হাছন রাজা: বাউলা কে বানাইলো রে
- প্রকাশ: ১০:৫০:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২
- / ৮৭১ বার পড়া হয়েছে
বাউল গানের জগতে মুকুটহীন রাজা ছিলেন দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী। হাছন রাজার ধমনীতে জমিদারের রক্ত। হাতের কাছে ভোগের সকল সামগ্রী। বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। এই হাছন রাজা এক সময় সমস্ত ভোগ বিলাস উপেক্ষা করে অনাসক্ত জীবনাচারে অভ্যস্ত হয়ে মজেছিলেন— বাউল মরমীবাদের ভাব দর্শনে। তাইতো এক সময় বাউল প্রেমে মগ্ন হয়ে হাছন গেয়েছেন…
বাউলা কে বানাইলো রে, হাছন রাজারে বাউলা কে বানাইলো রে ॥ বানাইলো বানাইলো বাউলা তার নাম হয় যে মাওলা দেখিয়া তার রূপের ঝলক হাছন রাজা হইল আউলা ॥
হাছন রাজা ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার আলী রাজা চৌধুরী ও হুরমত জাহান বিবির ২য় পুত্র। দেওয়ান হাছন রাজা সিলেটের লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে ২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। নাজির আব্দুল্লাহ নামক একজন বিখ্যাত ফারসি ভাষাবিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শমতে তার নামকরণ করা হয় হাছন রাজা। পরবর্তীতে বহু দলিল দস্তাবেজে দস্তখত করেছেন আরবি অক্ষরে। অথচ হাছন রাজার পূর্বপুরুষ ছিল হিন্দু এবং আদি বসবাস ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায়। অযোধ্যা থেকে তারা এসে পড়ে দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার কাগদি গ্রামে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে হাছন রাজার দাদা বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহদেব (বাবু রায় চৌধুরী) সিলেটে পাড়ি জমান এবং এখানেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
দাদা বাবু রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর হাছন পিতা পিতৃ ও মাতৃবংশীয় সকল সম্পদের মালিক হন। এত অল্প বয়সে বিপুল বিত্তবৈভব হাতে পেয়ে হাছন হয়ে ওঠেন ভোগবিলাসী, শৌখিন ও কিছুটা বেপরোয়া। প্রথম যৌবনে নারী সম্ভোগে অক্লান্তি বোঝা যায় তারই রচনা থেকে—
‘হাছন রাজার অভিলাষ নারীর বাস শুঙ্গে পেয়ারা চেহারার নারী পাইলে ঘষে অঙ্গে অঙ্গে’!
নারীর প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নারীর সংস্পর্শে আসার কথা জানা যায় অনেক লেখা থেকেই। হাসান দৌহিত্র অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জানান, ‘কবির ৪ জন পত্নী ছাড়াও ১৬ জন উপ-পত্নী ছিল।
হাছন পরিবারের উত্তরসূরি সাদিয়া চৌধুরী পরাগ ‘প্রেম বাজারে হাছন রাজা’ প্রবন্ধে লেখেন, ‘জমিদার দেওয়ান হাছন রাজা যৌবনে বহু সুন্দরী নারীর শয্যাসঙ্গী হয়ে বহু সন্তান-সন্তানাদির জন্মদান করেছিলেন।’ (প্রসঙ্গ হাছন রাজা, আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত। বাংলা একাডেমি ঢাকা। ১৯৯৮ পৃষ্ঠা ১৪৮)
কথিত আছে যে, দিন দিন ছেলের কর্মকাণ্ডে লজ্জিত হয়ে হাসন রাজার মা তাকে এ পথ থেকে ফেরানোর জন্য নিজে অজ্ঞাত নাইওরী সেজে যাত্রা করেন এবং নিজেকে যৌনশিকার হিসেবে উপস্থাপন করেন। হাছন রাজা লজ্জায় তার মায়ের পায়ে ক্ষমা চেয়ে লুটিয়ে পড়েন এবং এ পথ থেকে ফিরে আসেন। লোকমুখে শোনা যায়, মায়ের ভূমিকার পাশাপাশি হাছন রাজার এক আধ্যাত্মিক স্বপ্ন-দর্শন তার জীবনদর্শন আমূল পরিবর্তন করে দেয়। হাছন রাজা যেমন ঘোর বুঝতে পেরে বলেছেন, ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন/ সাধন বিনে নারী সনে হারাইলাম মূলধন’। তেমন বহির্জগৎ-অন্তর্জগৎ মিলিয়ে প্রজারা যেনো দেখা পেলো তাদের অন্য এক রাজার। ভোগবিলাস ছেড়ে বেছে নিলেন চাকচিক্যবিহীন উদাসীন জীবন।
একদিকে প্রজাদের খোঁজখবর রাখা থেকে শুরু করে নিজের বিষয়সম্পত্তি বিলিবণ্টন করে অনেক স্কুল, ধর্মপ্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপন করা শুরু করলেন। মরমীভাব ধারণ করে তৈরি করতে লাগলেন একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টি। যেখানে জীবনবোধ- গান-নানামুখী দ্যোতনা একাকার হয়ে গেছে।
হাছন রাজা রচিত প্রায় ৫০০ গানের সব উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিছু তার নায়েব কর্মচারীরা সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন, কিছু গান প্রচলিত হয়েছে লোকমুখে, কিছু হারিয়ে গিয়েছে কালের স্রোতে।
হাছন রাজা জাতি ধর্ম বর্ণের উপরে গিয়ে সঙ্গীত চেতনায় তুলে এনেছেন মরমী দর্শন। কেউ কেউ তাকে উল্লেখ করেছেন বাউল বা বৈষ্ণব গোত্রীয় হিসেবে। কিন্তু হাছন দৌহিত্র দেওয়ান আজরফের মতে হাছন রাজা বাউল নয় বরং চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন, কেননা নিরাসক্ত জীবনাচার গ্রহণ করলেও তিনি সংসার ত্যাগী ছিলেন না।
সুনামগঞ্জের তেঘরিয়ার রয়েছে হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি যা বর্তমানে অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এছাড়াও ‘মিউজিয়াম অফ রাজাস’ নামে সিলেট নগরীর প্রাণকেন্দ্র জিন্দাবাজারে গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘর। তার ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বই, নিজের হাতে লেখা পা-ুলিপিসহ তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য এখনো আপ্লুত করে দর্শনার্থীদের। দেশ বিদেশের দর্শনার্থীরা সেখানে প্রতিদিন ভিড় করে হাছন রাজার মাধ্যমে হয়তো মরমী দর্শনকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চান। মৃত্যু তাকে এক সময় নিয়ে যায় মহাকালের অনন্ত অসীমের পথে। চারদিকে শোকের সুর।
মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে। কান্দে হাছন রাজার মন ময়নারে॥