০৩:৪৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

কুতাইবার কাছে চীন সম্রাটের আত্মসমর্পণ

মুসা আল হাফিজ
  • প্রকাশ: ০৪:১০:৪৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ জুন ২০২৩
  • / ৮৩০ বার পড়া হয়েছে

কুতাইবা বিন মুসলিমকে কল্পনা করে আঁকা ছবি।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

চীনা সভ্যতার প্রতিকূলতা উজিয়ে টিকে থাকার অদ্ভুদ বৈশিষ্ট্য এখানে রাজাকে বিনয়ী করল। তিনি কুতাইবার কাছে পত্র পাঠালেন- ‘আমার কাছে আপনাদের কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে প্রেরণ করুন যেন আপনাদের উদ্দেশ্য ও আপনাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারি।’

ইবনুল আসির জানান, কুতাইবা প্রেরণ করলেন একটি প্রতিনিধি দল। যাদের নেতা ছিলেন হুবাইরা ইবনুল মুশামরাজ কিলাবি। তার সঙ্গে কয়েকজন বিদগ্ধ ভাষ্যকার। সম্রাটের সঙ্গে মোলাকাত হলো তাদের। সম্রাটকে তারা জানিয়ে দিলেন কুতায়বার ঘোষিত প্রতিশ্রুতি- ‘হয় চীনকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে, নয় জিজিয়া বা অধীনতামূলক কর দিতে হবে। নতুবা মুসলিম বাহিনী চীনকে পদানত করবে। রাজপুত্রদের কুতায়বা বিন মুসলিমের আওতায় নেওয়া হবে।

সম্রাটের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ হলো তিন দিনে তিনবার। তাদের অভিব্যক্তি ও প্রতীকগুলো ছিল চীনাদের কাছে হতবুদ্ধিকর, যা তাদের প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক দক্ষতাকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করছিল। প্রথম দিনের সাক্ষাতে তাদের পরনে ছিল সাদা জামা, হালকা গাউন, পায়ে ছিল চামড়ার জুতা, শরীরে আশ্চর্য সুগন্ধি। দ্বিতীয় দিন তারা পরিধান করেন নকশা করা আবা বা অভিজাত বিশত, মাথায় ছিল সুগোল পাগড়ি। তৃতীয় দিন তারা দরবারে এলেন বিশেষ ধরনের সাদা পোশাকে, হাতে ছিল তরবারি ও বর্শা, মাথায় ছিল লোহার বর্মটুপি। সম্রাট জানতে চাইলেন তিন দিনের তিন রকম পোশাকের মর্ম। তারা বললেন প্রথম দিন আমরা যা পরেছি, তা আমরা পরি আপন পরিবারে। দ্বিতীয় দিন পরেছি রাজাদের দরবারে হাজির হবার পোশাক। তৃতীয় দিনের পোশাক পরে আমরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করি। সম্রাট জানতেন কুতায়বার বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম। আর চীনের বাহিনীর বিশালতা মুসলমানদের অজানা ছিল না। সম্রাট মনে করিয়ে দিলেন, সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে বিশাল চীনা বাহিনীকে পরাস্ত করা অসম্ভব। তোমরা বরং ফিরে যাও। নতুবা চীনা যোদ্ধাদের পায়ের তলে পিষ্ট হয়ে মরতে হবে।

হুবায়রা যেন সম্রাটের এমন উক্তির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি মুহূর্তেই জবাব দিলেন প্রবল ভঙ্গিতে। বললেন- যে বাহিনীর এক হাত আপনার সীমান্তে, আরেক হাত জয়তুন বাগানে (বিশ্বশাসনের কেন্দ্রীয় শক্তি দামেশকে), সেই বাহিনীকে হালকা মনে করার দুঃসাহস কে করবে? আপনি আমাদের শুনাচ্ছেন হত্যার গল্প। কিন্তু আমরা তো বিশ্বাস করি নির্ধারিত একটি সময় নিয়ে ইহলোকে আমরা এসেছি। সময় শেষ হলে মৃত্যুকে বরণ করতেই হবে। ফলে মরণে আমাদের কোনো ভয় নেই।

সম্রাট তার সবচেয়ে বড় হুমকি ইতোমধ্যে দিয়ে ফেলেছেন। হত্যার শক্তি ও মৃত্যুর চেয়ে বড় কোনো ভয় দেখাবার ছিল না। কিন্তু সেই ভয়কে তারা ভয়ই মনে করে না। সম্রাটের কাছে এ বাহিনীকে ভীত করার কিছুই ছিল না আর। তিনি মূলত বন্ধুত্ব চাইছিলেন। মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে আপন সাম্রাজ্যকে পারস্য-রোমের পরিণতির দিকে ঠেলে দেবার হুমকি এড়াতে চাইছিলেন। সম্রাট বললেন, তাহলে কী তোমরা চাও, যা পেলে চীন ছেড়ে তোমরা ফিরে যাবে? হুবায়রা বললেন, আমাদের সেনাপতি শপথ করেছেন আপনি হয় ইসলাম কবুল করবেন, নয় জিজিয়া দেবেন। নতুবা তিনি আপনার ভূমিকে পদদলিত করবেন এবং রাজপুত্রদের নিয়ে যাবেন নিজের কব্জায়। সম্রাট বললেন, যেহেতু তিনি শপথ করেছেন, তা পূরণ করব আমি। তিনি স্বর্ণের পাত্র ভরে চীনের মাটি প্রেরণ করলেন কুতায়বার কাছে, যেন তিনি মাটিকে পদপিষ্ট করতে পারেন। নিজের চার সন্তানকেও পাঠালেন তার কাছে, যেন তিনি কব্জায় নিতে পারেন তাদেরকে।

এর পর সন্ধি হলো এবং চীন এড়াতে পারল মুসলিম অভিযানের প্রবল জোয়ারকে। উমাইয়া ও আব্বাসি আমলে চীন মুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন জারি রেখেছে রাষ্ট্রিয়ভাবে।

সপ্তম শতাব্দীর পরে মুসলিম বণিকরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চীনে আসতে থাকে বিপুলভাবে। সেখানকার বড় বড় শহরগুলোতে তারা অভিবাসী হন। বিশেষত গুয়াংজু, কুয়াংজু ও হাংজুর মতো উপকূলীয় বাণিজ্যিক নগরীগুলোতে মুসলিমদের উপস্থিতি ও প্রভাব ছিল ব্যাপক। সেখানে তৈরি হয় বহু মসজিদ। প্রায় ১৩০০ বছর আগে ইয়াংজুতে প্রতিষ্ঠিত হুয়েইশেং মসজিদ চীনে মুসলিম সভ্যতার প্রাচীন উপস্থিতির ঘোষণা করছে। প্রথম দিকে আরব ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা চীনে বসবাস শুরু করলেও ধীরে ধীরে স্থানীয়রা ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকেন। কয়েক শতাব্দীর ধারাবাহিকতায় তা ক্রমবর্ধমান ছিল।

চীনের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয় তাং রাজত্বকালকে। প্রায় তিনশত বছর (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) অব্যাহত ছিল এই রাজত্বকাল। চীনা রাষ্ট্র, প্রশাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতিতে তাংদের প্রভাব অব্যাহত ছিল উনিশ শতকেও। তাং আমলে মুসলিম সংস্পর্শের পরে চীনে অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন বিশেষ মাত্রা লাভ করে। উমাইয়া ও আব্বাসি খেলাফতের সঙ্গে তাংদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। তাদের সীমান্তবর্তী বিশাল অঞ্চল খেলাফতের অধীনে ছিল। মুসলিমদের সঙ্গে ব্যবসায়িক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন ছিল তখনকার এক প্রবল বাস্তবতা। তাং রাজাদের সঙ্গে উমাইয়াদের কূটনৈতিক সুসম্পর্ক প্রচারকদের জন্য পথ করে দেয়। সেখানে সামাজিকভাবে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয় উমাইয়াদের আমলে। আব্বাসি আমলে সেটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বরে চীনে বিখ্যাত আন লুশান বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। তিয়ানবাও ক্যাওস নামে পরিচিত এই বিশৃঙ্খলা সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে সংগঠিত হয়েছিল। এর সঙ্গে ছিল কথিত ধর্মীয় নেতাদের যোগসাজশ। কমান্ডার বিদ্রোহ হিসেবে সূচিত এই গৃহযুদ্ধ চীনকে ভীষণভাবে বিশৃঙ্খল করে দেয়। সাত বছর দুই মাস ধরে এই বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। আশিনা উপজাতি থেকে উ™ূ¢ত দরিদ্র লুশান রাজা জুয়ানজং-এর আদরে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রভাবশালী জেনারেল হয়ে উঠলেও তিনি রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বিভিন্ন শহর দখল করে লুশান নিজেকে নতুন গ্রেট ইয়ান রাজবংশের সম্রাট ঘোষণা করেন। তার বাহিনী ক্রমেই অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। শহর-জনপদগুলোকে ধ্বংস করতে করতে আন লুশান সমগ্র চীন অধিকারে এগিয়ে চলছিলেন। প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে রাজা ঝুঁড়হম (শাসনকাল : ৭১২-৭৫৬) রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। জনগণ আরো বেশি হতাশ হলো। জনপদ ছেড়ে পালাতে লাগল। প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ল নানা এলাকা। রাজার অব্যাহত পতন, পলায়ন ও পরাজয় তার সৈন্যদেরকে বীতশ্রদ্ধ, হীনমন্য ও বিদ্রোহী করে তুলল। চীনা স্বর্ণযুগ নরকের খাদ্যে পরিণত হতে চলছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রাজা দাঁড়াতে থাকল। এরই মধ্যে জুয়ানজং-এর তৃতীয় পুত্র লি হেংকে সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন তার কিছু অনুসারী। লিংউউকে রাজধানী করে রাজা ঝুঁড়হম নাম নিয়ে তিনি জনগণকে আনুগত্যের জন্য আহ্বান করলেন। ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট তিনি রাজা হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন। স্থানীয় কর্মকর্তাদের একটি অংশ তাকে কবুল করল। কিন্তু কর্মকর্তাদের আরেকটি অংশ নানজিং-এ ইয়ং-এর যুবরাজ লি লিনের আনুগত্য করছিল।

বিদ্রোহ ও নৈরাজ্য মোকাবিলার সামর্থ্য ছিল না সম্রাট সুজং-এর। কিন্তু তাকে কাজটি করতেই হতো। আব্বাসি খলিফা আল মনসুরের কাছে তিনি সহায়তা চাইলেন। ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা ৩ হাজার শক্তিমান আরব যোদ্ধাকে পাঠালেন চীনে। দেশের বৈধ সরকারের সুরক্ষার জন্য, দেশীয় সরকারের আমন্ত্রণে। আরবরা ছিলেন রণনিপুণ ও সমরবিশারদ। তাদের জেনারেলরা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন সম্মিলিত বাহিনীর। সম্রাট সুজং-এর সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল গুও জিয়াই ও লি গুয়াংবি। মুসলিম সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে তাদেরকে যুদ্ধপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনাকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে হলো। তুর্কি তুজুয়ে উপজাতি এবং উইঘুরদের হুইহে বা হুইগে উপজাতির যোদ্ধাদের সহায়তা নেওয়া হয়, যাদের অনেকেই ছিলেন মুসলিম। আব্বাসি বাহিনী যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। কারণ চীনে প্রচলিত স্থানীয় সামরিক সক্ষমতার যেমন দরকার ছিল, তেমনি দরকার ছিল আরো অধিক, আরো ফলপ্রসু রণকৌশল, যা প্রতিপক্ষের ঝুলিতে নেই। মুসলিমরা তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রধান ও অপ্রতিহত সামরিক শক্তি। তখনকার জ্ঞাত বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের সামরিক নৈপুণ্যের ওপর তাদের অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। যুদ্ধ নতুন মাত্রা লাভ করল এবং সম্রাট সুজং এর ময়দান প্রশস্ত হতে থাকল। অব্যাহত জয় পেতে থাকল তার সৈন্যরা। নতুন বাস্তবতায় নেস্টোরিয়ান চার্চ তাং রাজবংশের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করল। মধ্য এশিয়ার গির্জাপতিরা তখন চীনে খ্রিষ্টধর্মের জন্য জমি তৈরির কৌশল সন্ধান করছিল। তারা খ্রিষ্টানদেরকে চীনে ব্যাপক অভিবাসনে উদ্বুদ্ধ করে আসছিলেন। বিশেষত হানদের সঙ্গে আত্মীয়তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করছিলেন। বিদ্রোহের আবহাওয়াকে তারা গভীরভাবে পরখ করছিলেন, যেন ভুল সিদ্ধান্ত থেকে বাঁচা যায়। সেটা থেকে তাঁরা বাঁচতে সক্ষম হলেন এবং বালখের ব্যাক্ট্রিয়ান প্রিস্ট ইসি একজন সামরিক কমান্ডার হিসেবে রাজা সুজং-এর পক্ষে ভূমিকা রাখলেন।

বজ্রযান বৌদ্ধরা যুদ্ধ থেকে দূরেই অবস্থান করছিলেন। ক্ষমতার ভারসাম্য তাংদের দিকে স্পষ্টভাবে ঝুঁকে পড়েছিল। বজ্রযান বৌদ্ধ গুরু আমোভজরা আন লুশান বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন এবং তাং রাজ্যের পক্ষে আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদর্শনের ঘোষণা দিলেন। অচিরেই আন লুশানের সেনাপতি ঝু ঝিগুয়াং মারা গেলেন এবং প্রচার করা হলো আমোভজরার আধ্যাত্মিক আক্রমণ এই হত্যাকে সম্ভব করেছে। আমোঘবজ্রের আচার-অনুষ্ঠান বাড়ানো হলো। যেন এর মাধ্যমে আন লুশানের ক্ষমতা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বৌদ্ধ পুরোহিত গোপন সাংকেতিক চিঠির মাধ্যমে রাজাকে কিছু তথ্যও দিয়েছিলেন বিদ্রোহীদের সম্পর্কে।

যুদ্ধে রাজা সুজং জয়ী হলেন। হারানো শহরগুলো পুনরুদ্ধার হলো। তাং রাজবংশ নতুন শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করল। আব্বাসি খলিফার প্রেরিত তিন হাজার যোদ্ধা চীনে থেকে গেলেন। স্থায়ীভাবে তারা অবস্থান করলেন চীনে। বিয়ে-শাদি করলেন। স্থানীয় ভাষা শিক্ষা করলেন। চীন তাদেরকে অতিথি হিসেবে উচ্চসম্মানে বরণ করল। তারা তাঁদের সংস্কৃতি নিয়ে ছিলেন এবং ইসলামের প্রচারে ভূমিকা রাখছিলেন। সেখানকার শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সামরিকতায় তাঁদের অবদান ও অবস্থান ছিল বলিষ্ঠ।

চীনা রাষ্ট্র এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন ও প্রগতির জন্য তাদের দক্ষতার সহায়তা নিল। অন্যদিকে চীনা সংস্কৃতির সংরক্ষণবাদ এ পরিস্থিতির চাপে পিষ্ট না হবার জন্য ভারসাম্যের নতুন প্রেক্ষাপট রচনা করল। যুদ্ধে সহায়তার জন্য নেস্টোরিয় খ্রিষ্টানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা হিসেবে চার্চগুলোকে বহুমুখী সুবিধা প্রধান করল। রাষ্ট্র ও সমাজে খ্রিষ্টানদের জন্য উদার একটা প্রেক্ষাপট দেওয়া হলো। প্রচারকামী ধর্ম ও সংস্কৃতি হিসেবে ইসলামের সঙ্গে খ্রিষ্টবাদের প্রতিযোগিতাকে নিশ্চিত করা হলো।

এটা জানা বিষয় ছিল যে, প্রাধান্যটা ইসলামের অনুকূলেই থাকবে। ইসলাম চীনের অনেক গভীরে প্রবেশ করবে। কিন্তু এতটুকু সুযোগ না দিয়ে উপায় ছিল না। অপরদিকে চীনা দর্শন, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির আত্মীয় এস্টোরিক বৌদ্ধ ধর্মকে পরিণত করা হয় রাষ্ট্রীয় ধর্মে। বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা, প্রচার, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করা হলো, মঠ ও মন্দির নির্মাণ করা হলো বিপুল উদ্যমে। কারণ আন লুশানকে চূর্ণ করার জন্য বৌদ্ধ ধর্মের আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে চীন ঋণী। আমোঘবজ্র্যের সহায়তার ফলস্বরূপ বৌদ্ধধর্ম চীনের রাষ্ট্রধর্ম হবার সম্মানের যথার্থ দাবিদার। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে চীনা ঐতিহ্যের যৌথতা বিনির্মাণ করা হলো। সেটা করা হলো নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতির স্বাস্থ্য ও মানসিক ভিত্তির সুরক্ষার স্বার্থেই। কারণ কনফুসিয়াস শিখিয়েছেন সমাজ রক্ষা করতে হলে প্রাচীন শিক্ষার ভিত্তি অটুট রাখার বিকল্প নেই।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মুসা আল হাফিজ

কবি, লেখক ও গবেষক

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

কুতাইবার কাছে চীন সম্রাটের আত্মসমর্পণ

প্রকাশ: ০৪:১০:৪৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ জুন ২০২৩

চীনা সভ্যতার প্রতিকূলতা উজিয়ে টিকে থাকার অদ্ভুদ বৈশিষ্ট্য এখানে রাজাকে বিনয়ী করল। তিনি কুতাইবার কাছে পত্র পাঠালেন- ‘আমার কাছে আপনাদের কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে প্রেরণ করুন যেন আপনাদের উদ্দেশ্য ও আপনাদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে পারি।’

ইবনুল আসির জানান, কুতাইবা প্রেরণ করলেন একটি প্রতিনিধি দল। যাদের নেতা ছিলেন হুবাইরা ইবনুল মুশামরাজ কিলাবি। তার সঙ্গে কয়েকজন বিদগ্ধ ভাষ্যকার। সম্রাটের সঙ্গে মোলাকাত হলো তাদের। সম্রাটকে তারা জানিয়ে দিলেন কুতায়বার ঘোষিত প্রতিশ্রুতি- ‘হয় চীনকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে, নয় জিজিয়া বা অধীনতামূলক কর দিতে হবে। নতুবা মুসলিম বাহিনী চীনকে পদানত করবে। রাজপুত্রদের কুতায়বা বিন মুসলিমের আওতায় নেওয়া হবে।

সম্রাটের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ হলো তিন দিনে তিনবার। তাদের অভিব্যক্তি ও প্রতীকগুলো ছিল চীনাদের কাছে হতবুদ্ধিকর, যা তাদের প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক দক্ষতাকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করছিল। প্রথম দিনের সাক্ষাতে তাদের পরনে ছিল সাদা জামা, হালকা গাউন, পায়ে ছিল চামড়ার জুতা, শরীরে আশ্চর্য সুগন্ধি। দ্বিতীয় দিন তারা পরিধান করেন নকশা করা আবা বা অভিজাত বিশত, মাথায় ছিল সুগোল পাগড়ি। তৃতীয় দিন তারা দরবারে এলেন বিশেষ ধরনের সাদা পোশাকে, হাতে ছিল তরবারি ও বর্শা, মাথায় ছিল লোহার বর্মটুপি। সম্রাট জানতে চাইলেন তিন দিনের তিন রকম পোশাকের মর্ম। তারা বললেন প্রথম দিন আমরা যা পরেছি, তা আমরা পরি আপন পরিবারে। দ্বিতীয় দিন পরেছি রাজাদের দরবারে হাজির হবার পোশাক। তৃতীয় দিনের পোশাক পরে আমরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করি। সম্রাট জানতেন কুতায়বার বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম। আর চীনের বাহিনীর বিশালতা মুসলমানদের অজানা ছিল না। সম্রাট মনে করিয়ে দিলেন, সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে বিশাল চীনা বাহিনীকে পরাস্ত করা অসম্ভব। তোমরা বরং ফিরে যাও। নতুবা চীনা যোদ্ধাদের পায়ের তলে পিষ্ট হয়ে মরতে হবে।

হুবায়রা যেন সম্রাটের এমন উক্তির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি মুহূর্তেই জবাব দিলেন প্রবল ভঙ্গিতে। বললেন- যে বাহিনীর এক হাত আপনার সীমান্তে, আরেক হাত জয়তুন বাগানে (বিশ্বশাসনের কেন্দ্রীয় শক্তি দামেশকে), সেই বাহিনীকে হালকা মনে করার দুঃসাহস কে করবে? আপনি আমাদের শুনাচ্ছেন হত্যার গল্প। কিন্তু আমরা তো বিশ্বাস করি নির্ধারিত একটি সময় নিয়ে ইহলোকে আমরা এসেছি। সময় শেষ হলে মৃত্যুকে বরণ করতেই হবে। ফলে মরণে আমাদের কোনো ভয় নেই।

সম্রাট তার সবচেয়ে বড় হুমকি ইতোমধ্যে দিয়ে ফেলেছেন। হত্যার শক্তি ও মৃত্যুর চেয়ে বড় কোনো ভয় দেখাবার ছিল না। কিন্তু সেই ভয়কে তারা ভয়ই মনে করে না। সম্রাটের কাছে এ বাহিনীকে ভীত করার কিছুই ছিল না আর। তিনি মূলত বন্ধুত্ব চাইছিলেন। মুসলিম বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে আপন সাম্রাজ্যকে পারস্য-রোমের পরিণতির দিকে ঠেলে দেবার হুমকি এড়াতে চাইছিলেন। সম্রাট বললেন, তাহলে কী তোমরা চাও, যা পেলে চীন ছেড়ে তোমরা ফিরে যাবে? হুবায়রা বললেন, আমাদের সেনাপতি শপথ করেছেন আপনি হয় ইসলাম কবুল করবেন, নয় জিজিয়া দেবেন। নতুবা তিনি আপনার ভূমিকে পদদলিত করবেন এবং রাজপুত্রদের নিয়ে যাবেন নিজের কব্জায়। সম্রাট বললেন, যেহেতু তিনি শপথ করেছেন, তা পূরণ করব আমি। তিনি স্বর্ণের পাত্র ভরে চীনের মাটি প্রেরণ করলেন কুতায়বার কাছে, যেন তিনি মাটিকে পদপিষ্ট করতে পারেন। নিজের চার সন্তানকেও পাঠালেন তার কাছে, যেন তিনি কব্জায় নিতে পারেন তাদেরকে।

এর পর সন্ধি হলো এবং চীন এড়াতে পারল মুসলিম অভিযানের প্রবল জোয়ারকে। উমাইয়া ও আব্বাসি আমলে চীন মুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন জারি রেখেছে রাষ্ট্রিয়ভাবে।

সপ্তম শতাব্দীর পরে মুসলিম বণিকরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চীনে আসতে থাকে বিপুলভাবে। সেখানকার বড় বড় শহরগুলোতে তারা অভিবাসী হন। বিশেষত গুয়াংজু, কুয়াংজু ও হাংজুর মতো উপকূলীয় বাণিজ্যিক নগরীগুলোতে মুসলিমদের উপস্থিতি ও প্রভাব ছিল ব্যাপক। সেখানে তৈরি হয় বহু মসজিদ। প্রায় ১৩০০ বছর আগে ইয়াংজুতে প্রতিষ্ঠিত হুয়েইশেং মসজিদ চীনে মুসলিম সভ্যতার প্রাচীন উপস্থিতির ঘোষণা করছে। প্রথম দিকে আরব ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা চীনে বসবাস শুরু করলেও ধীরে ধীরে স্থানীয়রা ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকেন। কয়েক শতাব্দীর ধারাবাহিকতায় তা ক্রমবর্ধমান ছিল।

চীনের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয় তাং রাজত্বকালকে। প্রায় তিনশত বছর (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ) অব্যাহত ছিল এই রাজত্বকাল। চীনা রাষ্ট্র, প্রশাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতিতে তাংদের প্রভাব অব্যাহত ছিল উনিশ শতকেও। তাং আমলে মুসলিম সংস্পর্শের পরে চীনে অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন বিশেষ মাত্রা লাভ করে। উমাইয়া ও আব্বাসি খেলাফতের সঙ্গে তাংদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। তাদের সীমান্তবর্তী বিশাল অঞ্চল খেলাফতের অধীনে ছিল। মুসলিমদের সঙ্গে ব্যবসায়িক, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন ছিল তখনকার এক প্রবল বাস্তবতা। তাং রাজাদের সঙ্গে উমাইয়াদের কূটনৈতিক সুসম্পর্ক প্রচারকদের জন্য পথ করে দেয়। সেখানে সামাজিকভাবে ইসলাম প্রচারের সূচনা হয় উমাইয়াদের আমলে। আব্বাসি আমলে সেটা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বরে চীনে বিখ্যাত আন লুশান বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। তিয়ানবাও ক্যাওস নামে পরিচিত এই বিশৃঙ্খলা সেনাবাহিনীর ভেতর থেকে সংগঠিত হয়েছিল। এর সঙ্গে ছিল কথিত ধর্মীয় নেতাদের যোগসাজশ। কমান্ডার বিদ্রোহ হিসেবে সূচিত এই গৃহযুদ্ধ চীনকে ভীষণভাবে বিশৃঙ্খল করে দেয়। সাত বছর দুই মাস ধরে এই বিদ্রোহের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল। আশিনা উপজাতি থেকে উ™ূ¢ত দরিদ্র লুশান রাজা জুয়ানজং-এর আদরে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রভাবশালী জেনারেল হয়ে উঠলেও তিনি রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বিভিন্ন শহর দখল করে লুশান নিজেকে নতুন গ্রেট ইয়ান রাজবংশের সম্রাট ঘোষণা করেন। তার বাহিনী ক্রমেই অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। শহর-জনপদগুলোকে ধ্বংস করতে করতে আন লুশান সমগ্র চীন অধিকারে এগিয়ে চলছিলেন। প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে রাজা ঝুঁড়হম (শাসনকাল : ৭১২-৭৫৬) রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। জনগণ আরো বেশি হতাশ হলো। জনপদ ছেড়ে পালাতে লাগল। প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ল নানা এলাকা। রাজার অব্যাহত পতন, পলায়ন ও পরাজয় তার সৈন্যদেরকে বীতশ্রদ্ধ, হীনমন্য ও বিদ্রোহী করে তুলল। চীনা স্বর্ণযুগ নরকের খাদ্যে পরিণত হতে চলছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রাজা দাঁড়াতে থাকল। এরই মধ্যে জুয়ানজং-এর তৃতীয় পুত্র লি হেংকে সম্রাট বলে ঘোষণা করলেন তার কিছু অনুসারী। লিংউউকে রাজধানী করে রাজা ঝুঁড়হম নাম নিয়ে তিনি জনগণকে আনুগত্যের জন্য আহ্বান করলেন। ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট তিনি রাজা হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন। স্থানীয় কর্মকর্তাদের একটি অংশ তাকে কবুল করল। কিন্তু কর্মকর্তাদের আরেকটি অংশ নানজিং-এ ইয়ং-এর যুবরাজ লি লিনের আনুগত্য করছিল।

বিদ্রোহ ও নৈরাজ্য মোকাবিলার সামর্থ্য ছিল না সম্রাট সুজং-এর। কিন্তু তাকে কাজটি করতেই হতো। আব্বাসি খলিফা আল মনসুরের কাছে তিনি সহায়তা চাইলেন। ৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা ৩ হাজার শক্তিমান আরব যোদ্ধাকে পাঠালেন চীনে। দেশের বৈধ সরকারের সুরক্ষার জন্য, দেশীয় সরকারের আমন্ত্রণে। আরবরা ছিলেন রণনিপুণ ও সমরবিশারদ। তাদের জেনারেলরা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন সম্মিলিত বাহিনীর। সম্রাট সুজং-এর সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল গুও জিয়াই ও লি গুয়াংবি। মুসলিম সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে তাদেরকে যুদ্ধপ্রস্তুতি ও পরিকল্পনাকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করতে হলো। তুর্কি তুজুয়ে উপজাতি এবং উইঘুরদের হুইহে বা হুইগে উপজাতির যোদ্ধাদের সহায়তা নেওয়া হয়, যাদের অনেকেই ছিলেন মুসলিম। আব্বাসি বাহিনী যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। কারণ চীনে প্রচলিত স্থানীয় সামরিক সক্ষমতার যেমন দরকার ছিল, তেমনি দরকার ছিল আরো অধিক, আরো ফলপ্রসু রণকৌশল, যা প্রতিপক্ষের ঝুলিতে নেই। মুসলিমরা তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রধান ও অপ্রতিহত সামরিক শক্তি। তখনকার জ্ঞাত বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের সামরিক নৈপুণ্যের ওপর তাদের অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণ রয়েছে। যুদ্ধ নতুন মাত্রা লাভ করল এবং সম্রাট সুজং এর ময়দান প্রশস্ত হতে থাকল। অব্যাহত জয় পেতে থাকল তার সৈন্যরা। নতুন বাস্তবতায় নেস্টোরিয়ান চার্চ তাং রাজবংশের পক্ষে অবস্থান স্পষ্ট করল। মধ্য এশিয়ার গির্জাপতিরা তখন চীনে খ্রিষ্টধর্মের জন্য জমি তৈরির কৌশল সন্ধান করছিল। তারা খ্রিষ্টানদেরকে চীনে ব্যাপক অভিবাসনে উদ্বুদ্ধ করে আসছিলেন। বিশেষত হানদের সঙ্গে আত্মীয়তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে অনুপ্রাণিত করছিলেন। বিদ্রোহের আবহাওয়াকে তারা গভীরভাবে পরখ করছিলেন, যেন ভুল সিদ্ধান্ত থেকে বাঁচা যায়। সেটা থেকে তাঁরা বাঁচতে সক্ষম হলেন এবং বালখের ব্যাক্ট্রিয়ান প্রিস্ট ইসি একজন সামরিক কমান্ডার হিসেবে রাজা সুজং-এর পক্ষে ভূমিকা রাখলেন।

বজ্রযান বৌদ্ধরা যুদ্ধ থেকে দূরেই অবস্থান করছিলেন। ক্ষমতার ভারসাম্য তাংদের দিকে স্পষ্টভাবে ঝুঁকে পড়েছিল। বজ্রযান বৌদ্ধ গুরু আমোভজরা আন লুশান বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন এবং তাং রাজ্যের পক্ষে আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদর্শনের ঘোষণা দিলেন। অচিরেই আন লুশানের সেনাপতি ঝু ঝিগুয়াং মারা গেলেন এবং প্রচার করা হলো আমোভজরার আধ্যাত্মিক আক্রমণ এই হত্যাকে সম্ভব করেছে। আমোঘবজ্রের আচার-অনুষ্ঠান বাড়ানো হলো। যেন এর মাধ্যমে আন লুশানের ক্ষমতা বিধ্বস্ত হয়ে যায়। বৌদ্ধ পুরোহিত গোপন সাংকেতিক চিঠির মাধ্যমে রাজাকে কিছু তথ্যও দিয়েছিলেন বিদ্রোহীদের সম্পর্কে।

যুদ্ধে রাজা সুজং জয়ী হলেন। হারানো শহরগুলো পুনরুদ্ধার হলো। তাং রাজবংশ নতুন শক্তিতে আত্মপ্রকাশ করল। আব্বাসি খলিফার প্রেরিত তিন হাজার যোদ্ধা চীনে থেকে গেলেন। স্থায়ীভাবে তারা অবস্থান করলেন চীনে। বিয়ে-শাদি করলেন। স্থানীয় ভাষা শিক্ষা করলেন। চীন তাদেরকে অতিথি হিসেবে উচ্চসম্মানে বরণ করল। তারা তাঁদের সংস্কৃতি নিয়ে ছিলেন এবং ইসলামের প্রচারে ভূমিকা রাখছিলেন। সেখানকার শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সামরিকতায় তাঁদের অবদান ও অবস্থান ছিল বলিষ্ঠ।

চীনা রাষ্ট্র এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন ও প্রগতির জন্য তাদের দক্ষতার সহায়তা নিল। অন্যদিকে চীনা সংস্কৃতির সংরক্ষণবাদ এ পরিস্থিতির চাপে পিষ্ট না হবার জন্য ভারসাম্যের নতুন প্রেক্ষাপট রচনা করল। যুদ্ধে সহায়তার জন্য নেস্টোরিয় খ্রিষ্টানদের প্রতি কৃতজ্ঞতা হিসেবে চার্চগুলোকে বহুমুখী সুবিধা প্রধান করল। রাষ্ট্র ও সমাজে খ্রিষ্টানদের জন্য উদার একটা প্রেক্ষাপট দেওয়া হলো। প্রচারকামী ধর্ম ও সংস্কৃতি হিসেবে ইসলামের সঙ্গে খ্রিষ্টবাদের প্রতিযোগিতাকে নিশ্চিত করা হলো।

এটা জানা বিষয় ছিল যে, প্রাধান্যটা ইসলামের অনুকূলেই থাকবে। ইসলাম চীনের অনেক গভীরে প্রবেশ করবে। কিন্তু এতটুকু সুযোগ না দিয়ে উপায় ছিল না। অপরদিকে চীনা দর্শন, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির আত্মীয় এস্টোরিক বৌদ্ধ ধর্মকে পরিণত করা হয় রাষ্ট্রীয় ধর্মে। বৌদ্ধ ধর্মের চর্চা, প্রচার, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করা হলো, মঠ ও মন্দির নির্মাণ করা হলো বিপুল উদ্যমে। কারণ আন লুশানকে চূর্ণ করার জন্য বৌদ্ধ ধর্মের আধ্যাত্মিক শক্তির কাছে চীন ঋণী। আমোঘবজ্র্যের সহায়তার ফলস্বরূপ বৌদ্ধধর্ম চীনের রাষ্ট্রধর্ম হবার সম্মানের যথার্থ দাবিদার। বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে চীনা ঐতিহ্যের যৌথতা বিনির্মাণ করা হলো। সেটা করা হলো নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতির স্বাস্থ্য ও মানসিক ভিত্তির সুরক্ষার স্বার্থেই। কারণ কনফুসিয়াস শিখিয়েছেন সমাজ রক্ষা করতে হলে প্রাচীন শিক্ষার ভিত্তি অটুট রাখার বিকল্প নেই।