হিজরি নববর্ষ: জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- প্রকাশ: ০২:৫১:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ জুলাই ২০২৩
- / ৪৬৬ বার পড়া হয়েছে
হিজরি সন গণনা ইসলামি সংস্কৃতির অনুসরণ। এজন্য চান্দ্রমাস হিসেবে হিজরি সন গণনা করা মুসলমানদের জন্য কর্তব্য। হিজরি সন ইসলামি ঐতিহ্যের বাস্তব নমুনা, যা নিজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে শেখায়।
আমরা দিন দিন যত আধুনিক হচ্ছি, আমাদের ভেতর থেকে ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির চেতনাবোধ ততটাই হারিয়ে যাচ্ছে। অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে বাঁচা বড় দায় হয়ে গিয়েছে। শরয়ি বিধান এবং ইসলামি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির চেয়েও আমাদের কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে উঠেছে পশ্চিমা বস্তাপচা সংস্কৃতি। আমাদের জীবনে অন্যতম মূল্যায়নযোগ্য বিষয় হলো সময় তথা দিন-তারিখ ও বছর গণনা। কারণ, সময়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের গৌরবময় ইসলামি ঐতিহ্য, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসব এবং আমাদের মূল্যবান ইবাদত বন্দেগি। এজন্য প্রত্যেক মুসলমান ভাইয়ের লক্ষ্য করা উচিত, যেন এই মূল্যবান সময়ের গণনা একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর সম্মানিত রাসুল (সা.) কর্তৃক নির্দেশিত পন্থায় হয়। কিন্তু বিশ্বের সিংহভাগ মুসলমান দিন-তারিখ গণনার ক্ষেত্রে গুরুত্বহীন হয়ে ইউরোপীয় সভ্যতায় বুঁদ হয়ে আছে। সেকারণ, মুসলিম জীবনে দিন-তারিখ গণনায় ইসলামি পদ্ধতি কী এবং এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
মুসলমানদের জীবনে দিন-তারিখ ও বছর গণনা হবে চান্দ্রবর্ষ অনুযায়ী
মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার উপযোগী করে আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন দিন, রাত, মাস, বছর ইত্যাদি। আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন, নিশ্চয় আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাসগুলোর গণনা হলো ১২টি। যার মধ্যে চারটি মাস হলো ‘হারাম’ (মহাসম্মানিত)। এটিই হলো প্রতিষ্ঠিত বিধান। অতএব এ মাসগুলিতে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। আর তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে যুদ্ধ করে। আর জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের সঙ্গে থাকেন। তদুপরি মহান আল্লাহই আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে আমরা এই ১২টি মাসের গণনা করব। মহান আল্লাহ বলেন, তিনিই সেই সত্তা, যিনি সূর্যকে করেছেন কিরণময় ও চন্দ্রকে করেছেন জ্যোতির্ময় এবং ওর গতির জন্য মনজিলগুলো নির্ধারণ করেছেন। যাতে তোমরা বছরের গণনা ও সময়ের হিসাব করতে পার।
আল্লাহ এগুলোকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিদর্শনগুলো সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন বিজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্য। তাফসিরে আল্লামা ইমাম বাগাভী (রহ.) তার গ্রন্থ তাফসিরে বাগাভীতে উল্লেখ করেছেন, ১২ মাস হলো- মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউল আখের, জমাদিউল উলা, জমাদিউল আখেরাহ, রজব, শাবান, রামজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো- মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ।
মহররম: মহররমের অর্থ হলো পবিত্র, সম্মানিত। যেহেতু এটি হারাম মাসের একটি। তাই একে মহররম হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে।
সফর: সফর শব্দের অর্থ খালি হওয়া। কেননা হারাম মাস মহররমের পরে সবাই ঘর ছেড়ে যুদ্ধে বের হতো, তাই একে সফর বা খালি নামে নামকরণ করা হয়েছে।
রবিউল আউয়াল, রবিউল আখের: এ দুই মাস নামকরণের সময় রবি তথা বসন্তকালে এসেছে। তাই এ দুই মাসকে প্রথম বসন্ত ও শেষ বসন্ত অর্থাৎ রবিউল আউয়াল ও রবিউল আখের বলা হয়।
জমাদিউল উলা, জমাদিউল আখেরাহ: জমদ শব্দের অর্থ হলো, বরফ জমাট বাধা। যেহেতু এ দুই মাসে প্রচণ্ড ঠান্ডা আবহাওয়া হওয়ার কারণে বরফ জমাট বাধে, তাই মাসদ্বয়কে জমাদিউল উলা ও জমাদিউল আখেরাহ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
রজব: রজব শব্দের অর্থ সম্মান করা। এ মাসকে সম্মান করে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকা হয়, তাই এ মাসকে রজব নামে নামকরণ করা হয়েছে।
শাবান: এর অর্থ হলো বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হওয়া। যেহেতু হারাম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকার পর আরবরা শাবান মাসে আবার তাদের আক্রমণের জন্য বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হতো, তাই একে শাবান নামে নামকরণ করা হয়েছে।
রামজান: রমজ শব্দের অর্থ-দগ্ধ হওয়া। রামজান মাসে গরমের প্রচণ্ডতার কারণে এ মাসকে রামজান নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ মাসের নাম মহাগ্রন্থ আল কোরআনে উল্লেখ আছে।
শাওয়াল: শাওয়াল শব্দের অর্থ কমে যাওয়া। যেহেতু সে সময়ে আরবদের উটের দুধ নানা কারণে কমে যেত। তাই এ মাসকে শাওয়াল নামে নামকরণ করা হয়েছে।
জিলকদ: কাদা শব্দের অর্থ বসে থাকা। সম্মানিত ও হারাম মাস হওয়ার কারণে আরবরা যুদ্ধ-বিগ্রহে না গিয়ে বসে থাকত। তাই একে জিলকদ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
জিলহজ: জিলহজ শব্দের অর্থ হজওয়ালা। যেহেতু এ মাস হজের মাস। তাই একে জিলহজ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে, চান্দ্রমাস গণনা তথা হিজরি সন গণনা করা শরয়ি বিধান ও মুসলিম ঐতিহ্য অনুসরণ।
চান্দ্রবর্ষ বা হিজরি সন সূচনার ইতিহাস
ইসলামি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক চন্দ্রবর্ষটি বিক্ষিপ্তভাবে গণনা শুরু হয় স্বয়ং রাসুল (সা.)-এর যুগে। তখন আরবে সুনির্দিষ্ট কোনো সাল প্রচলিত ছিল না। বিশেষ ঘটনার নামে বছরগুলোর নামকরণ করা হতো। যেমন বিদায়ের বছর, অনুমতির বছর, হস্তীর বছর, আমুল হুযন অর্থাৎ দুঃখের বছর ইত্যদি। তবে সুশৃঙ্খল ও কাঠামোগত অবয়বপ্রাপ্ত হয় রাসুল (সা.) এর ওফাতের সাত বছর পর, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে। ১৭ হিজরি মোতাবেক ৫৩৮ মতান্তরে ৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। তৎকালীন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) যখন খলিফা হন, তখন অনেক নতুন ভূখণ্ড ইসলামি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাষ্ট্রীয় কাগজপত্র ইত্যাদিতে সাল-তারিখ উল্লেখ না থাকায় অসুবিধা হতো। তখন এর গুরুত্ব বোঝার পর হিজরি সন গণনা শুরু হয়। এর প্রেক্ষাপট ছিল হজরত ওমর (রা.)-এর কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চিঠি আসত। সেখানে মাসের নাম ও তারিখ লেখা হতো। কিন্তু সনের নাম থাকত না। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতো। তখন পরামর্শের ভিত্তিতে একটি সন নির্ধারণ ও গণনার সিদ্ধান্ত হয়। বিভিন্ন উপলক্ষ থেকে সন গণনার মতামত এলেও শেষ পর্যন্ত হিজরতের ঘটনা থেকে সন গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঐতিহাসিক আলবিরুনির বিবরণী থেকে জানা যায়, হজরত আবু মুসা আশ’আরী (রা.) একটি পত্রে উমর (রা.)-কে অবহিত করেন, সরকারি চিঠিপত্রে সন-তারিখ না থাকায় আমাদের অসুবিধা হয়। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে হজরত ওমর (রা.) একটি সাল চালু করেন। আল্লামা শিবলি নোমানী (রা.) হিজরি সালের প্রচলন সম্পর্কে ‘আল-ফারুক’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হজরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ১৬ হিজরি সালের শাবান মাসে খলিফা ওমরের কাছে একটি দাপ্তরিক পত্রের খসড়া পেশ করা হয়, পত্রটিতে মাসের উল্লেখ ছিল; সালের উল্লেখ ছিল না। খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, পরবর্তী কোনো সময়ে তা কীভাবে বোঝা যাবে এটি কোন সালে পেশ করা হয়েছিল? এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর না পেয়ে হজরত ওমর (রা.) সাহাবায়ে কেরাম ও অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের জ্ঞানী-গুণীকে নিয়ে আলোচনা করে মহানবী (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের বছর থেকে সাল গণনা করার সিদ্ধান্তে উপনীত হন। হিজরতের বছর থেকে সাল গণনার পরামর্শ দেন হজরত আলী (রা.)। পবিত্র মহররম মাস থেকে ইসলামি বর্ষ হিজরি সালের শুরু করার ও জিলহজ মাসকে সর্বশেষ মাস হিসেবে নেওয়ার পরামর্শ দেন হজরত ওসমান (রা.)।
হিজরতের বছর থেকেই সন গণনার তাৎপর্য
রবিউল আউয়াল মাসই হিজরি সালের প্রথম মাস হওয়া উচিত ছিল। কেননা এ মাসেই রাসুল (সা.) মদিনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন; কিন্তু রবিউল আউয়ালের পরিবর্তে মহররম মাসকে প্রথম মাস এজন্য করা হয় যে, রাসুল (সা.) মহররম মাস থেকেই হিজরতের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। মদিনার আনসাররা ১০ জিলহজ তাঁর হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং জিলহজের শেষ তারিখে তারা মদিনা মুনাওয়ারায় প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি তাদের প্রত্যাবর্তনের কয়েক দিন পরই হিজরতের ইচ্ছা পোষণ করেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে মদিনায় হিজরতের অনুমতি দেন। এ কারণে মহররমকে হিজরি সনের প্রথম মাস করা হয়েছে। এ ছাড়া ওসমান এবং আলী (রা.) পরামর্শ দেন যে, হিজরি সনের সূচনা মহররাম মাস থেকেই হওয়া উচিত। কেউ কেউ বললেন, রামজানুল মুবারক থেকেই বছরের সূচনা হওয়া উচিত।
ওমর (রা.) বললেন, মহররম মাসই উপযুক্ত মাস। কারণ হজ থেকে মানুষ মহররম মাসেই প্রত্যাবর্তন করে। এর ওপরই সবাই একমত হন। আবার কোনো কোনো ইতিহাসবেত্তা বলেন, সন গণনার আলোচনার সময় প্রস্তাব উঠেছিল, ঈসায়ি সনের সূচনার সঙ্গে মিল রেখে নবীজির জন্মের সন থেকে ইসলামি সনের শুরু হোক। এ রকম আরও কিছু কিছু উপলক্ষের কথাও আলোচিত হয়। কিন্তু হিজরতের সন থেকে সন গণনা চূড়ান্ত হওয়ার পেছনে তাৎপর্য হলো, হিজরতকে মূল্যায়ন করা হয় ‘আল ফারিকু বাইনাল হাক্কি ওয়াল বাতিল’ অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী বিষয় হিসেবে। হিজরতের পর থেকেই মুসলমানরা প্রকাশ্য ইবাদত ও সমাজ গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। প্রকাশ্যে আজান, সালাত, জুমা, দুই ঈদ- সবকিছু হিজরতের পর থেকেই শুরু হয়েছে। এসব তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য করেই মুসলমানদের সন গণনা হিজরত থেকেই শুরু হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সভ্যতা-সংস্কৃতিতে হিজরি সালের গুরুত্ব অপরিসীম।
মুসলিম ঐতিহ্যের অনুকরণ
হিজরি সন গণনা ইসলামি সংস্কৃতির অনুসরণ। এজন্য চান্দ্রমাস হিসেবে হিজরি সন গণনা করা মুসলমানদের জন্য কর্তব্য। হিজরি সন ইসলামি ঐতিহ্যের বাস্তব নমুনা, যা নিজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে শেখায়। মুসলিম হিসেবে আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হলো, আল্লাহর দেওয়া এই বারোটি মাস সম্পর্কে যত্নশীল হওয়া। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবনসহ রাষ্ট্রীয় জীবনে এর যথাসাধ্য প্রয়োগ করা। আল্লাহ আমাদের সেই তৌওফিক দান করুন। আমিন।