আত্মশুদ্ধি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তায় ইদ-উল-আজহা
- প্রকাশ: ০১:০১:০৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ জুন ২০২৩
- / ৩৪২ বার পড়া হয়েছে
বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবারো ফিরে এসেছে পবিত্র ইদ-উল-আজহা। ইদ-উল-আজহা মুসলমানদের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। সারা বিশ্বে মুসলমানরা হিজরি বর্ষের দ্বাদশ মাস জিলহজের ১০ তারিখে ইদ-উল-আজহা বা কোরবানির ইদ উদযাপন করে। মহান আল্লাহতায়ালার আদেশে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নিজ পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর জন্য কোরবানি করার ইচ্ছা ও ত্যাগের কারণে সারা বিশ্বের মুসলমানরা আল্লাহর কাছে নিজেদের সোপর্দ করে দেওয়ার লক্ষ্যে পবিত্র হজের পরদিন ইদ-উল-আজহা উদযাপন ও পশু কোরবানি করে থাকে। আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম (আ.)-এর আনুগত্যে সন্তুষ্ট হন এবং পুত্রের পরিবর্তে তাকে পশু কোরবানি করার নির্দেশ দেন। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সে সুন্নত অনুসরণে ইদ-উল-আজহার সময় মুসলমানরা পশু কোরবানি করেন। ইদ-উল-আজহা প্রতিবছর আমাদের কাছে ঘুরেফিরে আসে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ পশু কোরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশা করে। এই কোরবানির শিক্ষা কী, তা আমাদের জানা দরকার। মনে রাখতে হবে, কোরবানি শুধু পশু জবেহ করা নয়, কোরবানি হলো নিজের ভেতরের পশু সত্তাকে জবেহ করা। তার মানে মনের সব কুপ্রবৃত্তিকে খতম করা। কোরবানির গোশত পেয়ে গরিব-দুঃখী খুশি হয়। কোরবানি করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আনুগত্য ও নির্দেশ মানার শিক্ষা গ্রহণ করে। কোরবানির দিন মুসলমানরা একে অপরের সঙ্গে মহামিলনে মিলিত হয়। এদিন ধনী-গরিব কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবাই সাম্য, ঐক্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে। এতে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি হয়। তাই কোরবানি যাবতীয় আহকাম মেনে খোদাভীতির মানসিকতা নিয়ে কোরবানি করা দরকার। তাহলে আশা করা যায়, আল্লাহর দরবারে আমাদের কোরবানি কবুল হবে। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সমর্থ্য হব।
ইদ-উল-আজহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের কাছে অপরিসীম। আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা ইদ-উল-আজহা বা কোরবানির ইদ পালন করে থাকে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন : ‘আমার কাছে পশুর রক্ত, মাংস, হাড় ইত্যাদি কিছুই পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু তোমাদের অন্তরের তাকওয়া বা ভয়ভীতি।’ আমরা কোরবানির মাধ্যমে কে কতটুকু আত্মত্যাগ, আল্লাভীতির পরিচয় দিচ্ছি এবং আল্লাহর পবিত্র আদেশ কতটুকু পালন করছি, আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন। ধনী-গরিব-নির্বিশেষে বিশ্বের মুসলমানরা আনন্দঘন পরিবেশে ইদ-উল-আজহা পালন করে। এটি মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন মুসলমানরা খুশির এক মোহনায় এসে মিলিত হয়। ইদ-উল-আজহার দিন মুসলমানরা সকালে ওয়াজিব নামাজ আদায় করে। তারপর পশু কোরবানি করে। ইদের নামাজ আদায় ও কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ লাভ করে। ইদুল ফিতরের আমেজ কাটতে না কাটতে আসে ইদ-উল-আজহা। এই ইদের বড় কাজ হলো কোরবানি করা। নেক আমলগুলোর মধ্যে কোরবানি একটি বিশেষ ইবাদত। কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা হয়। আল্লাহর আদেশ থাকার কারণে মুসলমানরা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য এই আদেশ পালন করে। পশু কোরবানি করা মুখ্য বিষয় নয়; বরং আল্লাহভীতিই এখানে মুখ্য বিষয়। তাই ইদ-উল-আজহার গুরুত্ব ও আনন্দ অপরিসীম। উৎসব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ইসলামের দৃষ্টিতে জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাঁথা। তাই ইদ শুধু আনন্দের উৎস নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটাই এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ইদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে।
ইদ-উল-আজহায় যে কোরবানি দেওয়া হয়, তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কারণ কোরবানির রক্ত-গোশত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না; শুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়। এই ইদে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। তাই পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন। এটাই ইদের শিক্ষা ও সার্থকতা। কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামী নিদর্শন ও অন্যতম ঐতিহ্য। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয় বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করাই হলো কোরবানির তাৎপর্য। বস্তুত কোরবানির ইদ বা ইদ-উল-আজহা আমাদের কাছে আত্মশুদ্ধি, আত্মতৃপ্তি ও আত্মত্যাগের এক সুমহান বার্তা নিয়ে প্রতিবছর উপস্থিত হয়। ইদ-উল-আজহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে আমরা সব পাপ, বঞ্চনা, সামাজিক অনাচার, রিপুর তাড়না ও শয়তানের প্রবঞ্চনা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম হব। তাই ইদ-উল-আজহার পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুকেই কোরবানি দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কোরবানির মাধ্যমে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়।
কোরবানির ইতিহাস ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। কোরবানি নামক এ মহান নিদর্শন আদম (আ.)-এর পর থেকে মানবজাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সব শরিয়তেই কার্যকর ছিল। সব নবীর উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছিন্নভাবে কোরবানির ধারাবাহিকতা চলে আসছে তথা সব নবীর উম্মতকেই কোরবানি করতে হয়েছে। প্রত্যেক নবীর উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। মানবসভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোনভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে। এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব।
আমাদের ওপর যে কোরবানির নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর রাহে কোরবানি দেওয়ার অনুসরণে সুন্নাতে ইব্রাহীম হিসেবে চালু হয়েছে। মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহিম ও ইসমাইল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ইদ-উল-আজহা’ বা কোরবানির ইদ। হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু পুত্র ইসমাইলকে তার উদ্দেশ্যে কোরবানি করতে প্রস্তুত ছিলেন, ইদ-উল-আজহার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কোরবানির মাধ্যমে নিজেদের প্রিয়তম জানমাল আল্লাহর পথে কোরবানি করার সাক্ষ্য প্রদান করেন।
হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সেই মহত্ত্ব ও মাকবুল কোরবানিকে শাশ্বত রূপদানের জন্যই আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসুল (সা.) এই দিনে মুসলমানদেরকে ইদ-উল-আজহা উপহার দিয়েছেন এবং কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই কোরবানি হলো চিত্তশুদ্ধির এবং পবিত্রতার মাধ্যম। এটি সামাজিক রীতি হলেও আল্লাহর জন্যই এ রীতি প্রবর্তিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র বিধাতা প্রতি মুহূর্তেই যার করুণা লাভের জন্য মানুষ প্রত্যাশী। আমাদের বিত্ত, সংসার এবং সমাজ তাঁর উদ্দেশেই নিবেদিত এবং কোরবানি হচ্ছে সেই নিবেদনের একটি প্রতীক। কোরবানির মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে রাজি আছে কি-না সেটিই পরীক্ষার বিষয়। কোরবানি আমাদেরকে সেই পরীক্ষার কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আল্লাহর পরীক্ষাও ছিল তাই। আমাদের এখন আর পুত্র কোরবানি দেওয়ার মতো কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় না। একটি হালাল পশু কোরবানি করেই আমরা সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি।
ঈমানের এসব কঠিন পরীক্ষায় যারা যত বেশি নম্বর অর্জন করতে পারেন, তারাই হন তত বড় খোদাপ্রেমিক ও ততই সফল মানুষ এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ততই সফল। ইদের প্রকৃত আধ্যাত্মিক আনন্দ তারা ঠিক ততটাই উপভোগ করতে পারেন যতটা তারা এ জাতীয় পরীক্ষায় সফল হন। কোরবানির পশুর রক্ত মাটি স্পর্শ করার আগেই আল্লাহর কাছে তার সওয়াব গ্রাহ্য হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে কোরবানির সওয়াব গ্রাহ্য হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে, যে অকুণ্ঠ ঈমান আর ত্যাগের মহিমায় উদ্দীপ্ত হয়ে ইবরাহিম (আ.) স্বীয় প্রাণাধিক পুত্রের স্কন্ধে ছুরি উত্তোলিত করেছিলেন, কোরবানির পশুর গলায় ছুরি দেওয়ার সময়ে কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত হতে হবে। কোরবানিদাতার হৃদয়তন্ত্রী যদি সেই ঈমান ও ত্যাগের সুরে অনুরণিত না হয়ে ওঠে, তাদের দেহ আর মনের পরতে পরতে যদি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের আকুল আগ্রহ উদ্বেলিত না হয়, তাহলে তাদের এই কোরবানির উৎসব পর্বেই পর্যবসিত হবে। মূলত কোরবানি হচ্ছে একটি প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহর জন্য বান্দার আত্মত্যাগের একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। কোরবানি থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা বছরই আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় নিজ সম্পদ অন্য মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মনোভাব গড়ে উঠলে বুঝতে হবে কোরবানি সার্থক হয়েছে, কোরবানির ইদ সার্থক হয়েছে। নতুবা এটি নামমাত্র একটি ভোগবাদী অনুষ্ঠানই থেকে যাবে চিরকাল। কোরবানি কোনো লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উৎসব নয়। কোরবানিতে যদি আল্লাহভীতি ও মনের একাগ্রতা না থাকে, তাহলে এই সুবর্ণ সুযোগ বিফল মনোরথ ছাড়া আর কিছুই হবে না।
ইদ-উল-আজহার চিরায়ত শিক্ষা মানুষ মহান আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে, এই শিক্ষাই ইবরাহিম (আ.) আমাদের জন্য রেখে গেছেন। সুতরাং কোরবানির মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিম পরিবারের আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পণ করাই হবে একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। ইদ হোক ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধন। ইদ হোক আনন্দের।