০৮:৩৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

লাইলি-মজনু মহাকাব্য— জামির কাব্যের সঙ্গে বাংলার আত্মীয়তা

মুসা আল হাফিজ
  • প্রকাশ: ০১:২৬:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০২২
  • / ২৩১৯ বার পড়া হয়েছে

লাইলি-মজনু মূলত সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনুল মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদীর প্রেমনির্ভর লোকগাঁথা।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

লাইলি-মজনু বা লায়লা-মজনু হলো ৭ম শতাব্দীর প্রেমকাহিনি নির্ভর প্রাচীন আরব্য লোকগাথা।

লাইলি-মজনু মহাকাব্য সংশ্লিষ্ট কিছু কথা

সুফিতত্ত্বের চারণভূমি ইরান ও মধ্য এশিয়া। এর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুফি কবিরা মানুষে ও পরমে আশিক মাশুক তত্ত্বের রূপক হিসেবে তৈরি করেন মানবিক নানা প্রণয়োপাখ্যান। এর প্রভাব ভারত উপমহাদেশে আসে সরাসরি ফারসি ভাষার আশ্রয়ে। এখানেও সুফিসাধনার শেকড় অত্যন্ত গভীর। প্রতিটি ভাষা ও সাহিত্যে এর স্বাক্ষর মুদ্রিত। অধ্যাত্মতত্ত্বের রূপক কাব্য এখানে রচিত হয়েছে মরমি-সাংস্কৃতিক বিকাশের দরকারে। হিন্দি, উর্দু যেমন এসব আধ্যাত্মিক ইতিবৃত্তকে আমন্ত্রণ করেছে সহজেই, বাংলাও একে আত্তিকরণে বিলম্ব করেনি। এসব রূপকের অন্যতম হচ্ছে লাইলি-মজনু প্রেম কাহিনি, যদিও অনেক ঐতিহাসিকের মতে, লাইলি-মজনু সত্যিকার চরিত্র। 

লোককথা এর ওপর বিচিত্র রং চড়িয়েছে। লোককথা হিসেবে এর বিস্তার আরবে এবং এর সাহিত্যিক চিত্রায়ণ মূলত ফারসি ভাষায় হলেও এ কাহিনি আরবি বা ফারসি ভাষার নিজস্ব সম্পদ হয়ে নেই। বৈশ্বিক বিস্তার লাভ করেছে বহু শতক আগেই। তুর্কি, হিন্দি, পশতু, উর্দুসহ নানা ভাষার নিজস্ব সাহিত্য সম্ভারে এ রোম্যান্স কাহিনি যুক্ত করেছে নতুন অধ্যায়, নতুন বিভূতি। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি বাস্তব।

লাইলি-মজনু মহাকাব্যের কাহিনিসংক্ষেপ ও বিভিন্ন চরিত্র

লাইলি-মজনু মূলত সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনুল মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদীর প্রেমনির্ভর লোকগাঁথা। লাইলি-পরবর্তী সময়ে লায়লা আল আমিরিয়া নামে পরিচিত হন। আর কায়েস পরিচিত হন মজনু নামে।

আরবের ধনী রাজা আমির আল মুলাওয়ার একমাত্র সন্তান তিনি। বহুকাল ধরে নিঃসন্তান ছিলেন আমির। অনেক প্রার্থনা শেষে মজনুকে লাভ করেন। ছেলেটি ছিল আলো দিয়ে সাজানো। জ্যোতি যেন ঝরে পড়ত তার মুখ থেকে, হাসি থেকে। মুক্তোর মতো ত্বক, শরীর যেন গোলাপ দিয়ে রাঙানো। তার গড়ন ও রূপ ছিল এক বিস্ময়। সন্তান লাভ করে বেহিসাবে ধনসম্পদ দান করতে লাগলেন আমির। প্রচুর দান পেয়ে জনতাও প্রফুল্ল। তাদের মন খুশিতে একাকার, আনন্দে অধীর। শিশুটির যত্নের জন্য রাখা হলো দক্ষ সেবিকা। সব সময় যত্ন, সব সময় নজর রাখা। কিছু দিনের মধ্যে দেখা গেল সুন্দরী নারীর কোল সে বেশি পছন্দ করে। রাজা সন্তানকে কোলে রাখার জন্য সুন্দরীতমার ব্যবস্থা করলেন।

এক জ্যোতিষী একদিন তাকে দেখলেন। হাত দেখে বললেন, ছেলেটি বড় হয়ে প্রেমে পড়বে এক রূপসীর। তারপর উন্মাদ হয়ে যাবে। কায়েসের পিতা সেই থেকে মনোযোগী থাকলেন, যেন ছেলেটি প্রেমরোগে আক্রান্ত না হয়। কায়েসের বয়স বাড়ছিল আর বাড়ছিল সুন্দরতা। বয়স যখন সাত হলো, তার মুখে আভাসিত হলো চুলের রেখা। দামেশকে পাঠানো হলো পড়াশোনার জন্য। দ্রুতই সেখানে হয়ে উঠল সেরা ছাত্র। সেখানে ছেলেরা, মেয়েরা পড়ত একসঙ্গে। একদা অভিজাত এক রূপসী এলো বিদ্যালয়ে। তার অপরূপা যেন স্বর্গ থেকে এসেছে। তার নাম লাইলি। হরিণীর মতো চোখ, চাহনি মাত্রই হৃদয় হরণ করে। তার চোখের মায়াবি বিদ্যুতে ছাই হতে পারে দুনিয়ার অন্তর। তার লাস্যময়ী চেহারা যেন মরুর আকাশের মায়াচাঁদ, কিন্তু হৃদয়ে ঢেউ তোলার প্রশ্নে সে যেন পারস্যের পরীরানী।

প্রথম দেখাতেই কায়েসের হৃদয়ে বিদ্ধ হয়ে গেল লাইলির চোখ। সে বন্দি হয়ে গেল লাইলির মায়ায়। তখনও তার বয়স ১০ ছাড়ায়নি। বাবা খবর পেলেন। বাধা দিলেন। কিন্তু কায়েস নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। লাইলির জন্য সে লিখতে থাকল কবিতার পর কবিতা। শোনাতে লাগল লোকদের। দিনের পর দিন বাড়তে থাকল মত্ততা। পথের মোড়ে কায়েস আবৃত্তি করতে থাকে লাইলিকে। অচিরেই উন্মাদনার দিকে ধাবিত হলো এই প্রেম। লোকেরা তাকে ডাকতে থাকল মজনু, পাগল। লাইলিও মজে গিয়েছিল মজনুর মায়ায়। পাঠশালার বইয়ের চেয়ে সে ডুবে থাকত মজনুর চোখে, উচ্চারণে, আচরণে, অভিব্যক্তিতে। তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও স্বাভাবিক থাকতে পারত না। প্রেমে মত্ত লাইলির খবর জনে জনে রটে গেল। শুনলেন তার মা। মেয়েটিকে করলেন গৃহবন্দি। অনেক বুঝানো হলো, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই তার। তার ধ্যানে ও জ্ঞানে কেবলই মজনু।

গৃহবন্দি লাইলিকে দেখতে উদগ্রীব মজনু ছদ্মবেশে আসে লাইলির বাড়িতে, ধরা পড়ে তার বাবার হাতে, মার খায় খুব। লাইলি তাকে দেখতে না পেয়ে খাবার-দাবার ছেড়ে দেয়। মজনু যায় বনে। পশুদের সঙ্গে থাকে। সব কিছুর মধ্যে লায়লিকে খোঁজে। লায়লিও মজনুকে জপে আর কাঁদে। মাটিতে লেখে লায়লার নাম। স্মরণকে তাজা রাখে স্বাদ পাবে বলে। জপে তার নাম। মজনুর বাবা লাইলির বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এক উন্মাদের কাছে কে বিয়ে দেবে কন্যাকে? একসময় বিয়েতে সম্মত হলেন লাইলির পিতা। আয়োজন হলো সাড়ম্বরে। কিন্তু বিয়ে অনুষ্ঠানে লাইলির কুকুরকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে মজনু। সবাই দেখে সে আসলেই উন্মাদ। বিয়ে ভেঙে যায়।

মজনু আরও ব্যাকুল হয়ে পড়ে। লাইলিও পুড়তে থাকে প্রেমের দাহনে। গাছের পাতায় মজনু লেখে লাইলির নাম। একা একা কথা বলে তার সঙ্গে। নামাজরত মানুষের সামনে দিয়ে চলে যায়, ভ্রুক্ষেপ করে না। লোকটি তিরস্কার করলে সে বলে লায়লার স্রষ্টার প্রেমিক হয়ে তুমি দেখলে আমি যাচ্ছি তোমার সামন দিয়ে। কিন্তু তার সৃষ্টির প্রেমিক আমি দেখতেই পাইনি তুমি নামাজে আছো। কেমন প্রেমিক হলে তুমি?

লাইলির বাবা জোর করে মেয়েকে বিয়ে দেন ইবনে সালাম নামক এক অভিজাতের সঙ্গে। কিন্তু লাইলি তো হৃদয় দিয়েছে মজনুকে, বাসর রাতেই স্বামীকে সে প্রত্যাখ্যান করে। মজনুর মা-বাবা ছেলেকে ফেরাতে সব চেষ্টা করেন। প্রতিদিন বাগানবাড়িতে রেখে আসেন উন্নত খাবার-দাবার। যদি ছেলেটি ফিরে আসে। কিন্তু মজনু ফিরবে না। জঙ্গলে সে থাকে লাইলির প্রত্যাশা নিয়ে। কাপড় পরে না, খাবার খায় না। পশুরা ছিল তার সহমর্মী। তারা তাকে ঘিরে রাখত। সে বৃক্ষকে, পাহাড়কে, হাওয়াকে শোনাত আপন বিরহের মর্মবেদনা। মজনুর মা-বাবা ছেলের দুঃখে মারা গেলেন। খবরটি এক বৃদ্ধের মাধ্যমে মজনুকে জানায় লাইলি। অনেক পরে তার কাছে যখন খবরটি পৌঁছল, সে সিদ্ধান্ত নিল আর লোকালয়ে ফিরবে না।

এ পরিস্থিতিতে লাইলির মা-বাবা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সিরিয়ায়। পথে ছিল অরণ্য। লাইলি পালিয়ে অরণ্যে চলে যায়। দেখা করে মজনুর সঙ্গে। তাকে দেয় বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু মজনু ভাবল, গোপনে, অরণ্যে এই বিয়ে সামাজিক স্বীকৃতি পাবে না, গুরুজন একে গ্রহণ করবেন না। সে লাইলিকে ফিরিয়ে দেয়।

সমাজ শাসনে শ্রদ্ধাশীল মজনু দেহজ কামনা থেকে অনেক দূরে। সে লাইলির অপরূপ রূপের আবাহন প্রত্যক্ষ করেছে। শরীরী মানুষকে পাওয়ার চেয়ে শরীরের শিল্পী ও প্রেমের পরমতার কাছে অধিক ধরা দেয়। এ অবশ্য লাইলির প্রেমের মধ্য দিয়ে। প্রথম প্রেম ছিল মাজাজি বা রূপক, পরের প্রেম হলো হাকিকি বা প্রকৃত। লাইলির প্রেমও কামমত্ত ছিল না। কিন্তু হৃদয়ের ব্যাকুলতা ছিল দাহিকাসম। সেই দহনে মৃত্যু হয় তার। খবর পায় মজনু। চলে যায় লাইলির কবরে। কাঁদতে থাকে। ব্যাকুল অশ্রু ঝরাতেই থাকে। সেখানে বিরহব্যাকুল রাত্রিদিন কাটে তার। সে এর মধ্যে অনুভব করছিল সান্নিধ্যের মৌতাত। শরীরের প্রতি অব্যাহত অবিচার তাকেও করে অতিশয় দুর্বল। অবশেষে সেও ঢলে পড়ে মরণের কোলে। প্রেমের পথ বেয়ে ভূমি থেকে ভূমায় ঘটে তার উত্তরণ, দৃশ্য থেকে আত্মায় লাভ করে সে উদ্ধার।

লাইল-মজনু মহাকাব্যের মূলকথা

আবদুর রহমান জামির লাইলি ও মজনু মহাকাব্যের মূলকথা হচ্ছে এই। জামির আগে আবু আব্দুল্লাহ জাফর ইবনে মুহাম্মদ আল রুদাকি (৮৮০-৯৪১), জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মদ ইলিয়াস নিজামী গঞ্জাবী (আ. ১১৪১-১২০৯), আবুল হাসান ইয়ামিন উদ্দীন খসরু (১২৫৩-১৩২৫), লাইলি-মজনুর ইতিবৃত্তকে ঘিরে মহাকাব্য লেখেন। তারপরে জামির ভাতিজা আব্দুল্লাহ হাতিফী (১৪৫৪- ১৫২১), বদর উদ্দীন হিলালী আস্ত্রাবাদী (১৪৭০-১৫২৯), মুহাম্মদ বিন মুসা দামিরী (১৩৪১-১৪০৫), মীর্জা মুহম্মদ কাসেমী গুণাবাদী (১৫২৩-১৫৭৪/১৫৭৬)। মজার ব্যাপার হলো এসব ইতিবৃত্তের একটির সঙ্গে আরেকটির ভিন্নতা প্রচুর। জামির কাব্যে যেখানে কাহিনির সমাপ্তি বিরহাত্মক, সেখানে অনেকেই মিলনের মধ্য দিয়ে পরিণতি রচনা করেছেন। লোককথনেও লাইলি-মজনুর মিলনের বয়ান রয়েছে। ভারতের রাজস্থানে রয়েছে এক মাজার, যা লাইলি-মজনুর মাজার নামে পরিচিত। বাংলা ভাষায় এ ইতিবৃত্ত জামিবাহিত হয়ে আসে। আনুমানিক ১৪৮৪ সালে রচিত হয় জামির কাব্য। রচিত হয় মসনবি আকারে।

ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, বাংলা ভাষায় ষোড়শ শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান লায়লী-মজনু কাব্য রচনা করেন ১৫৪৫-১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। গ্রন্থটি মূলত ফারসিজাত হলেও দৌলত উজির মৌলিকত্ব এনেছেন বিষয়বিন্যাসে, কাহিনিবয়ানে। জামি যেখানে পরমের সঙ্গে মানবহৃদয়ের প্রেমবন্ধনকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন, দৌলত উজির সেখানে প্রাধান্য দিয়েছেন লোকজ প্রেমকে, মানবীয় প্রণয়-বিরহকে। কিন্তু এর অন্তরালে কি আধ্যাত্মিকতার একটি সুর বয়ে যাচ্ছিল না? দৌলত উজির নিজেই ছিলেন সুফিভক্ত এবং সাধনায় ছিল তার লিপ্ততা। কিন্তু সমাজ মানস কাহিনির যে রূপায়ণে একাত্মবোধ করবে, দৌলত উজির সেই রূপকে বয়ন করেছেন সৃষ্টিশীল শৃঙ্খলায়।

এতে অশ্লীলতার উপস্থিতি ছিল না কোথাও। এর মধ্য দিয়ে ব্রজবুলি ভাষার রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ থেকে বাঙালি মনকে লাইলি-মজনুর হৃদয়কাঁপানো প্রেম পরিবেশে মজিয়ে রাখার জন্য তাকে অবলম্বন করতে হয়েছে নতুন ট্রাডিশন, দাঁড় করাতে হয়েছে নতুন টেকনিক। ফারসির লীলাময় প্রবাহ ও ছন্দমধুরতা, সংস্কৃতের গাম্ভীর্য ও ব্রজবুলির রসময়তা তার কাব্যে মোহনা রচনা করেছে। তার কাব্যে বাংলার পরিপ্রেক্ষিত অভিযোজিত হয়েছে। এখানকার পরিচিত আবেগ, দৃশ্য, সংলাপ ও ঐতিহ্য প্রযুক্ত হয়েছে ফারসির কাহিনি শরীরে। অলৌকিকতা খুব কমই প্রতিফলিত হয়েছে কাহিনিতে। জামিও অলৌকিকতাকে প্রশ্রয় দেননি তেমন। তার কাছে বরং তাত্ত্বিকতার আশ্রয় ছিল। দৌলত উজির সেখানে লোকজ রসধারা বইয়ে দেন মুখর নদীর মতো। বস্তুত বাংলা কাব্যে মানবিক বিরহজাত আখ্যানের প্রবর্তক দৌলত কাজী।

লাইলি-মজনু মূলত সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনুল মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদীর প্রেমনির্ভর লোকগাঁথা।
লাইলি-মজনু মূলত সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনুল মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদীর প্রেমনির্ভর লোকগাঁথা।

আরও যত লাইলি-মজনু

লাইলি-মজনু মহাকাব্যটি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। পরবর্তী সময়ে একই বিষয় ও শিরোনামে আরও অনেকেই এ কাব্য রচনা করেন। মুহম্মদ খাতের (১৮৬৪), আবুজদ জহিরুল হক (১৯৩০), ওয়াজেদ আলী (১৯৪৪) রচিত লায়লী-মজনু কাব্য গ্রাম বাঙলার ঘরে ঘরে বহুল পঠিত ছিল। সুকুমার সেন এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধান উপস্থাপন করেন সাপ্তাহিক দেশ সাহিত্য-এ। (কলকাতা, ১৩৭২, পৃ.৫৭)। তিনি দেখান আধুনিক কালপর্বে মহেশ চন্দ্র মিত্র (১৮৫৩), শেখ ফজলুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯০৩), লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনি নিয়ে লিখেছেন আখ্যায়িকা। কাহিনিকে নাট্যরূপ দিয়েছেন রাজকৃষ্ণ রায়, ১৮৯১ সালে। তবে এ তথ্যই সবটুকু নয়। দ্বারকানাথ রায় ১৮৫৯ সালে লাইলি-মজনু নিয়ে নাটক লেখেন এবং গীতিনাট্য লিখেন বাঁশরীমোহন মুখোপাধ্যায়। গদ্যে একে চিত্রায়ণ করেছেন বহু লেখক।

বায়রন যদিও লাইলি-মজনুকে প্রাচ্যের রোমিও-জুলিয়েট বলেছেন, কিন্তু বাঙালির কাছে লাইলি-মজনু রোমিও জুলিয়েটের অধিক। বাংলা কবিতায় সে আজও প্রেমের প্রতীক হিসেবে বন্দিত। কাজী নজরুল ইসলামের গানে লাইলি-মজনু উচ্চারিত হয় জীবন্ত বাস্তবতায়। কাজীর ভাষায়—

লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোল

প্রিয়তম! এতদিনে বিরহের নিশি বুঝি ভোর হলো ॥

মজনু! তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু-নদী পর্বতে

বন্দিনী আজ ভেঙেছে পিঞ্জর বাহির হয়েছে পথে।

কাজী নজরুল ইসলামের লাইলি-মজনু খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকার প্রেরণা। ঠিক জামির মতো। তাঁর ভাষায়—

কায়েস যেমন লাইলী লাগি’ লভিল মজনু খেতাব

যেমন ফরহাদ শিঁরির প্রেমে হ’ল দিওয়ানা বেতাব।

বে-খুদীতে মশগুল আমি তেমনি মোর খোদার তরে ॥

লেখক : কবি, গবেষক

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মুসা আল হাফিজ

কবি, লেখক ও গবেষক

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

লাইলি-মজনু মহাকাব্য— জামির কাব্যের সঙ্গে বাংলার আত্মীয়তা

প্রকাশ: ০১:২৬:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই ২০২২

লাইলি-মজনু বা লায়লা-মজনু হলো ৭ম শতাব্দীর প্রেমকাহিনি নির্ভর প্রাচীন আরব্য লোকগাথা।

লাইলি-মজনু মহাকাব্য সংশ্লিষ্ট কিছু কথা

সুফিতত্ত্বের চারণভূমি ইরান ও মধ্য এশিয়া। এর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুফি কবিরা মানুষে ও পরমে আশিক মাশুক তত্ত্বের রূপক হিসেবে তৈরি করেন মানবিক নানা প্রণয়োপাখ্যান। এর প্রভাব ভারত উপমহাদেশে আসে সরাসরি ফারসি ভাষার আশ্রয়ে। এখানেও সুফিসাধনার শেকড় অত্যন্ত গভীর। প্রতিটি ভাষা ও সাহিত্যে এর স্বাক্ষর মুদ্রিত। অধ্যাত্মতত্ত্বের রূপক কাব্য এখানে রচিত হয়েছে মরমি-সাংস্কৃতিক বিকাশের দরকারে। হিন্দি, উর্দু যেমন এসব আধ্যাত্মিক ইতিবৃত্তকে আমন্ত্রণ করেছে সহজেই, বাংলাও একে আত্তিকরণে বিলম্ব করেনি। এসব রূপকের অন্যতম হচ্ছে লাইলি-মজনু প্রেম কাহিনি, যদিও অনেক ঐতিহাসিকের মতে, লাইলি-মজনু সত্যিকার চরিত্র। 

লোককথা এর ওপর বিচিত্র রং চড়িয়েছে। লোককথা হিসেবে এর বিস্তার আরবে এবং এর সাহিত্যিক চিত্রায়ণ মূলত ফারসি ভাষায় হলেও এ কাহিনি আরবি বা ফারসি ভাষার নিজস্ব সম্পদ হয়ে নেই। বৈশ্বিক বিস্তার লাভ করেছে বহু শতক আগেই। তুর্কি, হিন্দি, পশতু, উর্দুসহ নানা ভাষার নিজস্ব সাহিত্য সম্ভারে এ রোম্যান্স কাহিনি যুক্ত করেছে নতুন অধ্যায়, নতুন বিভূতি। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও বিষয়টি বাস্তব।

লাইলি-মজনু মহাকাব্যের কাহিনিসংক্ষেপ ও বিভিন্ন চরিত্র

লাইলি-মজনু মূলত সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনুল মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদীর প্রেমনির্ভর লোকগাঁথা। লাইলি-পরবর্তী সময়ে লায়লা আল আমিরিয়া নামে পরিচিত হন। আর কায়েস পরিচিত হন মজনু নামে।

আরবের ধনী রাজা আমির আল মুলাওয়ার একমাত্র সন্তান তিনি। বহুকাল ধরে নিঃসন্তান ছিলেন আমির। অনেক প্রার্থনা শেষে মজনুকে লাভ করেন। ছেলেটি ছিল আলো দিয়ে সাজানো। জ্যোতি যেন ঝরে পড়ত তার মুখ থেকে, হাসি থেকে। মুক্তোর মতো ত্বক, শরীর যেন গোলাপ দিয়ে রাঙানো। তার গড়ন ও রূপ ছিল এক বিস্ময়। সন্তান লাভ করে বেহিসাবে ধনসম্পদ দান করতে লাগলেন আমির। প্রচুর দান পেয়ে জনতাও প্রফুল্ল। তাদের মন খুশিতে একাকার, আনন্দে অধীর। শিশুটির যত্নের জন্য রাখা হলো দক্ষ সেবিকা। সব সময় যত্ন, সব সময় নজর রাখা। কিছু দিনের মধ্যে দেখা গেল সুন্দরী নারীর কোল সে বেশি পছন্দ করে। রাজা সন্তানকে কোলে রাখার জন্য সুন্দরীতমার ব্যবস্থা করলেন।

এক জ্যোতিষী একদিন তাকে দেখলেন। হাত দেখে বললেন, ছেলেটি বড় হয়ে প্রেমে পড়বে এক রূপসীর। তারপর উন্মাদ হয়ে যাবে। কায়েসের পিতা সেই থেকে মনোযোগী থাকলেন, যেন ছেলেটি প্রেমরোগে আক্রান্ত না হয়। কায়েসের বয়স বাড়ছিল আর বাড়ছিল সুন্দরতা। বয়স যখন সাত হলো, তার মুখে আভাসিত হলো চুলের রেখা। দামেশকে পাঠানো হলো পড়াশোনার জন্য। দ্রুতই সেখানে হয়ে উঠল সেরা ছাত্র। সেখানে ছেলেরা, মেয়েরা পড়ত একসঙ্গে। একদা অভিজাত এক রূপসী এলো বিদ্যালয়ে। তার অপরূপা যেন স্বর্গ থেকে এসেছে। তার নাম লাইলি। হরিণীর মতো চোখ, চাহনি মাত্রই হৃদয় হরণ করে। তার চোখের মায়াবি বিদ্যুতে ছাই হতে পারে দুনিয়ার অন্তর। তার লাস্যময়ী চেহারা যেন মরুর আকাশের মায়াচাঁদ, কিন্তু হৃদয়ে ঢেউ তোলার প্রশ্নে সে যেন পারস্যের পরীরানী।

প্রথম দেখাতেই কায়েসের হৃদয়ে বিদ্ধ হয়ে গেল লাইলির চোখ। সে বন্দি হয়ে গেল লাইলির মায়ায়। তখনও তার বয়স ১০ ছাড়ায়নি। বাবা খবর পেলেন। বাধা দিলেন। কিন্তু কায়েস নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে। লাইলির জন্য সে লিখতে থাকল কবিতার পর কবিতা। শোনাতে লাগল লোকদের। দিনের পর দিন বাড়তে থাকল মত্ততা। পথের মোড়ে কায়েস আবৃত্তি করতে থাকে লাইলিকে। অচিরেই উন্মাদনার দিকে ধাবিত হলো এই প্রেম। লোকেরা তাকে ডাকতে থাকল মজনু, পাগল। লাইলিও মজে গিয়েছিল মজনুর মায়ায়। পাঠশালার বইয়ের চেয়ে সে ডুবে থাকত মজনুর চোখে, উচ্চারণে, আচরণে, অভিব্যক্তিতে। তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও স্বাভাবিক থাকতে পারত না। প্রেমে মত্ত লাইলির খবর জনে জনে রটে গেল। শুনলেন তার মা। মেয়েটিকে করলেন গৃহবন্দি। অনেক বুঝানো হলো, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই তার। তার ধ্যানে ও জ্ঞানে কেবলই মজনু।

গৃহবন্দি লাইলিকে দেখতে উদগ্রীব মজনু ছদ্মবেশে আসে লাইলির বাড়িতে, ধরা পড়ে তার বাবার হাতে, মার খায় খুব। লাইলি তাকে দেখতে না পেয়ে খাবার-দাবার ছেড়ে দেয়। মজনু যায় বনে। পশুদের সঙ্গে থাকে। সব কিছুর মধ্যে লায়লিকে খোঁজে। লায়লিও মজনুকে জপে আর কাঁদে। মাটিতে লেখে লায়লার নাম। স্মরণকে তাজা রাখে স্বাদ পাবে বলে। জপে তার নাম। মজনুর বাবা লাইলির বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু এক উন্মাদের কাছে কে বিয়ে দেবে কন্যাকে? একসময় বিয়েতে সম্মত হলেন লাইলির পিতা। আয়োজন হলো সাড়ম্বরে। কিন্তু বিয়ে অনুষ্ঠানে লাইলির কুকুরকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে মজনু। সবাই দেখে সে আসলেই উন্মাদ। বিয়ে ভেঙে যায়।

মজনু আরও ব্যাকুল হয়ে পড়ে। লাইলিও পুড়তে থাকে প্রেমের দাহনে। গাছের পাতায় মজনু লেখে লাইলির নাম। একা একা কথা বলে তার সঙ্গে। নামাজরত মানুষের সামনে দিয়ে চলে যায়, ভ্রুক্ষেপ করে না। লোকটি তিরস্কার করলে সে বলে লায়লার স্রষ্টার প্রেমিক হয়ে তুমি দেখলে আমি যাচ্ছি তোমার সামন দিয়ে। কিন্তু তার সৃষ্টির প্রেমিক আমি দেখতেই পাইনি তুমি নামাজে আছো। কেমন প্রেমিক হলে তুমি?

লাইলির বাবা জোর করে মেয়েকে বিয়ে দেন ইবনে সালাম নামক এক অভিজাতের সঙ্গে। কিন্তু লাইলি তো হৃদয় দিয়েছে মজনুকে, বাসর রাতেই স্বামীকে সে প্রত্যাখ্যান করে। মজনুর মা-বাবা ছেলেকে ফেরাতে সব চেষ্টা করেন। প্রতিদিন বাগানবাড়িতে রেখে আসেন উন্নত খাবার-দাবার। যদি ছেলেটি ফিরে আসে। কিন্তু মজনু ফিরবে না। জঙ্গলে সে থাকে লাইলির প্রত্যাশা নিয়ে। কাপড় পরে না, খাবার খায় না। পশুরা ছিল তার সহমর্মী। তারা তাকে ঘিরে রাখত। সে বৃক্ষকে, পাহাড়কে, হাওয়াকে শোনাত আপন বিরহের মর্মবেদনা। মজনুর মা-বাবা ছেলের দুঃখে মারা গেলেন। খবরটি এক বৃদ্ধের মাধ্যমে মজনুকে জানায় লাইলি। অনেক পরে তার কাছে যখন খবরটি পৌঁছল, সে সিদ্ধান্ত নিল আর লোকালয়ে ফিরবে না।

এ পরিস্থিতিতে লাইলির মা-বাবা মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সিরিয়ায়। পথে ছিল অরণ্য। লাইলি পালিয়ে অরণ্যে চলে যায়। দেখা করে মজনুর সঙ্গে। তাকে দেয় বিয়ের প্রস্তাব। কিন্তু মজনু ভাবল, গোপনে, অরণ্যে এই বিয়ে সামাজিক স্বীকৃতি পাবে না, গুরুজন একে গ্রহণ করবেন না। সে লাইলিকে ফিরিয়ে দেয়।

সমাজ শাসনে শ্রদ্ধাশীল মজনু দেহজ কামনা থেকে অনেক দূরে। সে লাইলির অপরূপ রূপের আবাহন প্রত্যক্ষ করেছে। শরীরী মানুষকে পাওয়ার চেয়ে শরীরের শিল্পী ও প্রেমের পরমতার কাছে অধিক ধরা দেয়। এ অবশ্য লাইলির প্রেমের মধ্য দিয়ে। প্রথম প্রেম ছিল মাজাজি বা রূপক, পরের প্রেম হলো হাকিকি বা প্রকৃত। লাইলির প্রেমও কামমত্ত ছিল না। কিন্তু হৃদয়ের ব্যাকুলতা ছিল দাহিকাসম। সেই দহনে মৃত্যু হয় তার। খবর পায় মজনু। চলে যায় লাইলির কবরে। কাঁদতে থাকে। ব্যাকুল অশ্রু ঝরাতেই থাকে। সেখানে বিরহব্যাকুল রাত্রিদিন কাটে তার। সে এর মধ্যে অনুভব করছিল সান্নিধ্যের মৌতাত। শরীরের প্রতি অব্যাহত অবিচার তাকেও করে অতিশয় দুর্বল। অবশেষে সেও ঢলে পড়ে মরণের কোলে। প্রেমের পথ বেয়ে ভূমি থেকে ভূমায় ঘটে তার উত্তরণ, দৃশ্য থেকে আত্মায় লাভ করে সে উদ্ধার।

লাইল-মজনু মহাকাব্যের মূলকথা

আবদুর রহমান জামির লাইলি ও মজনু মহাকাব্যের মূলকথা হচ্ছে এই। জামির আগে আবু আব্দুল্লাহ জাফর ইবনে মুহাম্মদ আল রুদাকি (৮৮০-৯৪১), জামালুদ্দীন আবু মুহাম্মদ ইলিয়াস নিজামী গঞ্জাবী (আ. ১১৪১-১২০৯), আবুল হাসান ইয়ামিন উদ্দীন খসরু (১২৫৩-১৩২৫), লাইলি-মজনুর ইতিবৃত্তকে ঘিরে মহাকাব্য লেখেন। তারপরে জামির ভাতিজা আব্দুল্লাহ হাতিফী (১৪৫৪- ১৫২১), বদর উদ্দীন হিলালী আস্ত্রাবাদী (১৪৭০-১৫২৯), মুহাম্মদ বিন মুসা দামিরী (১৩৪১-১৪০৫), মীর্জা মুহম্মদ কাসেমী গুণাবাদী (১৫২৩-১৫৭৪/১৫৭৬)। মজার ব্যাপার হলো এসব ইতিবৃত্তের একটির সঙ্গে আরেকটির ভিন্নতা প্রচুর। জামির কাব্যে যেখানে কাহিনির সমাপ্তি বিরহাত্মক, সেখানে অনেকেই মিলনের মধ্য দিয়ে পরিণতি রচনা করেছেন। লোককথনেও লাইলি-মজনুর মিলনের বয়ান রয়েছে। ভারতের রাজস্থানে রয়েছে এক মাজার, যা লাইলি-মজনুর মাজার নামে পরিচিত। বাংলা ভাষায় এ ইতিবৃত্ত জামিবাহিত হয়ে আসে। আনুমানিক ১৪৮৪ সালে রচিত হয় জামির কাব্য। রচিত হয় মসনবি আকারে।

ড. মুহম্মদ এনামুল হকের মতে, বাংলা ভাষায় ষোড়শ শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান লায়লী-মজনু কাব্য রচনা করেন ১৫৪৫-১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। গ্রন্থটি মূলত ফারসিজাত হলেও দৌলত উজির মৌলিকত্ব এনেছেন বিষয়বিন্যাসে, কাহিনিবয়ানে। জামি যেখানে পরমের সঙ্গে মানবহৃদয়ের প্রেমবন্ধনকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন, দৌলত উজির সেখানে প্রাধান্য দিয়েছেন লোকজ প্রেমকে, মানবীয় প্রণয়-বিরহকে। কিন্তু এর অন্তরালে কি আধ্যাত্মিকতার একটি সুর বয়ে যাচ্ছিল না? দৌলত উজির নিজেই ছিলেন সুফিভক্ত এবং সাধনায় ছিল তার লিপ্ততা। কিন্তু সমাজ মানস কাহিনির যে রূপায়ণে একাত্মবোধ করবে, দৌলত উজির সেই রূপকে বয়ন করেছেন সৃষ্টিশীল শৃঙ্খলায়।

এতে অশ্লীলতার উপস্থিতি ছিল না কোথাও। এর মধ্য দিয়ে ব্রজবুলি ভাষার রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ থেকে বাঙালি মনকে লাইলি-মজনুর হৃদয়কাঁপানো প্রেম পরিবেশে মজিয়ে রাখার জন্য তাকে অবলম্বন করতে হয়েছে নতুন ট্রাডিশন, দাঁড় করাতে হয়েছে নতুন টেকনিক। ফারসির লীলাময় প্রবাহ ও ছন্দমধুরতা, সংস্কৃতের গাম্ভীর্য ও ব্রজবুলির রসময়তা তার কাব্যে মোহনা রচনা করেছে। তার কাব্যে বাংলার পরিপ্রেক্ষিত অভিযোজিত হয়েছে। এখানকার পরিচিত আবেগ, দৃশ্য, সংলাপ ও ঐতিহ্য প্রযুক্ত হয়েছে ফারসির কাহিনি শরীরে। অলৌকিকতা খুব কমই প্রতিফলিত হয়েছে কাহিনিতে। জামিও অলৌকিকতাকে প্রশ্রয় দেননি তেমন। তার কাছে বরং তাত্ত্বিকতার আশ্রয় ছিল। দৌলত উজির সেখানে লোকজ রসধারা বইয়ে দেন মুখর নদীর মতো। বস্তুত বাংলা কাব্যে মানবিক বিরহজাত আখ্যানের প্রবর্তক দৌলত কাজী।

লাইলি-মজনু মূলত সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনুল মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদীর প্রেমনির্ভর লোকগাঁথা।
লাইলি-মজনু মূলত সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনুল মুলাওয়া এবং তার প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদীর প্রেমনির্ভর লোকগাঁথা।

আরও যত লাইলি-মজনু

লাইলি-মজনু মহাকাব্যটি প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। পরবর্তী সময়ে একই বিষয় ও শিরোনামে আরও অনেকেই এ কাব্য রচনা করেন। মুহম্মদ খাতের (১৮৬৪), আবুজদ জহিরুল হক (১৯৩০), ওয়াজেদ আলী (১৯৪৪) রচিত লায়লী-মজনু কাব্য গ্রাম বাঙলার ঘরে ঘরে বহুল পঠিত ছিল। সুকুমার সেন এ বিষয়ে একটি অনুসন্ধান উপস্থাপন করেন সাপ্তাহিক দেশ সাহিত্য-এ। (কলকাতা, ১৩৭২, পৃ.৫৭)। তিনি দেখান আধুনিক কালপর্বে মহেশ চন্দ্র মিত্র (১৮৫৩), শেখ ফজলুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৯০৩), লাইলি-মজনুর প্রেমকাহিনি নিয়ে লিখেছেন আখ্যায়িকা। কাহিনিকে নাট্যরূপ দিয়েছেন রাজকৃষ্ণ রায়, ১৮৯১ সালে। তবে এ তথ্যই সবটুকু নয়। দ্বারকানাথ রায় ১৮৫৯ সালে লাইলি-মজনু নিয়ে নাটক লেখেন এবং গীতিনাট্য লিখেন বাঁশরীমোহন মুখোপাধ্যায়। গদ্যে একে চিত্রায়ণ করেছেন বহু লেখক।

বায়রন যদিও লাইলি-মজনুকে প্রাচ্যের রোমিও-জুলিয়েট বলেছেন, কিন্তু বাঙালির কাছে লাইলি-মজনু রোমিও জুলিয়েটের অধিক। বাংলা কবিতায় সে আজও প্রেমের প্রতীক হিসেবে বন্দিত। কাজী নজরুল ইসলামের গানে লাইলি-মজনু উচ্চারিত হয় জীবন্ত বাস্তবতায়। কাজীর ভাষায়—

লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোল

প্রিয়তম! এতদিনে বিরহের নিশি বুঝি ভোর হলো ॥

মজনু! তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু-নদী পর্বতে

বন্দিনী আজ ভেঙেছে পিঞ্জর বাহির হয়েছে পথে।

কাজী নজরুল ইসলামের লাইলি-মজনু খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকার প্রেরণা। ঠিক জামির মতো। তাঁর ভাষায়—

কায়েস যেমন লাইলী লাগি’ লভিল মজনু খেতাব

যেমন ফরহাদ শিঁরির প্রেমে হ’ল দিওয়ানা বেতাব।

বে-খুদীতে মশগুল আমি তেমনি মোর খোদার তরে ॥

লেখক : কবি, গবেষক