বজ্রপাতের কারণ এবং নিরাপদ থাকার উপায়
- প্রকাশ: ১০:১১:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ জুলাই ২০২৩
- / ৫৫৬ বার পড়া হয়েছে
বজ্রপাত নিঃসন্দেহে প্রকৃতির এক ভয়ংকর সুন্দর রূপ। সুন্দর এই অর্থে যে, এমন দৃশ্য মানুষের চোখে বছরের সব সময় দৃশ্যমান হয় না। শুধু বর্ষার আগমনে মৌসুমের শুরুতে মেঘের গর্জন হিসেবে পরিচিত ‘বজ্রপাত’ আমরা দেখতে পাই। বজ্রের গর্জন আর আকাশে চোখ ধাঁধানো স্ফুলিঙ্গ জানান দেয় রিমঝিম বৃষ্টির বার্তা। শীতের শুষ্ক প্রকৃতি যখন রূঢ় আচরণ করে ঠিক তখন বজ্রের গর্জন দিয়ে বৃষ্টি আসে। ইদানীংকালে এই বজ্রপাত আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ালেও অনেকের কাছে এটি বেশ উপভোগ্য। ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া পৃথিবীকে হঠাৎ আলোকিত করে বজ্র যে ডাক দেয় তা শুনে চমকে উঠে হেসে দেন অনেকেই।
২০২১ সালের ৪ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার পদ্মা নদীর পাড়ের একটি ঘাটের ঘরে বিয়ের অনুষ্ঠানে পার্শ্ববর্তী শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা এলাকায় যাওয়ার সময় বজ্রপাতে ৫ জন মহিলাসহ ১৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলে তারা ঘাটেই একটি টিনের দোচালা ঘরে আশ্রয় নেয় এবং ঘরেই তাদের মৃত্যু হয়। তখন বজ্রপাতের এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া, এলাকাবাসী বজ্রপাতে নিহতদের লাশ চুরি ঠেকাতে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে রড সিমেন্ট দিয়ে কবর বাঁধাই এর কাজে নেমে পড়েছিল। বজ্রপাতে কারও মৃত্যু হলে সেই মরদেহ মহামূল্যবান কোনো বস্তুতে পরিণত হয়। এমন ধারণা থেকে দেশে প্রায়ই বজ্রপাতে নিহতদের লাশ চুরির ঘটনা ঘটে এবং সেই আশঙ্কা থেকেই গ্রামবাসীর এই উদ্যোগ নিয়েছিল বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। তবে ঘটনা যাই হোক, বর্তমান সময়ে বজ্রপাতে প্রাণহাণির ঘটনা বেড়েই চলেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই এ ধরনের মৃত্যুর খবর শোনা যায়। ২০২১ সালে মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত চার মাসে সারাদেশে বজ্রপাতে ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালাপুর, নেত্রকোনা ও চট্টগ্রামে বজ্রাঘাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে। তবে বজ্রপাতের হটস্পট হিসেবে ইতোমধ্যে সিরাজগঞ্জ চিহ্নিত হয়েছে।
অন্যদিকে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত বজ্রপাতে সারাদেশে ৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে ১০ জন নারী, ৩ জন শিশু এবং ৬৮ জনই পুরুষ। এ চার মাসে বজ্রাঘাতে ২১ জন আহতও হয়েছেন। বজ্রপাত নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫-২০২০ সালে বাংলাদেশে তিন ধরনের বজ্রপাত সংঘটিত হয়। এক মেঘ থেকে আরেক মেঘে বা আন্তঃমেঘ, একই মেঘের এক স্থান থেকে আরেক স্থান বা অন্তঃমেঘ এবং মেঘ থেকে ভূমিতে। এ সময়ে ওই তিন ধরনের বজ্রপাতের মোট পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫০ লাখ। এগুলোর দৈনিক ও ঋতুভিত্তিক সংঘটনে আবার ভিন্নতা দেখা গেছে। যেমন ২৪ ঘণ্টা হিসাবে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় রাত ৮-১০টার মধ্যে, ১২ শতাংশ। অন্যদিকে ঋতুভিত্তিক বিন্যাসেও বজ্রপাতের ধরনে পার্থক্য রয়েছে।
মার্চ থেকে মে মাসে প্রায় ৫৯ শতাংশ, আর মৌসুমি বায়ু আসার সময়, অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৩১ শতাংশ বজ্রপাত হয়। তবে মোট বজ্রপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় এপ্রিল থেকে জুনে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশে আসার আগের দুই মাসে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে বজ্রপাতের প্রকোপ অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি হয়। বর্ষাকালে রাঙামাটি, সুনামগঞ্জ ও চট্টগ্রাম বজ্রপাত সংঘটনের দিক থেকে প্রথম তিনটি জেলা। শীতকালে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট আর মৌসুমি-উত্তর ঋতুতে রাঙামাটি, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতের কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভূ-পৃষ্ঠের পানি যখন বাষ্প হয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে তখন মেঘের নিচের দিকে ভারী অংশের সঙ্গে জলীয়বাষ্পের সংঘর্ষ হয়। এর ফলে অনেক জলকণা ইলেকট্রন ত্যাগকৃত হয়ে ধনাত্মক চার্জ এ পরিণত হয় এবং অনেক জলকণা সে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়। ডিসচার্জ প্রক্রিয়া সাধারণত তিনভাবে হয়ে থাকে।
যথা- ক. একই মেঘের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ এর মধ্যে। খ. একটি মেঘের ধনাত্মক চার্জ এর সাথে অন্য মেঘের ঋণাত্মক, আবার অন্য মেঘের ধনাত্মক চার্জের সঙ্গে ওই মেঘের ঋণাত্মক চার্জ এর মধ্যে এবং গ. মেঘের পজেটিভ আধানের ও ভূমির মধ্যে (একে ক্লাউড টু গ্রাউন্ড ডিসচার্জিং বলে)। এ চার্জিত জলীয়বাষ্প মেঘে পরিণত হলে মেঘে বিপুল পরিমাণ স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয়। এ সময় অপেক্ষাকৃত হালকা ধনাত্মক আধান মেঘের ওপরে এবং অপেক্ষাকৃত ভারী ঋণাত্মক চার্জ নিচে অবস্থান করে। মেঘে এই দুই বিপরীত চার্জের পরিমাণ যথেষ্ট হলে ডিসচার্জ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ডিসচার্জিংয়ের ফলে বাতাসের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক প্রবাহিত হয়। এ বৈদ্যুতিক স্পার্কের প্রবাহই ‘বজ্রপাত’। কিন্তু সব বজ্র ভূপৃষ্ঠে পড়ে না। শুধু ক্লাউড টু গ্রাউন্ড ডিসচার্জিংয়ের ফলে সৃষ্ট বজ্রই ভূপৃষ্ঠে পড়ে। বজ্রপাতের সময় আমরা যে আলো দেখতে পাই তা মূলত এই সরু চ্যানেলের আয়নিত পরমাণু থেকে বিকীর্ণ শক্তির তীব্র আলোকছটা। এই সরু, আয়নিত ও বিদ্যুৎ পরিবাহী চ্যানেল তৈরির সময় বায়ুর তাপমাত্রা প্রায় ২৭০০০ এবং চাপ প্রায় ১০-১০০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। কিন্তু এই পুরো ঘটনাটি ঘটে এক সেকেন্ডের কয়েক হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ে। এ পরিবর্তন আশপাশের বাতাসকে প্রচণ্ড গতিতে বিস্ফোরণের মতো সম্প্রসারিত করে। এর ফলে প্রবল শব্দ উৎপন্ন হয়। এই শব্দকেই আমরা বজ্রপাতের শব্দ হিসেবে শুনি ও দেখি।
বজ্রপাতের কারণ হিসেবে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বজ্রপাত। তাপমাত্রা যত বাড়বে, বজ্রপাতও তত বাড়বে। তাপমাত্রা গড়ে এক ডিগ্রি বেড়ে গেলে বজ্রপাত ১০ শতাংশ বা তার চয়ে বেশি বজ্রপাত বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইদানীং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এই কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে বজ্রপাতের পরিমাণ। বিদ্যুৎ প্রবাহ মানুষের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয় অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে মানুষ যেভাবে দ্রুত শকড হয়, ঠিক একইভাবে বজ্রপাতেও মানুষ শকড হয়ে মারা যায়। কারণ মানুষের শরীর বিদ্যুৎ পরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। যদি কোনো খোলা স্থানে বজ্রপাত হওয়ার মতো কোনো বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ না থাকে আর সেখানে যদি মানুষ থাকে যার উচ্চতা অন্য বিদ্যুৎ পরিবাহীর চেয়ে বেশি, তাহলে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। সরাসরি মাটিতে সাধারণত বজ্রপাত হয় না। বজ্র বিদ্যুৎ পরিবাহীর ওপর পড়ে। এর পর ওই পরিবাহির মাধ্যমে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উঁচু গাছ, ভবন, পাহাড়ের শীর্ষে সাধারণত বজ্রপাত অধিক হয়। বজ্রপাত একটি আকস্মিক ঘটনা, যা প্রতিরোধ করা অত্যন্ত কঠিন। যদি বজ্রপাত হয়ে যায় তাহলে অনেকের মৃত্যু হতে পারে। আমাদের দেশে সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। বজ্রপাতে মৃত্যু ও হতাহত এড়াতে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। সেগুলো হলো—
- বজ্রঝড় সাধারণত ৩০-৩৫ মিনিট স্থায়ী হয়। এ সময়টুকু ঘরে অবস্থান করুন। অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যেতে হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাবেন, এটি বজ্রঝড় বা বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা দেবে।
- বজ্রপাতের সময় ধানক্ষেত বা খোলামাঠে যদি থাকেন তাহলে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এবং কানে আঙুল দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়তে হবে।
- বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব ভবন বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। ভবনের ছাদে বা উঁচু ভূমিতে যাওয়া উচিত হবে না।
- বজ্রপাতের সময় যেকোনো ধরনের খেলাধুলা থেকে শিশুকে বিরত রাখতে হবে, ঘরের ভেতরে অবস্থান করতে হবে।
- খালি জায়গায় যদি উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ধাতব পদার্থ বা মোবাইল টাওয়ার থাকে, তার কাছাকাছি থাকবেন না। বজ্রপাতের সময় গাছের নিচে থাকা বিপজ্জনক।
- বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া উচিত নয়। সমুদ্র বা নদীতে থাকলে মাছ ধরা বন্ধ রেখে নৌকার ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে।
- যদি কেউ গাড়ির ভেতর অবস্থান করেন, তাহলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ রাখা যাবে না।
- বাড়ির ছাদ কিংবা উঁচু স্থানে অবস্থান করলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। মৌসুমে ঘন কালো (ঝড়মেঘ) মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে এবং বৃষ্টি শুরুর আগে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
- পায়ে রাবারের স্যান্ডেল পরে থাকা এবং পানি ও যে কোনো ধাতববস্তুর যেমন সিঁড়ির বা বারান্দার রেলিং, পানির কল ইত্যাদির স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।
- বিদ্যুৎ পরিবাহী যে কোনো বস্তুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। পুকুর বা জলাশয়ে থাকা নিরাপদ নয়।
- বজ্রপাতে বাড়ির ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র যেগুলো ইলেকট্রিক সংযোগ বা ডিসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা ভালো। এগুলো বন্ধ থাকলেও স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।
বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা বৈদ্যুতিক শকে আহত ব্যক্তিদের মতো। শরীর থেকে দ্রুত বৈদ্যুতিক চার্জ অপসারণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শরীরে ম্যাসাজ করতে হবে। আহত ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণে বিচলিত না হয়ে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বজ্রপাত থেকে নিরাপদ থাকতে হলে সচেতনতার বিকল্প নেই ও বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে তাল গাছ জাতীয় সুউচ্চ প্রজাতির গাছ প্রচুর পরিমাণে খালি জায়গা বা মাঠের মধ্যে লাগাতে হবে।