বাংলাদেশে নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক পদায়নে জটিলতা
- প্রকাশ: ০৮:০৪:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ১০৮৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের উত্তর কামারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণিকক্ষ। ছবিটি প্রতীকী। | © Mott MacDonald
আমরা এরই মধ্যে জানতে পেরেছি যে, বাংলাদেশে২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত নতুন পাঠ্যপুস্তক ও শিখনসামগ্রীর বাস্তবায়ন শুরু হতে যাচ্ছে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষকদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি ও গুরুত্বপূর্ণ।
এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বেশির ভাগ বিষয়ে ৫০ শতাংশ নম্বরের জন্য পরীক্ষা ও বাকি ৫০ শতাংশের ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে শ্রেণিকক্ষে। অর্থাৎ এখানেও শিক্ষকদেরই বিশাল ভূমিকা। নতুন শিক্ষাক্রমে চারটি ধর্ম শিক্ষাসহ মোট ১০টি বিষয় রয়েছে। সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান পদগুলোতে যাঁরা শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে কর্মরত তাঁরা সবাই যে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক এমন নয়। যেমন—গণিতের শিক্ষকই যে মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত করাচ্ছেন আর ইংরেজির শিক্ষকই যে ইংরেজি পড়াচ্ছেন এমনটি নয়। দেখা যাচ্ছে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক ইংরেজি পড়াচ্ছেন, কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষক গণিত কিংবা বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন। এটি একটি বাস্তবতা।
নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় পড়ানোর জন্য একটি বিষয়ে একাধিক শিক্ষক এবং কোনো বিষয়ে শিক্ষক নেই এভাবে বণ্টন করা যাবে না। হিন্দু ধর্ম শিক্ষা, খ্রিস্ট ধর্ম শিক্ষা ও বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয়ে না থাকলে ওই বিষয়ে আগ্রহী সংশ্লিষ্ট ধর্মানুসারে শিক্ষককে তাঁর নিজ বিষয়ের দায়িত্ব বণ্টনের পর অতিরিক্ত হিসেবে এ বিষয়গুলোর দায়িত্ব বণ্টন করা যেতে পারে। চারু ও কারুকলা বিষয়ে শিক্ষক না থাকলে শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ের ক্ষেত্রে আগ্রহী বা এ বিষয়ে দক্ষতা আছে এ ধরনের শিক্ষককে ওই বিষয়ের দায়িত্ব বণ্টন করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে কে কোন বিষয়ে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এবং কোন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন তা বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা এই তালিকা অনুসরণ করে তাঁর প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জন্য বিষয় বণ্টন করবেন। তালিকা অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা শিক্ষকদের জন্য বিষয় বণ্টন করে অনলাইনে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের ডাটা এন্ট্রি দেবেন। অনলাইনে বিদ্যমান সব বিষয়ের শিক্ষককে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী নির্বাচিত বিষয়গুলোর কোনো না কোনো বিষয়ের নাম এন্ট্রি দিতে হবে।কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ১০ জন হলে ১০ জন শিক্ষককে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমের ১০টি বিষয়ে বণ্টন করে দিতে হবে। একটি বিষয়ে একাধিক শিক্ষক এবং কোনো বিষয়ে শিক্ষক নেই এভাবে বণ্টন করা যাবে না। শিক্ষকসংখ্যা ১০ জনের বেশি হলে ম্যাচিং তালিকা অনুযায়ী নতুন শিক্ষাক্রমের ১০টি বিষয়ে ১০ জনকে দায়িত্ব বণ্টনের পর অন্য শিক্ষকদের জন্য তালিকা অনুযায়ী বিষয় বণ্টন করতে হবে। শিক্ষকসংখ্যা ১০ জনের কম হলে ম্যাচিং তালিকা অনুযায়ী তাঁদের বিষয় বণ্টন করে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে অন্যান্য বিষয়, তাঁদের নিজ বিষয়ে আগ্রহ ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বণ্টন করে দিতে হবে। বর্তমানে বাংলার শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে বিষয় হবে বাংলা, ইংরেজি শিক্ষকদের ইংরেজি, গণিত শিক্ষকদের গণিত, ভৌতবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের শিক্ষকদের বিষয় হবে বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও ভূগোল শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে বিষয় হবে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞান বা আইসিটিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা আইসিটিতে দক্ষ যেকোনো বিষয়ের শিক্ষকদের বিষয় নতুন শিক্ষাক্রমে হবে ডিজিটাল প্রযুক্তি। কৃষিশিক্ষা ও ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে বিষয় হবে কৃষিশিক্ষা ও ব্যবসায় শিক্ষা, শারীরিক শিক্ষা ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি ও জীববিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষকদের বিষয় নতুন শিক্ষাক্রমে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ের শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বিষয় হবে ধর্ম শিক্ষা এবং চারু ও কারুকলা বিষয়ে শিক্ষকদের বিষয় নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী হবে শিল্প ও সংষ্কৃতি।
বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক মাধ্যমিকে সব বিষয়ে না থাকা একটি বাস্তবতা। এর জন্য এককভাবে কেউ দায়ী নয়। তবে বেশির ভাগ শিক্ষকই ইংরেজি, গণিত বিষয়ে পাঠদান করতে চান প্রাইভেট টিউশনির জন্য। আর এ জন্য কর্তৃপক্ষের আনুকূল্য পেতে হয়। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে গ্রামীণ এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের এমনিতেই ঘাটতি রয়েছে, তারপর বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক থাকার তো প্রশ্নই আসে না। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে অন্য ধরনের সমস্যা। ঢাকা সিটিসহ দেশের বড় বড় শহরে এবং অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অঞ্চলে অবস্থিত সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক আর গ্রামীণ এলাকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় খুব কমসংখ্যক শিক্ষক। তার পরও খোদ রাজধানীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক ধরন অনুসারে শিক্ষক পদায়ন করা নেই। এসব বিদ্যালয়ে এক বিষয়ের শিক্ষক আরেক বিষয়ের ক্লাস নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এখানে নতুন কারিকুলাম কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে সন্দিহান খোদ শিক্ষকরাই।
নতুন কারিকুলামে প্রশিক্ষণবিহীন কোনো শিক্ষক আগামী ৩১ ডিসেম্বরের পর আর ক্লাস নিতে পারবেন না। ডিসেম্বরের আগেই ঢাকার স্কুলগুলোর শিক্ষকদের বিষয় সমন্বয় করে ফেলা হবে বলে মন্তব্য করেছেন মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিদ্যমান শিক্ষকদের সফটওয়্যারের মাধ্যমে সমন্বয় করাতে প্রধান শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে মোট ১০টি বিষয় থাকছে। এর আলোকে বর্তমানে বিষয়ভিত্তিক পদে কর্মরত শিক্ষকদের বিষয় নির্ধারণ করে সেপ্টেম্বর ১০-এর মধ্যে ইএমআইএস ডাটাবেইস হালনাগাদ করতে বলা হয়েছিল, এই তারিখ আবার বাড়ানো হয়েছে।
২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে সারা দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের বিদ্যালয়, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১-এর আলোকে প্রণীত শিক্ষাক্রম ও পাঠপুস্তকের সাহায্যে শিখন কার্যক্রম চালু হতে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রশিক্ষণ প্রদানের আগে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের বিষয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখার আলোকে মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের বিষয় নির্ধারণ করে শিক্ষকদের ডাটাবেইস হালনাগাদ করার জন্য ইএমআইএস ওয়েবসাইটে একটি মডিউল করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, যাঁদের ইআইআইএন নম্বর আছে, তাঁরা ইএমআইএস ওয়েবসাইটে লগ ইন করে তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিষয় নির্ধারণ করতে পারবেন।
রাজধানী ঢাকায় প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক পদায়ন দিয়ে রাখলেও মফস্বলের এসব বিদ্যালয় এখন শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার কারগিল সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৫টি শিক্ষক পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র চারজন। কক্সবাজারের মহেশখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ জন শিক্ষকের মধ্যে এখন মাত্র চারজন পাঠদান করছেন। ফলে এ দুটি বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়াই দুরূহ হয়ে পড়ছে। রাঙামাটির জুরাইছড়ি উপজেলার ভুবন জয় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৫টি শিক্ষক পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র সাতজন। একই জেলার রাজস্থলী উপজেলার তাইতংপাড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ জন শিক্ষকের মধ্যে এখন আছেন চারজন। বরগুনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের মোট পদ ৪৯ জনের, আছেন মাত্র ২০ জন, ২৯ জনই নেই। বরগুনা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪৯ জনের মধ্যে আছেন ৩১ জন। পিরোজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪৯ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন ৩২ জন। ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪৯ জন শিক্ষকের মধ্যে আছেন ২৯ জন।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী একজন শিক্ষক একই এলাকায় সর্বোচ্চ তিন বছর থাকতে পারেন। তবে সুবিধাভোগীদের কেউ কেউ রাজধানীতে আছেন ২৬-২৭ বছর পর্যন্ত। ঢাকা সিটির সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন বিষয়ের পাঁচ শতাধিক শিক্ষক একই বিদ্যালয়ে কিংবা ঘুরেফিরে ঢাকার সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে বছরের পর বছর পার করছেন। ঢাকায় মোট সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ৩৮টি। এগুলোতে বর্তমানে ২১৯ জন শিক্ষক অতিরিক্ত আছেন। শুধু সামাজিক বিজ্ঞানেই অতিরিক্ত আছেন ৯৯ জন। এসব বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক পদ এক হাজার ৫৮০টি। এর মধ্যে সহকারী শিক্ষক ৭৯০ জন এবং সিনিয়র শিক্ষক ৭৯০ জন। অতিরিক্ত শিক্ষকের মধ্যে ৮৭ শতাংশই সিনিয়র শিক্ষক। বাকিরা সহকারী শিক্ষক। এটি আরেক ধরনের ক্ষতিকর বাস্তবতা।
সবাই ঢাকায় থাকতে চান, চাওয়াটাই স্বাভাবিক। সবাই ঢাকায় থাকলে অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীদের এবং শিক্ষার কী হবে? এই অসম অবস্থা তৈরির জন্য সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। কারণ শিক্ষক স্বল্পতা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করে আমাদের শিক্ষার্থীদের। যাদের জন্য এই বিশাল ব্যবস্থা তারাই যদি উপকৃত না হয়, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন কী? কোথাও এক-চতুর্থাংশ শিক্ষক কাজ করবেন আবার ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপচে পড়া শিক্ষক—এ কেমন বৈষম্য? শিক্ষক স্বল্পতা ও অতিরিক্ত শিক্ষক, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকা বা তার ধারেকাছেও না যাওয়া বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদানকে নিরুৎসাহ করে প্রাইভেট কোচিং, কোচিং সেন্টারও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। কাজেই এ বিষয়টিতে সমতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে আসা সময়ের দাবি।