মেটফরমিন ও ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে তার গুণাঢ্য ফার্মাকোলজি
- প্রকাশ: ১১:০৩:১৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর ২০২২
- / ১০২২ বার পড়া হয়েছে
বিশ্বব্যাপী নভেম্বর মাসকে বেছে নেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রোগের জনসচেতনতা মাস হিসেবে, যেমন: ফুসফুসের ক্যান্সার, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), ডায়াবিটিস এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। বিশেষ করে নভেম্বর ১৪-কে বেছে নেওয়া হয় বিশ্ব ডায়াবিটিস দিবস হিসেবে কারণ কানাডীয় মেডিকেল বিজ্ঞানী স্যার ফ্রেডেরিক গ্রান্ট ব্যানটিং এর জন্ম দিন ছিল ১৪ নভেম্বর। ফ্রেডেরিক গ্রান্ট ব্যানটিং এবং জন ম্যাকলিওড ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্য ১৯২৩ সনে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
ডায়াবিটিস একটি মারাত্মক রোগ, কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসার অধীনে থাকলে ও আলস্যহীন জীবনযাপন করলে এই রোগটি অনেকটা নিয়ন্ত্রণযোগ্য। ডায়াবেটিসকে একটি রোগ বললে সম্ভবত ভুল হবে, বরং ডায়াবেটিসকে বলা যায় বিপাকীয় ব্যাধিগুলির একটি গ্রুপ— যার কারণে রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং দেহে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করে। বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ ডায়াবিটিসে ভুগছেন, অর্থাৎ প্রতি আটজনের একজন এই রোগে আক্রান্ত। এই অসুখে আক্রান্ত হন গর্ভবতী নারী, এমনকি শিশুরাও। ডায়াবিটিস এর প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় মেটফরমিন একটি প্রথম সারির ওষুধ যার অসামান্য ও নানান আণবিক কৌশল ডায়াবিটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, সাথে প্রান্তস্থ টিস্যুগুলোতে ইনসুলিন সংবেদনশীলতাও বাড়ায়। মনোথেরাপি হিসেবে এবং অন্যান্য গ্লুকোজ-হ্রাসকারী ওষুধের সাথে একত্রে মেটফরমিন অনেক সার্থক একটি ওষুধ। ডায়াবিটিস সমন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির এই মাসে মেটফরমিন নিয়ে বিজ্ঞানের আলোকে কিছুটা আলোকপাত করাটাই হচ্ছে আমাদের উদ্দেশ্য।
মেটফরমিন (Metformin) একটি বাইগুয়ানাইড গ্রুপের ওষুধ যা ষাটের দশক থেকে টাইপ ২ ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। ফরাসি লাইলাক ‘গ্যালিগা অফিসিনালিস’ নামক একটি গুল্ম থেকে বাইগুয়ানাইড জাতীয় ওষুধগুলোর উৎপত্তি। এই গুল্ম থেকে প্রাপ্ত ‘গ্যালিজিন’ নামক প্রাকৃতিক উপাদান যা শতবছর পূর্বেই মধ্যযুগীয় ইউরোপে ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যদিও তৎকালে এটি মানবদেহে বিষাক্ত বলে প্রমাণিত হয়েছিল। প্রায় একই সময়ে গ্যালিজিনের দুইটি সিন্থেটিক উপজাত, মেটফরমিন ও ফেনফরমিন পরীক্ষা করা হয়েছিল তিন দশক ধরে, যখন এটিকে পঞ্চাশের দশকে মানবদেহে ব্যবহারের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু ভেষজ ওষুধ হিসেবেই মেটফরমিনের জন্ম তাই কোষের নির্দিষ্ট কোনো সংকেতপথকে লক্ষ্য করে এই ওষুধটি তৈরি করা হয়নি। আণবিক পর্যায়ে মেটফরমিনের কোষীয় প্রতিক্রিয়া কী সেটাও জানা ছিল না। এমনকি ৬০ বছর ধরে এটির ক্লিনিক্যাল ব্যবহার সত্ত্বেও, আণবিক পর্যায়ে মেটফরমিনের ফার্মাকোলজি সংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপের একটি সম্পূর্ণ চিত্র এখনও আমাদের অজানা।
মেটফরমিন অন্ত্রে গ্লুকোজের শোষণ কমায়, যকৃতে গ্লুকোজের উৎপাদন কমায় এবং প্রান্তস্থ বা পেরিফেরাল টিস্যু, যেমন কার্ডিয়াক বা অস্থিপেশির কোষগুলোতে গ্লুকোজের ব্যবহারকে বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ায়। তবে, ধনাত্মক-ধর্মী ও পানি-আকর্ষী বৈশিষ্টের কারণে মেটফরমিন সরাসরি কোষ মেমব্রেন অতিক্রম করতে পারে না, ফলে তার কোষাভ্যন্তরে প্রবেশ ও কোষ থেকে বহির্গমনের জন্য প্রয়োজন একটি জৈব-ক্যাটায়ন পরিবাহী প্রোটিন (ট্রান্সপোর্টার)। এই ধরণের সাতটি ট্রান্সপোর্টার প্রোটিন বিভিন্ন কোষে মেটফরমিন পরিবহনের সাথে জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, ‘অর্গানিক ক্যাটায়ন ট্রান্সপোর্টার’ (OCT3) ও ‘প্লাজমা মেমব্রেন মোন্যামিন ট্রান্সপোর্টার’ (PMAT) এর মাধ্যমে মেটফরমিন অন্ত্রের এন্টারোসাইটে প্রবেশ করে এবং OCT1 এর মাধ্যমে প্রস্থান করে। অন্যদিকে, OCT1 এবং OCT3 এর মাধ্যমে মেটফরমিন যকৃতকোষে (হেপাটোসাইট) প্রবেশ করে এবং ‘মাল্টিড্রাগ এন্ড টক্সিন এক্সট্রুশন’ (MATE1) ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে প্রস্থান করে এবং বৃক্কের এপিথেলীয় কোষ থেকে মেটফরমিন নির্গত হয় OCT2 এবং MATE1/2 এর মাধ্যমে।
গ্লুকোজ ট্রান্সপোর্টার (Glucose transporter)
যকৃত মেটফরমিনের ফার্মাকোডাইনামিক্সের একটি প্রধান স্থান হিসাবে স্বীকৃত হলেও কিন্তু বেশ কিছু গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে মেটফরমিনের প্রভাবে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে পৌষ্টিক-অন্ত্রের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। মেটফরমিন এই কাজটি করে অন্ত্রের গ্লুকোজ বিশোষণ প্রক্রিয়ার পরিবর্তন এবং অবায়ুজীবী বিপাকের পরিবর্তনের মাধ্যমে। অন্ত্রে গ্লুকোজ শোষণের জন্য দুইটি বাহক (ট্রান্সপোর্টার) প্রোটিন সরাসরি জড়িত- GLUT2 (গ্লুট-২) ও SGLT-1 (এসজিএলটি-১)। গ্লুকোজ ট্রান্সপোর্টার পরিবারে অন্তর্ভুক্ত গ্লুট-২ একটি দ্বিমুখী ট্রান্সপোর্টার, যার মাধ্যমে মুক্ত গ্লুকোজ অণুগুলির কোষঝিল্লির এপার-ওপার উভয় দিকেই পারাপারের সুযোগ রয়েছে। গ্লুট-২ উপস্থিত থাকে বৃক্কের টিউবুলার কোষ, যকৃত কোষ, অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ ও ক্ষুদ্রান্তের এপিথেলীয় শোষককোষ বা এন্টারোসাইটে। এন্টেরোসাইটের লুমেন অন্তর্মুখী এপিক্যাল মেমব্রেনে অবস্থিত কোট্রান্সপোর্টার এসজিএলটি-১ প্রোটিনের মাধ্যমে অন্ত্ৰীয় লুমেন থেকে গ্লুকোজ শোষিত হয় এন্টেরোসাইট কোষে এবং সেখান থেকে বেসোল্যাটারাল মেমব্রেনে অবস্থিত গ্লুট-২ এর মাধ্যমে গ্লুকোজ প্রবেশ করে রক্তপ্রবাহে। দেখা গিয়েছে, গ্লুট-২ বা এসজিএলটি-১ জিনের মিউটেশন গ্লুকোজ শোষণকে ব্যাহত করে, যা ইঙ্গিত করে গ্লুকোজ শোষণে এই দুটি প্রোটিনের গুরুত্ব। প্রসঙ্গতঃ GLUT পরিবারের সমস্ত প্রোটিন মানব ডিএনএ (DNA)-র SLC2 জিন দ্বারা সংকেত প্রাপ্ত। এছাড়া, মেটফরমিন গ্লুকাগন-সদৃশ পেপটাইড-১ (GLP-1) এর নিঃসরণকে বৃদ্ধি ক’রে অন্ত্রে তার গ্লুকোজ-হ্রাসকারী প্রভাবও প্রয়োগ করতে পারে। মেটফরমিন ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ায় ফলে গ্লুকোজকে ভেঙে জৈবিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করে। ফলে যকৃতে অতিরিক্ত গ্লুকোজ পুঞ্জীভূত থাকে না। আণবিক পর্যায়ে বিভিন্ন কোষে মেটফর্মিনের ফার্মাকোলজি, অর্থাৎ এটি কীভাবে কাজ করে তা এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের নিকট খুব স্পষ্ট নয়। মেটফরমিন মাইটোকন্ড্রিয় রেসপিরেটরি চেইন (কমপ্লেক্স I), এএমপি-অ্যাক্টিভেটেড প্রোটিন কাইনেজ (AMPK) সক্রিয়করণ, গ্লুকাগন-প্ররোচিত সাইক্লিক অ্যাডেনোসিন মনোফসফেট (cAMP) উদ্দীপনায় বাধা, কমপ্লেক্স IV-মধ্যস্থতায় মাইটোকন্ড্রিয় গ্লিসারল-৩-ফসফেট ডিহাইড্রোজিনেজের GPD2 ভ্যারিয়ান্টকে বাধা (এর ফলে গ্লিসারল থেকে প্রাপ্ত হেপাটিক গ্লুকোনোজেনেসিস হ্রাস), এবং অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটার উপর প্রভাব সৃষ্টি করে ।
গ্লুকোনিওজেনেসিস কী?
গ্লুকোনিওজেনেসিস একটি সর্বব্যাপী বিপাকীয় প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট নন-কার্বোহাইড্রেট (যেমন গ্লুকোজেনিক অ্যামিনো অ্যাসিড, ল্যাকটিক অ্যাসিড/ল্যাকটেট, পাইরুভেট ও গ্লিসেরল) অণু থেকে গ্লুকোজ তৈরি হয়। গ্লুকোনিওজেনেসিস অধিকাংশক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে যকৃতে এবং কিছুটা হলেও ঘটে বৃক্কের কর্টেক্সে, পেশি, অন্ত্র ও মস্তিষ্কের অ্যাস্ট্রোসাইটে (astrocyte)। গ্লুকোনিওজেনিক পূর্বসূরি হিসাবে যকৃত ব্যবহার করে ল্যাকটেট, গ্লিসারল এবং অ্যামিনো অ্যাসিড (বিশেষত অ্যালানিন)। অন্যদিকে, কিডনি ব্যবহার করে ল্যাকটেট, গ্লুটামিন ও গ্লিসেরল।
যকৃত কোষে যে কয়টি গ্লুকোনিওজেনিক উৎস রয়েছে তার মধ্যে ল্যাকটেট অন্যতম। ল্যাকটেট রূপান্তরিত হয় পাইরুভেটে ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজিনেজ (LDH) এনজাইম দ্বারা। গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজ-৬-ফসফাটেজ (G6Pase), ফ্রুক্টোজ-১,৬-বিসফসফেটেজ (FBPase) এবং ফসফোইনোল পাইরুভেট কার্বোক্সিকাইনেজ (PEPCK) এই তিনটি এনজাইম অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন প্রোটিন ফ্যাক্টর ও হরমোন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্সুলিন ও গ্লুকাগন বিপরীতমুখী প্রভাব ফেলে। অনাহার অবস্থায় গ্লুকাগন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে উদ্দীপিত করে; আর, রক্তে গ্লুকোজের আধিক্যে ইনসুলিন তা রোধ করে। গ্লুকাগন ও ইনসুলিন মূলতঃ তাদের কাজটি করে ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের মাধ্যমে। গ্লুকাগন হরমোনের সক্রিয়তায় অনাহার অবস্থায় ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর CREB 1 (cAMP-রেস্পন্স এলিমেন্ট-বাইন্ডিং প্রোটিন), CBP (CREB-বাইন্ডিং প্রোটিন), CRTC2 (CREB-নিয়ন্ত্রিত ট্রান্সক্রিপশন কো-অ্যাক্টিভেটর ২), FoxO1 (ফর্কহেড ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর) ও FoxO6 প্রোটিন গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত জিন (যেমন PEPCK, G6Pase, Fbpase)গুলোকে নানা ভাবে উদ্দীপিত করে ও তাদের প্রকাশ বৃদ্ধি করে। অপরদিকে, রক্তে গ্লুকোজের প্রাচুর্য্যে ইনসুলিনের সক্রিয়তায় ‘প্রোটিন কাইনেজ বি’ (Akt) দ্বারা FoxO1 ও FoxO6কে ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে তার ক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করে। ইনসুলিনের প্রতিরোধ (insulin resistance) ক্ষমতা হারাবার ফলে ইনসুলিন FoxO6-কে ব্লক করতে ব্যর্থ হয়, ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অধিক থাকা সত্ত্বেও গ্লুকোনিওজেনেসিস অব্যাহত থাকে, দেহে সৃষ্টি হয় হাইপারগ্লাইসেমিয়া। এই অবস্থায় মেটফরমিন CREB-CBP-CRTC2 কমপ্লেক্স ও FoxO6-কে বাধা দিতে সমর্থ হয়। এই কারণে গ্লুকোনিওজেনেসিস হলো টাইপ২ ডায়াবেটিস থেরাপির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।
দেহে কোষীয় গ্লুকোজ উৎপাদনের স্থান হচ্ছে যকৃত, যেখানে গ্লুকোজ-সংক্রান্ত চারটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া, অর্থাৎ গ্লুকোনিওজেনেসিস, গ্লাইকোজেনোলাইসিস (গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজে রূপান্তর), গ্লাইকোজেন সংশ্লেষণ (গ্লুকোজ থেকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তর) এবং গ্লাইকোলাইসিস (গ্লুকোজ থেকে পাইরুভেটে রূপান্তর) অবশেষে নির্ধারণ করে নেট গ্লুকোজ উৎপাদন। দেখা গিয়েছে, রাত্রিকালীন উপবাসের পরে এই চারটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ কোষীয় গ্লুকোজ উৎপাদনের জন্য দায়ী, যেখানে স্বয়ং গ্লুকোনিওজেনেসিস অবদান রাখে প্রায় ৫০%। তাই, দেহে টাইপ২ ডায়াবেটিস থেরাপি হিসেবে গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণে গ্লুকোনিওজেনেসিস হয়ে উঠেছে মেটফরমিনের একটি প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
মেটফরমিনের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে যকৃত এবং গ্লুকোনিওজেনেসিস
যকৃতে গ্লুকোজ উৎপাদন কমিয়ে এবং পেশিগুলোতে (বিশেষ করে অস্থিপেশিতে) গ্লুকোজের ব্যবহার বাড়িয়ে মেটফরমিন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। যকৃত কোষে মেটফরমিনের সম্ভাব্য প্রভাবকগুলির মধ্যে গ্লুকোজ উৎপাদনের প্রধান নিয়ন্ত্রক হচ্ছে, AMPK (ছবি দেখুন)। তাই AMPK-কে কেন্দ্র করে গবেষণাও হয়েছে ঢের, স্বয়ং ২০২১-২২ সালে গ্লুকোজ-AMPK-সংক্রান্ত গবেষণাপত্র প্রকাশ পেয়েছে প্রায় পাঁচ শত (https://www.ncbi.nlm.nih.gov/)। যকৃতে মেটফরমিনের টার্গেট হচ্ছে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াটিকে বাধা প্রদান করা। গ্লুকোজ উৎপাদনে মেটফরমিনের এই প্রতিরোধমূলক প্রভাবের জন্য AMPK এনজাইমটির সক্রিয়করণ প্রয়োজন। সক্রিয়করণের এই কাজটি করে মেটফরমিন-উদ্দীপ্ত লিভার কাইনেজ বি১ (LKB1) এনজাইম কর্তৃক ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে। তাই, এলকেবি-১ নকআউট ইঁদুরগুলিতে মেটফরমিনের অ্যান্টি-হাইপারগ্লাইসেমিক প্রভাবকে বাতিল করে দেয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে AMPK কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈব শক্তি বোধক এবং গ্লুকোজ, লিপিড ও প্রোটিন বিপাকের কোষীয় নিয়ন্ত্রক। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে যকৃতে মেটফরমিন কর্তৃক গ্লুকোজ উৎপাদনে প্রতিরোধমূলক প্রভাব AMPK-নির্ভর এবং AMPK-অনির্ভর উভয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সংঘটিত হতে পারে। দেখা গিয়েছে, এসিটিল-CoA কার্বক্সিলেজ (ACC1/2)-এর AMPK-মধ্যস্থ ফসফোরিলেশন সাইটের একটি একক মিউটেশন ডায়াবেটিক ইঁদুরের মেটফরমিন-উন্নত ইনসুলিন সংবেদনশীলতা এবং গ্লুকোজ সহনশীলতাকে দৃঢ়ভাবে ব্লক করে, যা ইঙ্গিত করে মেটফরমিন কার্যকারিতায় AMPK সক্রিয়করণের গুরুত্ব।
যকৃতে মেটফরমিন দুইটি কৌশলের মাধ্যমে কাজ করে। প্রথমতঃ কোষাভ্যন্তরে (সাইটোপ্লাজমে) মেটফরমিন অ্যাডিনোসিন মনোফসফেট (AMP)-এর পরিমাণ ও তার কার্যকলাপ বৃদ্ধি করে, যদিও মেটফরমিন কীভাবে এই কাজটি করে তার স্পষ্ট ধারণা এখনও জানা নেই- তবে, এটা এখন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, মেটফরমিন মাইটোকন্ড্রিয়ায় ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইনের কমপ্লেক্স-I ও গ্লিসারল-৩-ফসফেট ডিহাইড্রোজিনেজ (GPD2) এর কার্যক্রমকে বাধা দেয়- ফলে এই ড্রাগটি NADH জারণ প্রক্রিয়াকে হ্রাস করে, আন্তর-মাইটোকন্ড্রিয় ঝিল্লি জুড়ে প্রোটন (H+) পাম্পিং বা প্রোটন চলাচলকে হ্রাস করে, সার্বিক ATP সংশ্লেষণ বাধাগ্রস্থ হয়, এবং অক্সিজেন ব্যবহারের হারও কমে আসে। সুতরাং, হ্রাসকৃত প্রোটন গ্রেডিয়েন্ট এবং সাইটোপ্লাজমে বর্ধিত AMP/ATP এবং ADP/ATP অনুপাত, হ্রাসকৃত NAD+/NADH অনুপাত, বর্ধিত ল্যাকটেট/পাইরুভেট অনুপাত AMPK-কে সক্রিয় করে। এছাড়া, কোষে বর্ধিত ‘এএমপি’ (অ্যাডিনোসিন মনোফসফেট) AMPK-এর একটি সাবইউনিটের সাথে আবদ্ধ হয়ে এটিকে LKB1 দ্বারা ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে আরও সংবেদনশীল ও বোধিত করে তোলে, যা আগেই উল্লেখ করেছি। দেখা গিয়েছে, সক্রিয় AMPK যকৃতের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং হেপাটোসাইটগুলিকে অ্যানাবলিক (সংশ্লেষণ) পথ, যেমন গ্লুকোনিওজেনেসিস, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং প্রোটিন সংশ্লেষণ থেকে ক্যাটাবলিক (বিশ্লেষণ) পাথওয়েতে পরিবর্তন করে, যেমন গ্লাইকোলাইসিস এবং ফ্যাটি অ্যাসিড অক্সিডেশন যা কম শক্তি খরচ করে এবং শক্তির ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে। ফলশ্রুতিতে, উদ্দীপ্ত AMPK হেপাটোসাইট নিউক্লিয় ফ্যাক্টর ৪ (HNF4) এবং cAMP রেসপন্স-এলিমেন্ট বাইন্ডিং প্রোটিন (CREB)-নিয়ন্ত্রিত ট্রান্সক্রিপশন কোঅ্যাক্টিভেটর ২ (CRTC2)সহ ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরগুলিকে বাধা দিয়ে গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত জিন (যেমন PEPCK, G6Pase, FBPase) গুলোর প্রকাশকে অবদমিত করে, কমে আসে গ্লুকোজের উৎপাদন এবং পাশাপাশি AMPK কর্তৃক অ্যাসিটিল-CoA কার্বোক্সিলেজ (ACC 1/2)-এর ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে প্রতিহত করে লাইপোজেনেসিসের মতো প্রক্রিয়াও। যার ফলে যকৃতে ডায়াসিলগ্লিসারল উপাদান হ্রাস পায় এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত হয়।
বিকল্পভাবে, মাইটোকন্ড্রিয়ায় কমপ্লেক্স-I কে বাধা না দিয়ে এবং AMP/ATP অনুপাত পরিবর্তন না করেও মেটফরমিন AMPK কে সক্রিয় করতে সক্ষম। মেটফরমিন দ্বারা গ্লুকোজ হোমিওস্টেসিস নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য কৌশলও চিহ্নিত হয়েছে। এই প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে রয়েছে অ্যাডিনাইলেট সাইক্লেজ এনজাইমকে বাধা দিয়ে cAMP-এর উৎপাদন হ্রাস, এন্টারোসাইট কোষে গ্লুকাগন-সদৃশ পেপটাইড-১ (GLP-1) এর নিঃসরণ বৃদ্ধি, ডাইপেপটিডিল পেপটিডেজ-৪ (DPP-4) এনজাইমের কার্যকলাপ হ্রাস (যা GLP-1 কে নিষ্ক্রিয় করা থেকে বিরত থাকে) ইত্যাদি। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ইনক্রিটিন (incretins)-নামক হরমোন পরিবারে অন্তর্গত GLP-1 পেপ্টাইডের ভূমিকা অনন্য, যা অগ্নাশয়ের বিটা-কোষ থেকে ইন্সুলিনের নিঃসরণ বাড়ায় ও গ্লুকাগন নিঃসরণকে বাধা দেয়। ক্ষুদ্রান্ত্রের আস্তরণের কোষগুলি (যাকেএন্টারোএন্ডোক্রাইন ‘L-cells’ বলা হয়) হচ্ছে GLP-1 এর প্রধান উৎস, যদিও এটি অগ্ন্যাশয় এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে কম পরিমাণে নিঃসৃত হয়। এছাড়া, বর্ধিত এএমপি অ্যাডিনাইলেট সাইক্লেজ এনজাইমকে প্রতিহত করায় কোষে cAMP এর উপস্থিতিও কমে যায়, যার ফলে প্রতিহত হয় cAMP-PKA প্যাথওয়ে, বাধাগ্রস্থ হয় PKA-মধ্যস্থ CRTC2:CREB সক্রিয়করণ। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, CRTC2:CREB এই কমপ্লেক্স ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরযুগল গ্লুকোনিওজেনেসিস-সংশ্লিষ্ট তিনটি জিন (যেমন PEPCK, G6Pase, FBPase) প্রকাশের সাথে সরাসরি জড়িত।
মেটফর্মিনের থেরাপিউটিক প্রভাবের আরও একটি লক্ষ্যবস্তু হলো মাইটোকন্ড্রিয়স্থ গ্লিসেরোল-৩-ফসফেট ডিহাইড্রোজিনেজ (GPD2) এনজাইম (ছবি দেখুন)। লাইপোলাইসিস প্রক্রিয়ায় শ্বেত অ্যাডিপোজ টিস্যু তৈরি করে গ্লিসেরল এবং ননস্টেরিফাইড ফ্যাটি অ্যাসিড (NEFA), যা উভয়ই পৃথকভাবে যকৃতে গ্লুকোনিওজেনেসিসকে উদ্দীপিত করে। NEFA মাইটোকন্ড্রিয়ায় প্রবেশ ক’রে এসিটিল-CoA তৈরি করে। পাইরুভেট কার্বোক্সিলেজ দ্বারা পাইরুভেট থেকে অক্সালোঅ্যাসিটেটে রূপান্তরিত হয়ে তা সরাসরি গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে। অন্যদিকে, গ্লিসারল নিজেই একটি গ্লুকোনিওজেনিক সাবস্ট্রেট। গ্লিসেরল থেকে গ্লিসেরল-৩-ফসফেট এবং তা পরবর্তীতে GPD2 দ্বারা রূপান্তরিত হয় ডাইহাইড্রোক্সিঅ্যাসিটোন ফসফেটে (DHAP)। মেটফরমিন GPD2 দ্বারা এই অনুঘটন প্রতিক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ ক’রে কোষীয় NAD+/NADH অনুপাতকে হ্রাস করে, যার ফলে গ্লিসারল এবং ল্যাকটেট থেকে বিশেষত গ্লুকোনিওজেনেসিস বাধাপ্রাপ্ত হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মেটফরমিন মধ্যস্থতায় GPD2 এনজাইমের বাধাগ্রস্থতা কোষে NAD+ এর পরিমাণ হ্রাস নাকি বৃদ্বি করে, বা আদপে NAD+/NADH অনুপাতের পরিবর্তন হয় কি না, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
মাইটোকন্ড্রিয়া ছাড়াও মেটফরমিন-মধ্যস্থিত AMPK সক্রিয়করণের আরও একটি পথ চিহ্নিত হয়েছে। সেটি হলো লাইসোজোমীয় পথ। মেটফরমিন এই কাজটি করে গামা-সিক্রিটেজ (γ-secretase) এনজাইমের সাব-ইউনিট PEN২ (presenilin enhancer 2) প্রোটিনের সাথে আবদ্ধ হয়ে। মেটফরমিন-PEN২ একত্রে ATP6AP1-এর সাথে আবদ্ধ হয়ে লাইসোজোমীয় প্রোটন পাম্প v-ATPase-কে বাধা দেয় এবং AMPK কে সক্রিয় করে। দেখা গিয়েছে, উদ্দীপ্ত AMPK প্রোটিন সংশ্লেষণের প্রধান নিয়ামক mTORC1 কমপ্লেক্সকেও বাধা দেয়। mTOR এর প্রধান টার্গেট হল রাইবোজোমীয় প্রোটিন S6 kinase যা প্রোটিন সংশ্লেষণর একটি গুরুত্বপূর্ণ এনজাইম।
মেটফরমিন ও ইনসুলিন সংবেদনশীলতা
যকৃতে গ্লুকোনিওজেনেসিস বা গ্লুকোজ উৎপাদন কমানোর পাশাপাশি, মেটফরমিন ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়ায়, দেহের অন্যান্য টিস্যু বিশেষকরে অস্থিপেশিতে গ্লুট-৪ ট্রান্সপোর্টারের মাধ্যমে গ্লুকোজ গ্রহণ বাড়ায় এবং ফ্যাটি অ্যাসিডের জারণ বৃদ্ধি করে। দেহে মোট গ্লুকোজ উপস্থিতির প্রায় ৮০% গ্লুকোজ গ্রহণ করে অস্থিপেশির কোষগুলো। তবে গ্লুট-৪ প্রোটিনের প্রকাশ কমে যাওয়া বা সাইটোসল থেকে কোষঝিল্লিতে গ্লুট-৪ এর স্থানান্তরে ত্রুটি ইনসুলিন প্রতিবন্ধকতার বড়ো একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত । মানবকোষে SLC2A4 জিন দ্বারা সংকেতপ্রাপ্ত গ্লুট-৪ প্রধানত প্রকাশ পায় অস্থি পেশি ও অ্যাডিপোজ টিস্যুতে, কিন্তু স্বল্প সংখ্যক গ্লুট-৪ দেখা যায় মস্তিষ্ক, বৃক্ক, অন্ত্র ও যকৃতে। কোষাভ্যন্তরে গ্লুকোজ প্রবেশ করে ঝিল্লিবন্ধ গ্লুট-৪ ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের সহযোগিতায়। দেখা গিয়েছে, হাইপারগ্লাইসেমিক অবস্থায় অস্থি পেশিতে গ্লুট-৪ প্রোটিনের প্রকাশ কমে গেছে প্রায় ৭০%। জিনগত ত্রুটি ছাড়াও, অতিমাত্রায় চর্বি-ও চিনি-সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, স্থূলতা, ভিটামিন ডি এর ঘাটতি, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং কিছু ওষুধ (যেমন কর্টিকোস্টেরয়েড) ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সেরও কারণ হতে পারে। পরীক্ষামূলক গবেষণায় দেখা গেছে যে ইনসুলিন সংবেদনশীলতায় মেটফরমিন-মধ্যস্থিত উন্নতি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত, যার মধ্যে ইনসুলিন রিসেপ্টর (Ins-R)-র কার্যকলাপ বৃদ্ধি, গ্লাইকোজেন সংশ্লেষণ বৃদ্ধি ও গ্লুট-৪ এর প্রকাশ এবং তার কার্যকলাপ বৃদ্ধি। এছাড়াও, মেটফরমিন-মধ্যস্থতায় AMPK সক্রিয়করণে গ্লুকাগন-সদৃশ-পেপটাইড-1 (GLP-1) নিঃসরণ অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন ক্ষরণকে বৃদ্ধি করে, গ্লুট-৪ স্থানান্তর (সাইটোসল থেকে কোষঝিল্লিতে)কে বৃদ্ধি করে, ও প্লাজমা গ্লুকোজের মাত্রা কমায়। অধিকন্তু,, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটা ঘনত্বের পরিবর্তনও হতে পারে মেটফরমিনের অতিরিক্ত লক্ষ্যবস্তু ।
ইনসুলিনের ক্ষরণবৃদ্ধি ও ইনসুলিন রিসেপ্টর (Ins-R) এর সক্রিয়তার মাধ্যমে মেটফরমিন ইন্সুলিন সংকেতসংবহন পথকে সমুন্নত রাখে, যাতে ক’রে গ্লুকোজ কোষাভ্যন্তরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে। ইনসুলিনের কাজ হচ্ছে গ্লুকোজকে কীভাবে সুচারুরূপে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানো যায় তা নিশ্চিৎ করা। ইনসুলিন এই কাজটি করে তার স্বকীয় রিসেপ্টর (Ins-R) ও কোষের কতিপয় অনুঘটককে সক্রিয় করার মাধ্যমে, এবং সে কাজটি করতেও তার একটি নির্দিষ্ট সংকেতপ্রবাহের পথ অনুসরণ করতে হয় (ছবি দেখুন)। ইনসুলিন গ্রোথ ফ্যাক্টর, IGF-1, হরমোনের সংকেতপ্রবাহের পথও একই। Ins-R হলো এক ধরনের টাইরোসিন কাইনেজ (tyrosine kinase) রিসেপ্টর। Ins-R-এর সাথে ইনসুলিনের বাঁধন ইনসুলিন রিসেপ্টরের অটোফসফোরিলেশন (autophosphorylation) বিশেষত্বকে সজাগ করে তোলে। ফলে, ইনসুলিন রিসেপ্টর তার সক্রিয়তা ফিরে পায় ও তাৎক্ষণিক ‘ইনসুলিন রিসেপ্টর সাবস্ট্রেট (IRS-1, IRS-2)’কে ফসফোরিলেশনের মাধ্যমে জাগিয়ে তোলে। সক্রিয় IRS-1 পরবর্তীতে ফসফোইনোসিটাইড ৩-কাইনেজ (PI3K)-এর সাথে আবদ্ধ হয়ে সেটিকেও সক্রিয় করে, যা PIP2 (ফসফ্যাটিডিলিনোসিটল ৪,৫-বিসফসফেট) অণুকে PIP3 (ফসফ্যাটিডিলিনোসিটল ৩,৪,৫-ট্রিসফসফেট) অণুতে রূপান্তরিত করে। PIP3 একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেতবাহী অণু, যা পালাক্রমে আরও কয়েকটি কাইনেজ, বিশেষ করে PDPK (ফসফাইনোসিটাইড-ডিপেন্ডেন্ট কাইনেজ)-1 ও প্রোটিন কাইনেজ বি (protein kinase B, PKB)- এনজাইমকে উজ্জীবিত করে। PDPK-1 হলো একটি মাস্টার কাইনেজ, যা PKB সক্রিয়করণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গতঃ PKB এনজাইম Akt1/2 (সেরিন/থ্রিওনিন কাইনেজ) এনজাইম নামেও অভিহিত। কোষাভ্যন্তরে গ্লুকোজের আগমনকে সহজতর করার জন্য ‘প্রোটিন কাইনেজ বি’ ভেসিকল ও SNARE প্রোটিনের সহযোগিতায় গ্লুকোজ ট্রান্সপোর্টার (GLUT4)কে সাইটোপ্লাজম থেকে স্থানান্তরিত করে কোষঝিল্লিতে এবং সেখানে তার একটি নির্দিষ্টি অবস্থান তৈরি করে দেয়। আগেই উল্লেখ করেছি, ইন্সুলিনের ক্ষরণ কমে যাওয়া অথবা ইন্সুলিন রিসেপ্টরের কার্যক্ষমতা লাঘব হলে গ্লুকোজ তার গন্তব্যে অর্থাৎ কোষাভ্যন্তরে পৌঁছয় না। ফলে, রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায় এবং ডায়াবেটিস বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া-সহ উচ্চ রক্তচাপের সৃষ্টি হয়।
IRS-PI3K-Akt সংকেতসংবহন পথকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স (IR) বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, ডায়াবিটিস রোগীদের বিভিন্ন টিস্যুতে PI3K, Akt এবং GLUT4-এর প্রকাশ কমেছে, যা মেটফরমিন প্রয়োগে এই প্রোটিনগুলোর প্ৰাপ্যতা পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। মানব হেপাটোসাইট ও Huh7 কোষ কালচারে দেখা গিয়েছে মেটফরমিন (১ মাইক্রোগ্রাম/মি.লি.) ৩০ মিনিটের মধ্যে Ins-R টাইরোসিন ফসফোরিলেশন ৭৮% বাড়িয়েছে, সাথে IRS-2 এর উদ্দীপনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, ইনসুলিন-উদ্দীপ্ত গ্রানুলোসা-লিউটাল কোষে মেটফরমিন IRS-1 এর এমআরএনএ ও প্রোটিন সংশ্লেষণ উভয় স্তরের প্রকাশকে বৃদ্ধি করে, PI3K এর মাধ্যমে Akt এনজাইমকে সক্রিয় করে এবং সাইটোসল থেকে কোষঝিল্লিতে GLUT-4 এর ভেসিকল (vesicle)-মধ্যস্থ স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করে। অধিকন্তু, মেটফরমিন ইনোসিটোল ৫-ফসফাটেজ (SHIP2)-এর কার্যকলাপকে বাধা দিয়ে কোষে গ্লুকোজ গ্রহণ বাড়ায়। SHIP2 সাধারণত PI3K-মধ্যস্থতাকারী ইনসুলিন সংকেতকে দমন করে। এছাড়া, মেটফরমিন-উদ্দীপ্ত AMPK এর সক্রিয়করণ ও তার কার্যকলাপ বৃদ্ধিতে GLUT4 ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের (প্লাজমা ঝিল্লিতে) দ্রুত স্থানান্তরের মাধ্যমে কোষে গ্লুকোজ গ্রহণও বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
একটি অলৌকিক ওষুধ হচ্ছে মেটফরমিন! মেটফরমিনের অসামান্য ও নানান আণবিক কৌশল ডায়াবিটিস রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখে, সাথে দেহের প্রান্তস্থ টিস্যুগুলোতে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায়। এই কৌশলগুলির কেন্দ্রে রয়েছে এমপিকে (AMPK) এনজাইমের সক্রিয়করণ ও গ্লুকোনিওজেনেসিস প্রক্রিয়াকে বাধা দিয়ে যকৃত কোষে গ্লুকোজের উৎপাদন কমানো। এছাড়া, GLP-১ নিঃসরণের বৃদ্ধি, অন্ত্রে মাইক্রোবায়োমের পরিবর্তন ইত্যাদি প্রক্রিয়াতে মেটফরমিনের অসাধারণ কার্যদক্ষতা রক্তে গ্লুকোজের ভারসাম্যতা বজায় রাখে। কয়েক দশক গবেষণার পরেও আণবিক পর্যায়ে মেটফরমিনের কার্যপ্রনালী নিয়ে জানার কৌতূহল এখনও শেষ হয়নি। প্রয়োজন আরও গবেষণার। চিকিৎসা ক্ষেত্রে মেটফরমিনের ব্যবহার ব্যাপক। গ্লুকোজ হোমিওস্ট্যাসিস উন্নতির পাশাপাশি, মেটফরমিন সম্ভবত বিভিন্ন ক্যান্সার বিকাশের ঝুঁকি কমাতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মেটফরমিন প্যানক্রিয়াটিক ক্যানসার ও টিউমার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া, স্নায়ু অবক্ষয়জনিত রোগ, স্থূলতা, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম ইত্যাদি রোগেও মেটফরমিনের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। অধিকন্তু, রক্তের লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (LDL) এবং ট্রাইগ্লিসেরাইডের মাত্রা কমিয়ে মেটফরমিন হৃদরোগের ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমিয়েছে। বলা যেতেই পারে এসব হল মেটফরমিনের উপকারী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া! শরীরের জন্য মেটফরমিন নিরাপদ হওয়া সত্ত্বেও এই ড্রাগটির অপব্যবহার বা উচ্চ মাত্রায় ব্যবহার ডায়ারিয়াসহ ল্যাকটিক এসিডোসিসের মত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে- তাই, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই মেটফরমিন সেবন করা উচিৎ।
প্রফেসর ড. রাশিদুল হক, সাবেক উপ-উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, এবং সাবেক অধ্যাপক, এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়, আটলান্টা, যুক্তরাষ্ট্র, ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ। ড. সুলতানা রাজিয়া, সহকারী অধ্যাপক, সেন্টার ফর ইন্টারডিসিপ্লিনারি রিসার্চ (CIR), বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী, বাংলাদেশ।