০৬:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্পে সমাজ বাস্তবতা

নাজনীন বেগম
  • প্রকাশ: ১২:০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০২২
  • / ৩০২৯ বার পড়া হয়েছে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

১৮৯০ এর দশকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখার দায়িত্ব পান তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। ঘুরে বেড়ান জমিদারি দেখার সুবাদে নিভৃতপল্লীর নির্জন পরিবেশে। ঠাকুর বাড়ির ঐতিহ্যকে পরিবেশ ছেড়ে চলে আসতে হয় গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম ত্রিশটা বছর কাটে কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের নতুন আবহে। প্রমত্ত পদ্মায় ব্রজাভ্রমণের মধ্যে বেরিয়ে আসে ‘সোনার তরী’র মতো আরও অনেক কাব্য সম্ভার। শুধু তাই নয়, দরিদ্র নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গড়ে ওঠে অকৃত্রিম যোগাযোগ তৈরি হয় ব্যাপক গণসংযোগ। একেবারেই কাছ থেকে দেখতে পান নির্বিত্ত, ভূমিহীন, হতদরিদ্র সাধারণ জনগোষ্ঠীকে যারা নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত, উদাসীন। যাদের জীবন মন অদৃশ্য এক ভাগ্যদেবী কিংবা শক্তিমান অস্তিত্বের কাছে সমর্পিত।

শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার জোয়ার গ্রামবাংলার নিভৃত পল্লীতে তখনও গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। আর তাই সাধারণ জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্ব এবং মর্মান্তিক অবস্থা কবিকে যেভাবে তাড়িত করে সেটাই রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের মূল রসদ যোগায় রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন একজন সূক্ষ্ম সমাজ পর্যবেক্ষক। যা বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বাংলা সাহিত্য অর্জন করে এক অভূতপূর্ব ঐতিহ্যকে পরিমণ্ডল। আবেগপ্রবণ রবীন্দ্রনাথ সমাজ বাস্তবতার টানাপোড়েনে মূর্খ, মূঢ়, বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যে আন্তরিক সম্পর্কে বাধা পড়েন সেখান থেকেই তেরি হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের এক ভিন্নমাত্রা, অন্য আঙ্গিক। যা শুধু ছোটোগল্পের ধারাই সূচনা করল না অনেকখানি ভরিয়ে দিল রবীন্দ্র প্রতিভার অপার সম্ভাবনাকে। বাংলা সাহিত্যের ছোটো গল্প রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা করে এগোতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে নিরন্তর গতিতে এগিয়ে চলা তাঁর ছোটো গল্প ক্রমে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হলো। গল্পের এই ধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে কবিকে ৩০ বছর পেছনে ফেলে আসতে হয়। কিন্তু কেন?

বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ প্রমথনাথ বিশী এর যথাযথ যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তার মতো প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথ অতি বাল্যকাল থেকে কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক এমনকি উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু ছোটো গল্পের জন্য তাকে কেন এত সময় অপেক্ষা করতে হলো? কারণ বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের কোন ধারা ছিল না। সেটা রবীন্দ্রনাথকেই তৈরি করতে হয়েছে। নিজের ছোটোগল্প সম্পর্কে কবির অভিমত গল্পকার হিসেবে তাকে চেনাতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। প্রতিটি ছোটোগল্পে উত্তাল পদ্মার বাঁধভাঙা ঢেউ, ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্র্য এবং ভাগ্যহত জনগোষ্ঠীর গভীর জীবনবোধ সহজ এবং স্পষ্টভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। সঙ্গত কারণে তার ছোটোগল্পের আলোচনায় উঠে আসে গ্রাম-বাংলার মনোমুগ্ধকর রূপবৈচিত্র্য, নদী ও নারীর অপার সম্মোহনী শক্তি, খেটে খাওয়া মানুষের নীরব যন্ত্রণা সর্বোপরি পল্লীবালার সামগ্রিক জীবন ধারার মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। যা উজ্জ্বলভাবে বিধৃত আছে তার অসংখ্য কবিতায়, ‘ছিন্নপত্র’র প্রচুর চিঠিতে এবং ছোটোগল্পের বিষয়বস্তুতে।

কবির মতে, অনেকটাই নিজের দেখা বাকিটা কল্পনা মেশানো তার গল্পের সমৃদ্ধ অবয়ব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম বর্ণনায় ছোটোগল্পের যে রূপ মাধুরী সেখান থেকে অনেকেরই ধারণা হয় তার গল্পসমূহ মূলত লিরিকধর্মী। যা কখনই কবি মানতে চাননি। নদী বাংলাদেশের প্রাণ আর চিরায়ত নৈসর্গিক শোভা গ্রামবাংলার নিজস্ব বৈভব। তাকে বাদ দিয়ে যে কোন সৃষ্টিশীলতা অপূর্ণ থেকে যায়। আর সেভাবেই তার ছোটোগল্পে নদীর বর্ণনা, বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যের স্নিগ্ধতা গল্পের প্রয়োজনে কিংবা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। যার সঙ্গে কাব্যময়তা কিংবা গীতিরসের কোন যোগাযোগ নেই, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ বহু আগেই রবীন্দ্রনাথের নান্দনিক দৃষ্টি আর সৃষ্টি- প্রাচুর্যে ধরা দেয়। জমিদারি এলাকা তদারকি করতে গিয়ে যে সব সাধারণ মানুষের একান্ত সান্নিধ্যে নিজেকে পূর্ণ করেছেন মূলত তারাই হয়ে উঠেছে তার ছোটোগল্পের উপজীব্য। ফলে তার গল্পের সিংহভাগজুড়ে থাকে, অবহেলিত গ্রাম, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। যারা তার অনবদ্য গল্পের মূল রসদ যোগান দেয়। এমনই দুটো বিখ্যাত গল্প ‘কাবুলীওয়ালা’ এবং ‘শাস্তি’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখন্ড রূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখন্ড রূপে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটি যেমন

১৮৯২ সালে লেখা ‘কাবুলীওয়ালা’ গল্পটি আজও পাঠক সমাজকে নানাভাবে তাড়িত করে। মাতৃত্বের মহিমা, বন্দনা আমরা বিভিন্ন মাত্রিকে রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু পিতৃত্বের এমন চমৎকার মনোমুগ্ধকর অনুভব সত্যিই বিরল। স্নেহশীল পিতা এবং পিতৃভক্ত রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব এমন মানবীয় আবহে পিতার অন্তরনিঃসৃত সম্পদকে পাঠকের মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া। গল্পের প্রধান দুই চরিত্র রহমত এবং মিনি।

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন আলাপচারিতায় এবং প্রমথনাথ বিশীর লেখায় স্পষ্ট হয় কবির জ্যেষ্ঠ কন্যা বেলার আদলে তৈরি করা হয় মিনিকে। আর লেখক নিজেই রবীন্দ্রনাথ সে কথা বলার আর প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে ভিনদেশী রহমত কিংবা কাবুলীওয়ালা? কার ছবি মাথায় রেখে কবির তৈরি এই চরিত্র?

কবির ‘জীবন-স্মৃতি’তে একটি বেদনাদায়ক স্মৃতিময় ঘটনার উল্লেখ আছে। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে মোমেন মিঞা নামে এক মুসলমান প্রজা ঝাড়-মোছের কাজ করত। প্রতিদিন যথাসময়ে এসে সে তার দায়িত্ব পালন করে যেত। কবির লেখায় আছে মোমেন মিঞার উপস্থিতি তিনি টেরই পেতেন না। কিন্তু একদিন টের পেলেন যেদিন মোমেন আসেনি। প্রায় ঘণ্টা চারেক পর সে কুঠিবাড়িতে এসে হাজির উসকো-খুশকো, বিধ্বস্ত চেহারা দেখেই কবি চমকে ওঠেন। সে নিজেই বলা শুরু করল তার দেরিতে আসার কারণ। ‘হুজুর, আজ সকালে মেয়েটা মারা গেল, তাকে কবর দিয়ে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। এই জন্য সময়মতো আসতে পারিনি। পিতৃত্বের এমন করুণ আর্তি রবীন্দ্রনাথকে এতই মুহ্যমান বাক্য। ওই মুহূর্তে মনে হলো যেন সেও পিতা, আমিও পিতা। একই কথার প্রতিধ্বনি কি আমরা কাবুলীওয়ালাতে শুনি না? রহমত যখন তার বুকের ভেতর সযতেœ রাখ মেয়ের হাতের ছাপ লেখকের সামনে মেলে ধরে তখন ঠিক এই কথাটিই গল্পকার বলেছিলেন। মিনির সঙ্গে রহমতের আলাপ এবং সখ্য দুই অসম বয়সী মানুষের স্নেহাতিশর্যের নির্মলবন্ধন। থলের ভেতরে থাকত মিনির জন্য বাদাম, কিসমিস আর সেই সুবাদে মিনির সঙ্গে নিয়মিত বাক্যালাপ এবং দেখাশোনা। দৈনন্দিন জীবনের খুব সাধারণ একটি ঘটনা যা কবির শৈল্পিক ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত এবং অনবদ্য হয়ে ওঠে। হৃদয় সম্পর্কের এক চমৎকার উপস্থাপন। 

মিনি রহমতের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব এবং আন্তরিকতা পাঠকদের মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায়। কৌতুকালাপ ও রহমত মিনির সম্পর্কে ভিন্নমাত্রা দেয়। এই সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে যখন রহমত মারামারি করে জেলহাজতে যায়। কয়েক বছর তার সশ্রম কারাদ- হয়। রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করা কাবুলীওয়ালা গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া দিনমজুরদের ভিন্ন মাত্রার চিত্র। সবচেয়ে বেশি যা দৃশ্যমান তা হলো অবুঝ, অবোধ মিনি-কাবুলীওয়ালার অসম সম্পর্কের এক অদ্ভুত চিত্তাকর্ষক কাহিনীর নিরন্তর গতি পাওয়া। জেল থেকে বের হয়েই রহমত মিনির খোঁজে আসে। আর সেদিনই মিনির বিয়ে। অন্দর মহল থেকে প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বধূ সাজে সালঙ্করা মিনিকে রহমতের সামনে হাজির করা হয়। মুগ্ধ, অপলক নেত্রে রহমত মিনির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কি সেই কয়েক বছর আগের দেখা খুকী মিনি? এখানেই রবীন্দ্রনাথ গল্পের সমাপ্তি টানেন। আর এভাবে বাংলা সাহিত্যের ছোটোগল্পের সাধারণ ভূমি রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক সুষমার উর্বর থেকে উর্বরতর হতে থাকে। কবির সৃষ্টি ঐশ্বর্য এবং নান্দনিক দ্যোতনায় গল্পের মানবিক সম্পর্কগুলো যেভাবে দীপ্ত হয় তা যেমন অসাধারণ তেমনি তুলনাহীন।

জীবনপ্রবাহের নিখুঁত ছবি ‘শাস্তি’ গল্প

রবীন্দ্রনাথের আর এক বিখ্যাত গল্প ‘শাস্তি’ যা আজও পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন জাগায়। মূল চরিত্র দুখিরাম, ছিদাম, বড়ো বৌ আর ছোটো বৌ। ‘ছিন্নপত্রে’ দুখিরাম, ছিদামের কথা উল্লেখ আছে। দুভাই শিলাইদহের কবির পৈত্রিক জমিদারিতে কামলা খাটত। গ্রামবাংলার নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতিদিনের জীবনপ্রবাহের নিখুঁত ছবি এই ‘শাস্তি’ গল্পটি।

বাংলা সাহিত্যের ছোটোগল্পের মহানায়ক রবীন্দ্রনাথ সমাজ বিশ্লেষকের ভূমিকায়ও অনন্য। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতির করাল নিষ্পেশনে ঘুরপাক খাওয়া অসহায়-বিত্তহীন প্রজাকুলের যে যন্ত্রণার ছবি মূর্ত হয় তা যেমন হৃদয়বিদারক তেমনি বাস্তবোচিত। সমাজ বাস্তবতার টানাপোড়েনে কবি নিজেও হয়ে ওঠেন একজন বিদগ্ধ সমাজ গবেষক। ছোটো পরিবার থেকে শুরু করে বৃহত্তর সমাজ-প্রেক্ষাপটের সংঘর্ষে গড়ে ওঠা বিভিন্ন চরিত্রগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থার এক বিক্ষুব্ধ প্রতিচ্ছায়া।

বিভিন্ন চরিত্রে ছাপ পড়ে দৈনন্দিন বিবাদ-সঙ্কট-ক্ষোভ আর সংহারের মতো বেদনার্থ প্রতিবেশের নগ্নতা। প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চনা, অতিরিক্ত শ্রম বিনিয়োগের যন্ত্রণা আর উপরি পাওনা হিসেবে কটূবাক্য এবং গঞ্জনার পীড়নে দুভাইয়ের নিত্যদিনের জীবন অসহনীয় এবং দুর্বিষহ। অর্থনৈতিক অব্যবস্থার দুর্বিপাকে পড়া দুখিরাম ও ছিদামের পারিবারিক জীবনও সঙ্গত কারণেই সুখকর ছিল না। স্ত্রীদের ঝগড়া, কলহ, বিবাদও প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। ঘরে বাইরে এই বিধ্বস্ত অবস্থার শিকার দুখিরাম ও ছিদাম। আর গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের এটাই বাস্তবসম্মত চিত্র। যার ব্যত্যয় ঘটে খুব কমই।

শাস্তি গল্পের গতিপথ শুরু হয় ঠিক এভাবে— ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত দুখিরাম ঘরে ঢুকেই স্ত্রী রাধার কাছে খাবার চায়। ততোধিক শ্লেষবাক্যে রাধা তা প্রত্যাখ্যান করে। 

বিক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত দুখিরাম নিজেকে সামলাতে না পেরে হাতে থাকা দা দিয়ে স্ত্রী রাধার মাথায় সজোরে কোপ দেয়। আঘাত এতই গুরুতর হয় যে, রাধা সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ, বিমূঢ় এবং দিশেহারা হয়ে যায় দু’ভাই। শেষ অবধি এই ঘটনা জানাজানি হলে ছিদাম ভাইকে বাঁচানোর দায়িত্ববোধ থেকে স্ত্রী চন্দরা ওপর দায়ভাগ চাপায়। বিস্মিত এবং হতবিহ্বল চন্দরা অগ্নিঝরা নেত্রে স্বামী ছিদামের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এত বড়ো মিথ্যা অপবাদ দেয়ার কোন কারণ এই মুহূর্তে খুঁজে পায় না চন্দরা। দুঃখে, অপমানে, কষ্টে চন্দরার জীবন-মন অসাড়, অচল হয়ে যায়। তার পরে স্বামীর মুখে যা শুনে তাতে আরও বিধ্বস্ত সে। ‘বউ গেলে বউ পাবো, ভাই গেলে তো আর ভাই পাবো না।

ব্যক্তিক আর সমাজ আর সমাজ জীবন থেকে সীতা বিসর্জনের সময় রামায়নের রামও ঠিক এই কথাই বলেছিলেন। ছিদামের গলা কাঁপে নাই, স্ত্রীর সঙ্গে এতদিনের নির্মল বন্ধন পথরোধ করে নাই, ভালবাসার মহিমাও তাকে বিচলিত করল না। নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায় স্ত্রীর গলায় খুনের তকমা লাগিয়ে দিল। কিন্তু এক সময় দুখিরাম এবং ছিদাম চন্দরাকে এই দায়ভাগ থেকে মুক্তি দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু চন্দরাকে দিয়ে অন্য কোন কথা বলাতে কেউই পারল না। আর বিচারক ও চন্দরার জবানবন্দীকেই শেষ রায়ের জন্য বিবেচনায় আনেন।

অমানবিক, বিবেকবর্জিত এই গল্পে চন্দরার চারিত্রিক বলিষ্ঠতাই মূল শৌষ্ঠ। তা যেমন চন্দরার স্রষ্টাকে মহিমান্বিত করে একইভাবে পাঠক সমাজকেও বিমুগ্ধ করে। নারী-চেতনা রবীন্দ্র সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট পর্যায়, যে দীপ্ত নারীরা তার সাহিত্যে বিচিত্রভাবে নিজেদের জায়গা করে নেয়। দুভাই-এর অনেক সাধাসাধির পরও চন্দরার অবিচলিত দৃঢ়তায় দুখিরাম, ছিদাম শেষ অবধি বেঁচে থেকেও পরাভূত হয়। এই চিত্র শুধু সমকালের নয়, সেই পুরাকাল থেকে আজ অবধি এই ধরনের নির্মম, নিষ্ঠুর নারী নিষ্পেশনের অমানবিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ মানুষের চিরায়ত চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের যে স্বচ্ছ ছবি এঁকেছেন সময়ের পরিবর্তনেও তা আজ অম্লান। সমাজ ব্যবস্থার শেকড়ে অবগাহন করে কঠিন, কঠোর বাস্তবতাকে যেভাবে তার ছোটোগল্পে তুলে ধরেছেন সেখানে আজও তিনি শ্রেষ্ঠতম।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

নাজনীন বেগম

নাজনীন বেগম একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। মূলত সমাজতত্ত্বের ছাত্রী হলেও সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় নিজেকে পুরোপুরি যুক্ত রেখেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষে দৈনিক পূর্বকোণের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় অভিষেক। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল ধরে দৈনিক জনকণ্ঠে অপরাজিতা পাতার বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রবল রবীন্দ্র অনুরাগী নাজনীন বেগম ২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস থেকে অধ্যাপক ড. স্বরোচিষ সরকারের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেশী-বিদেশী জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটোগল্পে সমাজ বাস্তবতা

প্রকাশ: ১২:০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০২২

১৮৯০ এর দশকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখার দায়িত্ব পান তৎকালীন পূর্ববঙ্গের কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিসর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। ঘুরে বেড়ান জমিদারি দেখার সুবাদে নিভৃতপল্লীর নির্জন পরিবেশে। ঠাকুর বাড়ির ঐতিহ্যকে পরিবেশ ছেড়ে চলে আসতে হয় গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম ত্রিশটা বছর কাটে কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের নতুন আবহে। প্রমত্ত পদ্মায় ব্রজাভ্রমণের মধ্যে বেরিয়ে আসে ‘সোনার তরী’র মতো আরও অনেক কাব্য সম্ভার। শুধু তাই নয়, দরিদ্র নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে গড়ে ওঠে অকৃত্রিম যোগাযোগ তৈরি হয় ব্যাপক গণসংযোগ। একেবারেই কাছ থেকে দেখতে পান নির্বিত্ত, ভূমিহীন, হতদরিদ্র সাধারণ জনগোষ্ঠীকে যারা নিজেরাই নিজেদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত, উদাসীন। যাদের জীবন মন অদৃশ্য এক ভাগ্যদেবী কিংবা শক্তিমান অস্তিত্বের কাছে সমর্পিত।

শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার জোয়ার গ্রামবাংলার নিভৃত পল্লীতে তখনও গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। আর তাই সাধারণ জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্ব এবং মর্মান্তিক অবস্থা কবিকে যেভাবে তাড়িত করে সেটাই রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের মূল রসদ যোগায় রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন একজন সূক্ষ্ম সমাজ পর্যবেক্ষক। যা বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। বাংলা সাহিত্য অর্জন করে এক অভূতপূর্ব ঐতিহ্যকে পরিমণ্ডল। আবেগপ্রবণ রবীন্দ্রনাথ সমাজ বাস্তবতার টানাপোড়েনে মূর্খ, মূঢ়, বিত্তহীন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যে আন্তরিক সম্পর্কে বাধা পড়েন সেখান থেকেই তেরি হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের এক ভিন্নমাত্রা, অন্য আঙ্গিক। যা শুধু ছোটোগল্পের ধারাই সূচনা করল না অনেকখানি ভরিয়ে দিল রবীন্দ্র প্রতিভার অপার সম্ভাবনাকে। বাংলা সাহিত্যের ছোটো গল্প রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা করে এগোতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে নিরন্তর গতিতে এগিয়ে চলা তাঁর ছোটো গল্প ক্রমে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হলো। গল্পের এই ধারায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে কবিকে ৩০ বছর পেছনে ফেলে আসতে হয়। কিন্তু কেন?

বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ প্রমথনাথ বিশী এর যথাযথ যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তার মতো প্রতিভাবান রবীন্দ্রনাথ অতি বাল্যকাল থেকে কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক এমনকি উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু ছোটো গল্পের জন্য তাকে কেন এত সময় অপেক্ষা করতে হলো? কারণ বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের কোন ধারা ছিল না। সেটা রবীন্দ্রনাথকেই তৈরি করতে হয়েছে। নিজের ছোটোগল্প সম্পর্কে কবির অভিমত গল্পকার হিসেবে তাকে চেনাতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে। প্রতিটি ছোটোগল্পে উত্তাল পদ্মার বাঁধভাঙা ঢেউ, ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্র্য এবং ভাগ্যহত জনগোষ্ঠীর গভীর জীবনবোধ সহজ এবং স্পষ্টভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। সঙ্গত কারণে তার ছোটোগল্পের আলোচনায় উঠে আসে গ্রাম-বাংলার মনোমুগ্ধকর রূপবৈচিত্র্য, নদী ও নারীর অপার সম্মোহনী শক্তি, খেটে খাওয়া মানুষের নীরব যন্ত্রণা সর্বোপরি পল্লীবালার সামগ্রিক জীবন ধারার মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। যা উজ্জ্বলভাবে বিধৃত আছে তার অসংখ্য কবিতায়, ‘ছিন্নপত্র’র প্রচুর চিঠিতে এবং ছোটোগল্পের বিষয়বস্তুতে।

কবির মতে, অনেকটাই নিজের দেখা বাকিটা কল্পনা মেশানো তার গল্পের সমৃদ্ধ অবয়ব। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম বর্ণনায় ছোটোগল্পের যে রূপ মাধুরী সেখান থেকে অনেকেরই ধারণা হয় তার গল্পসমূহ মূলত লিরিকধর্মী। যা কখনই কবি মানতে চাননি। নদী বাংলাদেশের প্রাণ আর চিরায়ত নৈসর্গিক শোভা গ্রামবাংলার নিজস্ব বৈভব। তাকে বাদ দিয়ে যে কোন সৃষ্টিশীলতা অপূর্ণ থেকে যায়। আর সেভাবেই তার ছোটোগল্পে নদীর বর্ণনা, বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যের স্নিগ্ধতা গল্পের প্রয়োজনে কিংবা প্রসঙ্গক্রমে এসে যায়। যার সঙ্গে কাব্যময়তা কিংবা গীতিরসের কোন যোগাযোগ নেই, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ বহু আগেই রবীন্দ্রনাথের নান্দনিক দৃষ্টি আর সৃষ্টি- প্রাচুর্যে ধরা দেয়। জমিদারি এলাকা তদারকি করতে গিয়ে যে সব সাধারণ মানুষের একান্ত সান্নিধ্যে নিজেকে পূর্ণ করেছেন মূলত তারাই হয়ে উঠেছে তার ছোটোগল্পের উপজীব্য। ফলে তার গল্পের সিংহভাগজুড়ে থাকে, অবহেলিত গ্রাম, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। যারা তার অনবদ্য গল্পের মূল রসদ যোগান দেয়। এমনই দুটো বিখ্যাত গল্প ‘কাবুলীওয়ালা’ এবং ‘শাস্তি’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখন্ড রূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অনন্ত জীবন, চিরজীবী মানবাত্মা ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। মৃত্যুকে তিনি দেখেছেন মহাজীবনের যতি হিসেবে। জীবন-মৃত্যু ও জগৎ-সংসার তাঁর নিকট প্রতিভাত হয় এক অখন্ড রূপে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটি যেমন

১৮৯২ সালে লেখা ‘কাবুলীওয়ালা’ গল্পটি আজও পাঠক সমাজকে নানাভাবে তাড়িত করে। মাতৃত্বের মহিমা, বন্দনা আমরা বিভিন্ন মাত্রিকে রবীন্দ্র সাহিত্যে প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু পিতৃত্বের এমন চমৎকার মনোমুগ্ধকর অনুভব সত্যিই বিরল। স্নেহশীল পিতা এবং পিতৃভক্ত রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব এমন মানবীয় আবহে পিতার অন্তরনিঃসৃত সম্পদকে পাঠকের মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া। গল্পের প্রধান দুই চরিত্র রহমত এবং মিনি।

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন আলাপচারিতায় এবং প্রমথনাথ বিশীর লেখায় স্পষ্ট হয় কবির জ্যেষ্ঠ কন্যা বেলার আদলে তৈরি করা হয় মিনিকে। আর লেখক নিজেই রবীন্দ্রনাথ সে কথা বলার আর প্রয়োজন পড়ে না। তাহলে ভিনদেশী রহমত কিংবা কাবুলীওয়ালা? কার ছবি মাথায় রেখে কবির তৈরি এই চরিত্র?

কবির ‘জীবন-স্মৃতি’তে একটি বেদনাদায়ক স্মৃতিময় ঘটনার উল্লেখ আছে। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে মোমেন মিঞা নামে এক মুসলমান প্রজা ঝাড়-মোছের কাজ করত। প্রতিদিন যথাসময়ে এসে সে তার দায়িত্ব পালন করে যেত। কবির লেখায় আছে মোমেন মিঞার উপস্থিতি তিনি টেরই পেতেন না। কিন্তু একদিন টের পেলেন যেদিন মোমেন আসেনি। প্রায় ঘণ্টা চারেক পর সে কুঠিবাড়িতে এসে হাজির উসকো-খুশকো, বিধ্বস্ত চেহারা দেখেই কবি চমকে ওঠেন। সে নিজেই বলা শুরু করল তার দেরিতে আসার কারণ। ‘হুজুর, আজ সকালে মেয়েটা মারা গেল, তাকে কবর দিয়ে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। এই জন্য সময়মতো আসতে পারিনি। পিতৃত্বের এমন করুণ আর্তি রবীন্দ্রনাথকে এতই মুহ্যমান বাক্য। ওই মুহূর্তে মনে হলো যেন সেও পিতা, আমিও পিতা। একই কথার প্রতিধ্বনি কি আমরা কাবুলীওয়ালাতে শুনি না? রহমত যখন তার বুকের ভেতর সযতেœ রাখ মেয়ের হাতের ছাপ লেখকের সামনে মেলে ধরে তখন ঠিক এই কথাটিই গল্পকার বলেছিলেন। মিনির সঙ্গে রহমতের আলাপ এবং সখ্য দুই অসম বয়সী মানুষের স্নেহাতিশর্যের নির্মলবন্ধন। থলের ভেতরে থাকত মিনির জন্য বাদাম, কিসমিস আর সেই সুবাদে মিনির সঙ্গে নিয়মিত বাক্যালাপ এবং দেখাশোনা। দৈনন্দিন জীবনের খুব সাধারণ একটি ঘটনা যা কবির শৈল্পিক ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত এবং অনবদ্য হয়ে ওঠে। হৃদয় সম্পর্কের এক চমৎকার উপস্থাপন। 

মিনি রহমতের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব এবং আন্তরিকতা পাঠকদের মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায়। কৌতুকালাপ ও রহমত মিনির সম্পর্কে ভিন্নমাত্রা দেয়। এই সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে যখন রহমত মারামারি করে জেলহাজতে যায়। কয়েক বছর তার সশ্রম কারাদ- হয়। রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করা কাবুলীওয়ালা গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া দিনমজুরদের ভিন্ন মাত্রার চিত্র। সবচেয়ে বেশি যা দৃশ্যমান তা হলো অবুঝ, অবোধ মিনি-কাবুলীওয়ালার অসম সম্পর্কের এক অদ্ভুত চিত্তাকর্ষক কাহিনীর নিরন্তর গতি পাওয়া। জেল থেকে বের হয়েই রহমত মিনির খোঁজে আসে। আর সেদিনই মিনির বিয়ে। অন্দর মহল থেকে প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বধূ সাজে সালঙ্করা মিনিকে রহমতের সামনে হাজির করা হয়। মুগ্ধ, অপলক নেত্রে রহমত মিনির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই কি সেই কয়েক বছর আগের দেখা খুকী মিনি? এখানেই রবীন্দ্রনাথ গল্পের সমাপ্তি টানেন। আর এভাবে বাংলা সাহিত্যের ছোটোগল্পের সাধারণ ভূমি রবীন্দ্রনাথের শৈল্পিক সুষমার উর্বর থেকে উর্বরতর হতে থাকে। কবির সৃষ্টি ঐশ্বর্য এবং নান্দনিক দ্যোতনায় গল্পের মানবিক সম্পর্কগুলো যেভাবে দীপ্ত হয় তা যেমন অসাধারণ তেমনি তুলনাহীন।

জীবনপ্রবাহের নিখুঁত ছবি ‘শাস্তি’ গল্প

রবীন্দ্রনাথের আর এক বিখ্যাত গল্প ‘শাস্তি’ যা আজও পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন জাগায়। মূল চরিত্র দুখিরাম, ছিদাম, বড়ো বৌ আর ছোটো বৌ। ‘ছিন্নপত্রে’ দুখিরাম, ছিদামের কথা উল্লেখ আছে। দুভাই শিলাইদহের কবির পৈত্রিক জমিদারিতে কামলা খাটত। গ্রামবাংলার নিম্নবিত্ত, খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতিদিনের জীবনপ্রবাহের নিখুঁত ছবি এই ‘শাস্তি’ গল্পটি।

বাংলা সাহিত্যের ছোটোগল্পের মহানায়ক রবীন্দ্রনাথ সমাজ বিশ্লেষকের ভূমিকায়ও অনন্য। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতির করাল নিষ্পেশনে ঘুরপাক খাওয়া অসহায়-বিত্তহীন প্রজাকুলের যে যন্ত্রণার ছবি মূর্ত হয় তা যেমন হৃদয়বিদারক তেমনি বাস্তবোচিত। সমাজ বাস্তবতার টানাপোড়েনে কবি নিজেও হয়ে ওঠেন একজন বিদগ্ধ সমাজ গবেষক। ছোটো পরিবার থেকে শুরু করে বৃহত্তর সমাজ-প্রেক্ষাপটের সংঘর্ষে গড়ে ওঠা বিভিন্ন চরিত্রগুলো বিদ্যমান ব্যবস্থার এক বিক্ষুব্ধ প্রতিচ্ছায়া।

বিভিন্ন চরিত্রে ছাপ পড়ে দৈনন্দিন বিবাদ-সঙ্কট-ক্ষোভ আর সংহারের মতো বেদনার্থ প্রতিবেশের নগ্নতা। প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চনা, অতিরিক্ত শ্রম বিনিয়োগের যন্ত্রণা আর উপরি পাওনা হিসেবে কটূবাক্য এবং গঞ্জনার পীড়নে দুভাইয়ের নিত্যদিনের জীবন অসহনীয় এবং দুর্বিষহ। অর্থনৈতিক অব্যবস্থার দুর্বিপাকে পড়া দুখিরাম ও ছিদামের পারিবারিক জীবনও সঙ্গত কারণেই সুখকর ছিল না। স্ত্রীদের ঝগড়া, কলহ, বিবাদও প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। ঘরে বাইরে এই বিধ্বস্ত অবস্থার শিকার দুখিরাম ও ছিদাম। আর গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের এটাই বাস্তবসম্মত চিত্র। যার ব্যত্যয় ঘটে খুব কমই।

শাস্তি গল্পের গতিপথ শুরু হয় ঠিক এভাবে— ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত দুখিরাম ঘরে ঢুকেই স্ত্রী রাধার কাছে খাবার চায়। ততোধিক শ্লেষবাক্যে রাধা তা প্রত্যাখ্যান করে। 

বিক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত দুখিরাম নিজেকে সামলাতে না পেরে হাতে থাকা দা দিয়ে স্ত্রী রাধার মাথায় সজোরে কোপ দেয়। আঘাত এতই গুরুতর হয় যে, রাধা সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ, বিমূঢ় এবং দিশেহারা হয়ে যায় দু’ভাই। শেষ অবধি এই ঘটনা জানাজানি হলে ছিদাম ভাইকে বাঁচানোর দায়িত্ববোধ থেকে স্ত্রী চন্দরা ওপর দায়ভাগ চাপায়। বিস্মিত এবং হতবিহ্বল চন্দরা অগ্নিঝরা নেত্রে স্বামী ছিদামের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এত বড়ো মিথ্যা অপবাদ দেয়ার কোন কারণ এই মুহূর্তে খুঁজে পায় না চন্দরা। দুঃখে, অপমানে, কষ্টে চন্দরার জীবন-মন অসাড়, অচল হয়ে যায়। তার পরে স্বামীর মুখে যা শুনে তাতে আরও বিধ্বস্ত সে। ‘বউ গেলে বউ পাবো, ভাই গেলে তো আর ভাই পাবো না।

ব্যক্তিক আর সমাজ আর সমাজ জীবন থেকে সীতা বিসর্জনের সময় রামায়নের রামও ঠিক এই কথাই বলেছিলেন। ছিদামের গলা কাঁপে নাই, স্ত্রীর সঙ্গে এতদিনের নির্মল বন্ধন পথরোধ করে নাই, ভালবাসার মহিমাও তাকে বিচলিত করল না। নিঃসঙ্কোচে, নির্দ্বিধায় স্ত্রীর গলায় খুনের তকমা লাগিয়ে দিল। কিন্তু এক সময় দুখিরাম এবং ছিদাম চন্দরাকে এই দায়ভাগ থেকে মুক্তি দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু চন্দরাকে দিয়ে অন্য কোন কথা বলাতে কেউই পারল না। আর বিচারক ও চন্দরার জবানবন্দীকেই শেষ রায়ের জন্য বিবেচনায় আনেন।

অমানবিক, বিবেকবর্জিত এই গল্পে চন্দরার চারিত্রিক বলিষ্ঠতাই মূল শৌষ্ঠ। তা যেমন চন্দরার স্রষ্টাকে মহিমান্বিত করে একইভাবে পাঠক সমাজকেও বিমুগ্ধ করে। নারী-চেতনা রবীন্দ্র সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট পর্যায়, যে দীপ্ত নারীরা তার সাহিত্যে বিচিত্রভাবে নিজেদের জায়গা করে নেয়। দুভাই-এর অনেক সাধাসাধির পরও চন্দরার অবিচলিত দৃঢ়তায় দুখিরাম, ছিদাম শেষ অবধি বেঁচে থেকেও পরাভূত হয়। এই চিত্র শুধু সমকালের নয়, সেই পুরাকাল থেকে আজ অবধি এই ধরনের নির্মম, নিষ্ঠুর নারী নিষ্পেশনের অমানবিক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ মানুষের চিরায়ত চাওয়া-পাওয়া, আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের যে স্বচ্ছ ছবি এঁকেছেন সময়ের পরিবর্তনেও তা আজ অম্লান। সমাজ ব্যবস্থার শেকড়ে অবগাহন করে কঠিন, কঠোর বাস্তবতাকে যেভাবে তার ছোটোগল্পে তুলে ধরেছেন সেখানে আজও তিনি শ্রেষ্ঠতম।