টপ্পা গান কী, টপ্পা গানের উৎপত্তি, বাংলায় টপ্পা গান ও এর বিশেষত্ব
- প্রকাশ: ০৫:১৮:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২২
- / ৯৬৭২ বার পড়া হয়েছে
মৌসুমী দাসগুপ্ত নামের একজন কণ্ঠশিল্পী হারমোনিয়াম বাজিয়ে টপ্পা গান গাইছেন। | শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
টপ্পা গান এক ধরনের লোকিক গান বা লোকগীতি যা ভারত ও বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। এই টপ্পা গান বলতে কী বোঝায়, এর উৎপত্তি ও বাংলা টপ্পা গানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো।
টপ্পা গান নিয়ে এখানে যা আছে
টপ্পা গান গান কী?
টপ্পা গান পাঞ্জাব ও বাংলা অঞ্চলের একটি লৌকিক গান। এটি পাঞ্জাব অঞ্চলের মূল গানের সাথে মিল থাকলেও বাংলায় এটি রাগাশ্রয়ী গান হিসেবে পরিচিত। অনেকে বিশ্বাস করেন রামনিধি গুপ্ত টপ্পা গানের উদ্ভাবক। রামনিধি গুপ্ত সকলের কাছে নিধু বাবু নামে পরিচিত। পণ্ডিতগণের একটি বড়ো অংশ আবার মনে করেন— বাংলা টপ্পা গান চালু করে কালী মীর্জা তবে নিধু বাবুর কারণে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বাংলা অঞ্চলের আধুনিক বাংলাদেশের চেয়ে আধুনিক ভারতের পশ্চিমবঙ্গে টপ্পা গানের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি।
টপ্পা গানের আদিভূমি পাঞ্জাব
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পাঞ্জাব অঞ্চলের লোকগীতি টপ্পা গানের প্রচলন শুরু হয়। প্রধানত উটের গাড়ি চালকের মুখেই টপ্পা গান বেশি শোনা যেত। শোরী মিয়া (১৭৪২-১৭৯২) নামে একজন সংগীতজ্ঞ টপ্পা গানগুলোকে সাঙ্গিতিক আদর্শে সাজিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি গায়ন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু (১৭৪১-১৮৩৯) বাংলা টপ্পা রচনা করেন। এখানেই ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী রাগসংগীতের ধারার সঙ্গে বাংলা রাগসংগীত চর্চা যুক্ত হয়। পরবর্তীতে টপ্পাকার কালীমির্জা (১৭৫০-১৮২০), বাংলা ভাষায় ধ্রুপদ রীতির প্রবর্তক রামশংকর ভট্টাচার্য (১৭৬১-১৮৫৩) এবং বাংলা ভাষায় খেয়াল রচয়িতা রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬) বাংলা গানকে আরও সমৃদ্ধ করে হিন্দুস্থানী রাগসংগীতের ধারার সঙ্গে যুক্ত করেন।
টপ্পা গান কীভাবে চালু হয়
টপ্পা গানের উৎপত্তি কখন এবং কীভাবে শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে নানা রকমের গল্প আছে। A.F. Strangways তার Music of India গ্রন্থে বলেন যে, পাঞ্জাবের উট চালকদের লোকগান থেকে টপ্পার উৎপত্তি। কিন্তু অনেকেই এই কথা মানতে রাজি নন। তবে আদি টপ্পাতে পাঞ্জাবি ভাষার আধিক্য রয়েছে। এই বিচারে বলা যায়, পাঞ্জাবের লোকগীতি থেকে টপ্পা গানের সূত্রপাত ঘটেছিল। হয়তো অন্যান্য পেশার মানুষের সাথে উটচালকরা এই গান গাইতেন। কাপ্তেন উইলার্ভকে উদ্ধৃতিকে অনুসরণ করে রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর বাংলার গীতিকার ও বাংলা গানের নানা দিক গ্রন্থের টপ্পা গানের উৎস সম্পর্কে লিখেছেন: “টপ্পা ছিল রাজপুতনার উষ্ট্র চালকদের গীত। শোনা যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যেসব বণিক উটের পিঠে চেপে বাণিজ্য করতে আসত, তারা সারারাত নিম্নস্বরে টপ্পার মতো একপ্রকার গান গাইতে গাইতে আসত। তাদের গানের দানাদার তানকেই বলা হতো ‘জমজমা’। আসলে জমজমা শব্দে ‘দলবদ্ধ উষ্ট্র’ বোঝায়। সাধারণভাব উষ্ট্রবিহারিদের গানও এই শব্দের আওতায় এসে গেছে। লাহোরে উট বদল হতো। এই লাহোর থেকেই টপ্পার চলটি ভারতীয় সংগীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে।”
বাংলা টপ্পা গান
বাংলা টপ্পা গানের আদি পুরুষ কালী মীর্জা। ১৭৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি সংগীত শিক্ষা শেষে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। কালী মীর্জা হুগলিতে এসে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি বাংলা টপ্পা গানের চর্চা শুরু করেন। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক ছিলেন।
বলা হয়ে থাকে যে, নিধু বাবুর অনেক আগে থেকে বাংলা টপ্পার প্রচলন করেন কালী মীর্জা। উল্লেখ্য, ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে নিধুবাবু বাংলা টপ্পা শুরু করেন ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। সময়ের নিরিখে বাংলা টপ্পার আদি পুরুষ বলতে কালী মির্জাকে বিবেচনা করা হয়।
বাংলা টপ্পা জলপ্রিয়তা লাভ করেছিল রামনিধি গুপ্ত তথা নিধুবাবু’র সূত্রে। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সরকারী রাজস্ব আদায় বিভাগে চাকরি লাভ করেন। এই বছরেই তিনি বিহারের ছাপরা জেলার কালেক্টর অফিসে দ্বিতীয় কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ছাপরাতে তিনি প্রথম তিনি এক ওস্তাদের কাছে রাগ সংগীতের তালিম নেওয়া শুরু করেন। পরে ছাপরা জেলার রতনপুরা গ্রামের ভিখন রামস্বামীর মন্ত্র শিষ্য হন। এই সময় তিনি উত্তরভারতের বিভিন্ন ধরনের গানের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং বিভিন্ন সংগীতশিল্পীদের কাছে রাগ সংগীত শেখেন। এই সময় লক্ষ্ণৌ অঞ্চলে শোরী মিঞা’র টপ্পা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বিভিন্ন শিল্পীদের মাধ্যমে তিনি সম্ভবত ওই টপ্পার সাথেও তার পরিচয় ঘটেছিল।
১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে শোরী মিঞা ছাপরা থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় ফিরে তিনি শোভাবাজারে একটি আটচালা ঘরে সংগীতের বসানো শুরু করেন। এই ঘরে প্রতিরাত্রে নিধুবাবু’র গানের আসর বসতো। এই আসরেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে টপ্পার সূচনা করেন তিনি। পরে এই আসরের আয়োজন হতো বাগবাজারের রসিকচাঁদ গোস্বামীর বাড়িতে। এই সকল আসরের ভিতর দিয়ে রামনিধি গুপ্ত-এর গান হয়ে যায় নিধুবাবু’র গান বা নিধুবাবু’র টপ্পা।
কালী মীর্জা এবং নিধুবাবুর পরে বাংলা টপ্পাকে সচল রাখেন শ্রীধর কথক। শ্রীধর সযত্নে কালী মীর্জা এবং নিধুবাবুর টপ্পাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে তার গানে নিধুবাবুর প্রভাবই বেশি। এরপর পশ্চিমা টপ্পা শিখে বাংলা টপ্পার জগতে আসেন মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সংগীতে তার অসাধারণ দখলের কারণে তিনি মহেশ ওস্তাদ নামে খ্যাত হয়েছিলেন। মহেশচন্দ্র ১৮৫০-১৯০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তার বাংলা টপ্পাকে সজীব করে রেখেছিলেন। এরপরে শ্রী রামকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২১-২০০৯) ছিলেন টপ্পা সংগীতের শেষ জনপ্রিয় গায়ক।
টপ্পা গানের নামকরণ হয় কীভাবে?
উত্তর ভারতীয় সংগীতে অর্ধ-শাস্ত্রীয় সংগীত হিসেবে টপ্পা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সংস্কৃত লম্ফ শব্দ রূঢ়ারার্থে হিন্দুস্থানি সংগীত গৃহীত হয়েছিল। এর অর্থ সংক্ষেপ্ত। খেয়াল বা ধ্রুপদের সংক্ষিপ্তরূপ হিসেবে হিন্দিতে ‘টপা’ শব্দ গৃহীত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এই শব্দটি দাঁড়ায় টপ্পা।
টপ্পা গানের বিশেষত্ব
টপ্পার স্বাভাবিক করুণ রস, প্রেম, প্রধানত বিরহকে বিষয়বস্ত্ত করে রচিত বলে টপ্পার উপযোগী কিছু বিশেষ রাগও আছে, যেমন: রাগ ভৈরবী, খাম্বাজ, দেশ, সিন্ধু, কালাংড়া, ঝিঁঝিট, পিলু, বারোয়া প্রভৃতি।
নিধুবাবুর রচিত টপ্পা গানে বিরহের প্রকাশ কত মার্জিত, পরিশীলিত; একটি গানের উদাহরণ দিলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে: “বিধি দিলে যদি বিরহ যাতনা / প্রেম গেল কেন প্রাণ গেল না / হইয়ে বহিয়ে গেছে প্রেম ফুরায়েছে / রহিল কেবলি প্রেমেরি নিশানা।”
কিছু জনপ্রিয় টপ্পা গানের নাম
- মারিলে মারিতে পারো, রাখিতে কে করে মানা?
- নানান দেশে নানান ভাষা
- পিরীতি না জানে সখী
- আসিবে হে প্রাণ কেমনে এখানে
- সখি! কোথায় পাব তারে, যারে প্রাণ সঁপিলেম
- যাও! তারে কহিও, সখি, আমারে কি ভুলিলে
- আমি আর পারি না সাধিতে এমন করিয়ে
- ভ্রমরারে! কি মনে করি আইলে প্রাণ নলিনী ভবনে
- শুন, শুন, শুনলো প্রাণ! কেন তুমি হও কাতর
- ঋতুরাজ! নাহি লাজ, একি রাজনীত
- কি চিত্র বিচিত্র কুসুম ঋতুর চরিত্র গুণ
- মধুর বসন্ত ঋতু! হে কান্ত! যাবে কেমনে
- এ কি তোমার মানের সময় ? সমুখে বসন্ত
- শৈলেন্দ্রতনয়া শিবে, সদাশিবে প্রদাভবে
- অপার মহিমা তব, উপমা কেমনে দিব
- শঙ্করি শৈলেন্দ্র সুতে, শশাঙ্ক শিখরাশ্চিতে