মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশ: ০৯:৪৫:৫২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ অগাস্ট ২০২২
- / ১২৫৩ বার পড়া হয়েছে
কাজী নজরুল ইসলাম সর্বহারা দুঃখী ও নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর ছিলেন। তাঁর লেখনিতে থাকত স্বাধীনতা, বিপ্লব ও সাম্য। তাই নজরুল সকল শ্রেণির ও সকল মানুষের কবি।
একজনের এত অভিধা কারও কাছে তিনি প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, কারও মতে সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, আবার কেউ বলেন, তিনি মানবতার কবি। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম
তিনি ছিলেন একটি রুটি দোকানের কর্মচারী, পরে সেনাবাহিনীর হাবিলদার। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে তিনি একজন সৃষ্টিশীল লেখক। তাই কবি নজরুল নিজেই বলেছেন, ‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি কেবলমাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
সত্যিই নজরুল হলেন বাঙালির আলোকবর্তিকা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শিয়ারশোল রাজহাইস্কুলের দশমশ্রেণির কৃতী ছাত্র নজরুল দেশপ্রেমের আহ্বানে সৈনিক বৃত্তি নিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে ১৯১৭ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর চাকরিতে ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হাবিলদার নজরুল বাংলাদেশের পত্রিকার জন্য বহু, গল্প, কবিতা, গান প্রভৃতি লিখে পাঠাতেন।
১৯১৯ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলামের ‘মুক্তি’ কবিতা প্রথম ছাপা হয়। পাশাপাশি ব্যথার দান ও হেনা গল্প ছাপা হয়। ১৯২০ সালে দেশে অসহযোগ আন্দোলনে একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যোগ দেন নজরুল। বিভিন্ন শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে তিনি স্বরচিত গান গাইতেন। তা হল- ‘এ কোন্ পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী মার আঙিনায়, আজি রক্ত – নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি – কোলাহল বন্দী শৃঙ্খলে’ প্রভৃতি।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামের হাতিয়ার ছিল তাঁর কবিতা ও গান। ১৯২১ সালে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বিজলি পত্রিকায়। দু’দফায় ২৯ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। যা প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ মানুষ কবিতাটি পাঠ করে। ফলে কাব্যমোদি মহলে যেমন বিপুল চমকের সৃষ্টি করে, তেমনি আলোড়িত করে বাংলার তরুণ ও যুব সমাজকে। তিনি আখ্যায়িত হন বিদ্রোহী কবি অভিধায়, যা পরবর্তীকালে তাঁর নামের অবিচেছদ্য অংশ হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী কবিতা দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ও মানব মনের অব্যক্ত অভিপ্রায় প্রকাশে বাংলা সাহিত্যে শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যে অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন বক্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গী ও প্রাণশক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর কবিতায় বৈশিষ্ট্যের অন্যতম ধারক তাঁর ছন্দ পরীক্ষায় নানামাত্রিক উৎকর্ষ। ১৯২০ সালে নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি হয়। করাচি সেনানিবাসে থাকাকালীন বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। তখন তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতা ফিরে আসেন। কলেজ স্ট্রিটের বঙ্গীয় মুসলিম সমিতির অফিসে তিনি বাস করেন, সেখানে মুজফফর আহমেদ সহ মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, মহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো বহু সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। নজরুলের লেখা প্রকাশিত হয় মোসলেম ভারত, নবযুগ পত্রিকায়। তাঁর অনেকগুলি লেখা ‘যুগবাণী’ নাম দিয়ে পুস্তাকারে প্রকাশিত হয়। কাজী নজরুলের মধ্যে তখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। কবিতা, গান রচনা তারই জয়ধ্বনি। এমন সময় উদয় হন ‘ধূমকেতু’।
১৯২২ সালে প্রকাশিত ধূমকেতুতে কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন, সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কাগজে ঘোষণা করে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিকে বাংলাদেশে প্রথম তিনিই তুলে ধরেছিলেন। ১২ আগস্ট নজরুলের সম্পাদনায় ধূমকেতু প্রকাশিত হয়। তিনি ধূমকেতু’র আশীর্বাদ বাণী চাইলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ পরম উৎসাহে লিখলেন— ‘আয় চলে আয় রে ধূমকেতু, আঁধারে ভাঙ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে, উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন।’ ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশের পর স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ল যুবসমাজে। কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় ও রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার করে কাজী নজরুল ইসলামকে। এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। ধূমকেতুর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলা চালাতে বহু আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে এলেন। নজরুল জেলে বন্দি হওয়ায় দুই সপ্তাহ কাগজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বীরেন সেনগুপ্তর সম্পাদনায় দুটো সংখ্যা প্রকাশ হয়। কিন্তু অর্থাভাবে সেই পত্রিকা চালানো সম্ভব হয়নি।
এদিকে নজরুলকে হুগলি জেলে সাধারণ কয়েদির পর্যায়ে আচরণ করা হলে তিনি রাজনৈতিক সহবন্দিদের সঙ্গে নিয়ে অনশন শুরু করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, অতুল সেন, হেমন্ত সরকার সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অনুরোধ করা সত্ত্বেও অনশন তুললেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে টেলিগ্রাম করে বলেছিলেন, “Give up hunger strike, our literature claims you.” তা সত্ত্বেও অনশন তুললেন না কাজী নজরুল ইসলাম। দীর্ঘ ৩৯ দিন পর রবীন্দ্রনাথের চেষ্টায় মাতৃসমা বিরজাসুন্দরীর অনুরোধে তাঁর হাতে লেবুর শরবত খেয়ে অনশন ভঙ্গ করেন নজরুল।
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকার সময় রবীন্দ্রনাথ ১৯২৩ সালের ২২ জানুয়ারি নজরুলকে তাঁর ‘বসন্ত’ নাটিকা উৎসর্গ করে জেলে বইটি পাঠিয়েছিলেন। বইটি পাওয়ার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে জেলে বসেই নজরুল সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, শিকল পরা ছল সহ কয়েকটি গান রচনা করেন। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯২৪ সালে কুমিল্লার গিরিবালা দেবীর কন্যা প্রমীলা সেনগুপ্তকে বিবাহ করেন। ১৯২৫ সালে ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরে প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সদস্য হিসেবে কংগ্রেস সম্মেলনে স্বেচছাসেবক বাহিনী গঠন ও তাদের কুচকাওয়াজ শেখানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় ‘কাণ্ডারি হুঁশিয়ার’ গান রচনা করেন। ১৯২৮ সালে কলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানিতে কাজ পান। রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ থাকার কারণে ব্রিটিশ গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে দূরে রেখেছিল; পরে নজরুলকে আহ্বান জানায়।
কাজী নজরুল ইসলামের রচিত গানের সংখ্যা চার হাজারের মতো। গীত রচনা ছাড়াও বিদ্যাপতি, সাপুড়ে প্রভৃতি ছবির কাহিনীকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এর আগে ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘বিষের বাঁশি’ ও ‘ভাঙার গান’। প্রকাশিত হওয়া মাত্র রাজরোষের শিকার হয় এবং সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাঁর রচিত বিষের বাঁশি সম্পর্কে তৎকালীন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় মন্তব্য ছিল— “কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ের প্রচণ্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমুর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মৃত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।” কাজী নজরুল ইসলাম গোরা চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন।
কাজী নজরুল ইসলাম যেমন ইসলামি সংগীত রচনা করেছেন, তেমনি অসাধারণ শ্যামাসঙ্গীতও বাঙালিদের মনে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর দেশাত্মবোধক কবিতা ও গান উদ্বুদ্ধ করেছিল সুভাষচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সহ প্রথম সারির দেশনেতাদের। ‘চল, চল, চল’ গানটি ১৯২৮ সালে প্রথম ‘শিখা’ পত্রিকায় ছাপা হয়। পরে ‘সন্ধ্যা’ গ্রন্থতে অন্তর্ভুক্ত হয়। অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে কবিকে। এই ‘চল চল চল’ গানটি বাংলাদেশের রণসংগীত।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে বোধশক্তিহীন নীরব নির্বাক হয়ে যান। ১৯৫৩ সালে চিকিৎসার জন্য সস্ত্রীক ইউরোপে পাঠানো হয় কবিকে। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডিলিট’ দেন। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে’ পদক দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট বার্ধক্যজনিত কারণে নজরুলের জীবন চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়।