মূল্যস্ফীতি কী এবং মূল্যস্ফীতি কীভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে?
- প্রকাশ: ০৮:৫২:৩১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জানুয়ারি ২০২৩
- / ১৫৬৭ বার পড়া হয়েছে
মূল্যস্ফীতি হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের বা পণ্যসমূহের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া। মূল্যস্ফীতি বিভিন্নভাবে একটি দেশে বসবাসরত মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। কীভাবে আপনার জীবনকে প্রভাবিত করে— এ নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে এই নিবন্ধে।
মূল্যস্ফীতি কী?
অর্থনীতিবিদদের মতে, আগের বছর বা মাসের সঙ্গে অথবা কোনো নির্দিষ্ট সময়কালের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে খাদ্য, কাপড়, পোশাক, বাড়ি, সেবা ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদানের মূল্য বৃদ্ধির যে পার্থক্য যাচাই করেন সেটাই মূল্যস্ফীতি।
মূল্যস্ফীতি দিয়ে আমরা যেটা বুঝি তা হলো, কোনো একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে পরবর্তী আরেকটি সময়ে দাম কেমন বেড়েছে? যেমন, একটা জিনিসের দাম ২০২০ সালে ছিল ৫ টাকা, পরবর্তী বছর তা হয়েছে ৬ টাকা। সব জিনিসের দাম তো একইরকমভাবে বাড়ে না। বিভিন্ন জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির তথ্য একটি পদ্ধতির মাধ্যমে গড় করে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়।’
কয়েকভাবে মূল্যস্ফীতি বের করা হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ২০২১ সালের ১৫ই জুলাই মূল্য কী ছিল আর এই বছরের ১৫ই জুলাই কী মূল্য আছে— এই দুইয়ের শতকরা ব্যবধান।
আরেকটি হচ্ছে, এক বছরে জিনিসপত্রের গড় মূল্য আর পরের বছরের ১২ মাসে গড় মূল্যের তুলনা করেও মূল্যস্ফীতি বের করা হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতি গণনা করা হয়।
এ নিয়ে আপত্তি আছে অর্থনীতিবিদদের। কারণ তারা মনে করেন, মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে, খাদ্যাভ্যাস ও ভোগের ধরন পাল্টেছে। ফলে ভিত্তি বছরও নতুন করে নির্ধারণ করা উচিত।
পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০৫-০৬ এর খানা জরিপে আয়-ব্যয়ের তথ্যের ভিত্তিতে কনজুমার প্রাইস ইনডেক্স তৈরি করে। ফলে, মূল্যস্ফীতির তথ্যে বড় ধরনের পার্থক্য তৈরি হয়েছে।
প্রকৃত খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবিএসের দেয়া তথ্যের চেয়ে বেশি। বিবিএস মূল্যস্ফীতির তথ্য গণনায় ২০০৫ সালের ভিত্তি বছর বিবেচনায় নিচ্ছে। এ ভিত্তি বছরে খাদ্যপণ্যের ওপর কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ এখন সরকারের হাতে ২০১৬ সালের খানা জরিপের নতুন তথ্য আছে।
মূল্যস্ফীতি কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করে?
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি জানা গেলে বোঝা যায় যে কোনো নির্দিষ্ট সেবা বা পণ্যের জন্য আগের তুলনায় একজন মানুষকে কত টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে, এবং তা তার জীবনযাত্রার ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে।
একজন ব্যক্তি হয়তো গত বছর কোনো একটি খাবার ১০০ টাকা দিয়ে কিনতেন। ফলে পাঁচশো টাকায় তিনি পাঁচটা খাবার কিনতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সেটার দাম হয়েছে ১০৭ টাকা। এখন ওই ব্যক্তির আয়ের কেনা পরিবর্তন না হলে, ৫০০ টাকায় তিনি এখন আর পাঁচটা খাবার কিনতে পারবেন না, তাকে কম কিনতে হবে।
এভাবেই মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে থাকে।
মূল্যস্ফীতি হলে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, বাড়িভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। মানুষকে এসব সেবা বা পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। আয়ের পরিবর্তন না হলে তখন মানুষ এগুলো প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে বাধ্য হন। তাদের সঞ্চয় কমে যায় এবং অন্যান্য খাতের খরচ কমিয়ে ফেলতে হয়।
মূল্যস্ফীতি হলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে সীমিত এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর। কারণ জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক দ্রব্য তাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।
মূল্যস্ফীতি অনেক সময় একেকজনের ওপর একেকভাবে প্রভাব ফেলে। গড়ে এখন মূল্যস্ফীতি সাড়ে সাত শতাংশ বলা হলেও, বাস্তবে কোন কোন ক্ষেত্রে কারও কারও জন্য এটা আরও বেশি মনে হতে পারে।
উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, একটি পরিবারের মাসে ৩০ কেজি চাল দরকার হয়। ৫০ টাকা চালের দাম যদি ৬০ টাকা হয়ে যা, তাহলে একজন নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে সেটা বেড়েছে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ চালের দামই তার কাছে মূল্যস্ফীতির একটা নিয়ামক হতে পারে। গড়ের তুলনায় তার ক্রয়ক্ষমতা বেশি কমে যায়, তার ওপর প্রভাব বেশি পড়ে।
কেন মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে?
বিশ্বের একেকটি দেশে একেক রকম মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। অনেক উন্নত দেশে মূল্যস্ফীতির হপরে সামান্যই পরিবর্তন হয়ে থাকে।
অনেক সময় মৃদু মূল্যস্ফীতি হয়, অনেক সময় অতি মূল্যস্ফীতি। যখন জিনিসপত্রের দাম আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে, মানুষ তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটা মৃদু মূল্যস্ফীতি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম রাতারাতি বেড়ে গেলে তাকে অতি মূল্যস্ফীতি বলা হয়।
বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে আমদানি বেশি করতে হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে এখানেও দাম বাড়বে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আগের মতো থাকলেও কোনো কারণে ডলার যদি অবমূল্যায়িত হয়, তাহলেও দেশে মূল্যস্ফীতি হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির এটাও একটা কারণ।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে স্থানীয় বাজারেও পরিবহন খরচ, উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে সেটার কারণে দেশে উৎপাদিত পণ্যর দাম বাড়ে। আবার যখন একটি পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পণ্যেরও দাম বাড়তে শুরু করে। যেমন তেলের দাম বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ে, কাঁচামালের দাম বাড়লে পণ্যের দাম বাড়ে।
কোনো পণ্যের চাহিদা বেশি থাকার পরেও প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো কারণে যোগান কমে গেলে মূল্য বাড়তে পারে।
দেশে অতিরিক্ত টাকার যোগান তৈরি হলেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। তখন মানুষ বেশি টাকা দিয়ে হলেও পণ্য কিনতে শুরু করে।
অনেক সময় বাজারে কারসাজির মাধ্যমে পণ্য বা সেবার দাম বেড়ে যায়।
এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের মূল্যস্ফীতির পার্থক্য কেন তৈরি হয়?
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় মূল্যস্ফীতির ঘটনা দেখা গেছে আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়েতে। সেখানে আয়ের চেয়ে সরকারের ব্যয় বেশি হলে সরকার অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। ফলে, বাজারে পণ্যের চেয়ে টাকার যোগান বেশি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছিল ৩৭০০ শতাংশে।
একই রকম চিত্র দেখা গিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে। ১৯২২ থেকে ১৯২৩ সালে জার্মানিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছিল ৩২২ শতাংশ।
যেসব দেশের আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি, তারা সহজে এটা সামাল দিতে পারে। কিন্তু যেসব দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দুর্বল, বাজারে নজরদারি কম, সেখান মূল্যস্ফীতি প্রবল হয়ে ওঠে।
মূল্যস্ফীতির উল্টো কি হয়?
কোনো দেশে বড়ো ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা হলে মূল্যস্ফীতির উল্টো ঘটনা ঘটতে পারে। তবে মূল্য বাড়ার দিকে যতটা প্রবণতা থাকে, কমার দিকে ততটা থাকে না। তবে অনেক সময় অনেকে দেশে মৌলিক জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পরে আবার সেটা কমে আসতেও দেখা গেছে। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম এবং খাদ্য পণ্যের দাম কমলে বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি কমে আসতে পারে।
[বিশ্লেষণ‘র পাঠকদের জন্য শুধু প্রয়োজনীয় অংশ তুলে ধরা হলো। মূল প্রতিবেদন পড়তে ক্লিক করুন।]