০৫:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবদীপ্ত পথচলা

বিশ্লেষণ সংকলন টিম
  • প্রকাশ: ০৬:১১:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ মে ২০২২
  • / ১২৮৫ বার পড়া হয়েছে

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবদীপ্ত পথচলা


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় প্রদত্ত তার ঐতিহাসিক ভাষণে বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থনের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এরই ফলস্বরূপ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত সব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে।

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুসৃত এই আদর্শ অনুসরণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ শান্তি ও সম্প্রীতির এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিশ্ব পরিধিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সদা প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয়েই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তাদের সর্বোচ্চ পেশাদারির পরিচয় দিয়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে। কর্মস্পৃহা ও পেশাদারির অভাবনীয় সাফল্যে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি অপরিহার্য নাম।

১৯৮৮ সালের ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে এ অগ্রযাত্রার সূচনা হয়। পরবর্তী বছরগুলোয় দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশাদারি ও কর্মস্পৃহার মূর্তপ্রতীক হিসাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছে। জাতিসংঘ মিশনের প্রথম দশকটিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের গতিধারা চড়াই-উতরাইয়ে পরিপূর্ণ ছিল। তবে নিঃসন্দেহে প্রথম দশকের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এর পরবর্তী দশকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। সংঘাতে প্রতিদ্বন্দ্বী যেসব দল বা গোষ্ঠী থাকে, তাদেরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে হয় যে, কাউকে আঘাত করা শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য নয় বরং তাদের মূল উদ্দেশ্য বেসামরিক নাগরিক এবং জাতিসংঘের কর্মরত সদস্যদের জানমাল রক্ষা করা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বর্তমানে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে ৯টি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে। শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করেছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে এ স্থান পুনরুদ্ধার নিঃসন্দেহে একটি ঈর্ষাজাগানিয়া মাইলফলক।

অনন্য মাত্রার অধিকারী আফ্রিকা মহাদেশের ১৫০টির বেশি মিলিশিয়া বাহিনীর নিরন্তর সংঘাতের পটভূমিতে নিবেদিতপ্রাণ নীল শিরস্ত্রাণধারী বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী আজ ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা এবং জাতিগুলোর মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় সংঘাত-পরবর্তী শান্তি বিনির্মাণে নিয়োজিত শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ বাংলাদেশ।

বর্তমানে বাংলাদেশের ১৫টি কন্টিনজেন্টকে ইউনাইটেড নেশনস ক্যাপাবিলিটি রেডিনেস সিস্টেমের (ইউএনপিসিআরএস) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নতুন কন্টিনজেন্টগুলো মোতায়েনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে এ কন্টিনজেন্টগুলোর মূল্যায়ন ও অ্যাডভাইজারি পরিদর্শন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যেই দুটি কন্টিনজেন্ট ইউএনপিসিআরএস, র‌্যাপিডলি ডেপ্লয়েবল লেভেল (আরডিএল) হিসাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

দেশ থেকে ৮ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে থেকেও করোনা মহামারিতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে দায়িত্ব পালনের অংশ হতে পেরে পেশাগত জীবনে বিরল অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। জাতিসংঘ যেহেতু বহুজাতিক ফোর্স নিয়ে কাজ করে, সেহেতু একেক দেশের সেনাবাহিনীর চিন্তাভাবনার সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে, ভাষাগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের কমান্ডারদের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করে সমন্বিতভাবে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং যথাযথভাবে তা কার্যে পরিণত করা নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ, যা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন।

ইউএন মিশনে যাত্রাকালীন অনিশ্চয়তা, অবস্থানের সময়কাল, নিজ ও পরিবারের প্রস্তুতির সময়সীমার অপর্যাপ্ততা, পরিবার-পরিজন থেকে দীর্ঘদিন আলাদা থাকা, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি, মিশনের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াজনিত অনিশ্চয়তা ইত্যাদি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েনের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ তৈরি করে, যা একজন আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীর জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়ংকর ও চরম প্রতিকূল পরিবেশ মন ও মস্তিষ্কে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, তা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায় যুদ্ধের নৃশংসতা ও ধ্বংসাবশেষ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে। এতসব চাপ সামলেও জাতিসংঘ মিশনগুলোতে দক্ষতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্যরা।

প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেশাদার বাহিনী হিসাবে তাদের শ্রম, চেতনা, দেশপ্রেম ও দক্ষতার মাধ্যমে নিজেদেরকে করে তুলেছেন জাতির গর্ব। গত দুই বছর ধরে চলমান প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা, দেশের তরে’ এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার দক্ষতা ও পেশাদারির মাধ্যমে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো একটি প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনী বিশ্বের যে কোনো জায়গায় জাতিসংঘের ম্যান্ডেটে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে বৈশ্বিক শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে অনন্য ও যুগোপযোগী অবদান রাখছে, যা নিঃসন্দেহে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য জাতিসংঘের মতো একটি বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ অনেক ব্যাপৃত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ ধরনের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একদিকে যেমন সামরিক খাতে বৈশ্বিক অগ্রগতির কারণে সংগঠিত সব নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রত্যক্ষ অংশীদার হতে পারছে, ঠিক তেমনি শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সেনাসদস্যরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের সেনা সদস্যদের সঙ্গে কাজের প্রয়োজনে যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাচ্ছেন। এর ফলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিভিন্ন ভাষাগত দক্ষতা, সামরিক পেশাদারি, নৈপুণ্য এবং ব্যক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা এ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য নতুন সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এই চলমান প্রক্রিয়া যে কোনো দেশের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য অনস্বীকার্য। শান্তিরক্ষা মিশনগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পরোক্ষ আর্থিক সুবিধাও তৈরি করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য কৃষি ও ওষুধ খাতগুলোয় নতুন বাজার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কৃষিজমি লিজ নিয়ে খামার স্থাপন করেছে, যা বাংলাদেশ এবং লিজ প্রদানকারী দেশ উভয়ের খাদ্যচাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে এবং একই সঙ্গে তা উভয় দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ থেকে জাতি হিসাবে আমাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি অফিসার ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের সাহসী আত্মত্যাগের ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারব না। বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ আজ নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে সেনা প্রেরণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। বাংলাদেশ আজ আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে-এই হোক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য হিসাবে আমাদের সবার দৃঢ় অঙ্গীকার।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গৌরবদীপ্ত পথচলা

প্রকাশ: ০৬:১১:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ মে ২০২২

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় প্রদত্ত তার ঐতিহাসিক ভাষণে বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থনের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এরই ফলস্বরূপ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত সব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে।

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুসৃত এই আদর্শ অনুসরণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আজ শান্তি ও সম্প্রীতির এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বিশ্ব পরিধিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে সদা প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয়েই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও তাদের সর্বোচ্চ পেশাদারির পরিচয় দিয়ে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে। কর্মস্পৃহা ও পেশাদারির অভাবনীয় সাফল্যে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি অপরিহার্য নাম।

১৯৮৮ সালের ইউএন ইরান-ইরাক মিলিটারি অবজারভেশন গ্রুপ (ইউনিমগ) মিশনে মাত্র ১৫ জন সেনা পর্যবেক্ষক প্রেরণের মাধ্যমে এ অগ্রযাত্রার সূচনা হয়। পরবর্তী বছরগুলোয় দক্ষতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পেশাদারি ও কর্মস্পৃহার মূর্তপ্রতীক হিসাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেছে। জাতিসংঘ মিশনের প্রথম দশকটিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের গতিধারা চড়াই-উতরাইয়ে পরিপূর্ণ ছিল। তবে নিঃসন্দেহে প্রথম দশকের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এর পরবর্তী দশকে অর্পিত দায়িত্ব পালনে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। সংঘাতে প্রতিদ্বন্দ্বী যেসব দল বা গোষ্ঠী থাকে, তাদেরকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে হয় যে, কাউকে আঘাত করা শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য নয় বরং তাদের মূল উদ্দেশ্য বেসামরিক নাগরিক এবং জাতিসংঘের কর্মরত সদস্যদের জানমাল রক্ষা করা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বর্তমানে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে ৯টি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে। শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করেছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসাবে এ স্থান পুনরুদ্ধার নিঃসন্দেহে একটি ঈর্ষাজাগানিয়া মাইলফলক।

অনন্য মাত্রার অধিকারী আফ্রিকা মহাদেশের ১৫০টির বেশি মিলিশিয়া বাহিনীর নিরন্তর সংঘাতের পটভূমিতে নিবেদিতপ্রাণ নীল শিরস্ত্রাণধারী বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী আজ ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশ্বব্যাপী শান্তিরক্ষা এবং জাতিগুলোর মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় সংঘাত-পরবর্তী শান্তি বিনির্মাণে নিয়োজিত শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ বাংলাদেশ।

বর্তমানে বাংলাদেশের ১৫টি কন্টিনজেন্টকে ইউনাইটেড নেশনস ক্যাপাবিলিটি রেডিনেস সিস্টেমের (ইউএনপিসিআরএস) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নতুন কন্টিনজেন্টগুলো মোতায়েনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে এ কন্টিনজেন্টগুলোর মূল্যায়ন ও অ্যাডভাইজারি পরিদর্শন কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতোমধ্যেই দুটি কন্টিনজেন্ট ইউএনপিসিআরএস, র‌্যাপিডলি ডেপ্লয়েবল লেভেল (আরডিএল) হিসাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

দেশ থেকে ৮ হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে থেকেও করোনা মহামারিতে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সম্মুখযোদ্ধা হিসাবে দায়িত্ব পালনের অংশ হতে পেরে পেশাগত জীবনে বিরল অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। জাতিসংঘ যেহেতু বহুজাতিক ফোর্স নিয়ে কাজ করে, সেহেতু একেক দেশের সেনাবাহিনীর চিন্তাভাবনার সঙ্গে সমন্বয়সাধন করে, ভাষাগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের কমান্ডারদের সঙ্গে যোগযোগ রক্ষা করে সমন্বিতভাবে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং যথাযথভাবে তা কার্যে পরিণত করা নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ, যা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন।

ইউএন মিশনে যাত্রাকালীন অনিশ্চয়তা, অবস্থানের সময়কাল, নিজ ও পরিবারের প্রস্তুতির সময়সীমার অপর্যাপ্ততা, পরিবার-পরিজন থেকে দীর্ঘদিন আলাদা থাকা, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি, মিশনের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াজনিত অনিশ্চয়তা ইত্যাদি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েনের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ তৈরি করে, যা একজন আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীর জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক। এছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়ংকর ও চরম প্রতিকূল পরিবেশ মন ও মস্তিষ্কে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, তা অনেকগুণ বৃদ্ধি পায় যুদ্ধের নৃশংসতা ও ধ্বংসাবশেষ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে। এতসব চাপ সামলেও জাতিসংঘ মিশনগুলোতে দক্ষতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে চলেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্যরা।

প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পেশাদার বাহিনী হিসাবে তাদের শ্রম, চেতনা, দেশপ্রেম ও দক্ষতার মাধ্যমে নিজেদেরকে করে তুলেছেন জাতির গর্ব। গত দুই বছর ধরে চলমান প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের মহামারির মধ্যেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা, দেশের তরে’ এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার দক্ষতা ও পেশাদারির মাধ্যমে আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো একটি প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল বাহিনী বিশ্বের যে কোনো জায়গায় জাতিসংঘের ম্যান্ডেটে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করে বৈশ্বিক শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে অনন্য ও যুগোপযোগী অবদান রাখছে, যা নিঃসন্দেহে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য জাতিসংঘের মতো একটি বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করার সুযোগ অনেক ব্যাপৃত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এ ধরনের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে একদিকে যেমন সামরিক খাতে বৈশ্বিক অগ্রগতির কারণে সংগঠিত সব নীতি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রত্যক্ষ অংশীদার হতে পারছে, ঠিক তেমনি শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত সেনাসদস্যরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন দেশের সেনা সদস্যদের সঙ্গে কাজের প্রয়োজনে যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ পাচ্ছেন। এর ফলে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিভিন্ন ভাষাগত দক্ষতা, সামরিক পেশাদারি, নৈপুণ্য এবং ব্যক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা এ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য নতুন সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

এই চলমান প্রক্রিয়া যে কোনো দেশের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য অনস্বীকার্য। শান্তিরক্ষা মিশনগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য পরোক্ষ আর্থিক সুবিধাও তৈরি করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য কৃষি ও ওষুধ খাতগুলোয় নতুন বাজার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কৃষিজমি লিজ নিয়ে খামার স্থাপন করেছে, যা বাংলাদেশ এবং লিজ প্রদানকারী দেশ উভয়ের খাদ্যচাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে এবং একই সঙ্গে তা উভয় দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ থেকে জাতি হিসাবে আমাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি অফিসার ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের সাহসী আত্মত্যাগের ঋণ আমরা কখনোই শোধ করতে পারব না। বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী’ আজ নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে সেনা প্রেরণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ভবিষ্যতের সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা। বাংলাদেশ আজ আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলব এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে-এই হোক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য হিসাবে আমাদের সবার দৃঢ় অঙ্গীকার।