০৩:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

ভোক্তাশ্রেণি মূল্যস্ফীতির ভয়ে থাকলে কোনো শাসনব্যবস্থাই সুস্থির থাকতে পারে না

ড. মো. আইনুল ইসলাম
  • প্রকাশ: ১১:৩৬:২৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২২
  • / ৬২৪ বার পড়া হয়েছে

ভোক্তাশ্রেণি মূল্যস্ফীতির ভয়ে থাকলে কোনো শাসনব্যবস্থাই সুস্থির থাকতে পারে না


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

আমার এক পরিচিত ব্যক্তি দিন কয়েক আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘স্যার, সেদিন বাসায় ফিরতেই গিন্নি বলল, ফ্রেশ হওয়ার আগে স্টোররুম থেকে চালের ড্রাম দুটি নামিয়ে দাও। জিজ্ঞেস করতেই জানাল, ঐ বাসার ভাবির হাজবেন্ড সরকারের বিদ্যুত্ অফিসে চাকরি করেন, গিয়ে দেখি পাঁচ বস্তা চাল বারান্দায় ফেলে রেখেছে। ওভাবে খোলা পড়ে থাকলে চালগুলো নষ্ট হবে, তাই ড্রামগুলো দিচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম, এত চাল কেন, ওদের তো ছোট তিনটি সন্তান। গিন্নি জানাল, সবাই বলাবলি করছে, সামনে চালের দাম আরো অনেক বাড়বে। প্রধানমন্ত্রীও নাকি বলছেন সঞ্চয় করতে। তাই।’ মানুষের বেড়ে যাওয়া এ ধরনের সঞ্চয়প্রবণতা নিয়ে আরো কয়েক জন প্রায় একই রকম কথা বললেন। তীব্র মূল্যস্ফীতির মধ্যে মানুষের টাকাকড়ি আটকে রাখার প্রাণান্তকর এই চেষ্টায় বোঝা যাচ্ছে, তারা ভোগব্যয় কমিয়ে সঞ্চয়ে জোর দিচ্ছেন। এখন এক টাকাও কেউ বাড়তি খরচ করেন না, খুব হিসাব-নিকাশ করে চলছেন। অবশ্য যাদের সীমিত উপার্জন বা নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা, মূল্যস্ফীতির এই বাজরে তাদের সঞ্চয়ের প্রশ্নই আসে না।

অর্থনীতির মানুষ হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি, অর্থনীতিতে মন্দা আসার আগে আমাদের দেশে নিম্নবিত্ত মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, বিশেষ করে চাল-ডাল-পেঁয়াজ কিনে রাখেন, মধ্যবিত্তরা কেনেন সোনাদানা, আর উচ্চবিত্তরা বাড়ি-গাড়ি-জমি কিংবা বিদেশবিভুঁইয়ে টাকা সরিয়ে রাখেন। দেশি-বিদেশি সাম্প্রতিক সব পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে এসবের সত্যতা মেলে। অর্থাত্, যে যেভাবে পারছে সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করছে। এখন কী করলে সঞ্চয় করতে পারবে, কোথায় সঞ্চয় করবে, সঞ্চয় কেন করবে—এমন সব খবর সাধারণ মানুষকে বেশি আকর্ষণ করছে। তবে মানুষের এই সঞ্চয় প্রথাগত ব্যাংকিংব্যবস্থায় যে হচ্ছে না, তা চাল-ডাল-সোনাদানা আর বাড়ি-গাড়ি কেনার চিত্র থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এখন প্রতিদিন সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে—এই ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে এত টাকা নিয়েছে, ঐ ব্যাংক অত টাকা নিয়েছে, ব্যাংকগুলোর চাহিদা বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নগদ টাকার সরবরাহ বাড়িয়েছে। কারণ মানুষ হাতে টাকা আটকে রাখছে, ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা টাকা তোলার তুলনায় জমা করছেন কম। ফলে ব্যাংকগুলো নগদ টাকার অভাবে পড়েছে। করোনার পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে মানুষের অর্থ-সম্পদ সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষার এই তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় একটি বিষয় অন্তত পরিষ্কার—অর্থনীতিতে মন্দা আসছে।

অর্থনীতিতে সাধারণত অতিরিক্ত চাহিদা ও সঞ্চয়ের চেয়ে বিনিয়োগ বেশি হলে মূল্যস্ফীতি, অর্থাত্ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী চলমান তীব্র মূল্যস্ফীতি ঠিক চাহিদা ও বিনিয়োগসৃষ্ট নয়, মূলত মুক্তবাজারের আর্থিকীকরণকৃত খেলা ও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসৃষ্ট। করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে ঠিকই। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আসলে পুরো প্রেক্ষাপটই পালটে দিয়েছে। করোনায় বিপর্যস্ত বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিশ্বমোড়লদের ক্ষমতার লড়াইয়ে বলা যায়, একেবারে ভেঙেই গেছে। পরিবহনব্যবস্থার সমস্যা, ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা, জ্বালানিসহ দৈনন্দিন সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতিকে আরো বিষিয়ে তুলছে। এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে যদি যুক্ত হয় সবকিছু আর্থিকীকরণের প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের কারসাজি, তাহলে অর্থনীতির স্বাভাবিক ছন্দ টিকিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন। নিজের দেশে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় একদিকে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার মুখে সারা দুনিয়া থেকে, বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতিগুলো থেকে পুঁজি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে।

মন্দার দিকে ধাবিত হওয়া অর্থনীতিতে যদি অনুত্পাদনশীল খাতে সঞ্চয় বিনিয়োজিত হয়, তাহলে দেশজ উত্পাদন বাড়ে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটে না। মূল্যস্ফীতির এই অর্থনীতি উলটোমুখী হয়ে মূল্য সংকোচনের কবলে পড়লে অর্থনীতি ব্যবস্থাটাই ভেঙে গিয়ে মহাবিপজ্জনক পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে, যা অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ‘প্যারাডক্স অব থ্রেফট’ শিরোনামে তত্ত্ব উপস্থাপন করে ১৯৩০ সালে প্রমাণ করে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, মিতব্যয়ী হওয়ার কঠিন এক জটিলতায় ধনিক শ্রেণি ইন্ধন জোগালে যেকোনো দেশের রাজনীতি বিষাক্ত হয়ে যায়। কারণ, অর্থনীতি সংকুচিত হওয়াকালে অত্যধিক মূল্যহ্রাস ওপর থেকে ভালো মনে হলেও মূল্যহ্রাসের চক্রে শ্রমজীবী মানুষের মজুরি ক্রমাগত কমতে থাকে। এ সময় ব্যবসায়ীরা মুনাফা কমান, শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেন, যা আরো বেকারত্ব বাড়ায়। স্থবির বিনিয়োগ, শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়া এবং কর্মসংস্থানের অভাবে কমে যাওয়া আয়ের কারণে সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তা সামাল দেওয়া মহাশক্তিশালী শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেও দুঃসাধ্য। ১৯২৯-৩০-এর মহামন্দার সময় মূল্য সংকোচনের চক্রকে কাজে লাগিয়ে চরম স্বার্থপর ধনিক শ্রেণির সহায়তা নিয়ে জার্মানির ক্ষমতায় বসেছিলেন ফ্যাসিবাদী হিটলার।

আমাদের জাতীয় সঞ্চয় হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল জিডিপির ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাত্, সঞ্চয়ের হার ছিল মোট বিনিয়োগ হারের (জিডিপির ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ) তুলনায় কম। সে সময় জিডিপির প্রায় ৬৯ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ভোগ থেকে আসায় বাহ্যিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি একরকম সুরক্ষিত-সুস্থির ছিল। কিন্তু চলতি মাসের হিসাব অনুযায়ী, এখন মানুষের সঞ্চয়ের হার মোট জাতীয় আয়ের ৩৪ শতাংশ, যেখানে বৈশ্বিক হার ২৭ শতাংশ। এখানে তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের এই সঞ্চয় ব্যাংকে যাচ্ছে না কিংবা উত্পাদনশীল খাতেও বিনিয়োগ হচ্ছে না, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আগে বাজারে প্রচলনে থাকা ফিজিক্যাল মুদ্রা বা নগদ আকারে ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা, যা গত অক্টোবর শেষে এসে হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। ৪০ দিনের এক হিসাবে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। মানুষের হাতে টাকা পুঞ্জীভূত হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ টাকার চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। নগদ অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে এখন মোট আমানত রয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফিজিক্যাল ফরম তথা ছাপানো নগদ টাকার পরিমাণ ৩ লাখ ১৭ হাজার কোটি। প্রচলনে থাকা কাগজি নোটের বাইরে একটি বড় অংশ অপ্রচলনযোগ্য রূপে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের চেস্টসহ বিভিন্ন ব্যাংক শাখায় জমা রয়েছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে কোরবানি ঈদের আগে ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা প্রচলনে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ঈদের পর প্রচুর টাকা জমার ফলে ঐ মাস শেষেই তা ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। পরে প্রতি মাসে কমতে কমতে গত অক্টোবরে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত রিজার্ভ তথা নগদ অর্থ ছিল ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা গত জুনে ২৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছিল। আর গত বছরের জুন শেষে ছিল ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

বিপুল ভোক্তাশ্রেণি, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য মানসিকতা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অগ্রগতি, বেসরকারি খাতের দ্রুত বিকাশের সুযোগে অর্থনৈতিক সফলতার যে চিত্র এত দিন প্রকাশ পাচ্ছিল, তাতে কোথাও কোথাও বড় ধরনের ফাঁকফোঁকর দেখা যাচ্ছে, যেখানে তুষের আগুন দিয়ে ইন্ধন জোগাচ্ছে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বিশ্বপ্রেক্ষাপট এবং ধনি রাষ্ট্র-শ্রেণির চরম মুনাফাকামী খেলা।

একদিকে সরকার অর্থনীতি গতিশীল রাখতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিচ্ছে; অন্যদিকে দুর্নীতি, কালোটাকা, বিদেশে অর্থ পাচার আর ব্যাংকিং খাতের নতুন নতুন সংকটের খবর প্রকাশ পাচ্ছে। এর সঙ্গে আবার ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার চিরাচরিত খেলা। এ তো জানা কথা, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনীতি মন্দায় পড়লে অভেদ্য এক চক্রের সৃষ্টি হয়, যেখানে ধনিক শ্রেণি কম মুনাফার কথা বলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে হাত গোটানোর ভান শুরু করে। সরকার তখন তাদের সচল রাখতে বাড়তি ঋণ দেয়। ধনিক শ্রেণি ঐ অর্থ দিয়ে মানুষের হাতে অর্থ না থাকার সুযোগ নিয়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কিনে অনুত্পাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে। ধনিক শ্রেণি ঋণের অর্থ ফেরত না দিয়ে অনুত্পাদনশীল খাতে ব্যবহার করায় অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বলতর হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে সরকার ধনিক শ্রেণিকে আবারও ঋণ দেয়। ধনিক শ্রেণি আবারও ঐ একই কাজ করে

মোদ্দা কথা, সমস্ত অর্থ নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির কাছে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সরকার যখন ক্ষমতা ধরে রাখতে ধনিক শ্রেণিকে মরিয়া চাপ দেয়, ধনিক শ্রেণি তখন শাসনক্ষমতাই উলটে দিয়ে নতুন শাসকদের ক্ষমতায় বসায়। এভাবেই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা এক চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের কারণে মানুষের আশাবাদ এখন অত্যন্ত নিম্নমুখী। উপার্জন কমে যাওয়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিজনিত ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ কংকালসার হচ্ছে আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি হচ্ছে দুর্বলতর। এমন এক প্রেক্ষাপটে অনুত্পাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োজিত হওয়া এবং দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সামনের দিনগুলোয় মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করবে। পরিশেষে বলা যায়, বিগত বছরগুলোয় মানুষের জীবনমানের যে উন্নতি হয়েছিল, এখন দ্রুত তা ক্ষয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বিশ্বের গড় হারের চেয়ে বেশি। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের হাতে টাকা আটকে রেখে অনুত্পাদনশীল খাতে ব্যবহারের বাড়তি প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে আরো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, যা আমাদের অর্থনীতির বিকাশকে চরম বাধাগ্রস্ত করবে। অথচ অর্থনীতি স্বাভাবিক ছন্দে থাকলে আগামী ২০৩০ সালে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে টপকে বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণির বিশ্বের নবম বৃহত্তম হওয়ার কথা।

ভোক্তাশ্রেণির সংখ্যা বড়ো হলে অর্থনীতিও বড় হয় এবং মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়। ধনিক শ্রেণির গুটি কয়েক চরম মুনাফালোভীর লালসায় বিকাশমান বিশাল এক ভোক্তাশ্রেণি মূল্যস্ফীতি ও মূল্যহ্রাসের ভয়ে আবদ্ধ থাকলে কোনো শাসনব্যবস্থা বা শ্রেণিব্যবস্থাই সুস্থির থাকতে পারে না, সে কথা সবাইকে স্মরণে রাখতে হবে।

লেখক :অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়;

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

ড. মো. আইনুল ইসলাম

ড. মো. আইনুল ইসলাম, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

ভোক্তাশ্রেণি মূল্যস্ফীতির ভয়ে থাকলে কোনো শাসনব্যবস্থাই সুস্থির থাকতে পারে না

প্রকাশ: ১১:৩৬:২৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২২

আমার এক পরিচিত ব্যক্তি দিন কয়েক আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘স্যার, সেদিন বাসায় ফিরতেই গিন্নি বলল, ফ্রেশ হওয়ার আগে স্টোররুম থেকে চালের ড্রাম দুটি নামিয়ে দাও। জিজ্ঞেস করতেই জানাল, ঐ বাসার ভাবির হাজবেন্ড সরকারের বিদ্যুত্ অফিসে চাকরি করেন, গিয়ে দেখি পাঁচ বস্তা চাল বারান্দায় ফেলে রেখেছে। ওভাবে খোলা পড়ে থাকলে চালগুলো নষ্ট হবে, তাই ড্রামগুলো দিচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম, এত চাল কেন, ওদের তো ছোট তিনটি সন্তান। গিন্নি জানাল, সবাই বলাবলি করছে, সামনে চালের দাম আরো অনেক বাড়বে। প্রধানমন্ত্রীও নাকি বলছেন সঞ্চয় করতে। তাই।’ মানুষের বেড়ে যাওয়া এ ধরনের সঞ্চয়প্রবণতা নিয়ে আরো কয়েক জন প্রায় একই রকম কথা বললেন। তীব্র মূল্যস্ফীতির মধ্যে মানুষের টাকাকড়ি আটকে রাখার প্রাণান্তকর এই চেষ্টায় বোঝা যাচ্ছে, তারা ভোগব্যয় কমিয়ে সঞ্চয়ে জোর দিচ্ছেন। এখন এক টাকাও কেউ বাড়তি খরচ করেন না, খুব হিসাব-নিকাশ করে চলছেন। অবশ্য যাদের সীমিত উপার্জন বা নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা, মূল্যস্ফীতির এই বাজরে তাদের সঞ্চয়ের প্রশ্নই আসে না।

অর্থনীতির মানুষ হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি, অর্থনীতিতে মন্দা আসার আগে আমাদের দেশে নিম্নবিত্ত মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, বিশেষ করে চাল-ডাল-পেঁয়াজ কিনে রাখেন, মধ্যবিত্তরা কেনেন সোনাদানা, আর উচ্চবিত্তরা বাড়ি-গাড়ি-জমি কিংবা বিদেশবিভুঁইয়ে টাকা সরিয়ে রাখেন। দেশি-বিদেশি সাম্প্রতিক সব পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে এসবের সত্যতা মেলে। অর্থাত্, যে যেভাবে পারছে সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করছে। এখন কী করলে সঞ্চয় করতে পারবে, কোথায় সঞ্চয় করবে, সঞ্চয় কেন করবে—এমন সব খবর সাধারণ মানুষকে বেশি আকর্ষণ করছে। তবে মানুষের এই সঞ্চয় প্রথাগত ব্যাংকিংব্যবস্থায় যে হচ্ছে না, তা চাল-ডাল-সোনাদানা আর বাড়ি-গাড়ি কেনার চিত্র থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এখন প্রতিদিন সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে—এই ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে এত টাকা নিয়েছে, ঐ ব্যাংক অত টাকা নিয়েছে, ব্যাংকগুলোর চাহিদা বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও নগদ টাকার সরবরাহ বাড়িয়েছে। কারণ মানুষ হাতে টাকা আটকে রাখছে, ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা টাকা তোলার তুলনায় জমা করছেন কম। ফলে ব্যাংকগুলো নগদ টাকার অভাবে পড়েছে। করোনার পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে মানুষের অর্থ-সম্পদ সঞ্চয়ের আকাঙ্ক্ষার এই তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় একটি বিষয় অন্তত পরিষ্কার—অর্থনীতিতে মন্দা আসছে।

অর্থনীতিতে সাধারণত অতিরিক্ত চাহিদা ও সঞ্চয়ের চেয়ে বিনিয়োগ বেশি হলে মূল্যস্ফীতি, অর্থাত্ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী চলমান তীব্র মূল্যস্ফীতি ঠিক চাহিদা ও বিনিয়োগসৃষ্ট নয়, মূলত মুক্তবাজারের আর্থিকীকরণকৃত খেলা ও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসৃষ্ট। করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মকাণ্ডে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে ঠিকই। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আসলে পুরো প্রেক্ষাপটই পালটে দিয়েছে। করোনায় বিপর্যস্ত বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিশ্বমোড়লদের ক্ষমতার লড়াইয়ে বলা যায়, একেবারে ভেঙেই গেছে। পরিবহনব্যবস্থার সমস্যা, ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা, জ্বালানিসহ দৈনন্দিন সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতিকে আরো বিষিয়ে তুলছে। এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে যদি যুক্ত হয় সবকিছু আর্থিকীকরণের প্রবক্তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের কারসাজি, তাহলে অর্থনীতির স্বাভাবিক ছন্দ টিকিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন। নিজের দেশে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় একদিকে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার মুখে সারা দুনিয়া থেকে, বিশেষ করে উদীয়মান অর্থনীতিগুলো থেকে পুঁজি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছে।

মন্দার দিকে ধাবিত হওয়া অর্থনীতিতে যদি অনুত্পাদনশীল খাতে সঞ্চয় বিনিয়োজিত হয়, তাহলে দেশজ উত্পাদন বাড়ে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটে না। মূল্যস্ফীতির এই অর্থনীতি উলটোমুখী হয়ে মূল্য সংকোচনের কবলে পড়লে অর্থনীতি ব্যবস্থাটাই ভেঙে গিয়ে মহাবিপজ্জনক পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে, যা অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড কেইনস ‘প্যারাডক্স অব থ্রেফট’ শিরোনামে তত্ত্ব উপস্থাপন করে ১৯৩০ সালে প্রমাণ করে দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, মিতব্যয়ী হওয়ার কঠিন এক জটিলতায় ধনিক শ্রেণি ইন্ধন জোগালে যেকোনো দেশের রাজনীতি বিষাক্ত হয়ে যায়। কারণ, অর্থনীতি সংকুচিত হওয়াকালে অত্যধিক মূল্যহ্রাস ওপর থেকে ভালো মনে হলেও মূল্যহ্রাসের চক্রে শ্রমজীবী মানুষের মজুরি ক্রমাগত কমতে থাকে। এ সময় ব্যবসায়ীরা মুনাফা কমান, শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেন, যা আরো বেকারত্ব বাড়ায়। স্থবির বিনিয়োগ, শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়া এবং কর্মসংস্থানের অভাবে কমে যাওয়া আয়ের কারণে সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি হয়, তা সামাল দেওয়া মহাশক্তিশালী শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেও দুঃসাধ্য। ১৯২৯-৩০-এর মহামন্দার সময় মূল্য সংকোচনের চক্রকে কাজে লাগিয়ে চরম স্বার্থপর ধনিক শ্রেণির সহায়তা নিয়ে জার্মানির ক্ষমতায় বসেছিলেন ফ্যাসিবাদী হিটলার।

আমাদের জাতীয় সঞ্চয় হার ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল জিডিপির ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। অর্থাত্, সঞ্চয়ের হার ছিল মোট বিনিয়োগ হারের (জিডিপির ৩১ দশমিক ৫৬ শতাংশ) তুলনায় কম। সে সময় জিডিপির প্রায় ৬৯ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ভোগ থেকে আসায় বাহ্যিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি একরকম সুরক্ষিত-সুস্থির ছিল। কিন্তু চলতি মাসের হিসাব অনুযায়ী, এখন মানুষের সঞ্চয়ের হার মোট জাতীয় আয়ের ৩৪ শতাংশ, যেখানে বৈশ্বিক হার ২৭ শতাংশ। এখানে তাত্পর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের এই সঞ্চয় ব্যাংকে যাচ্ছে না কিংবা উত্পাদনশীল খাতেও বিনিয়োগ হচ্ছে না, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্তে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আগে বাজারে প্রচলনে থাকা ফিজিক্যাল মুদ্রা বা নগদ আকারে ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা, যা গত অক্টোবর শেষে এসে হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। ৪০ দিনের এক হিসাবে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। মানুষের হাতে টাকা পুঞ্জীভূত হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কাছে নগদ টাকার চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। নগদ অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ধার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে এখন মোট আমানত রয়েছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফিজিক্যাল ফরম তথা ছাপানো নগদ টাকার পরিমাণ ৩ লাখ ১৭ হাজার কোটি। প্রচলনে থাকা কাগজি নোটের বাইরে একটি বড় অংশ অপ্রচলনযোগ্য রূপে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের চেস্টসহ বিভিন্ন ব্যাংক শাখায় জমা রয়েছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে কোরবানি ঈদের আগে ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা প্রচলনে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ঈদের পর প্রচুর টাকা জমার ফলে ঐ মাস শেষেই তা ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ায়। পরে প্রতি মাসে কমতে কমতে গত অক্টোবরে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত রিজার্ভ তথা নগদ অর্থ ছিল ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা গত জুনে ২৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছিল। আর গত বছরের জুন শেষে ছিল ৬২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

বিপুল ভোক্তাশ্রেণি, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য মানসিকতা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অগ্রগতি, বেসরকারি খাতের দ্রুত বিকাশের সুযোগে অর্থনৈতিক সফলতার যে চিত্র এত দিন প্রকাশ পাচ্ছিল, তাতে কোথাও কোথাও বড় ধরনের ফাঁকফোঁকর দেখা যাচ্ছে, যেখানে তুষের আগুন দিয়ে ইন্ধন জোগাচ্ছে পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক বিশ্বপ্রেক্ষাপট এবং ধনি রাষ্ট্র-শ্রেণির চরম মুনাফাকামী খেলা।

একদিকে সরকার অর্থনীতি গতিশীল রাখতে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিচ্ছে; অন্যদিকে দুর্নীতি, কালোটাকা, বিদেশে অর্থ পাচার আর ব্যাংকিং খাতের নতুন নতুন সংকটের খবর প্রকাশ পাচ্ছে। এর সঙ্গে আবার ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার চিরাচরিত খেলা। এ তো জানা কথা, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অর্থনীতি মন্দায় পড়লে অভেদ্য এক চক্রের সৃষ্টি হয়, যেখানে ধনিক শ্রেণি কম মুনাফার কথা বলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে হাত গোটানোর ভান শুরু করে। সরকার তখন তাদের সচল রাখতে বাড়তি ঋণ দেয়। ধনিক শ্রেণি ঐ অর্থ দিয়ে মানুষের হাতে অর্থ না থাকার সুযোগ নিয়ে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ কিনে অনুত্পাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে। ধনিক শ্রেণি ঋণের অর্থ ফেরত না দিয়ে অনুত্পাদনশীল খাতে ব্যবহার করায় অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বলতর হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে সরকার ধনিক শ্রেণিকে আবারও ঋণ দেয়। ধনিক শ্রেণি আবারও ঐ একই কাজ করে

মোদ্দা কথা, সমস্ত অর্থ নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির কাছে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সরকার যখন ক্ষমতা ধরে রাখতে ধনিক শ্রেণিকে মরিয়া চাপ দেয়, ধনিক শ্রেণি তখন শাসনক্ষমতাই উলটে দিয়ে নতুন শাসকদের ক্ষমতায় বসায়। এভাবেই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা এক চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে।

সামষ্টিক অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জের কারণে মানুষের আশাবাদ এখন অত্যন্ত নিম্নমুখী। উপার্জন কমে যাওয়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতিজনিত ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ কংকালসার হচ্ছে আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি হচ্ছে দুর্বলতর। এমন এক প্রেক্ষাপটে অনুত্পাদনশীল খাতে অর্থ বিনিয়োজিত হওয়া এবং দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সামনের দিনগুলোয় মানুষের জীবনকে আরো দুর্বিষহ করবে। পরিশেষে বলা যায়, বিগত বছরগুলোয় মানুষের জীবনমানের যে উন্নতি হয়েছিল, এখন দ্রুত তা ক্ষয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা বিশ্বের গড় হারের চেয়ে বেশি। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের হাতে টাকা আটকে রেখে অনুত্পাদনশীল খাতে ব্যবহারের বাড়তি প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে আরো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, যা আমাদের অর্থনীতির বিকাশকে চরম বাধাগ্রস্ত করবে। অথচ অর্থনীতি স্বাভাবিক ছন্দে থাকলে আগামী ২০৩০ সালে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে টপকে বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণির বিশ্বের নবম বৃহত্তম হওয়ার কথা।

ভোক্তাশ্রেণির সংখ্যা বড়ো হলে অর্থনীতিও বড় হয় এবং মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়। ধনিক শ্রেণির গুটি কয়েক চরম মুনাফালোভীর লালসায় বিকাশমান বিশাল এক ভোক্তাশ্রেণি মূল্যস্ফীতি ও মূল্যহ্রাসের ভয়ে আবদ্ধ থাকলে কোনো শাসনব্যবস্থা বা শ্রেণিব্যবস্থাই সুস্থির থাকতে পারে না, সে কথা সবাইকে স্মরণে রাখতে হবে।

লেখক :অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়;

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি