেক দেশে গাণিতিক হিসাবে ইদের দিন নির্ধারিত হলেও বাংলাদেশে ইদের দিন নির্ধারিত হয় দেশের কোথাও না-কোথাও চাঁদ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে। দেশের কোনো স্থানে স্থানীয় ভাবে চাঁদ দেখা গেলে যথাযথ প্রমাণ সাপেক্ষে ইদের দিন ঠিক করা হয়। মুসলমানদের জন্য ইদের পূর্বে পুরো রমজান মাস রোজা রাখা হলেও ইদের দিনে রোজা রাখা নিষিদ্ধ বা হারাম।
ইদের নামাজ
ইদের দিন ভোরে মুসলমানরা আল্লাহর ইবাদত করে থাকে। ইসলামিক বিধান অনুসারে ২ রাকাত ইদের নামাজ ৬ তাকবিরের সাথে ময়দান বা বড়ো মসজিদে পড়া হয়। ফযরের নামাজের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর ইদ-উলফিতরের নামাজের সময় হয়। এই নামাজ আদায় করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ইমাম কর্তৃক শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পূর্বে খুৎবা (ইসলামিক বক্তব্য) প্রদানের বিধান থাকলেও ইদের নামাজের ক্ষেত্রে তা নামাজের পরে প্রদান করার নিয়ম ইসলামে রয়েছে।
ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী ইদুল ফিতরের নামাজ শেষে খুৎবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা নামাজির জন্য ইসলামে ওয়াজিব।
সাধারণত ইদের নামাজের পরে মুসলমানরা সমবেতভাবে মুনাজাত করে থাকে এবং একে অন্যের সাথে কোলাকুলি করে ইদের সম্ভাষণ বিনিময় করে থাকে। ইদের বিশেষ শুভেচ্ছাসূচক সম্ভাষণটি হলো, “ইদ মুবারাক”।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো ইদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া নামক স্থানে।
ইদের প্রস্ততি
মুসলমানদের বিধান অনুযায়ী ইদের নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে একটি খেজুর কিংবা খোরমা অথবা মিষ্টান্ন খেয়ে রওনা হওয়া সওয়াবের (পুণ্যের) কাজ। ইদুল ফিতরের ব্যাপারে ইসলামী নির্দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে গোসল করা, মিসওয়াক করা, আতর-সুরমা লাগানো, এক রাস্তা দিয়ে ইদের মাঠে গমন এবং নামাজ-শেষে ভিন্ন পথে গৃহে প্রত্যাবর্তন। এছাড়া সর্বাগ্রে অযু-গোসলের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার বিধানও রয়েছে। ইসলামে নতুন পোশাক পরিধান করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বিভিন্ন দেশে তা বহুল প্রচলিত একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে।
ফিতরা
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমযান মাসের রোজার ভুলত্রুটির দূর করার জন্যে ইদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। ইদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করার বিধান রয়েছে। তবে ভুলক্রমে নামাজ পড়া হয়ে গেলেও ফিতরা আদায় করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। ফিতরার ন্যূনতম পরিমাণ ইসলামি বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট।
সাধারণত ফিতরা নির্দিষ্ট পরিমাণ আটা বা অন্য শস্যের (যেমন: যব, কিসমিস) মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব করা হয়। সচরাচর আড়াই সের আটার স্থানীয় মূল্যের ভিত্তিতে ন্যূনতম ফিতরার পরিমাণ নিরূপণ করা হয়। স্বীয় গোলামের ওপর মালিক কর্তৃক ফিতরা আদায়যোগ্য হলেও বাসার চাকর/চাকরানি অর্থাৎ কাজের লোকের ওপর ফিতরা আদায়যোগ্য নয়; বরং তাকে ফিতরা দেয়া যেতে পারে। ইসলামে নিয়ম অনুযায়ী, যাকাত পাওয়ার যোগ্যরাই ফিতরা লাভের যোগ্য।
ফিতরা সম্পর্কে আরও জানতে জানতে এখানে ক্লিক করুন।
ইদ এবং ইদের উৎসব
ইদের দিনে সকালে প্রথম আনুষ্ঠানিকতা হলো নতুন জামা-কাপড় পরে ইদের নামাজ পড়তে যাওয়া। ইদের নামাজ সবার জন্য। নামাজের পর সবাই একসাথে হওয়া, দেখা করা। ইদের দিনে সালামি (গুরুজন প্রদত্ত অর্থ) গ্রহণ করা প্রায় সব দেশেই রীতি আছে। তবে এর ধর্মীয় কোন বাধ্যবাধকতা বা রীতি নেই।
ইদের দিনে সেমাই সবচেয়ে প্রচলিত খাবার। এবং বিশেষ আরো অনেক ধরনের খাবার ধনী-গরিব সকলের ঘরে তৈরি করা হয়। এ উৎসবের আরো একটি রীতি হলো আশেপাশের সব বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। এবং প্রত্যেক বাড়িতেই হালকা কিছু খাওয়া। এ রীতি বাংলাদেশে প্রায় সবাই-ই মেনে থাকে।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম-প্রধান দেশে ইদুল ফিতরই হলো বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব। বাংলাদেশে ইদ উপলক্ষে সারা রমজান মাস ধরে সন্ধ্যাবেলা থেকে মধ্যরাত অবধি কেনাকাটা চলে। অধিকাংশ পরিবারে ইদের সময়েই নতুন পোশাক কেনা হয়। পত্র-পত্রিকাগুলো ইদ উপলক্ষে ইদ সংখ্যা নামে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে থাকে। ইদ উপলক্ষে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ইদের দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েকদিন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করে। ইদের দিন ঘরে ঘরে সাধ্যমতো বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়।
বাংলাদেশের শহরগুলো থেকে ইদের ছুটিতে প্রচুর লোক নিজেদের আদি নিবাসে বেড়াতে যায়। এ কারণে ইদের সময়ে রেল, সড়ক, ও নৌপথে প্রচণ্ড ভিড় দেখা যায়।
ইদের ইতিহাস
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর ইদের প্রবর্তন হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছে দেখতে পান যে মদিনায় বসবাসকারী ইহুদিরা শরতের পূর্ণিমায় নওরোজ উৎসব এবং বসন্তের পূর্ণিমায় মেহেরজান উৎসব উদ্যাপন করছে। তারা এ উৎসবে নানা আয়োজন, আচার-অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন আনন্দ উৎসব করে থাকে। মহানবী (সা.) মুসলমানদের এ দুটি উৎসব পালন করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, মহান আল্লাহ তোমাদের ওই উৎসবের বিনিময়ে ইদুল ফিতর ও ইদুল আজহার মতো পবিত্র দুটি দিন দান করেছেন। এতে তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে উৎসব পালন করো। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন তখন তাদের দুটি দিন ছিল, যাতে তারা উৎসব পালন করত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এ দুটি কিসের দিন? তারা বলল, আমরা জাহেলি যুগে এ দুই দিন খেলাধুলা ইত্যাদি উৎসব পালন করতাম। এ নিয়মই চলে আসছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দুটির পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হলো ইদুল ফিতর ও ইদুল আজহা।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১১৩৬; মুসনাদ আহমাদ, হাদিস : ১৩৬৪৭)