দেহে গ্লুকোজের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে আলফা ও বিটা কোষ উভয়ই অংশীদার
- প্রকাশ: ১০:৪৬:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ জুন ২০২২
- / ১৬২৫ বার পড়া হয়েছে
দেহ থেকে নিঃসৃত ইন্সুলিন আমাদের প্রতিদিনের একটি হরমোন, যা কার্বোহাইড্রেট, চর্বি এবং প্রোটিন বিপাক নিয়ন্ত্রণের প্রধান হরমোন। এটি একটি প্রোটিনধর্মী হরমোন, যা ক্ষরিত হয় অগ্নাশয়ের সাথে বেড়ে ওঠা অন্তঃক্ষরাবিশিষ্ট কতগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের ন্যায় কোষসমষ্টি থেকে- যার সমষ্টিগত নাম দেয়া হয়েছে ‘আইলেটস অব লাঙ্গারহ্যান্স (Islets of Langerhans) বা লাঙ্গারহ্যান্সের দ্বীপপুঞ্জ, একজন আবিষ্কারক (Paul Langerhans)র নাম অনুসারে। কার্যক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয় হচ্ছে একটি বহিঃক্ষরা (exocrine) অঙ্গ, কিন্তু আইলেটসগুলো অন্তঃক্ষরা (endocrine) প্রকৃতির, অর্থাৎ এদের তৈরি হরমোনগুলো কোনো নালী ছাড়াই সরাসরি রক্তপ্রবাহে ক্ষরিত হতে পারে। আইলেটসগুলো পাঁচ ধরণের স্বতন্ত্র কোষ নিয়ে গঠিত: α কোষ (আলফা: মোট আইলেট কোষের ২০%), β কোষ (বিটা: মোট আইলেট কোষের ৭০%), δ কোষ (ডেল্টা: <১০%), ε- কোষ (ইপ্সিলন: <১%) এবং PP কোষ (<৫%)। এইসব কোষগুলোর মধ্যে আলফা ও বিটা কোষ-ই হচ্ছে প্রধান। এক একটি দ্বীপে (Islet) প্রায় ৩০০-৪০০ কোষ থাকে এবং সবগুলো দ্বীপে একত্রে সর্বমোট কোষ থাকে প্রায় দশ লক্ষ। যদিও ল্যাঙ্গারহ্যান্সের দ্বীপগুলি আয়তনের দিক থেকে একটি অগ্ন্যাশয়ের আনুমানিক ২% জুড়ে থাকে, কিন্তু অগ্ন্যাশয়ে প্রবাহিত রক্ত সরবরাহের ল্যাঙ্গারহ্যান্স পায় ২০%। তার থেকেই বোঝা যায় এই দ্বীপগুলির গুরুত্ব কত অপরিসীম।
একটি বিস্ময়কর বিষয় হলো মানব আইলেটগুলির পুঞ্জ জুড়ে আলফা এবং বিটা কোষগুলি একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে, বলা যায় তাদের জন্মলগ্ন থেকেই। তারা একে অপরের পড়শী কোষ এবং তারা একজন আরেকজনের অনুভূতি খুব সহজেই ধরতে পারে। দুই প্রতিবেশীর এই বোঝাপড়া কাজটি করে কতিপয় নিউরোট্রান্সমিটার: গ্লুটামেট (glutamate) এবং γ-অ্যামিনোবিউটারিক অ্যাসিড (GABA: gamma-aminobutyric acid)। গ্লুটামেট α-কোষ থেকে গ্লুকাগনের সাথে মুক্ত হয় এবং পার্শ্ববর্তী β-কোষগুলির গ্লুটামেট রিসেপ্টর (receptor)কে সক্রিয় করে। আর, β-কোষ থেকে মুক্তি পাওয়া GABA দুইটি কাজ করে- α-কোষকে গ্লুকাগন নিঃসরণে বাধা দেয় , কিন্তু GABA(A) রিসেপ্টরকে উদ্দীপিত করে β-কোষগুলিকে সক্রিয় করে। এইভাবেই আলফা ও বিটা কোষগুলিতে প্যারাক্রাইন (paracrine)/অটোক্রাইন (autocrine) মিথস্ক্রিয়ায় রক্তে গ্লুকোজের ভারসাম্যতা বজায় রাখে। তবে, ইনসুলিন নিঃসরণে স্থানীয়ভাবে β-কোষ থেকে ক্ষরিত ডোপামিন (dopamine) নিউরোট্রান্সমিটারের কী ধরণের ভূমিকা রয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি।
আরও একটি হরমোনের কথা না বল্লেই নয়, সেটি হলো অন্ত্রের এন্টারোএন্ডোক্রাইন এল- (enteroendocrine L-cells) ধরণের কোষ থেকে নিঃসৃত গ্লুকাগন-লাইক পেপটাইড-1 (GLP-1)। β-কোষের ঝিল্লিতে অবস্থিত GLP-1-রিসেপ্টর (GLP1-R)র সাথে আবদ্ধ হয়ে GLP-1 অ্যাডিনাইলেট সাইক্লেজ (adenylate cyclase) এনজাইমকে উদ্দীপিত করে ও প্রচুর পরিমানে cAMP তৈরি করে, যা ইন্সুলিন নিঃসরণকে ত্বরান্বিত করে। এছাড়া, দীর্ঘস্থায়ী হাইপারগ্লাইসেমিক (hyperglycemic) অবস্থায় অপঘাতে মৃতপ্রায় অ্যাপোপটোটিক (apoptotic)-কোষগুলোকে GLP-1-এর প্ররোচনায় প্রতিস্থাপিত করে অগ্ন্যাশয়-নালী থেকে সৃষ্ট নতুন কোষের মাধ্যমে। এছাড়া, গ্লুকোজ বিপাকীয় নিয়ন্ত্রণে ডেল্টা কোষ থেকে নিঃসৃত সোমাটোস্ট্যাটিন হরমোনের ভূমিকা কী তা এখনও স্পষ্ট নয়।
একজন জীববিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন বা ফার্মাকোলজির ছাত্র হিসেবে ইন্সুলিন ও গ্লুকাগন সমন্ধে জানতে হলে আরও গভীরে প্রবেশ করতে হবে। ইন্সুলিন কী তা আমরা সবাই জানি, কিন্তু দেহে ইন্সুলিন কীভাবে কাজ করে তা হয়তো আমাদের কাছে ততোটা স্পষ্ট নয়। আমার এই নিবন্ধে খুব সহজবোধ্যভাবে ইন্সুলিনের মাহাত্ম্যকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। একান্ন অ্যামিনো অ্যাসিডবিশিষ্ট এই হরমোনটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেহকে সঠিক পরিমাণে গ্লুকোজ সরবরাহে সাহায্য করে। ইন্সুলিন গ্লুকোজকে সারা শরীরের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেয়- কোথাও (এডিপোজ টিস্যু) তা লাইপোজেনেসিস (lipogenesis) প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হয় ট্রাইগ্লিসেরাইডে (triglyceride), আবার গ্লাইকোজেনেসিস (glycogenesis) প্রক্রিয়ায় কোথাও (পেশী কোষ, যকৃত) গ্লাইকোজেন-এ রূপান্তরিত হয়ে সঞ্চিত থাকে গ্লুকোজ, দেহের পরবর্তী চাহিদা মিটাতে। এটা জেনে রাখা ভালো যে, ইন্সুলিনের সঙ্গে গ্লুকোজের সরাসরি বন্ধন কোনো সময়ই ঘটে না। তবে, কোষপৃষ্ঠে অবস্থিত ইন্সুলিন রিসেপ্টর (Insulin receptor, Ins-R)র মাধ্যমে রক্তে প্রবাহিত গ্লুকোজ অণুগুলিকে কোষাভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য একটি আণবিক আবহ তৈরি করাটাই হচ্ছে ইন্সুলিনের মূল ভূমিকা। এটাই তার মুখ্য কাজ। ইনসুলিনের নিঃসরণ কমে যাওয়া বা ইন্সুলিন রিসেপ্টরের কার্যকারিতা হ্রাস পাওয়ায় ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রোগের সৃষ্টি হতে পারে। অগ্নাশয়ের β-কোষের নিকটতম প্রতিবেশী আলফা কোষ (α-cells) থেকে নিঃসৃত গ্লুকাগন (glucagon) দেহের কমে যাওয়া গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে রক্তরসে গ্লুকোজের মাত্রা সব সময়ই সাম্যাবস্থায় (glucose homeostasis) রাখার চেষ্টা করে। তবে, অগ্ন্যাশয়ে চর্বি জমলে সঠিকভাবে ইনসুলিন বা গ্লুকাগন কোনটাই সঠিক পরিমাণে তৈরি হয় না। ফলে, দেহে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কলেস্টেরলজনিত জটিলতার সৃষ্টি হয়।
মলিক্যুলার বায়োলজি: চৌদ্দ হাজার নিউক্লিওটাইড (nucleotide) নিয়ে গঠিত ইন্সুলিনের একটি মাত্র জিন (INS) মানবজিনোমের ১১ নং (11p15.5) ক্রোমোজোমে অবস্থিত। তবে, ইঁদুর গ্রুপ ও কতিপয় মাছ প্রজাতির মধ্যে একটি নয়, দুটি কার্যকরী ইনসুলিন জিন থাকে (INS-1 ও INS-2)। কেনই বা তাদের ওই ছোট্ট দেহে দুটো ইন্সুলিন জিনের প্রয়োজন হলো- তা জানা নেই। মানব-INS জিনের মূল প্রতিলিপন অঞ্চলটি মাত্র ১৪৩১টি নিউক্লিওটাইড নিয়ে গঠিত, যার তিনটি একসন (Exon) ও দুইটি ইন্ট্রোন (Intron) অংশ রয়েছে। আর, ১৪,০০০ নিউক্লিওটাইডের বাকি নিউক্লিওটাইডগুলো জিনের নিয়ন্ত্রণ অঞ্চলে রয়েছে, যা এই জিনটির অভিব্যাক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। রক্তে গ্লুকোজের আধিক্যে ইনসুলিন জিনের প্রতিলিপিকরণ (transcription) বৃদ্ধি পায়। INS জিনের প্রতিলিপিকরণ কয়েকটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর (PDX1, NeuroD1 এবং MafA) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই তিনটি ফ্যাক্টরের সম্মিলিত কর্মোদ্যোগ একটি জটিল প্রক্রিয়ায় INS এমআরএনএ (mRNA) তৈরির কাজটি সম্পন্ন করে। ১১০ অ্যামিনো অ্যাসিড-দীর্ঘ একটি পূর্বসূরী ইন্সুলিন (preproinsulin) তিনটি ধাপে (প্রিপ্রোইন্সুলিন-প্রোইন্সুলিন-ইন্সুলিন), বিভিন্ন এনজাইমের সহযোগিতায়, পরিবর্তিত হয়ে একটি সক্রিয় ইনসুলিন (৫১ অ্যামিনো অ্যাসিড বিশিষ্ট)’র পলিপেপ্টাইড A ও পলিপেপ্টাইড B-তে রূপ পায়। সংশ্লেষণসহ ওই বিশোধনগুলো ঘটে থাকে তিনটি অঙ্গাণুতে- রাইবোজোমে, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিক্যুলামে এবং গলজি বস্তুতে। প্রসঙ্গতঃ বর্তমানে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের ইনসুলিন উৎপাদনকারী জিন ই. কোলাই (E. coli) ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর করে ব্যাপক হারে ইনসুলিন উৎপাদন করা হচ্ছে ।
গ্লুকোজ হলো দেহে শক্তির উৎস। কোষের ভিতরে গ্লুকোজের মূল কাজ হচ্ছে গ্লাইকোলাইসিস (glycolysis) প্রক্রিয়ায় এটিপি (ATP)রূপে শক্তি তৈরি করা; আর, কোষের মাইটোকোন্দ্রিয়াগুলো ATP রূপে জন্ম দেয় এই শক্তি। তাই প্রাথমিকভাবে সেই কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পড়েছে ইনসুলিনের ওপর। তাই ইনসুলিনের কাজ হচ্ছে গ্লুকোজকে কীভাবে সুচারুরূপে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো যায় তা নিশ্চিৎ করা। ইন্সুলিন এই কাজটি করে তার স্বকীয় রিসেপ্টর (Ins-R) ও কোষের কতিপয় উৎসেচক (enzyme)কে সক্রিয় করার মাধ্যমে, এবং সে কাজটি করতেও তার একটি নির্দিষ্ট সংকেতপ্রবাহের পথ অনুসরণ করতে হয়। বলা বাহুল্য, IGF (Insulin-like growth factor)-1 হরমোনের সংকেতপ্রবাহের পথও একই। Ins-R হলো এক ধরনের টাইরোসিন কাইনেজ (tyrosine kinase) রিসেপ্টর, যা আলফা (α) ও বিটা (β), সাব-ইউনিট নিয়ে গঠিত। Ins-R-এর সাথে ইনসুলিনের বাঁধন টাইরোসিন কাইনেজ রিসেপ্টরের অটোফসফোরিলেশন (autophosphorylation) বিশেষত্বকে সজাগ করে তোলে। ফলে, সাবইউনিটজুটি একে অপরের টাইরোসিন অবশিষ্টাংশগুলিতে অটোফসফোরিলেশন অর্থাৎ ফসফেট গ্রুপ যুক্ত করে ফেলে। ফসফেট গ্রুপের সংযোজনে ইনসুলিন রিসেপ্টর তার সক্রিয়তা ফিরে পায় ও তাৎক্ষণিক ‘ইনসুলিন রিসেপ্টর সাবস্ট্রেট (IRS-1)’কে ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলে। সক্রিয় IRS-1 পরবর্তীতে ফসফোইনোসিটাইড 3-কাইনেজ (PI3K)-এর সাথে আবদ্ধ হয়ে সেটিকেও সক্রিয় করে, যা PIP2 (Phosphatidylinositol 4,5-bisphosphate) অণুকে PIP3 (Phosphatidylinositol (3,4,5)-trisphosphate) অণুতে রূপান্তরিত করে (ছবি দেখুন)। PIP3 একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেতবাহী অণু, যা পালাক্রমে আরও কয়েকটি কাইনেজ, বিশেষ করে PDPK (Phosphoinositide-dependent kinase)-1 ও প্রোটিন কাইনেজ বি (protein kinase B, PKB)- এনজাইমকে উজ্জীবিত করে। PDPK-1 হলো একটি মাস্টার কাইনেজ, যা AKT/PKB সক্রিয়করণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গতঃ PKB এনজাইম Akt1/2 (serine/threonine kinase) এনজাইম নামেও অভিহিত। কোষাভ্যন্তরে PKB গ্লুকোজের আগমনকে সহজতর করার জন্য ভেসিকল (vesicle) ও SNARE প্রোটিনের সহযোগিতায় গ্লুকোজ ট্রান্সপোর্টার (GLUT4) বাহককে কোষঝিল্লিতে তার একটি নির্দিষ্টি অবস্থান তৈরি করে দেয়। গ্লুকোজ আকারে যেহেতু বড়, তাই সে ঝিল্লীভেদ্য অণু নয়, তার প্রয়োজন একটি বাহক, অর্থাৎ GLUT4 প্রোটিন। পর্যায়ক্রমে কোষের ভিতর ও বাহিরের মধ্যে একটি গ্লুকোজ ঘনত্বের তারতম্যের সৃষ্টি হয়- ঘনত্ব ভিতরে কম, বাইরে বেশি। অবশেষে, ব্যাপন (diffusion) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্লুকোজ সহজেই কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আর, এই কাজটি আরও সহজ করে দেয় PKB-মধ্যস্ততায় গ্লাইকোজেনেসিস (glycogenesis- গ্লাইকোজেন সংশ্লেষণ) প্রক্রিয়া, যা কোষের অভ্যন্তরে গ্লুকোজের ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে দেয়। ইন্সুলিনের ক্ষরণ কমে যাওয়া অথবা ইন্সুলিন রিসেপ্টরের কার্যক্ষমতা লাঘব হলে গ্লুকোজ তার গন্তব্যে অর্থাৎ কোষাভ্যন্তরে পৌঁছয় না। ফলে, রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া-সহ উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়। তাহলে এটা খুব স্পষ্ট যে গ্লুকোজের সঙ্গে সরাসরি বন্ধন GLUT4 প্রোটিনের, ইনসুলিনের সঙ্গে নয়। তবে, এটাও অনস্বীকার্য যে এই বন্ধনটি সম্ভব হয়েছে ইনসুলিনের সহযোগিতায়।
এখন আসি আলফা-কোষ থেকে নিঃসৃত গ্লুকাগন প্রসঙ্গে। ইন্সুলিনের মতো কোষে তারও একটি পর্যাবৃত্ত সংকেতবহনের পথ আছে। স্বাভাবিক অবস্থায়, ইনসুলিন এবং গ্লুকাগন হলো প্রতি-নিয়ন্ত্রক হরমোন, যার কার্যক্রম দেহে এক ধরণের গ্লুকোজ ভারসাম্যতা (homeostasis) নিশ্চিত করে। ইন্সুলিনের মহানুভবতায় গ্লুকোজ অণুগুলো রক্ত থেকে কোষগুলোতে অনুপ্রবেশের ফলে খুব স্বভাবিকভাবেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যায় (পরবর্তী আহার না আসা পর্যন্ত)। যখন রক্ত প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমান ৪.৪ -৪.৭ mmol/L (৮০-৮৫mg/dL) সীমার মধ্যে পড়ে যায়, তখন ল্যাংগারহ্যান্সের β-কোষ দ্বারা ইনসুলিন নিঃসরণ হ্রাস পেতে থাকে এবং কোষ ঝিল্লি থেকে GLUT4 প্রোটিনও সাইটোপ্লাজমে ফিরে আসে, যাতে কোষে অধিক পরিমাণে গ্লুকোজ প্রবেশ করতে না পারে। অধিকন্তু, দীর্ঘসময়কালীন অনাহারে যদি রক্তরস গ্লুকোজের মাত্রা ৩.৬ -৩.৯ mmol/L (৬৫-৭০mg/dL) পরিসরের নীচে নেমে যেতে থাকে (যে অবস্থাকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিয়া [hypoglycemia] যা আমরা সচরাচর বলে থাকি ‘হাইপো’), তখনি α-কোষ থেকে প্রতিনিয়ন্ত্রক হরমোন গ্লুকাগন নিঃসৃত হয় (ছবি দেখুন)। ফলে গ্লুকোনিওজেনেসিস (gluconeogenesis) ও গ্লাইকোজেনোলাইসিস (glycogenolysis) প্রক্রিয়ায় রক্তরসে গ্লুকোজের প্রাপনীয়তা বৃদ্ধি পায়। গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের মাত্রা হ্রাসের সাথে, যকৃৎ থেকে গ্লুকোজ উত্পাদনকে উদ্দীপিত করার জন্য α-কোষ থেকে গ্লুকাগনের ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়। গ্লুকোজ যকৃতে গ্লাইকোজেন হিসেবে সঞ্চিত থাকে। গ্লুকাগন যকৃত কোষের প্লাজমা মেমব্রেনে অবস্থিত (হেপাটোসাইট) গ্লুকাগন রিসেপ্টরগুলির সাথে আবদ্ধ হয়ে অ্যাডিনাইলেট সাইক্লেজ (adenylate cyclase) এনজাইমকে উদ্দীপিত করে, যা কোষাভ্যন্তরে প্রচুর পরিমাণে সংকেতবাহী অণু cAMP সৃষ্টি করে ও এনজাইম প্রোটিন কাইনেজ A (protein kinase A)কে সক্রিয় করে। ফলস্বরূপ, ফসফোরিলেজ কাইনেজ (phosphorylase kinase) উদ্দীপিত হয়ে গ্লাইকোজেন ফসফোরিলেজ (glycogen phosphorylase) কে সক্রিয় করে, যা সঞ্চিত গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ 1-ফসফেট (glucose 1-phosphate) নিঃসরণের পথকে সুগম করে দেয়। কোষ ফিরে পায় তার উদ্যমতা ও জৈবশক্তির উৎস।
ইন্সুলিন ও গ্লুকাগন বিপরীতধর্মী হরমোন হলেও এদের ইপ্সিত লক্ষ কিন্ত একই, অর্থাৎ রক্তরসে গ্লুকোজের ভারসাম্যতা বজায় রাখা। তবে সে পথে প্রতিবন্ধকতা চলে আসে বার্ধক্যের সাথে, যখন ইন্সুলিনের নিঃসরণ কমে যায় বা তার কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। তখন দেখা দেয় এক ধরণের বিপাকীয় সিন্ড্রোম, যেখানে দেহের কোষগুলি ইন্সুলিন হরমোনের প্রতি সাধারণভাবে সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়। এই অবস্থাকে বলা হয় ইন্সুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ইনসুলিন প্রতিবন্ধকতা। ইন্সুলিন প্রতিবন্ধকতার নানান কারণ রয়েছে, যদিও আণবিক পর্যায়ে এর অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণরূপে জানতে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে, রক্তে সালফেট আয়নের অভাবকে ইন্সুলিন প্রতিবন্ধকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সালফেটের উপস্থিতিতে কোষের PI3K/Akt/mTOR সংকেতপ্রবাহের পথকে সক্রিয় করে ইন্সুলিনের সংবেদনশীলতা (sensitivity) বাড়ায়। সাইটোকাইন TNF (tumor necrosis factor)-α লাইপোলাইসিস (lipolysis: যে প্রক্রিয়ায় চর্বি বা লিপিড রূপান্তরিত হয় ফ্যাটি অ্যাসিডে) প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে ইন্সুলিন সংকেতকে ব্যাহত করে এবং GLUT4 এর অভিব্যক্তি হ্রাস করে। ফলে, কোষাভ্যন্তরে গ্লুকোজের আগমন বাধাপ্রাপ্ত হয়। এছাড়াও, জিনগত কারণ হিসেবে NAT (human N-acetyltransferase)2, GCKR (Glucokinase regulatory protein) এবং IGF (insulin growth factor)1- এর মতো বেশ কয়েকটি জিন ইন্সুলিন প্রতিরোধের সাথে যুক্ত। তদ্ব্যতিরিক্ত, ইন্সুলিন প্রতিরোধের ঝুঁকির অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে অতিমাত্রায় চর্বি-ও চিনি-সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, স্থূলতা, ভিটামিন ডি এর অভাব, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং কিছু ওষুধ (যেমন কর্টিকোস্টেরয়েড)। প্রসঙ্গতঃ, গর্ভাবস্থা হলো গ্লুকোজ বিপাকীয় অবস্থার একটি বিশিষ্ট পরিবর্তন, যেখানে গর্ভিণী মা’কে তার পেশীগুলির ইন্সুলিন সংবেদনশীলতা হ্রাস করতে হয়- যাতে মায়ের ও ভ্রূণের মস্তিষ্কে বেশি করে গ্লুকোজ সংরক্ষণ করা যায়। সৃষ্টির এই অভাবনীয় মহিমা যে শুধু মানবদেহেই রয়েছে তা নয়, সমগ্র উচ্চতর মেরুদন্ডী প্রাণীতেও ইন্সুলিন ও গ্লুকাগনের- এই দুইটি প্রোটিনের একই খেলা। তবে, অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের অগ্ন্যাশয় নেই, হয়তো তুলনামূলক অন্তঃস্রাবী কোষগুলি অন্ত্রে বা মস্তিষ্কে পাওয়া যেতে পারে। ইন্সুলিন আবিষ্কারের (ফ্রেডরিক গ্র্যান্ট ব্যানটিং এবং জেমস রিকার্ড ম্যাকলিয়োড নোবেল পুরস্কার পান ১৯২৩ সালে) পর থেকে প্রায় ১০০ বছর পার হয়ে গেল, তবুও ইন্সুলিন নিয়ে গবেষণা ও জানার এখনও শেষ নেই। টাইপ ১ ডায়াবেটিসে, বিটা কোষগুলি বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে যায় এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসে বিটা কোষের সংখ্যা প্রায় ৪০-৬০% কমে যায়। হয়তো আগামী বছরগুলোতে অগ্ন্যাশয়ের বিটা সেল প্রতিস্থাপন থেরাপিতে স্টেম কোষগুলি এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
I would like to thank you for the efforts you have put in penning this blog. I am hoping to check out the same high-grade content from you in the future as well. In fact, your creative writing abilities has encouraged me to get my own, personal blog now 😉