১২:৪৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

রিভিউ: মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস— সমাজ বাস্তবতার চালচিত্র

নাজনীন বেগম
  • প্রকাশ: ১০:৩৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২
  • / ৮৩২৫ বার পড়া হয়েছে

কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

১৮৯৯ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। বিশ শতকের প্রথম দুই দশক কবির শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করার এক বিক্ষুব্ধ আর অস্থিরতার পরিবেশ। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক-প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের পালাক্রমের এক উত্তাল কালপর্ব। তার ওপর ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ আর পরিণতি তো আছেই। এমন পারিপার্শ্বিক টানাপোড়েনে সৃজনশীল চিন্তানায়করা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এমনকি বিশেষভাবে সমাজ সচেতনও। রাজনৈতিক অঙ্গন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিষবাষ্পে জর্জরিত। সেই সঙ্কটাপন্ন সামাজিক অব্যবস্থায় নজরুল তাড়িত হন বিশেষ এক বোধ আর আদর্শিক চৈতন্যের নির্মল অনুভবে।

নিজের বেপরোয়া এবং অস্থির জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয় যুগোত্তীর্ণ একং অদ্ভুত সৃজন শক্তি। ঠাণ্ডা মাথায় সৃজন আর মননকে সেভাবে নিমগ্ন করতে না পারলেও সৃষ্টির দ্যোতনায় এমনই ব্যাকুল হতেন তাতে যাই সৃষ্টি হতো তা যেমন অনবদ্য একইভাবে সমকালীন সমাজের এক বিক্ষুব্ধ প্রতিবেশের স্পষ্ট আর দৃঢ় প্রতিবাদ। সৃষ্টির আনন্দ আর আবেগে বিভোর নজরুল মননশীল জগতেও এক প্রতিভাদীপ্ত দৃঢ়শক্তি। জীবনভর নিজে তাড়িত হয়েছেন বাঁধনহারা এক অবাধ আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো। 

স্থিতিশীল জীবন প্রবাহ নজরুলের নিজস্ব বলয়ে সেভাবে প্রতীয়মান না হলেও তাঁর শৈল্পিক জগত ছিল এক সুসংবদ্ধ সৃষ্টি প্রবাহের দায়বদ্ধতা। এখানে তিনি অনন্য, সৃষ্টির নায়ক এবং যুগ ও কালের যথার্থ নির্মাতা। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ সেই সম্ভাবনার দিকনির্দেশক।

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি ১৯৩০ সালে প্রকাশ পায়। প্রায় দুই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও জীবনের নানামাত্রিক গতিময়তায় কয়েকটি সংখ্যায় তা অনুপস্থিতও থাকে। 

‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি রচনার সময় কাজী নজরুল ইসলাম পুরো পরিবার নিয়ে কৃষ্ণনগরে বাস করতেন। এলাকার নাম ছিল ‘চাঁদ সড়ক’। খ্রিস্টান মিশনারি এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাটির কলহ-বিবাদ, ধর্মীয় মতভেদ, আর্থিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিত্যদিনের জীবন প্রবাহ সব মিলিয়ে নজরুলের মানবিক চৈতন্যের যে বিদগ্ধ রচনাশৈলী তারই সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি কবির এই ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস। একেবারে কাছ থেকে দেখা সাধারণ মানুষের জীবন-ঘনিষ্ঠতার যে যথার্থ অবয়ব নজরুলের সৃজন-দ্যোতনায় গতি পায় তারই বিশিষ্ট আয়োজন তার এই উপন্যাসটি। 

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের বিস্তৃত বলয়, ঘটনাবহুল বিষয়বস্তু, বিচিত্র চরিত্রের বিন্যাস সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধর্মীয় আবহ গ্রন্থের আবেদনকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা যেমন সমকালীন বিক্ষুব্ধ ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করে একইভাবে ঔপন্যাসিককেও এক বিশিষ্ট মর্যাদায় দাঁড় করার। সামাজিক বিভেদ, ধর্মীয় বিরোধ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অসঙ্গতি এবং শাসন-শোষণের সুতীব্র আঁচড় নজরুল কখনও মানতে পারেননি। তার পরিচ্ছন্ন অনুভব যেমন কবিতায়, সঙ্গীতে একইভাবে তাঁর কথাশিল্পেও। নির্বিত্ত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে কোন ধরনের রোষানলকে তিনি তোয়াক্কাই করেননি।

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সৃষ্ট সব ধরনের অত্যাচার-অবিচার আর নিগ্রহের বিরুদ্ধে লড়াই করা অত সহজ ব্যাপার ছিল না। কারাবাস থেকে আরম্ভ করে বই বাজেয়াফত করা আরও হরেক রকম দণ্ডের বোঝা নজরুলকে বহন করতে হয়েছিল। কিন্তু অদম্য, দুর্দমনীয় বিদ্রোহীকে কোনভাবেই থামানো যায়নি। মৃত্যুক্ষুধা সেই বোধেরই রচনাশৈলী যা সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক শক্ত প্রতিবাদ। বিশেষ করে নিম্নবিত্তের শ্রম বিনিয়োগকারীরাই তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।

হিন্দু-মুসলমান, ক্রিশ্চিয়ান পাশাপাশি বাস করলেও বড় ধরনের বিবাদ-কলহের কোন সুযোগই নেই জীবনের তাড়নায়। উপন্যাসের শুরুতে লেখক যা বলেন— ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এদের পুরুষেরা জনমজুর খাটে— অর্থাৎ রাজমিস্ত্রী, খানসামা, বাবুর্চিগিরি বা ওই রকমের কিছু একটা করে। আর মেয়েরা ধান ভানে, ঘর-গেরস্থালির কাজকর্ম করে, বাঁধে, কাঁদে এবং নানা দুঃখ-ধান্ধা করে পুরুষের দুঃখ লাঘব করার চেষ্টা করে। বিধাতা যেন দয়া করেই এদের জীবনের দুঃখকে বড় করে দেখার অবকাশ দেননি। তাহলে হয়ত মস্ত বড় একটা অঘটন ঘটত। এরা যেন মৃত্যুর মাল গুদাম। অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে সাপ্লাই। আমদানি হতে যতক্ষণ, রফতানি হতেও ততক্ষণ।’ 

সৃষ্টির তাড়নায় উদ্বেলিত লেখকের কি অসাধারণ জীবনঘনিষ্ঠ অনুভব, দুঃখ আর কষ্টের ভাসমান স্রোতে বহমান নজরুলের নিজের জীবনটাই তো ছিল অতি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের কাতারে। এক সময় সেখান থেকে উঠে আসতে যে লড়াই করতে হয়েছিল তা সত্যিই জীবন প্রবাহের এক বিচিত্র অধ্যায়। বোধহয় সেই কারণে তাঁর সাহিত্যের সিংহভাগজুড়ে আছে অসহায়, নিঃস্ব এবং নিরীহ মানুষের করুণ আর্তি। মৃত্যুক্ষুধা সেই ধারারই একটি অনবদ্য সৃষ্টি।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের মূল নারী-পুরুষ চরিত্র নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন। প্রতিটি চরিত্রই গল্পের গতিময়তায় অনন্য। কোনো সময় মনে হয় গজালের মা-ই প্রধান নারী চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের নিজস্ব ধারায় মেজ বউয়ের যে সাবলীলতা, অনমনীয় দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্বের অবিচলতা তাতে মনে হয় অন্য সব চরিত্র ম্লান হয়ে যায় তার স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে।

ঘটনাপরম্পরায় মেজ বউ চরিত্রটি উপন্যাসে যে দীপ্তি ছড়ায় তার কিরণ শেষ হয়েও পরিণতি লাভ করে না। এই এক অদ্ভুত চরিত্র যে শুধু নিজের প্রয়োজনের তাগিদে তাকে গড়ে তোলে। কোনো মোহ বা আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে জীবনের গতির মোড় পরিবর্তন করে না। 

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে নজরুল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দেখান একটি ব্যক্তি চরিত্র যত না ব্যক্তিক তার চেয়েও বেশি সামাজিক।  সমাজ ব্যবস্থাই কোন মানুষের চরিত্রের গতি নির্ণয় করে দেয়, তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় সর্বোপরি এক অবধারিত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কিছু মানুষ বের হয়ে আসলেও তারা শুধুই ব্যতিক্রম।

গজালের মা তার বয়স, অভিজ্ঞতা আর প্রাত্যহিক জীবনের টানাপোড়েনে প্রচলিত ব্যবস্থার কাছে নিজেকে সমর্পিত করে। কিন্তু অকাল বিধবা মেজ বউয়ের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ঘর থেকে বের হওয়া মেজ বউ ধর্মীয় বাতাবরণের এক পরিবর্তিত অধ্যায়েরও শিকার হতে হয়।

মুসলমান থেকে একেবারে ক্রিশ্চিয়ান হওয়া তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার এক অসহনীয় পরিস্থিতি। যার শিকার হতে হয় উঠতি বয়সে অনাগত জীবনের নতুন করে কোন কিছু পাওয়ার এক প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষা। তৎকালীন সময়টা চিন্তা করলে বুঝতে কষ্ট হবে না খ্রীস্টান মিশনারিরা কিভাবে এদেশীয় হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার এক অপকৌশলে মেতে উঠেছিল। উপন্যাসের আকর্ষণীয় চরিত্র মেজ বউকে সেভাবেই লেখক পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। পাশাপাশি এসব ঘটনার সামাজিক বিরোধগুলোকে অত্যন্ত সহজ এবং স্বচ্ছভাবে পাঠকের কাছে নিয়ে আসা হয়।

হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের যে ধর্মগত বিভেদ তা কোন এক সময় মিলে মিশে একাত্ম হয়ে যেতেও বেশি দেরি লাগে না। আসলে সূক্ষ্ম বিরোধগুলো অতি সাধারণ এবং নিম্নবিত্ত মানুষদের অত ভাবায়ও না। যেমন প্যাঁকালে মুসলমান হয়েও ক্রিশ্চিয়ান কুর্শির প্রেমের সাগরে ডুবে যায়। এক সময় বিয়েও করে বসে। সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অন্যত্র পালিয়েও যায়। উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট চরিত্র এই প্যাঁকালে। সুপুরুষ প্যাঁকালে উদীয়মান কিশোরীদের স্বপ্নের মানুষ। তার মধ্যে কুর্শি তার আকাঙ্ক্ষিত নারী। কুর্শির জন্য সে সব কিছু করতে পারে এবং করে দেখায়ও।

মানুষের ব্যক্তিক ভালবাসা, উচ্ছ্বাস, আবেগ আর প্রীতির এক নির্মল বাঁধনে বাধা প্যাঁকালে এবং কুর্শি। প্রতিটি মানুষের জীবনের উল্লেখযোগ্য আর অপরিহার্য পর্যায় মায়া-মমতায় সিক্ত এই চিরায়ত বন্ধন যা লেখক কুর্শি আর প্যাঁকালের মধ্যে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করেন। ঘটনার টানাপোড়েনেও যে বন্ধন আলগা হয় না। বিয়ের আগে একবার প্যাঁকালে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে পছন্দের মানুষ কুর্শির সঙ্গেই জীবনের মালা গাঁথে। মানুষের জীবনে এই এক অপরিহার্য বন্ধন যা তাকে একটি নির্দিষ্ট গতিতে নিয়মমাফিক এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিনিয়তই ঘটনা প্রবাহের আবর্তে পড়া চরিত্রগুলো লেখকের অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে তৈরি হওয়া এক অভিনব সৃষ্টি যা গ্রন্থের মূল বার্তাকে পাঠকের সামনে হাজির করে দেয়।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের এক পর্যায়ে বিপ্লবী দলের সংগঠক আনসারের উপস্থিতি। বৈপ্লবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী সে। গোপন আস্তানায় তাদের সাংগঠনিক এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তরালে এই কার্যক্রম চালাতে গিয়ে এসব বিপ্লবীকে অনেক ঝক্কি ঝামেলাও পোহাতে হয়। পুলিশী ওয়ারেন্ট নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। ছন্নছাড়া, দিশেহারা এবং অনিশ্চিত জীবনের ঘানি টানতে টানতে কখনও বা কোথাও গিয়ে আস্তানা গাড়ে কয়েক দিনের জন্য। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে উদ্দীপ্ত আনসার সমাজের ছোটখাটো অনেক ঘটনারও অংশীদার হয়ে যায়। সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহ বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করে যা সামগ্রিক ব্যবস্থাকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়।

আনসারের কাছে ধর্মীয় বিভেদ তেমন কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু এর কারণে যেসব অনাহূত অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় সেটাই তাকে ভাবিয়ে তোলে। মেজ বউয়ের ক্রিশ্চিয়ান হয়ে এলাকা থেকে চলে যাওয়াটাও তেমনি এক দৃষ্টিকটু ব্যাপার যা আনসারকেও চিন্তিত করে। এর একটা যৌক্তিক সমাধানও তার পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়। যদিও মেজ বউ তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে এবং এক সময় তা করেও। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বভাবসুলভ বৈপ্লবিক চেতনায় প্রতিটি চরিত্রে যেভাবে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন একইভাবে তা প্রথাসিদ্ধ সমাজের একটি সচিত্র প্রতিবেদনও বটে। গঁৎ বাঁধা সামাজিক বিধি তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঔপনিবেশিক শাসনের করাল গ্রাস, ব্যক্তি চরিত্রের নানা সম্ভাবনা আর অসঙ্গতি সব মিলিয়ে উপন্যাসের যে গতি প্রকৃতি সব সময় তা স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণেও থাকে না।

মৃত্যুক্ষুধা— কাজী নজরুল ইসলামের একটি কালজয়ী

মৃত্যুক্ষুধার অনেক মৃত্যুর নির্মম পরিণতি যেমন পাঠককুলকে বিষণ্ণ আবেশে ব্যথিত করে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদা অন্ন-বস্ত্রের এক বিবর্ণ হাহাকার। আপনজনের মৃত্যু যন্ত্রণা এক সময় অভ্যাসে পরিণত হয় কিন্তু নিত্য ক্ষুধার অসহনীয় পেষণ একেবারে সহ্য সীমার বাইরে। দুটোকে একসঙ্গে মেলাতে গিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের অসঙ্গতিগুলোকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান সেখান থেকে পাঠক অন্যদিকে ফিরে তাকানোর অবকাশও পায় না। নজরুল উপন্যাসটা লিখেছেন নিজের দেখা একটি বস্তি এলাকার ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন রকমের জীবন ও ঘটনাপ্রবাহে। তাকে গল্পে রূপ দিতে গিয়ে প্রচলিত সামাজিক অবয়বকে অস্বীকার করে কোন ধরনের কল্পনার আশ্রয় নেয়া আদপেই সম্ভব হয়নি। নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে লিখলে হয়তবা মিলনের সুরে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ মাঝে মধ্যে হলেও ঝঙ্কৃত হতো।

গজালের মার প্রথম তিন সন্তানই মৃত। প্যাঁকেল বেঁচে থেকেও ছন্নছাড়া, গৃহহীন। মায়ের সঙ্গে পুরো সংসারের আবর্তে সে কখনই পড়তে চায়নি। এমনকি কুর্শির সঙ্গেও নয়। নিজেকে নিয়েই নিজে ব্যস্ত। কুর্শির অতিমাত্রায় আগ্রহের কারণে তার সঙ্গে বাধা পড়ে। মেজ বউ রূপে-গুণে সাধারণের নজরকাড়া এক দৃঢ়চিত্তের নারী। নিজের ইচ্ছেতেই দুই সন্তানকে বাদ দিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম গ্রহণ করা। বড় ছেলের মৃত্যুর পর আবার ঘরে ফিরে আসা। সেখানেও তার বিপন্ন অবস্থার আঁধার কাটে না। আর বিপ্লবী আনসার? প্রথম ভালবাসার মানুষ তার নিজের হয়নি। ব্যক্তিপ্রেমের উর্ধে উঠে দেশপ্রেমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। এভাবে জীবনটা দেশমাতার চরণে সঁপে দিয়ে নিজেও অনন্ত যাত্রায় এগিয়ে যায়। প্রতিটি চরিত্র বিধৃত হয়েছে দুঃখ, কষ্ট, বেদনার এক অবর্ণনীয় নির্মমতায়। যেখানে সুখ নামক আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি খুঁজে পাওয়া যায় না। 

চোখের সামনে তিন সন্তানের মৃত্যু দেখা গজালের মার মানসিক যন্ত্রণার শেষ কোথায় সেটা কেউ জানে না। এমনকি লেখকও না। সর্বশেষ সন্তান দিশেহারা, সংসারচ্যুত। ক্রিশ্চিয়ান হয়ে কুর্শিকে বিয়ে করে ঘর বাঁধে। বড় নাতির মৃত্যু, সেজ বউ ও তার খোকার অকালে চলে যাওয়া, মেজ বউয়ের ক্রিশ্চিয়ান হওয়া সব মিলিয়ে গজালের মার যে নিষ্ঠুর নিয়তি তা খ-ানোর কোন সুযোগ উপন্যাসে নেই। স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ আনসারের যে বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব, ব্রিটিশ তাড়ানোর যে উদ্দীপ্ত আবেগ তারও সর্বশেষ পর্যায় অনেক ব্যথা-বেদনা, কষ্ট আর স্বপ্নভঙ্গের করুণ আখ্যান। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াটাও সেভাবে কোন অনিবার্য পরিণতির দিকে এগুতো পারেনি।

দেশাত্মবোধের চেতনায় উৎসর্গিত এই অনিশ্চিত আর সাংঘর্ষিক টানাপোড়েন বিপ্লবী আনসারের জীবনে কোন সুস্থির গতিপথ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। পোড় খাওয়া মানুষ আর সমাজের এই এক অবশ্যম্ভাবী শেষ অধ্যায় যার ওপর না থাকে স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণ কিংবা না বেরুতে পারে গল্পের চরিত্র। নজরুলের সমাজের এসব অবর্ণনীয়, দুঃখ, দুর্দশা আর নির্মম শৃঙ্খলকে আপন অভিজ্ঞতায় নিজের মতো করে দেখার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য দুটোই হয়েছে। কাহিনীর গতিপথ নির্ধারণ, চরিত্রের গঠনশৈলী নির্মাণ কিংবা সমকালীন ব্যবস্থার সুতীক্ষè আঁচড় নজরুলের সৃজন এবং শিল্পসত্তাকে অতিক্রম করে যায়। আর তাই ঘটনাবহুল বিন্যাসে তার সুস্পষ্ট ছাপা যেমন লক্ষণীয় পাশাপাশি চরিত্রগুলোর সৃষ্টি আর বিকাশেও পড়েছে এর তীব্র প্রভাব। সব মিলিয়ে নজরুলের বাস্তব সমাজ নিরীক্ষার যে সূক্ষ্ম দৃষ্টি তাও পাঠককে নানামাত্রিকে মুগ্ধ করে। সমকালীন সমাজের জীবন্ত চালচিত্র পাঠকের সামনে নতুন করে উন্মোচিত হয়। নজরুলের জীবন সংগ্রাম শুরু হয় একেবারে কৈশোর থেকে। তার নিরন্তর গতি চলতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়া থেকে ফেরা অবধি। তার পরও যতদিন সচেতন অবস্থায় ছিলেন তার থেকে অব্যাহতি কোন দিনই পাননি। যার জ্বলন্ত স্বাক্ষর তার অনবদ্য সৃষ্টি সম্ভার।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে পরাভূত করে স্বাধীনতা এবং অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে তিনি প্রতিনিয়তই সম্পৃক্ত ছিলেন। এ জন্য তাঁকে বিভিন্ন মাত্রিকে অবিচারের দণ্ড দেয়া হয়েছে। কারাবরণ থেকে শুরু করে অনশনের মতো অসহনীয় কষ্ট তাকে পোহাতে হয়েছে। দুঃখে ভারাক্রান্ত জীবনের ঘানি টানতে টানতে সৃজন আর চিন্তাশীলতায়ও পড়ে ছিল এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। মৃত্যুক্ষুধা তারই একটি অনবদ্য শৈল্পিক প্রয়াস। কঠিন জীবনবোধ নজরুলকে যে মাত্রিকে অস্থির আর দিশেহারা করেছে তার পরিপূর্ণ বিকাশ তাঁর সৃজনসৌধ। কবিতায়, গানে যেমন একইভাবে প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং উপন্যাসেও তিনি একজন বাস্তবোচিত সমাজ নিরীক্ষক। সমাজ আর জীবনের গভীরতা, ব্যাপ্তী, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদকে আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হলে এর যথার্থ চিত্রও তুলে ধরা একেবারে অসম্ভব।

আলোচনার শুরুতেই বলা হয়েছে যাদের নিয়ে তাঁর এই গল্প কাহিনী সেই সব চরিত্রের একেবারে কাছাকাছি ছিলেন নজরুল। সাধারণ মানুষের নৈকট্য, তাদের প্রতিদিনের জীবন ও ঘটনাপ্রবাহ সরাসরি প্রত্যক্ষ করা লেখক নিজের সৃজন শক্তির মিলিত সম্পদে তৈরি করেছেন উপন্যাসের সুনির্দিষ্ট গতিপথ, চরিত্রগুলোও আপন বৈশিষ্ট্যে ঘটনার পালাক্রমে এগিয়ে যাওয়া। সবশেষে অনিবার্য পরিণতি টেনে আনতে শৈল্পিক আর মনোজাগতিক প্রভাবকেও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখেছেন। সব থেকে বেশি দায়বদ্ধতা ছিল প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত বিরোধ আর উদ্ভূত সঙ্কট স্পষ্ট করা।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

নাজনীন বেগম

নাজনীন বেগম একজন সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক। মূলত সমাজতত্ত্বের ছাত্রী হলেও সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় নিজেকে পুরোপুরি যুক্ত রেখেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষে দৈনিক পূর্বকোণের মাধ্যমে সাংবাদিকতায় অভিষেক। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল ধরে দৈনিক জনকণ্ঠে অপরাজিতা পাতার বিভাগীয় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রবল রবীন্দ্র অনুরাগী নাজনীন বেগম ২০১৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএস থেকে অধ্যাপক ড. স্বরোচিষ সরকারের অধীনে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ দেশী-বিদেশী জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

রিভিউ: মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস— সমাজ বাস্তবতার চালচিত্র

প্রকাশ: ১০:৩৮:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ জুলাই ২০২২

১৮৯৯ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। বিশ শতকের প্রথম দুই দশক কবির শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করার এক বিক্ষুব্ধ আর অস্থিরতার পরিবেশ। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক-প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের পালাক্রমের এক উত্তাল কালপর্ব। তার ওপর ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরম্ভ আর পরিণতি তো আছেই। এমন পারিপার্শ্বিক টানাপোড়েনে সৃজনশীল চিন্তানায়করা উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এমনকি বিশেষভাবে সমাজ সচেতনও। রাজনৈতিক অঙ্গন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিষবাষ্পে জর্জরিত। সেই সঙ্কটাপন্ন সামাজিক অব্যবস্থায় নজরুল তাড়িত হন বিশেষ এক বোধ আর আদর্শিক চৈতন্যের নির্মল অনুভবে।

নিজের বেপরোয়া এবং অস্থির জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয় যুগোত্তীর্ণ একং অদ্ভুত সৃজন শক্তি। ঠাণ্ডা মাথায় সৃজন আর মননকে সেভাবে নিমগ্ন করতে না পারলেও সৃষ্টির দ্যোতনায় এমনই ব্যাকুল হতেন তাতে যাই সৃষ্টি হতো তা যেমন অনবদ্য একইভাবে সমকালীন সমাজের এক বিক্ষুব্ধ প্রতিবেশের স্পষ্ট আর দৃঢ় প্রতিবাদ। সৃষ্টির আনন্দ আর আবেগে বিভোর নজরুল মননশীল জগতেও এক প্রতিভাদীপ্ত দৃঢ়শক্তি। জীবনভর নিজে তাড়িত হয়েছেন বাঁধনহারা এক অবাধ আর মুক্ত বিহঙ্গের মতো। 

স্থিতিশীল জীবন প্রবাহ নজরুলের নিজস্ব বলয়ে সেভাবে প্রতীয়মান না হলেও তাঁর শৈল্পিক জগত ছিল এক সুসংবদ্ধ সৃষ্টি প্রবাহের দায়বদ্ধতা। এখানে তিনি অনন্য, সৃষ্টির নায়ক এবং যুগ ও কালের যথার্থ নির্মাতা। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ সেই সম্ভাবনার দিকনির্দেশক।

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি ১৯৩০ সালে প্রকাশ পায়। প্রায় দুই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও জীবনের নানামাত্রিক গতিময়তায় কয়েকটি সংখ্যায় তা অনুপস্থিতও থাকে। 

‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি রচনার সময় কাজী নজরুল ইসলাম পুরো পরিবার নিয়ে কৃষ্ণনগরে বাস করতেন। এলাকার নাম ছিল ‘চাঁদ সড়ক’। খ্রিস্টান মিশনারি এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাটির কলহ-বিবাদ, ধর্মীয় মতভেদ, আর্থিক টানাপোড়েন, সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিত্যদিনের জীবন প্রবাহ সব মিলিয়ে নজরুলের মানবিক চৈতন্যের যে বিদগ্ধ রচনাশৈলী তারই সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি কবির এই ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস। একেবারে কাছ থেকে দেখা সাধারণ মানুষের জীবন-ঘনিষ্ঠতার যে যথার্থ অবয়ব নজরুলের সৃজন-দ্যোতনায় গতি পায় তারই বিশিষ্ট আয়োজন তার এই উপন্যাসটি। 

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের বিস্তৃত বলয়, ঘটনাবহুল বিষয়বস্তু, বিচিত্র চরিত্রের বিন্যাস সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধর্মীয় আবহ গ্রন্থের আবেদনকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা যেমন সমকালীন বিক্ষুব্ধ ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করে একইভাবে ঔপন্যাসিককেও এক বিশিষ্ট মর্যাদায় দাঁড় করার। সামাজিক বিভেদ, ধর্মীয় বিরোধ, শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অসঙ্গতি এবং শাসন-শোষণের সুতীব্র আঁচড় নজরুল কখনও মানতে পারেননি। তার পরিচ্ছন্ন অনুভব যেমন কবিতায়, সঙ্গীতে একইভাবে তাঁর কথাশিল্পেও। নির্বিত্ত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে কোন ধরনের রোষানলকে তিনি তোয়াক্কাই করেননি।

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সৃষ্ট সব ধরনের অত্যাচার-অবিচার আর নিগ্রহের বিরুদ্ধে লড়াই করা অত সহজ ব্যাপার ছিল না। কারাবাস থেকে আরম্ভ করে বই বাজেয়াফত করা আরও হরেক রকম দণ্ডের বোঝা নজরুলকে বহন করতে হয়েছিল। কিন্তু অদম্য, দুর্দমনীয় বিদ্রোহীকে কোনভাবেই থামানো যায়নি। মৃত্যুক্ষুধা সেই বোধেরই রচনাশৈলী যা সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক শক্ত প্রতিবাদ। বিশেষ করে নিম্নবিত্তের শ্রম বিনিয়োগকারীরাই তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।

হিন্দু-মুসলমান, ক্রিশ্চিয়ান পাশাপাশি বাস করলেও বড় ধরনের বিবাদ-কলহের কোন সুযোগই নেই জীবনের তাড়নায়। উপন্যাসের শুরুতে লেখক যা বলেন— ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এদের পুরুষেরা জনমজুর খাটে— অর্থাৎ রাজমিস্ত্রী, খানসামা, বাবুর্চিগিরি বা ওই রকমের কিছু একটা করে। আর মেয়েরা ধান ভানে, ঘর-গেরস্থালির কাজকর্ম করে, বাঁধে, কাঁদে এবং নানা দুঃখ-ধান্ধা করে পুরুষের দুঃখ লাঘব করার চেষ্টা করে। বিধাতা যেন দয়া করেই এদের জীবনের দুঃখকে বড় করে দেখার অবকাশ দেননি। তাহলে হয়ত মস্ত বড় একটা অঘটন ঘটত। এরা যেন মৃত্যুর মাল গুদাম। অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে সাপ্লাই। আমদানি হতে যতক্ষণ, রফতানি হতেও ততক্ষণ।’ 

সৃষ্টির তাড়নায় উদ্বেলিত লেখকের কি অসাধারণ জীবনঘনিষ্ঠ অনুভব, দুঃখ আর কষ্টের ভাসমান স্রোতে বহমান নজরুলের নিজের জীবনটাই তো ছিল অতি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের কাতারে। এক সময় সেখান থেকে উঠে আসতে যে লড়াই করতে হয়েছিল তা সত্যিই জীবন প্রবাহের এক বিচিত্র অধ্যায়। বোধহয় সেই কারণে তাঁর সাহিত্যের সিংহভাগজুড়ে আছে অসহায়, নিঃস্ব এবং নিরীহ মানুষের করুণ আর্তি। মৃত্যুক্ষুধা সেই ধারারই একটি অনবদ্য সৃষ্টি।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের মূল নারী-পুরুষ চরিত্র নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন। প্রতিটি চরিত্রই গল্পের গতিময়তায় অনন্য। কোনো সময় মনে হয় গজালের মা-ই প্রধান নারী চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের নিজস্ব ধারায় মেজ বউয়ের যে সাবলীলতা, অনমনীয় দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্বের অবিচলতা তাতে মনে হয় অন্য সব চরিত্র ম্লান হয়ে যায় তার স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্যে।

ঘটনাপরম্পরায় মেজ বউ চরিত্রটি উপন্যাসে যে দীপ্তি ছড়ায় তার কিরণ শেষ হয়েও পরিণতি লাভ করে না। এই এক অদ্ভুত চরিত্র যে শুধু নিজের প্রয়োজনের তাগিদে তাকে গড়ে তোলে। কোনো মোহ বা আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে জীবনের গতির মোড় পরিবর্তন করে না। 

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে নজরুল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দেখান একটি ব্যক্তি চরিত্র যত না ব্যক্তিক তার চেয়েও বেশি সামাজিক।  সমাজ ব্যবস্থাই কোন মানুষের চরিত্রের গতি নির্ণয় করে দেয়, তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় সর্বোপরি এক অবধারিত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকে কিছু মানুষ বের হয়ে আসলেও তারা শুধুই ব্যতিক্রম।

গজালের মা তার বয়স, অভিজ্ঞতা আর প্রাত্যহিক জীবনের টানাপোড়েনে প্রচলিত ব্যবস্থার কাছে নিজেকে সমর্পিত করে। কিন্তু অকাল বিধবা মেজ বউয়ের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ঘর থেকে বের হওয়া মেজ বউ ধর্মীয় বাতাবরণের এক পরিবর্তিত অধ্যায়েরও শিকার হতে হয়।

মুসলমান থেকে একেবারে ক্রিশ্চিয়ান হওয়া তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার এক অসহনীয় পরিস্থিতি। যার শিকার হতে হয় উঠতি বয়সে অনাগত জীবনের নতুন করে কোন কিছু পাওয়ার এক প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষা। তৎকালীন সময়টা চিন্তা করলে বুঝতে কষ্ট হবে না খ্রীস্টান মিশনারিরা কিভাবে এদেশীয় হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার এক অপকৌশলে মেতে উঠেছিল। উপন্যাসের আকর্ষণীয় চরিত্র মেজ বউকে সেভাবেই লেখক পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। পাশাপাশি এসব ঘটনার সামাজিক বিরোধগুলোকে অত্যন্ত সহজ এবং স্বচ্ছভাবে পাঠকের কাছে নিয়ে আসা হয়।

হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের যে ধর্মগত বিভেদ তা কোন এক সময় মিলে মিশে একাত্ম হয়ে যেতেও বেশি দেরি লাগে না। আসলে সূক্ষ্ম বিরোধগুলো অতি সাধারণ এবং নিম্নবিত্ত মানুষদের অত ভাবায়ও না। যেমন প্যাঁকালে মুসলমান হয়েও ক্রিশ্চিয়ান কুর্শির প্রেমের সাগরে ডুবে যায়। এক সময় বিয়েও করে বসে। সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অন্যত্র পালিয়েও যায়। উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট চরিত্র এই প্যাঁকালে। সুপুরুষ প্যাঁকালে উদীয়মান কিশোরীদের স্বপ্নের মানুষ। তার মধ্যে কুর্শি তার আকাঙ্ক্ষিত নারী। কুর্শির জন্য সে সব কিছু করতে পারে এবং করে দেখায়ও।

মানুষের ব্যক্তিক ভালবাসা, উচ্ছ্বাস, আবেগ আর প্রীতির এক নির্মল বাঁধনে বাধা প্যাঁকালে এবং কুর্শি। প্রতিটি মানুষের জীবনের উল্লেখযোগ্য আর অপরিহার্য পর্যায় মায়া-মমতায় সিক্ত এই চিরায়ত বন্ধন যা লেখক কুর্শি আর প্যাঁকালের মধ্যে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করেন। ঘটনার টানাপোড়েনেও যে বন্ধন আলগা হয় না। বিয়ের আগে একবার প্যাঁকালে পালিয়ে গেলেও পরবর্তীতে পছন্দের মানুষ কুর্শির সঙ্গেই জীবনের মালা গাঁথে। মানুষের জীবনে এই এক অপরিহার্য বন্ধন যা তাকে একটি নির্দিষ্ট গতিতে নিয়মমাফিক এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রতিনিয়তই ঘটনা প্রবাহের আবর্তে পড়া চরিত্রগুলো লেখকের অপূর্ব নির্মাণশৈলীতে তৈরি হওয়া এক অভিনব সৃষ্টি যা গ্রন্থের মূল বার্তাকে পাঠকের সামনে হাজির করে দেয়।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের এক পর্যায়ে বিপ্লবী দলের সংগঠক আনসারের উপস্থিতি। বৈপ্লবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী সে। গোপন আস্তানায় তাদের সাংগঠনিক এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তরালে এই কার্যক্রম চালাতে গিয়ে এসব বিপ্লবীকে অনেক ঝক্কি ঝামেলাও পোহাতে হয়। পুলিশী ওয়ারেন্ট নিয়ে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয়। ছন্নছাড়া, দিশেহারা এবং অনিশ্চিত জীবনের ঘানি টানতে টানতে কখনও বা কোথাও গিয়ে আস্তানা গাড়ে কয়েক দিনের জন্য। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে উদ্দীপ্ত আনসার সমাজের ছোটখাটো অনেক ঘটনারও অংশীদার হয়ে যায়। সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ঘটনাপ্রবাহ বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি করে যা সামগ্রিক ব্যবস্থাকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যায়।

আনসারের কাছে ধর্মীয় বিভেদ তেমন কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু এর কারণে যেসব অনাহূত অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় সেটাই তাকে ভাবিয়ে তোলে। মেজ বউয়ের ক্রিশ্চিয়ান হয়ে এলাকা থেকে চলে যাওয়াটাও তেমনি এক দৃষ্টিকটু ব্যাপার যা আনসারকেও চিন্তিত করে। এর একটা যৌক্তিক সমাধানও তার পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়। যদিও মেজ বউ তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে এবং এক সময় তা করেও। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বভাবসুলভ বৈপ্লবিক চেতনায় প্রতিটি চরিত্রে যেভাবে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন একইভাবে তা প্রথাসিদ্ধ সমাজের একটি সচিত্র প্রতিবেদনও বটে। গঁৎ বাঁধা সামাজিক বিধি তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঔপনিবেশিক শাসনের করাল গ্রাস, ব্যক্তি চরিত্রের নানা সম্ভাবনা আর অসঙ্গতি সব মিলিয়ে উপন্যাসের যে গতি প্রকৃতি সব সময় তা স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণেও থাকে না।

মৃত্যুক্ষুধা— কাজী নজরুল ইসলামের একটি কালজয়ী

মৃত্যুক্ষুধার অনেক মৃত্যুর নির্মম পরিণতি যেমন পাঠককুলকে বিষণ্ণ আবেশে ব্যথিত করে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদা অন্ন-বস্ত্রের এক বিবর্ণ হাহাকার। আপনজনের মৃত্যু যন্ত্রণা এক সময় অভ্যাসে পরিণত হয় কিন্তু নিত্য ক্ষুধার অসহনীয় পেষণ একেবারে সহ্য সীমার বাইরে। দুটোকে একসঙ্গে মেলাতে গিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম জীবনের অসঙ্গতিগুলোকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান সেখান থেকে পাঠক অন্যদিকে ফিরে তাকানোর অবকাশও পায় না। নজরুল উপন্যাসটা লিখেছেন নিজের দেখা একটি বস্তি এলাকার ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন রকমের জীবন ও ঘটনাপ্রবাহে। তাকে গল্পে রূপ দিতে গিয়ে প্রচলিত সামাজিক অবয়বকে অস্বীকার করে কোন ধরনের কল্পনার আশ্রয় নেয়া আদপেই সম্ভব হয়নি। নিজের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে লিখলে হয়তবা মিলনের সুরে উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহ মাঝে মধ্যে হলেও ঝঙ্কৃত হতো।

গজালের মার প্রথম তিন সন্তানই মৃত। প্যাঁকেল বেঁচে থেকেও ছন্নছাড়া, গৃহহীন। মায়ের সঙ্গে পুরো সংসারের আবর্তে সে কখনই পড়তে চায়নি। এমনকি কুর্শির সঙ্গেও নয়। নিজেকে নিয়েই নিজে ব্যস্ত। কুর্শির অতিমাত্রায় আগ্রহের কারণে তার সঙ্গে বাধা পড়ে। মেজ বউ রূপে-গুণে সাধারণের নজরকাড়া এক দৃঢ়চিত্তের নারী। নিজের ইচ্ছেতেই দুই সন্তানকে বাদ দিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম গ্রহণ করা। বড় ছেলের মৃত্যুর পর আবার ঘরে ফিরে আসা। সেখানেও তার বিপন্ন অবস্থার আঁধার কাটে না। আর বিপ্লবী আনসার? প্রথম ভালবাসার মানুষ তার নিজের হয়নি। ব্যক্তিপ্রেমের উর্ধে উঠে দেশপ্রেমকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। এভাবে জীবনটা দেশমাতার চরণে সঁপে দিয়ে নিজেও অনন্ত যাত্রায় এগিয়ে যায়। প্রতিটি চরিত্র বিধৃত হয়েছে দুঃখ, কষ্ট, বেদনার এক অবর্ণনীয় নির্মমতায়। যেখানে সুখ নামক আকাঙ্ক্ষিত বস্তুটি খুঁজে পাওয়া যায় না। 

চোখের সামনে তিন সন্তানের মৃত্যু দেখা গজালের মার মানসিক যন্ত্রণার শেষ কোথায় সেটা কেউ জানে না। এমনকি লেখকও না। সর্বশেষ সন্তান দিশেহারা, সংসারচ্যুত। ক্রিশ্চিয়ান হয়ে কুর্শিকে বিয়ে করে ঘর বাঁধে। বড় নাতির মৃত্যু, সেজ বউ ও তার খোকার অকালে চলে যাওয়া, মেজ বউয়ের ক্রিশ্চিয়ান হওয়া সব মিলিয়ে গজালের মার যে নিষ্ঠুর নিয়তি তা খ-ানোর কোন সুযোগ উপন্যাসে নেই। স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ আনসারের যে বিপ্লবী মনস্তত্ত্ব, ব্রিটিশ তাড়ানোর যে উদ্দীপ্ত আবেগ তারও সর্বশেষ পর্যায় অনেক ব্যথা-বেদনা, কষ্ট আর স্বপ্নভঙ্গের করুণ আখ্যান। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াটাও সেভাবে কোন অনিবার্য পরিণতির দিকে এগুতো পারেনি।

দেশাত্মবোধের চেতনায় উৎসর্গিত এই অনিশ্চিত আর সাংঘর্ষিক টানাপোড়েন বিপ্লবী আনসারের জীবনে কোন সুস্থির গতিপথ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। পোড় খাওয়া মানুষ আর সমাজের এই এক অবশ্যম্ভাবী শেষ অধ্যায় যার ওপর না থাকে স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণ কিংবা না বেরুতে পারে গল্পের চরিত্র। নজরুলের সমাজের এসব অবর্ণনীয়, দুঃখ, দুর্দশা আর নির্মম শৃঙ্খলকে আপন অভিজ্ঞতায় নিজের মতো করে দেখার সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্য দুটোই হয়েছে। কাহিনীর গতিপথ নির্ধারণ, চরিত্রের গঠনশৈলী নির্মাণ কিংবা সমকালীন ব্যবস্থার সুতীক্ষè আঁচড় নজরুলের সৃজন এবং শিল্পসত্তাকে অতিক্রম করে যায়। আর তাই ঘটনাবহুল বিন্যাসে তার সুস্পষ্ট ছাপা যেমন লক্ষণীয় পাশাপাশি চরিত্রগুলোর সৃষ্টি আর বিকাশেও পড়েছে এর তীব্র প্রভাব। সব মিলিয়ে নজরুলের বাস্তব সমাজ নিরীক্ষার যে সূক্ষ্ম দৃষ্টি তাও পাঠককে নানামাত্রিকে মুগ্ধ করে। সমকালীন সমাজের জীবন্ত চালচিত্র পাঠকের সামনে নতুন করে উন্মোচিত হয়। নজরুলের জীবন সংগ্রাম শুরু হয় একেবারে কৈশোর থেকে। তার নিরন্তর গতি চলতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়া থেকে ফেরা অবধি। তার পরও যতদিন সচেতন অবস্থায় ছিলেন তার থেকে অব্যাহতি কোন দিনই পাননি। যার জ্বলন্ত স্বাক্ষর তার অনবদ্য সৃষ্টি সম্ভার।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকে পরাভূত করে স্বাধীনতা এবং অধিকার অর্জনের লড়াইয়ে তিনি প্রতিনিয়তই সম্পৃক্ত ছিলেন। এ জন্য তাঁকে বিভিন্ন মাত্রিকে অবিচারের দণ্ড দেয়া হয়েছে। কারাবরণ থেকে শুরু করে অনশনের মতো অসহনীয় কষ্ট তাকে পোহাতে হয়েছে। দুঃখে ভারাক্রান্ত জীবনের ঘানি টানতে টানতে সৃজন আর চিন্তাশীলতায়ও পড়ে ছিল এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। মৃত্যুক্ষুধা তারই একটি অনবদ্য শৈল্পিক প্রয়াস। কঠিন জীবনবোধ নজরুলকে যে মাত্রিকে অস্থির আর দিশেহারা করেছে তার পরিপূর্ণ বিকাশ তাঁর সৃজনসৌধ। কবিতায়, গানে যেমন একইভাবে প্রবন্ধ, ছোটগল্প এবং উপন্যাসেও তিনি একজন বাস্তবোচিত সমাজ নিরীক্ষক। সমাজ আর জীবনের গভীরতা, ব্যাপ্তী, অন্তর্দ্বন্দ্ব, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বিষাদকে আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হলে এর যথার্থ চিত্রও তুলে ধরা একেবারে অসম্ভব।

আলোচনার শুরুতেই বলা হয়েছে যাদের নিয়ে তাঁর এই গল্প কাহিনী সেই সব চরিত্রের একেবারে কাছাকাছি ছিলেন নজরুল। সাধারণ মানুষের নৈকট্য, তাদের প্রতিদিনের জীবন ও ঘটনাপ্রবাহ সরাসরি প্রত্যক্ষ করা লেখক নিজের সৃজন শক্তির মিলিত সম্পদে তৈরি করেছেন উপন্যাসের সুনির্দিষ্ট গতিপথ, চরিত্রগুলোও আপন বৈশিষ্ট্যে ঘটনার পালাক্রমে এগিয়ে যাওয়া। সবশেষে অনিবার্য পরিণতি টেনে আনতে শৈল্পিক আর মনোজাগতিক প্রভাবকেও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রেখেছেন। সব থেকে বেশি দায়বদ্ধতা ছিল প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে চরিত্রগুলোর অন্তর্নিহিত বিরোধ আর উদ্ভূত সঙ্কট স্পষ্ট করা।