জীবনী: সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী
- প্রকাশ: ০৩:২২:৪২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২২
- / ১৪৯৪ বার পড়া হয়েছে
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ছিলেন একজন বাঙালি লেখক ও কবি। তিনি উনিশ ও বিশ শতকে বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রবক্তাদের একজন। সিরাজী মুসলিমদের জন্যে বিজ্ঞানসাধনা, মাতৃভাষাচর্চা, নারীদের শিক্ষা এসবের পক্ষে লেখালেখি করেন।
কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজী তাঁর অনল-প্রবাহ কাব্যগ্রন্থটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং স্বাধীনতার জন্য লিখে উপমহাদেশের প্রথম কবি হিসেবে কারাবন্দী হন।
এখানে যা আছে…
প্রারম্ভিক জীবনে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ১৩ই জুলাই, ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্মস্থানের সম্মানে নামের শেষের ‘সিরাজী’ পদবী যুক্ত করেন।
শৈশবে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী স্থানীয় পাঠশালা ও জ্ঞানদায়িনী মাইনর ইংরেজি স্কুলে পড়েন। এরপর সিরাজগঞ্জ বনোয়ারীলাল হাই স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সিরাজী পাঠশালায় ফার্সি এবং বাড়িতে সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন আর সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যের সাথে হিন্দুশাস্ত্র, যেমন: বেদ, মনুস্মৃতি ও উপনিষদ প্রভৃতি অধ্যয়ন করেছিলেন।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর কর্মজীবন, সাহিত্যে প্রবেশ, কারাদণ্ড এবং অন্যান্য
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বক্তা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তৎকালীন বাঙালি মুসলিমদের পুনর্জাগরণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি বক্তৃতা করতেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমিতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন, যেমন: কংগ্রেস, পরবর্তীতে মুসলিম লীগ, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, স্বরাজ পার্টি, কৃষক সমিতি ইত্যাদি।
ছাত্রাবস্থায়ই সিরাজী কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং ধর্মবক্তা মুনশী মেহের উল্লাহের এক জনসভায় তার অনল-প্রবাহ কবিতাটি পাঠ করেন। মুনশী মেহেরউল্লাহ কবিতা শুনে মুগ্ধ হন এবং নিজ ব্যয়ে ১৯০০ সালে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন।
১৯০৮ সালের শেষদিকে অনল-প্রবাহ বইটির বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় যা তৎকালীন বাংলা সরকার বাজেয়াপ্ত করে আর তার প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সিরাজী তখন ফরাসী-অধিকৃত চন্দননগরে গিয়ে ৮ মাস আত্মগোপন করে থাকেন। পরে আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগে তাকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধের সময় ভারতে ডা. মোখতার আহমদ আনসারীর নেতৃত্বে ‘ইন্ডিয়ান রেড ক্রিসেন্ট’ গঠিত হয়। এই সংগঠন একদল চিকিৎসকসহ ‘অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল মিশন’ প্রেরণ করে। ইসমাইল হোসেন সিরাজী মিশনের বঙ্গীয় প্রতিনিধি হিসেবে তুরস্কে যান। তিনি তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০) গ্রন্থে এই সফরের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন।
১৯১৯ সালে সিরাজী মাসিক নূর নামে একটি পত্রিকা বের করেন। তার নিজের মহাশিক্ষা-কাব্য এবং নজরুলের কয়েকটি গল্প এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে সিরাজী ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ছোলতান। সিরাজীর অধিকাংশ প্রবন্ধই এই পত্রিকায় মুদ্রিত হয়।
প্রাথমিকভাবে সিরাজী সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানির প্যান ইসলামিজম সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন। তবে সিরাজীকে মুসলিম পুনর্জাগরণের চিন্তায় বেশি প্রভাবিত করেন প্রায় সমসাময়িক শিবলী নোমানী এবং আল্লামা ইকবাল।
ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সাহিত্যকর্ম
ইসমাইল হোসেন সিরাজী আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম দিকের মুসলমান লেখকদের অন্যতম। তার রাজনৈতিক আদর্শ সাহিত্যকর্মেও দৃশ্যমান। তার রচনাসমূহকে ইসলামি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তবে কবি আবদুল কাদির মন্তব্য করেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের বৈশিষ্ট্যসূচক “উগ্র জাতীয়তাবাদ” মুসলমানদের মধ্যে সিরাজীর রচনাতে প্রথম দেখা যায়। উল্লেখ্য, সিরাজী বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর প্রতিক্রিয়ায় তার রায়নন্দিনী লেখেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলির প্রতিযোগী হিসেবে লেখেন প্রেমাঞ্জলি। তথাপি সময়োপযোগী হওয়ায় তখন তার উপন্যাস ও কবিতা পঠিত ও জনপ্রিয় হয়।
কাব্যগ্রন্থ
- অনল-প্রবাহ (১৯০০)
- আকাঙ্ক্ষা(১৯০৬)
- উচ্ছ্বাস (১৯০৭)
- উদ্বোধন (১৯০৭)
- নব উদ্দীপনা (১৯০৭)
- স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪)
- মহাশিক্ষা-কাব্য (১ম খণ্ড-১৯৬৯, ২য় খণ্ড-১৯৭১)
উপন্যাস
- রায়নন্দিনী (১৯১৫)
- তারাবাঈ (১৯১৬)
- ফিরোজা বেগম (১৯১৮)
- নূরউদ্দীন (১৯১৯)
- জাহানারা (১৯৩১)
- বঙ্গ ও বিহার বিজয় (১৮৯৯, অসমাপ্ত)
- বঙ্কিম দুহিতা
সঙ্গীত গ্রন্থ
- সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬)
- প্রেমাঞ্জলি (১৯১৬)
প্রবন্ধ
- স্ত্রীশিক্ষা
- স্বজাতি প্রেম (১৯০৯)
- আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪)
- স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা (১৯১৬)
- সুচিন্তা (১৯১৬)
- মহানগরী কর্ডোভা
- আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা
- তুর্কী নারী জীবন (১৯১৩)
ভ্রমণ কাহিনী
- তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০)
মৃত্যু
১৯৭২ সালের ১৭ জুলাই জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীমৃত্যুবরণ করেন।