ইসলাম পালনে দলিল (রেফারেন্স) কেন গুরুত্বপূর্ণ?
- প্রকাশ: ০৯:১৭:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
- / ১৬৫৫ বার পড়া হয়েছে
ইসলাম হচ্ছে প্রামাণিক ও দলিল ভিত্তিক ধর্ম। যার মূলে রয়েছে পবিত্র কুরআন। যে কুরআন সরাসরি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ থেকে মানুষের জন্য নাযিল হয়েছে। আর তাই ইসলামে যে-কোনো রীতিনীতি আইনকানুন পালন করার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণাদি ছাড়া গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলামের নামের যত কিছুই পালন করা হোক না কেন তার সুস্পষ্ট দলিল ও প্রমাণ অবশ্যই থাকতে হবে।
কেননা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুরা মায়েদার ৩ নং আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন যে, তিনি ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ইসলামে নতুন করে কোনো কিছু হ্রাস বৃদ্ধি ইত্যাদি করা যাবে না। একইসাথে কেউ ইসলামে নতুন কিছুর অবতারণা করলে তাকে সুস্পষ্ট দলিল প্রমাণাদি নিয়ে আসতে হবে। কেননা আল্লাহ নিজেই যে-কোনো কাজের জন্য দলিল প্রমাণাদির তথ্য চেয়ে থাকেন। যেমন সুরা ছাফফাতে কাফিররা ফিরিশতাদের আল্লাহর সন্তান বলে দাবি করলে, আল্লাহ উক্ত সুরার ১৫৬ নং আয়াতে তাদের কাছে এর প্রমাণ চেয়েছেন এভাবে, “না কি তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোন দলিল রয়েছে?”
সুতরাং ইসলামে যে-কোনো ইমান আমল আকিদার ক্ষেত্রে অবশ্যই দলিল এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দিতে হবে।
আজ ইসলাম বহুধারায় বিভক্ত। হাজারো শাখা উপশাখায় ভরপুর ইসলামের অলি গলি। এতসব শাখা উপশাখার মধ্যে কারা সঠিক ইমান আকিদা পোষণ করে তা যাচাই করা খুবই দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার। কেননা সবাই নিজেদের সঠিক এবং সত্য বলে দাবি করে। কিন্তু মুখের কথায় কখনোই কাউকে মান্য করা যাবে না। যে-কোনো দলের বা গোষ্ঠীর ইমান আমল গুলো অবশ্যই দালিলিকভাবে প্রমাণিত হতে হবে। যারা সুস্পষ্ট দলিল ও প্রমাণ দিতে পারবে না তাদের ইমান আকিদা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না।
অথচ আমাদের উপমহাদেশে অধিকাংশ মুসলমান ইমান আকিদায় এমন কিছু বিশ্বাস এবং আমল করে যা সরাসরি কুরআন সুন্নাহর বিরোধী। এমনকি তাদের ইমান আকিদা সমূহের দালিলিক ভিত্তি পর্যন্ত নেই। কিন্তু ইসলামে কুরআন সুন্নাহর বাইরে নিজেদের বা পূর্বপুরুষদের মনগড়া কথায় কোনো কিছুই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কেননা আল্লাহ নিজেই পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে কাফির মুশরিকদের থেকে দলিল প্রমাণাদি চাওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
বিশেষকরে মুশরিকরা যখন আল্লাহর সাথে অন্যান্য দেবদেবী অলি আউলিয়াদের শরিক করে তখন আল্লাহ বলেন, “আমি কি তাদের কাছে এমন কোনো দলিল নাযিল করেছি, যে তাদেরকে আমার শরিক করতে বলে? ” (সুরা: আর-রূম, আয়াত: ৩৫)
অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অন্যান্যদের শরিক হওয়ার কোনো দলিল আল্লাহ নাযিল করেন নাই, যে তারা দলিল দিতে পারবে। কিন্তু এক শ্রেণির মুসলমান তাদের বিভিন্ন পির অলি আউলিয়াদের আল্লাহর সমকক্ষ করে গাউসুল আযম গরীবে নেওয়াজ ইত্যাদি নামে ডাকে এবং তাদের কাছে সাহায্য চায়। যার কোনো দলিল ও প্রমাণ কুরআন হাদিসের কোথাও নেই। সুতরাং এটা শিরক। এই জাতীয় অসংখ্য শিরকি আকিদা অধিকাংশ মুসলমান দলিল ছাড়াই পালন করে। যা আল্লাহ কখনোই পছন্দ করেন না। কেননা আল্লাহ বলেন, “যারা নিজেদের কাছে আগত কোনো দলিল ছাড়াই আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে, তা আল্লাহ ও মুমিনদের কাছে খুবই অসন্তোষজনক।” (সুরা: আল-মু’মিন, আয়াত: ৩৫)
অর্থাৎ এইসব মুসলমানদের বিভিন্ন ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে সুস্পষ্ট আয়াত দিয়ে প্রমাণ দেওয়ার পরও, তারা তাদের অবস্থানে অনড় থাকে। এবং তারা তাদের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক করে কোনো দালিলিক প্রমাণ ছাড়াই। একইভাবে এইসব মুসলমানরা কুরআন হাদিসের বাইরে নিজেদের পির অলি আউলিয়াদের নানান উপাধিতে (গাউসুল আযম, গাউস, কুতুব, আবদাল ইত্যাদিতে) ভূষিত করে। যার কোনো প্রমাণ আল্লাহ থেকে প্রমাণিত নয়। যেমন প্রমাণিত ছিলো না তৎকালীন আরবের মুশরিকদের বিভিন্ন দেব দেবী লাত, মানাত, উযযা ইত্যাদি আল্লাহর শরিক হওয়া। যাদেরকে মুশরিকরা পূজা করত, সাহায্য চাইত এবং আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী হিসাবে মানতো। অথচ তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন, “এগুলো কতগুলো নাম বৈ নয়, যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব-পুরুষদের রেখেছ। এর সমর্থনে আল্লাহ কোন দলিল নাযিল করেননি।” (সুরা: আন-নাজম, আয়াত: ২৩)
অর্থাৎ যাদের সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো দলিল নেই, কিন্তু তারা তাদেরকে মানতে লাগল যেমন তাদের পূর্বপুরুষরা তাদের শিখিয়ে গেছে। যেমনটা হচ্ছে বর্তমান অধিকাংশ মুসলমানদের বেলায়। তারা তাদের বড় বড় বুজুর্গদের কাছ থেকে আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে বিভিন্ন কবরবাসীকে নানান উপাধিতে ভূষিত করে পূজা করে যাচ্ছে। যা সুস্পষ্ট গোমোরাহী।
এমনকি তারা সাধারণ মুসলমান যারা কুরআন হাদিস জানে না, তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে বিভ্রন্ত করে। এবং দাবি করে তাদের পির অলি আউলিয়ারা কিয়ামতের মাঠে সকল মুরিদদের সুপারিশের মাধ্যমে ক্ষমা করিয়ে নিবে। অথচ সুপারিশ করার বিষয়টি সরাসরি আল্লাহর হাতে। আল্লাহ বলেন, “কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া?” (সুরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৫৫)
অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে হলেও তাঁর অনুমতি লাগবে। তিনি যাকে যার জন্য অনুমতি দিবেন কেবলমাত্র তিনিই তার জন্য সুপারিশ করতে পারবেন। সুতরাং নেককার ব্যক্তি অবশ্যই সুপারিশ করতে পারবে, তবে আল্লাহ তাকে যার জন্য অনুমতি দিবেন। তাহলে যিনি দুনিয়ায় ইমান আমলের ধারে কাছেও ছিলো না, তাকে কীভাবে একজন নেককার সুপারিশ করতে পারেন কিংবা আল্লাহ সুপারিশ করার অনুমতি দিতে পারেন?
তারপরও অধিকাংশ মুসলমান দাবি করেন তাদের পিরেরা তাদের মুরিদদের অবশ্যই শত হাজার গুনাহ থাকলেও পার করিয়ে নিবেন। যেমনটা বলে ইহুদী নাসারা। “ওরা বলে, ইহুদী অথবা খ্রীস্টান ব্যতীত কেউ জান্নাতে যাবে না। এটা ওদের মনের বাসনা। বলে দিন, তোমরা সত্যবাদী হলে, প্রমাণ উপস্থিত কর।” (সুরা: আল বাকারা, আয়াত: ১১১)
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্ট বলে দিয়েছেন যারা জান্নাতের সার্টিফিকেট বিক্রি করে তারা কীসের ভিত্তিতে এই সার্টিফিকেট দেয়? তার দলিল আল্লাহ নিজেই দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার এমন কোনো দলিল কাউকেই দেননি। অথচ পির মুরিদির দরবার গুলো প্রতিনিয়তই জান্নাতের সার্টিফিকেট বিক্রি করে থাকে।
শুধু কি তাই, অধিকাংশ মুসলমানরা বিপদে-আপদে সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর পরিবর্তে সরাসরি তাদের পির আউলিয়াদের বিভিন্ন নামে ডাকে। এক একজন পির আউলিয়া এক এক কাজের জন্য সমাদৃত। যেমন মক্কার মুশরিকরা তাদের বিভিন্ন দেবদেবীকে নানান নামে ডেকে ইবাদত বন্দেগি করত। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের এবাদত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি।” (সুরা: ইউসুফ, আয়াত: ৪০)
সুতরাং মক্কার মুশরিকরা তাদের বাপ দাদাদের অনুসরণে তৎকালীন অসংখ্য দেবদেবীদের যেমন বিভিন্ন নামে ডাকতো, ঠিক তেমনি উপমহাদেশের মুসলমানরাও তাদের বড় বড় বুজুর্গদের অনুসরণে বিভিন্ন পির অলি আউলিয়াদের নানান নামে ডেকে তাদের ইবাদত বন্দেগি করে। অথচ আল্লাহ মুশরিকদের যেমন কোনো দলিল অবতীর্ণ করেননি, ঠিক তেমননি এইসব মাজার ভক্তদেরও কুরআন হাদিসের কোনো দলিল নেই। তারা শুধু আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতেই ইসলাম পালন করে। যেমন করত মক্কার মুশরিকরা। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “আপনি বলুনঃ তোমাদের কাছে কি কোনো প্রমাণ আছে যা আমাদেরকে দেখাতে পার। তোমরা শুধুমাত্র আন্দাজের অনুসরণ কর এবং তোমরা শুধু অনুমান করে কথা বল।” (সুরা: আল আনআম, আয়াত: ১৪৮)
সুতরাং আন্দাজ অনুমান দিয়ে কখনোই ইসলাম পালন করা যাবে না। আল্লাহ সৃষ্টির শুরু থেকেই বিভিন্ন দলিলাদি ও প্রমাণের ভিত্তিতে যুগে যুগে ইসলামের দাওআত দিয়েছেন। কখনোই কোনো প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছু আল্লাহ গ্রহণ করেন না। যার প্রমাণ আমরা পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতের মধ্যে দেখতে পাই।
অতএব ইসলামে দলিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যেকারণে ইসলামের নামে যে-কোনো ইমান আকিদা আমল করার আগে অবশ্যই তার স্বপক্ষে কুরআন হাদিসের দলিল ও প্রমাণ দিতে হবে। শুধু তাইনয় যে-কোনো মুমিন মুসলিম ইসলামের নামে যে-কোনো ইমান আমল করার আগে অবশ্যই তা যাচাই বাছাই করতে হবে। কেননা আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! কোনো ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবসত কোনো সম্পদ্রায়ের ক্ষতি না করে বস! ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের আনুতপ্ত হতে হয়।” (সুরা হুজুরাত : আয়াত ৬)
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি দুনিয়া সংক্রান্ত কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তা অবশ্যই যাচাই বাছাই করে এর সত্যতা নিরুপণ করতে হবে। যাতে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে না হয়। অতএব যেখানে দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে আল্লাহ সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন, সেখানে আখিরাতের বিষয়ে আমাদের অবশ্যই আরও বেশী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, ইসলামে দলিল এবং প্রমাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামে যে-কোনো ইমান আমল আকিদার ক্ষেত্রে অবশ্যই দলিল প্রমাণাদির সাপেক্ষে পালন করতে হবে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণ এবং দলিল ছাড়া কখনোই কোনো ইমান আমল ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা আল্লাহর রাসুল সা. বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন আমল করল যাতে আমার কোন নির্দেশনা নেই, তা পরিত্যাজ্য।” (মুসলিম হা/১৭১৮)
সুতরাং ইসলামের নামে যে-কোনো ইমান আকিদা আমল ক্ষেত্রে অবশ্যই আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের স্বীকৃতির দলিল থাকতে হবে। নতুবা তা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবেনা। একইসাথে কেউ যদি রাসুলের নামে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে থাকে বা রাসুলের নামে মিথ্যা বলে থাকে তাহলে তার স্থান হবে জাহান্নাম।” (সহীহ বুখারী : হাদিস ১০৭) অতএব দলিল ছাড়া কখনোই ইসলাম পালন নয়। আল্লাহ আমাদের উপযুক্ত দলিল প্রমাণাদি দিয়ে ইমান আমল পালন করার তৌফিক দিন। আমিন।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী,১ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০২৩ পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।