০১:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

শিশুর বিকাশে মা, বাবা ও পরিবার

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
  • প্রকাশ: ০৭:৩৫:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ অগাস্ট ২০২২
  • / ৫৫৪৫ বার পড়া হয়েছে


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য পারিবারিক উপাদানসমূহের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবারের মাধ্যমেই শিশুর শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। শিশুর প্রতি অভিভাবকের আচরণ থেকে হতে শিশুরা অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক কিছু শিখে থাকে, যা তার আচরণকে প্রভাবিত করে। পরিবারে বাবা-মায়ের সুসম্পর্ক শিশুর শিক্ষাবিকাশে অনেক সহায়তা করে থাকে। শিশুদের নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, তাদের পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দেয়া। যেমন- পরিবারে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা কত?

নির্দিষ্ট শিশুর অবস্থান কোথায়? সে কি প্রথম সন্তান, না দ্বিতীয়, নাকি ছোট, না এক মাত্র সন্তান? পরিবারটি কত দিন যাবত তাদের বর্তমান অবস্থায় রয়েছে? আগের অবস্থান কত দিন ছিল? বাবার পেশা কি? মা চাকরি করে কি না? দাদা-দাদী এবং অন্য কোন আত্মীয়ের বাসায় থাকেন কিনা? ডির্ভোস, মৃত্যু বা অভিভাবকদের দীর্ঘ দিনের অনুপস্থিতির কারণে ভগ্নপরিবার কিনা?

শিশুদের আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে এই সব প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন। পরিবারের ছোট সন্তানটি তার পরিবারের নতুন কোন সদস্যের জন্ম গ্রহণের ফলে অনেক সময়ই খুব উদ্বিগ্ন থাকে এবং অপরিপক্ব ও এলোমেলো আচরণ করে থাকে। নতুন ভাই বা বোনের আগমনে সে বাবা-মায়ের আদর যত্ন থেকে বঞ্চিত হবে এটা ভেবে অনেক সময়ই বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। ঘন ঘন বাসা বদল করলে নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে শিশুরা অসুবিধায় পড়ে। দীর্ঘ দিন ধরে বাড়িতে বাবা অথবা মা উভয়ের অনুপস্থিতির ফলে শিশুর শিক্ষার বিকাশ ব্যাহত হয়।

শিশু ও তার মা-বাবা

গবেষণায় দেখা রগছে, যে সব শিশু ভগ্ন পরিবার থেকে আসে, যাদের মা ফুলটাইম চাকরি করেন এবং যে সব শিশু অভিভাবকদের আদর যত্ন ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত তাদের মধ্যে মারাত্মকভাবে উপযোজন সমস্যা দেখা দেয়। ভগ্ন পরিবার  থেকে  আগত ১২৫ জন শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পরিবার থেকে আসা ১২৫ জন শিক্ষার্থী, যাদের বুদ্ধিমত্তার একই ধরনের এবং যাদের বাবা মায়ের পেশার মধ্যেও সামঞ্জস্য রয়েছে তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করে (Reyburn 1951) দেখা গেছে যে, দুই দলই স্কুলের পরীক্ষায় মোটা মুটি একই ধরনের ফলাফল করেছে কিন্তু অন্যের সাথে উপযোজনের ক্ষেত্রে ভগ্ন পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের  দেড়গুণ বেশি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, বাড়ি এবং পরিবার সম্পর্কিত বিষয়ে ভগ্ন পরিবারে শিক্ষার্থীদের তিনগুণ বেশি সমস্যা রয়েছে। শিশুদের সার্বিক বিকাশে পারিবারিক পরিস্থিতি বিশেষ করে, বাবা-মায়ের সাথে ছেলে-মেয়েদের সুসম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে কাজ করে। পারিবারিক পরিস্থিতি অনুকূল না হলে শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও লেখাপড়ায় অমনোযোগের মত সমস্যা সৃষ্টি হয় যা তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কেমন, একের প্রতি অন্যের মনোভাব অনুভূতি কেমন, তার দ্বারাই পরিবারের আবেগময় অবস্থা নির্ধারিত হয়ে থাকে। অনেক পরিবার রয়েছে যার সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সহর্মমিতা সহানুভূতি আস্থা ও ভালোবাসা বিরাজ করে। আবার অনেক পরিবারে এ পরিবেশের অভাব যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়। আবার কোন, কোন পরিবার পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

এই সব ধরনের পরিবার হতেই শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে এবং শ্রেণিকক্ষে একত্রে লেখাপড়া করে। কিন্তু পারিবারিক আবেগময় অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার ফলে তাদের আচরণের ভিন্নতা দেখা যায়। পরিবারের আবেগময় অবস্থা যেখানে অস্বাভাবিক, হতাশাজনক এবং শিশুদের চাহিদার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন সেসব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সমস্যামূলক আচরণ দেখা যায় এবং শ্রেণি কক্ষে তার প্রতিফলন ঘটে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, একই শিশু বিভিন্ন ধরনের আবেগময় অবস্থায় ভিন্ন, ভিন্ন আচরণ করে থাকে (Lewin, Lippitt and White-1939) মেয়ার (Meyer-1947) তার গবেষণায় দেখেছেন যে, বাবা মা যদি ছেলে-মেয়েদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন এবং তাদের আচরণ বোঝার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেন তাহলে শিশুদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব কম বিকশিত হয় এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে যে সমস্ত বাবা, মা ছেলে-মেয়েদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করেন এবং তাদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে চান তাদের ছেলে-মেয়েরা আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। এরা শ্রেণি কক্ষে সমস্যার সৃষ্টি করে এবং শিক্ষাকের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে। একই ধরনের আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত ছেলে-মেয়েরা গণতান্ত্রিক পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের চেয়ে শিক্ষা মূলক সমস্যা কম থাকে এবং তাদের উপযোজন ভালো হয় (Stone and lands-1953)।

উপরের আলোচনা হতে সহজেই বুঝা যায় যে, পারিবারিক সম্পর্ক শিশুর শিক্ষা জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। পারিবারিক আবেগময় অবস্থার উপর ভিত্তি করে শিশুর মধ্যে তার নিজের সম্পর্কে এবং জীবন সম্পর্কে একটি মনোভাব গড়ে ওঠে। আবেগময় অবস্থা যদি খুব উত্তেজনাকর ও উদ্বেগময় হয় তাহলে শিশুর মধ্যেও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা হতাশার সৃষ্টি হয়। আবেগময় অবস্থা যদি কর্তৃত্ববাদী হয় যেখানে বাবা-মা যা বলবে তাই ঠিক এবং শিশু যা বলবে তাই ভুল সেই পরিবারের শিশুরা হীনমন্যতায় ভোগে এবং কর্তৃপক্ষের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করে।

যদি পরিবারের আবেগময় অবস্থা ও খোলামেলা হয়, সেখানে শিশু তার আবেগ সহজেই প্রকাশ করতে পারে, সেই পরিবারের ছেলে-মেয়েরা দায়িত্বর্শীল হয় তার মধ্যে স্বতস্ফূর্ততা থাকে এবং তারা সব বুঝে তা সহজেই অপকটে প্রকাশ করতে পারে। সুতারং শিশুরা যেন সুষ্ঠুভাবে বিকাশ লাভ এবং সুস্থ জীবন-যাপন করতে পারে তাই নিচের বিষয়গুলোর প্রতি পিতা-মাতা এবং অভিভাবক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

১) পরিবারের পিতামাতার সুসম্পর্ক রেখে চলতে হবে। পিতা মাতার কথায় যেন নেতিবাচক না হয়ে ইতিবাচক হয়।  ছেলে-মেয়ের চালচলন রীতিনীতি এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এই বয়সে তাদেরকে যা শিখানো হবে তাই তারা রপ্ত করবে।

২) ছেলে-মেয়েদেরকে অতিশাসন কিংবা সোহাগ থেকে বিরত থাকতে হবে। পিতা-মাতা তাদের স্কুলে আসা-যাওয়া সর্বদা মনিটরিং করতে হবে। শ্রেণির কাজ এবং বাড়ির কাজ ভালো ভাবে করলো কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে।

৩) ভালো বন্ধুদের সাথে চলা ফেরা করে কি না বিদ্যালয় গিয়ে করণীয় দিক কি এবং বর্জনীয় দিক কি তা পিতা-মাতা বা অভিভাবক ঠিক করে দিতে হবে।

৪) বিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং শ্রেণি কক্ষে বসে শিক্ষকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার পরামর্শ শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

৫) পিতামাতাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে একজন শিশু বিদ্যালয়ে গিয়ে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টা শিক্ষাকের সান্নিধ্য বা বিদ্যালয়ে থাকে। বাকি সময় শিশু বাসার বাড়িতে থাকে। এই স্বল্প সময়ে শিশুেেক সব কিছুতে পারদর্শী করে তোলা সম্ভব নয়। শিশুর প্রথম শিক্ষাক্ষেত্র হলো পরিবার। পরিবার থেকে যা শিখে স্কুলে এবং পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে সুতারং শিশু যেন একজন প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠে পরিবারকেই তার প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে চালাতে হবে।

মনে রাখতে হবে, পরিবার হলে শিশুর শিক্ষার আগা। শিক্ষার এই আগা ভেঙে গেলে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই অভিভাবক, পিতা-মাতা, শিক্ষক সবাই সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে শিশুকে ভবিষ্যৎ দিক নিদের্শনার দিকে চালিত করা উচিত।

পরিবার একজন শিশুকে সমাজের কাছে পরিচিতি করে তোলে। শিশুর আচরণের উপর পরিবারের সাংস্কৃতিক ধারণার প্রভাব সুস্পষ্ট। পরিবারের আর্থসামজিক অবস্থান, সমাজিক শ্রেণি, পারিবারিক কাঠামো ইত্যাদি শিশুর আচরণ অনুধ্যানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে পরিবারের প্রভাব সম্পর্কে বিগত দশকগুলোতে অনেক লেখালেখি হয়েছে।

সব লেখক, গবেষক স্বীকার করেছেন যে, পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া শিশুর বিকাশে সুষ্ঠুধারা ও সন্তোষকজনক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। পারিবারিক নিয়ম, শৃঙ্খলা, ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহানুভূতি ও অনুপ্রেরণার মাধ্যমেই একজন শিশু সমাজে প্রত্যাশিত আচরণ করতে শেখে। পরিবারই সমাজকে শিশুর কাছে পরিচিত করে তোলে। গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, শুধু সাধারণ ও পারিবারিক সমস্যা নয়, শিক্ষার্থীর একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা ও তার শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করতে পারে। তাকে অমনযোগী হতে, স্কুল পালাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

একটি গল্পের মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করা যাক। দশ বছর বয়সের একটি ছেলে, নাম রবিন। মাকে খুব ভালোবাসে, প্রতিদিন স্কুলে যায়, কিন্তু পূর্ণ সময় স্কুলে থাকে না। পাঠে অমনোযোগ, সুযোগ পেলে প্রথম সুযোগেই স্কুল থেকে পালিয়ে বাড়িতে চলে আসে। তার এ অপরাধের জন্য শিক্ষক তাকে প্রায়ই বকাঝকা করে শাস্তি দেয়। তারপরেও শিক্ষকের শাস্তির ভয় উপেক্ষা করে সে সুযোগ পেলেই বাড়িতে ছুটে যায়। ছেলেটির স্কুল থেকে পালিয়ে বাড়িতে আসার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে?

সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে, সে স্কুল ও লেখাপড়া পছন্দ করে না। অথবা তার বাবা-মা স্কুলের বিরুদ্ধে বলে তার মন বিষিয়ে তুলেছে। এও হতে পারে যে স্কুলের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সে অপারগ বা অনিচ্ছুক। উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরে এই গবেষণা করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা থেকে দেখা গেছে যে রবিনের মা-বাবার মধ্যে প্রায়ই প্রচ- ঝগড়া হতো। ঝগড়ার এক পর্যায়ে তার মা জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দিত এবং মাঝে মাঝে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতো। দু’একদিন রবিনের মা তার বাবাকে এও বলেছেন যে তিনি এ বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাবেন। প্রতিনিয়ত এই ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে রবিনের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে সে স্কুলে গেলে এই ফাঁকে তার মা বাড়ি থেকে চলে যেতে পারে। এর ফলে স্কুল থেকে ফিরে সে আর মাকে পাবে না। ক্লাস রুমে বসে তার শুধু দুশ্চিন্তা হতো সে তার মা বুঝি চলে গেল। তাই ক্লাসে মনোযোগ দেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার দুশ্চিন্তা যখন খুব বেড়ে যেত তখনই সে পালানোর রাস্তা খুঁজতো এবং প্রথম সুযোগেই বাড়িতে চলে আসতো। রবিন নামক ছেলেটির ঘটনা হতে এ কথা সুস্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য ও ভালোবাসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

শিক্ষকদের অবশ্যই শিক্ষার্থীর এ ধরনের ব্যক্তিগত সমস্যা বিবেচনায় নিয়েই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। প্রতিটি সমাজেরই নিজস্ব জীবনযাপন প্রণালী বিশ্বাস-অবিশ্বাস, নৈতিকথা, লোকাচার, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয় এবং নিজস্ব ধ্যানধারণা রয়েছে।

সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুন মেনে চলা এবং অন্যকে তা অনুশীলন করতে উদ্বুদ্ধ করার কাজটি মূলত শুরু হয় পরিবার থেকেই। আমাদের সমাজে পারিবারিক মূল্যবোধ, অভিভাবকদের প্রতিশ্রদ্ধা প্রদর্শন ও তাদের প্রতি অনুগত থাকা, পারিবারিক ঐতিহ্য ভঙ্গ না করার যে সংস্কৃতি চালু রয়েছে তার পিছনে বড় অবদান কিন্তু পরিবারের। পরিবারের মধ্যে ছেলেমেয়েরা অন্যের সম্পদ, অধিকার ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শেখে, আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখে।

অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে এবং পরিবার ও দেশের প্রতি অনুগত হতে শেখে, তাই দেশজ সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধশীল করে তুলতে পরিবারে রয়েছে বিরাট ভূমিকা। বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে এ ধরনের শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু পরিবার থেকে যদি শিক্ষাটি আগেই শুরু হয় তা হলে তা এগিয়ে নিতে বিদ্যালয়ের পক্ষে অনেক সহজ হয়। তাছাড়া নৈতিকতা শিক্ষার মতো বিষয়টি শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবারই মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে এবং স্কুলের বাইরে দীর্ঘদিন পরিবার এই দায়িত্ব পালন করে থাকে।

যে সমস্ত পরিবার ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধ প্রকট সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ একভাবে হবে, আবার যেসব পরিবারে ধর্মীয় মূল্যবোধ দৃঢ় নয় বা ধর্মীয় অনুভূতি অনুপস্থিত সেখানে কার ছেলেমেয়েরা সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠবে। শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থসামাজিক শ্রেণিগত অবস্থান তার আচরণ ও শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা সাধারণত প্রাইভেট ও ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে বেশি উৎসাহী হয়ে থাকে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সাধারণত বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃতিগত পার্থক্যের ফলে প্রত্যেক শ্রেণির ছেলেমেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন মানসিক গঠন নিয়ে গড়ে ওঠে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকেরা তাদের পারিবারিক সুনাম, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর বেশি জোর দেয় এবং তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ওই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলে। পক্ষান্তরে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, স্বনির্ভরতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, পেশাগত সফলতা ব্যক্তিগত উন্নতি ইত্যাদির জন্য শিক্ষাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করতে চায়। অন্য দিকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ, যেমন- দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক, দিনমজুর কৃষক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণির মানুষ তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ন্যূনতম স্তরের শিক্ষা গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়।

এই ভাবে পরিবার থেকে শিক্ষাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার যে প্রবণতা বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় তার প্রভাব ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সার্বিক শিক্ষা বিকাশের উপর পড়ে। দুটি প্রধান কারণে পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

প্রথমত ছেলেমেয়েদের আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের আর্থসামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। স্কুলে যাওয়ার পূর্বেই ছেলেমেয়েদের আচরণে তাদের বিশ্বাসে, অনুভূতিতে ও মনোভাবে একটি নির্দিষ্ট ধারা সৃষ্টি হয়। তাই স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী ছেলেমেয়েরা একই ক্লাসে ভর্তি হয়ে এক সাথে লেখাপড়া শুরু করলে তাদের মধ্যে আচরণগত পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যা সুষ্ঠুভাবে ক্লাস পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করে।

এজন্যই শিক্ষার্থীদের শ্রেণিগত অবস্থান সম্পর্কে ধারণা থাকা একজন শিক্ষকের জন্য খুব প্রয়োজন। শিক্ষার প্রতি ছেলেমেয়েদের মনোভাব কেমন হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষার প্রতি পরিবারের বিশেষ করে অভিভাবকদের মনোভাব কেমন তার উপর। মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য জীবনে সফলতা লাভের ক্ষেত্রে শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে নিম্নবিত্তরা সফলতা লাভের ক্ষেত্রে অর্থকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে।

স্কুলে শিক্ষার্থীদের দলীয় আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে ও তাদের শ্রেণিগত অবস্থান সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা স্কুলের সহঃশিক্ষামূলক কার্যক্রম এবং স্কুলের বাইরে সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে চায় না যার ফলে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ও অন্যান্য প্রত্যাশিত সামাজিক আচরণের বিকাশ খুব কম হয়। আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা- আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তার উপর বেশি জোর দেওয়া হয় এবং বলা যায় যে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা নিম্নবিত্তদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে ততটা সহায়ক নয়।

শিক্ষার সাথে জড়িত কর্মকর্তা এমন কি যারা সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রমের সাথে জড়িত সেই শিক্ষকগণ ও মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত তাই তারাও শিক্ষার্থীদের সমস্যা চিহ্নিত করণ ও সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের শ্রেণিগত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে আসতে পারে না। 

নিম্নবিত্ত পরিবারের কাছে শিক্ষার চেয়ে পেটের খোরাক জোগানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে হলেও পারিবারিক আয় বৃদ্ধির জন্য ছেলেমেয়েদের কাজে লাগায়। নিম্নবিত্ত সমাজের এই যে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি এটা তাদের সন্তানদের শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করে। তাই স্কুলের প্রতি ন্যূনতম অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হলেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ড্রপআউট হয়ে যায়। এজন্য শিক্ষার্থীর প্রেষণা সৃষ্টিতে বিদ্যালয়ের যথাযথ ভূমিকা পালনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের “ঝরে পড়া” ঠেকানো এবং তাদেরকে লেখাপড়ায় মনোযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানা এবং সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। জেমস ডেভী তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির সাথে তাদের পারিবারিক, আর্থসামাজিক অবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ডেভির মতে, পরিবারের আর্থিক সংগতি ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ইচ্ছা এবং শিক্ষার প্রতি পরিবারের মনোভাব এই তিনটি উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়ার প্রভাব শিক্ষার্থীর উপর পড়ে। এই প্রভাব নেতিবাচক হলে সে ক্ষেত্রে তার শিক্ষার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর জীবন বিকাশের সব ক্ষেত্রেই পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম।

পরিবার থেকেই শিশু সব ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রথম অবগত হয়। শিশুর মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি কেমন হবে অন্যের প্রতি সে কিরূপ মনোভাব পোষণ করবে এবং কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে তা অনেকাংশেই শিশুর পারিবারিক কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। পরিবারে বাবা ও মায়ের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শিশুরা নারী ও পুরুষের ভূমিকা এবং নিজের লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয়। একক পরিবারের ক্ষেত্রে বাবা ও মায়ের মধ্যে যদি ভালোবাসা ও শৃঙ্খলা বোধের সম্মিলন ঘটে তা হলে পরিবারে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই ধরনের পরিবার হতে শিশু যে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা লাভ করে তা পরবর্তীতে তার সামাজিকি করণের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তবে ডিভোর্স বা অন্য কোন কারণে সৃষ্ট একক অভিভাবক পরিবারের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ফলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে রাগ, ভয়, অপরাধবোধ, হীনমন্যতা, হতাশা ইত্যাদি প্রবণতা দেখা দেয়। ছেলেরা অনেক সময়ই আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করে। কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়। জীবন, মানবিক সম্পর্ক সম্বন্ধে তাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠে। যার প্রভাব তাদের শিক্ষা জীবনে পড়ে। তাই, একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার বিকাশ তথা সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে তার আচরণ অনুধাবনের জন্য পরিবারের ভূমিকা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা অপরিহার্য।

সুতরাং অভিভাবক এবং পিতা-মাতার এ কথা মনে রাখা উচিত যে, পরিবার থেকে শিশু যে শিক্ষা পায় তা তাকে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। পরিবারের শিক্ষা যদি ভঙ্গুর হয় তা হলে শিশুর পরবর্তী জীবনে নানা বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়।

বিষয়:

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

শিক্ষক ও প্রবন্ধিক, কোটবাড়ি, কুমিল্লা

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শিশুর বিকাশে মা, বাবা ও পরিবার

প্রকাশ: ০৭:৩৫:৩৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ অগাস্ট ২০২২

শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্য পারিবারিক উপাদানসমূহের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পরিবারের মাধ্যমেই শিশুর শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। শিশুর প্রতি অভিভাবকের আচরণ থেকে হতে শিশুরা অনিচ্ছাকৃতভাবে অনেক কিছু শিখে থাকে, যা তার আচরণকে প্রভাবিত করে। পরিবারে বাবা-মায়ের সুসম্পর্ক শিশুর শিক্ষাবিকাশে অনেক সহায়তা করে থাকে। শিশুদের নিয়ে গবেষণা করার ক্ষেত্রে একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, তাদের পারিবারিক পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দেয়া। যেমন- পরিবারে ছেলে-মেয়ের সংখ্যা কত?

নির্দিষ্ট শিশুর অবস্থান কোথায়? সে কি প্রথম সন্তান, না দ্বিতীয়, নাকি ছোট, না এক মাত্র সন্তান? পরিবারটি কত দিন যাবত তাদের বর্তমান অবস্থায় রয়েছে? আগের অবস্থান কত দিন ছিল? বাবার পেশা কি? মা চাকরি করে কি না? দাদা-দাদী এবং অন্য কোন আত্মীয়ের বাসায় থাকেন কিনা? ডির্ভোস, মৃত্যু বা অভিভাবকদের দীর্ঘ দিনের অনুপস্থিতির কারণে ভগ্নপরিবার কিনা?

শিশুদের আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে এই সব প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন। পরিবারের ছোট সন্তানটি তার পরিবারের নতুন কোন সদস্যের জন্ম গ্রহণের ফলে অনেক সময়ই খুব উদ্বিগ্ন থাকে এবং অপরিপক্ব ও এলোমেলো আচরণ করে থাকে। নতুন ভাই বা বোনের আগমনে সে বাবা-মায়ের আদর যত্ন থেকে বঞ্চিত হবে এটা ভেবে অনেক সময়ই বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। ঘন ঘন বাসা বদল করলে নতুন নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে শিশুরা অসুবিধায় পড়ে। দীর্ঘ দিন ধরে বাড়িতে বাবা অথবা মা উভয়ের অনুপস্থিতির ফলে শিশুর শিক্ষার বিকাশ ব্যাহত হয়।

শিশু ও তার মা-বাবা

গবেষণায় দেখা রগছে, যে সব শিশু ভগ্ন পরিবার থেকে আসে, যাদের মা ফুলটাইম চাকরি করেন এবং যে সব শিশু অভিভাবকদের আদর যত্ন ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত তাদের মধ্যে মারাত্মকভাবে উপযোজন সমস্যা দেখা দেয়। ভগ্ন পরিবার  থেকে  আগত ১২৫ জন শিক্ষার্থী এবং সাধারণ পরিবার থেকে আসা ১২৫ জন শিক্ষার্থী, যাদের বুদ্ধিমত্তার একই ধরনের এবং যাদের বাবা মায়ের পেশার মধ্যেও সামঞ্জস্য রয়েছে তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করে (Reyburn 1951) দেখা গেছে যে, দুই দলই স্কুলের পরীক্ষায় মোটা মুটি একই ধরনের ফলাফল করেছে কিন্তু অন্যের সাথে উপযোজনের ক্ষেত্রে ভগ্ন পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের  দেড়গুণ বেশি সমস্যার কথা উল্লেখ করেছে।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে যে, বাড়ি এবং পরিবার সম্পর্কিত বিষয়ে ভগ্ন পরিবারে শিক্ষার্থীদের তিনগুণ বেশি সমস্যা রয়েছে। শিশুদের সার্বিক বিকাশে পারিবারিক পরিস্থিতি বিশেষ করে, বাবা-মায়ের সাথে ছেলে-মেয়েদের সুসম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে কাজ করে। পারিবারিক পরিস্থিতি অনুকূল না হলে শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও লেখাপড়ায় অমনোযোগের মত সমস্যা সৃষ্টি হয় যা তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা বিকাশে ব্যাঘাত ঘটায়।

পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কেমন, একের প্রতি অন্যের মনোভাব অনুভূতি কেমন, তার দ্বারাই পরিবারের আবেগময় অবস্থা নির্ধারিত হয়ে থাকে। অনেক পরিবার রয়েছে যার সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সহর্মমিতা সহানুভূতি আস্থা ও ভালোবাসা বিরাজ করে। আবার অনেক পরিবারে এ পরিবেশের অভাব যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়। আবার কোন, কোন পরিবার পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

এই সব ধরনের পরিবার হতেই শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে এবং শ্রেণিকক্ষে একত্রে লেখাপড়া করে। কিন্তু পারিবারিক আবেগময় অবস্থা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার ফলে তাদের আচরণের ভিন্নতা দেখা যায়। পরিবারের আবেগময় অবস্থা যেখানে অস্বাভাবিক, হতাশাজনক এবং শিশুদের চাহিদার প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন সেসব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সমস্যামূলক আচরণ দেখা যায় এবং শ্রেণি কক্ষে তার প্রতিফলন ঘটে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, একই শিশু বিভিন্ন ধরনের আবেগময় অবস্থায় ভিন্ন, ভিন্ন আচরণ করে থাকে (Lewin, Lippitt and White-1939) মেয়ার (Meyer-1947) তার গবেষণায় দেখেছেন যে, বাবা মা যদি ছেলে-মেয়েদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখেন এবং তাদের আচরণ বোঝার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করেন তাহলে শিশুদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব কম বিকশিত হয় এবং সহযোগিতামূলক মনোভাব বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে যে সমস্ত বাবা, মা ছেলে-মেয়েদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করেন এবং তাদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে চান তাদের ছেলে-মেয়েরা আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। এরা শ্রেণি কক্ষে সমস্যার সৃষ্টি করে এবং শিক্ষাকের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে। একই ধরনের আর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত ছেলে-মেয়েরা গণতান্ত্রিক পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলে মেয়েদের চেয়ে শিক্ষা মূলক সমস্যা কম থাকে এবং তাদের উপযোজন ভালো হয় (Stone and lands-1953)।

উপরের আলোচনা হতে সহজেই বুঝা যায় যে, পারিবারিক সম্পর্ক শিশুর শিক্ষা জীবনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। পারিবারিক আবেগময় অবস্থার উপর ভিত্তি করে শিশুর মধ্যে তার নিজের সম্পর্কে এবং জীবন সম্পর্কে একটি মনোভাব গড়ে ওঠে। আবেগময় অবস্থা যদি খুব উত্তেজনাকর ও উদ্বেগময় হয় তাহলে শিশুর মধ্যেও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা হতাশার সৃষ্টি হয়। আবেগময় অবস্থা যদি কর্তৃত্ববাদী হয় যেখানে বাবা-মা যা বলবে তাই ঠিক এবং শিশু যা বলবে তাই ভুল সেই পরিবারের শিশুরা হীনমন্যতায় ভোগে এবং কর্তৃপক্ষের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব পোষণ করে।

যদি পরিবারের আবেগময় অবস্থা ও খোলামেলা হয়, সেখানে শিশু তার আবেগ সহজেই প্রকাশ করতে পারে, সেই পরিবারের ছেলে-মেয়েরা দায়িত্বর্শীল হয় তার মধ্যে স্বতস্ফূর্ততা থাকে এবং তারা সব বুঝে তা সহজেই অপকটে প্রকাশ করতে পারে। সুতারং শিশুরা যেন সুষ্ঠুভাবে বিকাশ লাভ এবং সুস্থ জীবন-যাপন করতে পারে তাই নিচের বিষয়গুলোর প্রতি পিতা-মাতা এবং অভিভাবক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

১) পরিবারের পিতামাতার সুসম্পর্ক রেখে চলতে হবে। পিতা মাতার কথায় যেন নেতিবাচক না হয়ে ইতিবাচক হয়।  ছেলে-মেয়ের চালচলন রীতিনীতি এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে শিক্ষা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে এই বয়সে তাদেরকে যা শিখানো হবে তাই তারা রপ্ত করবে।

২) ছেলে-মেয়েদেরকে অতিশাসন কিংবা সোহাগ থেকে বিরত থাকতে হবে। পিতা-মাতা তাদের স্কুলে আসা-যাওয়া সর্বদা মনিটরিং করতে হবে। শ্রেণির কাজ এবং বাড়ির কাজ ভালো ভাবে করলো কিনা তা খেয়াল রাখতে হবে।

৩) ভালো বন্ধুদের সাথে চলা ফেরা করে কি না বিদ্যালয় গিয়ে করণীয় দিক কি এবং বর্জনীয় দিক কি তা পিতা-মাতা বা অভিভাবক ঠিক করে দিতে হবে।

৪) বিদ্যালয়ের পরিবেশ এবং শ্রেণি কক্ষে বসে শিক্ষকের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার পরামর্শ শিশুকে বুঝিয়ে দিতে হবে।

৫) পিতামাতাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে একজন শিশু বিদ্যালয়ে গিয়ে মাত্র ৫-৬ ঘণ্টা শিক্ষাকের সান্নিধ্য বা বিদ্যালয়ে থাকে। বাকি সময় শিশু বাসার বাড়িতে থাকে। এই স্বল্প সময়ে শিশুেেক সব কিছুতে পারদর্শী করে তোলা সম্ভব নয়। শিশুর প্রথম শিক্ষাক্ষেত্র হলো পরিবার। পরিবার থেকে যা শিখে স্কুলে এবং পরবর্তী জীবনে তার প্রতিফলন ঘটে সুতারং শিশু যেন একজন প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে উঠে পরিবারকেই তার প্রতি বিশেষ নজর দিয়ে চালাতে হবে।

মনে রাখতে হবে, পরিবার হলে শিশুর শিক্ষার আগা। শিক্ষার এই আগা ভেঙে গেলে শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই অভিভাবক, পিতা-মাতা, শিক্ষক সবাই সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে শিশুকে ভবিষ্যৎ দিক নিদের্শনার দিকে চালিত করা উচিত।

পরিবার একজন শিশুকে সমাজের কাছে পরিচিতি করে তোলে। শিশুর আচরণের উপর পরিবারের সাংস্কৃতিক ধারণার প্রভাব সুস্পষ্ট। পরিবারের আর্থসামজিক অবস্থান, সমাজিক শ্রেণি, পারিবারিক কাঠামো ইত্যাদি শিশুর আচরণ অনুধ্যানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুর সুষ্ঠু বিকাশে পরিবারের প্রভাব সম্পর্কে বিগত দশকগুলোতে অনেক লেখালেখি হয়েছে।

সব লেখক, গবেষক স্বীকার করেছেন যে, পরিবারের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া শিশুর বিকাশে সুষ্ঠুধারা ও সন্তোষকজনক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। পারিবারিক নিয়ম, শৃঙ্খলা, ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহানুভূতি ও অনুপ্রেরণার মাধ্যমেই একজন শিশু সমাজে প্রত্যাশিত আচরণ করতে শেখে। পরিবারই সমাজকে শিশুর কাছে পরিচিত করে তোলে। গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, শুধু সাধারণ ও পারিবারিক সমস্যা নয়, শিক্ষার্থীর একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা ও তার শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করতে পারে। তাকে অমনযোগী হতে, স্কুল পালাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

একটি গল্পের মাধ্যমে বিষয়টি উপস্থাপন করা যাক। দশ বছর বয়সের একটি ছেলে, নাম রবিন। মাকে খুব ভালোবাসে, প্রতিদিন স্কুলে যায়, কিন্তু পূর্ণ সময় স্কুলে থাকে না। পাঠে অমনোযোগ, সুযোগ পেলে প্রথম সুযোগেই স্কুল থেকে পালিয়ে বাড়িতে চলে আসে। তার এ অপরাধের জন্য শিক্ষক তাকে প্রায়ই বকাঝকা করে শাস্তি দেয়। তারপরেও শিক্ষকের শাস্তির ভয় উপেক্ষা করে সে সুযোগ পেলেই বাড়িতে ছুটে যায়। ছেলেটির স্কুল থেকে পালিয়ে বাড়িতে আসার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে?

সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে, সে স্কুল ও লেখাপড়া পছন্দ করে না। অথবা তার বাবা-মা স্কুলের বিরুদ্ধে বলে তার মন বিষিয়ে তুলেছে। এও হতে পারে যে স্কুলের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সে অপারগ বা অনিচ্ছুক। উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরে এই গবেষণা করে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা থেকে দেখা গেছে যে রবিনের মা-বাবার মধ্যে প্রায়ই প্রচ- ঝগড়া হতো। ঝগড়ার এক পর্যায়ে তার মা জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার হুমকি দিত এবং মাঝে মাঝে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতো। দু’একদিন রবিনের মা তার বাবাকে এও বলেছেন যে তিনি এ বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য চলে যাবেন। প্রতিনিয়ত এই ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করে রবিনের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে সে স্কুলে গেলে এই ফাঁকে তার মা বাড়ি থেকে চলে যেতে পারে। এর ফলে স্কুল থেকে ফিরে সে আর মাকে পাবে না। ক্লাস রুমে বসে তার শুধু দুশ্চিন্তা হতো সে তার মা বুঝি চলে গেল। তাই ক্লাসে মনোযোগ দেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার দুশ্চিন্তা যখন খুব বেড়ে যেত তখনই সে পালানোর রাস্তা খুঁজতো এবং প্রথম সুযোগেই বাড়িতে চলে আসতো। রবিন নামক ছেলেটির ঘটনা হতে এ কথা সুস্পষ্ট ভাবে বলা যায় যে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া ও সুষ্ঠু বিকাশের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সান্নিধ্য ও ভালোবাসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

শিক্ষকদের অবশ্যই শিক্ষার্থীর এ ধরনের ব্যক্তিগত সমস্যা বিবেচনায় নিয়েই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। প্রতিটি সমাজেরই নিজস্ব জীবনযাপন প্রণালী বিশ্বাস-অবিশ্বাস, নৈতিকথা, লোকাচার, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গ্রহণীয় ও বর্জনীয় বিষয় এবং নিজস্ব ধ্যানধারণা রয়েছে।

সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুন মেনে চলা এবং অন্যকে তা অনুশীলন করতে উদ্বুদ্ধ করার কাজটি মূলত শুরু হয় পরিবার থেকেই। আমাদের সমাজে পারিবারিক মূল্যবোধ, অভিভাবকদের প্রতিশ্রদ্ধা প্রদর্শন ও তাদের প্রতি অনুগত থাকা, পারিবারিক ঐতিহ্য ভঙ্গ না করার যে সংস্কৃতি চালু রয়েছে তার পিছনে বড় অবদান কিন্তু পরিবারের। পরিবারের মধ্যে ছেলেমেয়েরা অন্যের সম্পদ, অধিকার ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শেখে, আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখে।

অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে এবং পরিবার ও দেশের প্রতি অনুগত হতে শেখে, তাই দেশজ সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধশীল করে তুলতে পরিবারে রয়েছে বিরাট ভূমিকা। বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে এ ধরনের শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু পরিবার থেকে যদি শিক্ষাটি আগেই শুরু হয় তা হলে তা এগিয়ে নিতে বিদ্যালয়ের পক্ষে অনেক সহজ হয়। তাছাড়া নৈতিকতা শিক্ষার মতো বিষয়টি শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবারই মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে এবং স্কুলের বাইরে দীর্ঘদিন পরিবার এই দায়িত্ব পালন করে থাকে।

যে সমস্ত পরিবার ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধ প্রকট সেসব পরিবারের ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ একভাবে হবে, আবার যেসব পরিবারে ধর্মীয় মূল্যবোধ দৃঢ় নয় বা ধর্মীয় অনুভূতি অনুপস্থিত সেখানে কার ছেলেমেয়েরা সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠবে। শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থসামাজিক শ্রেণিগত অবস্থান তার আচরণ ও শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা সাধারণত প্রাইভেট ও ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে বেশি উৎসাহী হয়ে থাকে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সাধারণত বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃতিগত পার্থক্যের ফলে প্রত্যেক শ্রেণির ছেলেমেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন মানসিক গঠন নিয়ে গড়ে ওঠে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকেরা তাদের পারিবারিক সুনাম, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর বেশি জোর দেয় এবং তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ওই ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলে। পক্ষান্তরে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, স্বনির্ভরতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, পেশাগত সফলতা ব্যক্তিগত উন্নতি ইত্যাদির জন্য শিক্ষাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করতে চায়। অন্য দিকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ, যেমন- দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক, দিনমজুর কৃষক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী ইত্যাদি শ্রেণির মানুষ তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ন্যূনতম স্তরের শিক্ষা গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়।

এই ভাবে পরিবার থেকে শিক্ষাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করার যে প্রবণতা বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যে লক্ষ্য করা যায় তার প্রভাব ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সার্বিক শিক্ষা বিকাশের উপর পড়ে। দুটি প্রধান কারণে পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

প্রথমত ছেলেমেয়েদের আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের আর্থসামাজিক শ্রেণি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। স্কুলে যাওয়ার পূর্বেই ছেলেমেয়েদের আচরণে তাদের বিশ্বাসে, অনুভূতিতে ও মনোভাবে একটি নির্দিষ্ট ধারা সৃষ্টি হয়। তাই স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী ছেলেমেয়েরা একই ক্লাসে ভর্তি হয়ে এক সাথে লেখাপড়া শুরু করলে তাদের মধ্যে আচরণগত পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যা সুষ্ঠুভাবে ক্লাস পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি করে।

এজন্যই শিক্ষার্থীদের শ্রেণিগত অবস্থান সম্পর্কে ধারণা থাকা একজন শিক্ষকের জন্য খুব প্রয়োজন। শিক্ষার প্রতি ছেলেমেয়েদের মনোভাব কেমন হবে তা অনেকাংশে নির্ভর করে শিক্ষার প্রতি পরিবারের বিশেষ করে অভিভাবকদের মনোভাব কেমন তার উপর। মধ্যবিত্ত সমাজের জন্য জীবনে সফলতা লাভের ক্ষেত্রে শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে নিম্নবিত্তরা সফলতা লাভের ক্ষেত্রে অর্থকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে।

স্কুলে শিক্ষার্থীদের দলীয় আচরণ বোঝার ক্ষেত্রে ও তাদের শ্রেণিগত অবস্থান সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা স্কুলের সহঃশিক্ষামূলক কার্যক্রম এবং স্কুলের বাইরে সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে চায় না যার ফলে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ও অন্যান্য প্রত্যাশিত সামাজিক আচরণের বিকাশ খুব কম হয়। আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা- আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজনীয়তার উপর বেশি জোর দেওয়া হয় এবং বলা যায় যে এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা নিম্নবিত্তদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে ততটা সহায়ক নয়।

শিক্ষার সাথে জড়িত কর্মকর্তা এমন কি যারা সরাসরি শিক্ষাদান কার্যক্রমের সাথে জড়িত সেই শিক্ষকগণ ও মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত তাই তারাও শিক্ষার্থীদের সমস্যা চিহ্নিত করণ ও সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের শ্রেণিগত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে আসতে পারে না। 

নিম্নবিত্ত পরিবারের কাছে শিক্ষার চেয়ে পেটের খোরাক জোগানো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে হলেও পারিবারিক আয় বৃদ্ধির জন্য ছেলেমেয়েদের কাজে লাগায়। নিম্নবিত্ত সমাজের এই যে পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি এটা তাদের সন্তানদের শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করে। তাই স্কুলের প্রতি ন্যূনতম অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হলেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ড্রপআউট হয়ে যায়। এজন্য শিক্ষার্থীর প্রেষণা সৃষ্টিতে বিদ্যালয়ের যথাযথ ভূমিকা পালনের বিষয়টি অতীব গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের “ঝরে পড়া” ঠেকানো এবং তাদেরকে লেখাপড়ায় মনোযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানা এবং সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। জেমস ডেভী তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির সাথে তাদের পারিবারিক, আর্থসামাজিক অবস্থার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ডেভির মতে, পরিবারের আর্থিক সংগতি ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার ইচ্ছা এবং শিক্ষার প্রতি পরিবারের মনোভাব এই তিনটি উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়ার প্রভাব শিক্ষার্থীর উপর পড়ে। এই প্রভাব নেতিবাচক হলে সে ক্ষেত্রে তার শিক্ষার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুর জীবন বিকাশের সব ক্ষেত্রেই পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম।

পরিবার থেকেই শিশু সব ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রথম অবগত হয়। শিশুর মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি কেমন হবে অন্যের প্রতি সে কিরূপ মনোভাব পোষণ করবে এবং কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে তা অনেকাংশেই শিশুর পারিবারিক কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। পরিবারে বাবা ও মায়ের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শিশুরা নারী ও পুরুষের ভূমিকা এবং নিজের লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয়। একক পরিবারের ক্ষেত্রে বাবা ও মায়ের মধ্যে যদি ভালোবাসা ও শৃঙ্খলা বোধের সম্মিলন ঘটে তা হলে পরিবারে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই ধরনের পরিবার হতে শিশু যে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা লাভ করে তা পরবর্তীতে তার সামাজিকি করণের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তবে ডিভোর্স বা অন্য কোন কারণে সৃষ্ট একক অভিভাবক পরিবারের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে। বাবা-মায়ের ডিভোর্সের ফলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে রাগ, ভয়, অপরাধবোধ, হীনমন্যতা, হতাশা ইত্যাদি প্রবণতা দেখা দেয়। ছেলেরা অনেক সময়ই আক্রমণাত্মক মনোভাব পোষণ করে। কর্তৃপক্ষের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট হয়। জীবন, মানবিক সম্পর্ক সম্বন্ধে তাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠে। যার প্রভাব তাদের শিক্ষা জীবনে পড়ে। তাই, একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার বিকাশ তথা সামগ্রিক বিকাশের স্বার্থে তার আচরণ অনুধাবনের জন্য পরিবারের ভূমিকা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকা অপরিহার্য।

সুতরাং অভিভাবক এবং পিতা-মাতার এ কথা মনে রাখা উচিত যে, পরিবার থেকে শিশু যে শিক্ষা পায় তা তাকে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করে। পরিবারের শিক্ষা যদি ভঙ্গুর হয় তা হলে শিশুর পরবর্তী জীবনে নানা বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হয়।