শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতীয় দর্শন এবং এর প্রভাব
- প্রকাশ: ১০:৫৮:৫১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / ১৪৬০ বার পড়া হয়েছে
শিক্ষা ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক খুবই গভীর। শিক্ষার জগতে ভারতীয় দর্শন ও পাশ্চাত্য দর্শনের ঢের অবদান রয়েছে। শিক্ষা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ education। এই education শব্দটি তিনটি ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে ধরা হয়, যথা এডুকেয়ার যার অর্থ হলো প্রতিপালন করা, educo যার অর্থ হলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এডুকিরি যার অর্থ হলো অঙ্কন করা। অর্থাৎ শিক্ষা হলো সমস্ত প্রক্রিয়ার সমন্বয় যার দ্বারা ব্যক্তি তার সক্ষমতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ সহ সমস্ত রকম চারিত্রিক ও সামাজিক গুণের অধিকারী হয়ে ওঠে এবং যার ফলস্বরূপ ব্যক্তির সর্বোত্তম আত্মপরিস্ফুরণ সাধিত হয়।
এখানে যা আছে
কতিপয় ভারতীয় দার্শনিকের শিক্ষাদর্শন
স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় মানবাত্মার অন্তর্নিহিত উৎকর্ষর সার্বিক পরিস্ফূরণ ই-শিক্ষা। মহান শিক্ষাবিদ পেস্তালোজির মতে মানবাত্মার অন্তর্নিহিত শক্তির স্বাভাবিক মধুর ও প্রগতিশীল বিকাশই হলো শিক্ষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে অন্তরের আলোর সম্পদ শিক্ষা দ্বারা অর্জিত হয় শিক্ষা কে একটি প্রক্রিয়া ধরা হলে শিক্ষা একটি নিরবচ্ছিন্ন জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া যা দ্বারা মানুষ জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে সার্বিক গুণের অধিকারী হয়। শিক্ষাকে উৎপাদন হিসেবে ধরলে শিক্ষান্তে শিক্ষার্থী অর্জিত জ্ঞান দক্ষতা আদর্শ মূল্যবোধ দ্বারা শিক্ষার ফল বিচার করা হয় যা শিক্ষাকে পরিমাপ করতে সাহায্য করে অপরপক্ষে দর্শন শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ philosophy শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ফিলিও ও সোফিয়া এর সমন্বয় তার অর্থ হলো সত্যের প্রতি ভালোবাসা। আসলে দর্শন হলো সত্যের অনন্ত অনুসন্ধান বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে সার্বজনীন জিজ্ঞাসাই দর্শনের লক্ষ্য। মহান দার্শনিক প্লেটোর মতে বহুবিধ বস্তু বা ঘটনার সঠিক প্রকৃতি সম্পর্কীয় জ্ঞান ই দর্শন।
রাধাকৃষ্ণাণ বলেছেন বাস্তবতার যুক্তিসম্মত অনুসন্ধানই দর্শন। দর্শন মানব জীবনের তিনটি বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করে যথা metaphysics বা আধিভৌতিক epistemology বা জ্ঞানতত্ত্ব axiology বা মূল্যবোধের অনুসন্ধান। অনুসন্ধান যুক্তি নান্দনিকতা ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। সুতরাং উদ্দেশ্যগত ভাবেই দর্শন ও শিক্ষা নিবিড় সম্পর্কযুক্ত।
ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষা পদ্ধতি এবং তার সঠিক ইমপ্লিমেন্টেশন-এর ক্ষেত্রে ভারতীয় দার্শনিকগণ যথা বুদ্ধ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ, রাধাকৃষ্ণাণ প্রমুখের অবদান আছে।
প্রাচীন গ্রিস ও পাশ্চাত্যের মহান শিক্ষা দার্শনিকেরা
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সমস্ত সময়কার মহান দার্শনিকেরা তাদের নিজস্ব চিন্তা এবং চেতনা দ্বারা শিক্ষাব্যবস্থার রীতিনীতি ও সেগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে দৃষ্টিপাত করে গেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রাচীন গ্রিসের মহান দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টোটল; তাঁরা শিক্ষাব্যবস্থা ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করে গেছেন। পাশ্চাত্যের মহান দার্শনিক রুশো, কান্ট, হেগেল, জন ডিউই শিক্ষার প্রকৃতি, শিক্ষার লক্ষ্য এবং তার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন।
অবিচ্ছেদ্য বিষয় শিক্ষা ও দর্শন
শিক্ষা এবং দর্শন দুটি অবিচ্ছেদ্য বিষয় কারণ শিক্ষা ও দর্শন ও উভয়ের লক্ষ্যই হলো জ্ঞান এবং উভয় অর্জনের মাধ্যমই হলো ইনকোয়ারি বা অনুসন্ধান। ধারণা নির্মাণ ও তার যথার্থ বাস্তবিক প্রয়োগ দ্বারা শিক্ষা পরিচালিত হয় তাই যথার্থভাবে শিক্ষা প্রয়োগ করতে হলে তার একটি সুনির্দিষ্ট সুচিন্তিত অভিলক্ষ্য থাকা প্রয়োজন। এই অভিলক্ষ্য নির্মাণের কাজটি করে থাকে দর্শন। দর্শন জীবন ও মূল্যবোধের সাপেক্ষে একটি সুস্থির দিশা তৈরি করে যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সুদৃঢ় ও স্থির অভিমুখী করে তোলে। তাই বলা ভালো যে, সুস্থির দর্শন ছাড়া শিক্ষা অন্ধ আর সুস্থির শিক্ষা ছাড়া দর্শন অচল।
জন ডিউই যথার্থই বলেছেন, শিক্ষা হলো দর্শনের পরীক্ষাগার যেখানে সমস্ত দার্শনিক সত্যতার যথার্থতা পরীক্ষিত হয়। তাই দর্শনের কাজ হলো জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক গুণাবলী নির্দেশনার পথ স্থির করা আর শিক্ষার কাজ হলো সেই পথে চলে জীবনকে উৎকর্ষ থেকে উৎকর্ষতর করে তোলা। একটি মুদ্রার দুই পিঠ হলো শিক্ষা আর দর্শন। দর্শনের পিঠটি হলো চিন্তাশীল শিক্ষার পিঠটি হলো সক্রিয়। সুতরাং পরিশেষে বলা চলে যে, শিক্ষা এবং দর্শন দুটি পৃথক বিষয় নয় এটি একত্র করে যে শিক্ষাদর্শন ভাবনা করা হয়েছে সেটি যথার্থ।
শিক্ষার চার মৌলিক বিষয় এবং দর্শন
কোনো শিক্ষা ভাবনার বা শিক্ষা তত্ত্বের যে দ্বন্দ্ব ও ভ্রান্তিগুলো আছে সেগুলো দূর করা শিক্ষাদর্শনের অন্যতম কাজ। শিক্ষা দর্শন মানুষকে সক্ষম করে তোলে যার দ্বারা সে প্রচলিত ব্যবস্থা ও নীতিগুলির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করতে শেখে। শিক্ষাতত্ত্বগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধারণা উপলব্ধিগুলোকে বাস্তবতা দান করে শিক্ষাকে সময় উপযোগী করে তোলা শিক্ষা দর্শনের অন্যতম কাজ। শিক্ষা পদ্ধতি চারটি মৌলিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যথা—
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
- শিক্ষক
- শিক্ষাক্রম
- শিক্ষার্থী
এই চারটি মৌলিক বিষয় নিজেদের মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থেকে শিক্ষার লক্ষ্যকে পূর্ণতা দেয়। আর এই চারটি বিষয়কে একত্রিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উপযুক্ত শিক্ষা দর্শনের।
একটি যথার্থ সমাজদর্শনই পারে শিক্ষার ধারণা শিক্ষা পরিকল্পনাকে সুশৃংখল করে তুলতে দার্শনিক রীতিনীতি এবং দার্শনিকদের মৌলিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ উচ্চশিক্ষা এই রীতি-নীতিগুলো আশ্রয় করে অতীতের সমস্ত সম্পদ ও ঐতিহ্যকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য যা দার্শনিক চিন্তা ভাবনা দ্বারাই সম্ভব। শিক্ষাদর্শন একটি সামগ্রিক দর্শন যা শিক্ষাকে সুশৃংখল ও সুস্থির অভিমুখী করে তোলে শিখন ব্যবস্থাকে উপলব্ধি করা এবং তার উন্নতি সাধন করা শিক্ষা দর্শনের মৌলিক লক্ষ্য।
শিক্ষাব্যবস্থার চারটি মৌলিক উপাদানকে শিক্ষাদর্শন নিম্নলিখিতভাবে পরিশীলিত ও যথার্থ করে তোলে—
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো একটি সামাজিক সংস্থা যা শিক্ষার মূলাধার। শিক্ষা দর্শন মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পদগুলোর পুনস্থাপন করা যা পূর্বপুরুষ দ্বারা অর্জিত। এগুলির পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয় যেমন ভাষা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে যা তাদের বোধকে প্রাথমিক স্তর থেকে অন্তিম স্তরের দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। আর এই জ্ঞান অর্জন পর্বের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পাঠক্রম যা উপযুক্ত ও যথার্থ শিক্ষাদর্শন দ্বারা গঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষাঙ্গনে প্রতিটি শিশু তার সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্তব্যবোধ নীতিবোধ এবং তার চরিত্র ও মানসিক গঠন পাশাপাশি শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রগুলির প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল হওয়া আবশ্যক বলে বিবেচনা করবে। এ থেকেই তার মনে সাম্যের অধিকার ও সামাজিক ভাবনাগুলি বিকাশ পাবে যা তাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। বিদ্যালয় এর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি উপযুক্ত শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী নাহলে এই শিক্ষার লক্ষ্যগুলো কোনো রূপেই যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হওয়া অসম্ভব।
শিক্ষক
শিক্ষক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ হলো শিক্ষক। ই-লার্নিং ব্যবস্থায় শিক্ষকের গুণগতমানের ও তার দৃষ্টিভঙ্গি ও সামগ্রিক ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তন সাধিত হলেও শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিক্ষক একাধারে প্রশিক্ষক, নির্দেশক বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। শিক্ষাব্যবস্থায় তিনিই নেতা, তার নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী উপযুক্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। একজন যথার্থ শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে ও শ্রেণীকক্ষের বাইরে তার উপযুক্ত নেতৃত্ব দান ও কর্ম প্রয়াসের মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে এমন কার্যক্রম নির্ধারণ করে যে যার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা সানন্দে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাধ্য হয়। শিক্ষকের সে কারণেই প্রয়োজন যথার্থ দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকার।
শিক্ষাদর্শন শিক্ষককে সমর্থ করে তোলে যার দ্বারা সে তার নিজস্ব কর্মকাণ্ডের পরিধি, সীমা, লক্ষ্য, যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে আগে থেকেই অবগতি লাভ করতে পারেন। শিক্ষার্থীর শিক্ষার লক্ষ্য, শিখন পরামর্শ এবং শিখন কর্মকাণ্ড শিক্ষক দ্বারাই পরিচালিত হয়। কিন্তু তিনি কখনোই শিক্ষার্থীকে চাপ বা স্ট্রেস প্রদান করবেন না যাতে শিক্ষার্থীর শিক্ষা সম্পর্কে ভ্রান্ত ভয়ের শিকার হয়ে সে ব্যবস্থা থেকে ফিরে আসে শিক্ষকের নিজের গুণেই জ্ঞান-বুদ্ধি বিকশিত হবে এবং তার শিক্ষার্থী দ্বারা প্রয়োগে রূপান্তরিত হবে সম্মত সুস্থির পরিকল্পনা শিক্ষককে শিক্ষার্থীর শারীরিক মানসিক ও সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে। শিক্ষাদর্শন শিক্ষককে উৎসাহিত করবে। শিক্ষক নিজেকে সর্বজ্ঞ না ভেবে শিক্ষার্থীর সাথে একই আনন্দে শেখার লক্ষ্যে ব্রতী হবে। পরিস্থিতি এবং সময়ের সঙ্গে উপযোগী শিক্ষা শিক্ষক দ্বারাই পরিচালিত হয়। শিক্ষক, পাঠক্রম ও শিক্ষার্থীর সুস্থির সমন্বয় দ্বারাই শিক্ষার লক্ষ্য সাধিত হয়, তাই শিক্ষককে শিক্ষা, শিখন দর্শন অবশ্যই জানা প্রয়োজন এবং তা অনুযায়ী তাকে শ্রেণিকক্ষ পরিচালিত করা একান্ত কর্তব্য বলে মেনে নিতে হবে।
একজন শিক্ষক তিনি যদি মনে করেন যে তিনি পারবেন তবে তিনি প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত শিক্ষা প্রদান করতে পারবেন কিন্তু তিনি যদি মনে করেন তিনি পারবেন না তবে শিক্ষার সামগ্রিক লক্ষ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তাই শিক্ষাদর্শন শিক্ষককে সামগ্রিক পরিস্থিতি ও শিক্ষার্থী সম্পর্কে উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়নের সাহায্য করবে।
শিক্ষাক্রম
শিক্ষাক্রম বা পাঠক্রম হলো শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যে সুনির্দিষ্ট শিক্ষাদর্শন সম্মত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাদের শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় তা পাঠক্রমে সুপরিকল্পিতভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। এর ব্যাপ্তি শ্রেণিকক্ষ, শ্রেণীকক্ষের বাইরে উভয় জায়গাতেই সুবিন্যাস্ত থাকে। ক্রমিক ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী উভয়ই পাঠক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
শিক্ষার লক্ষ্য বিষয়বস্তু ও শিক্ষা পদ্ধতি, শিখন পদ্ধতি ও তার মূল্যায়ন পাঠক্রমের দ্বারাই সুস্পষ্ট হয়। শিক্ষার লক্ষ্য বলতে পাঠক্রম দ্বারা দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী উভয় লক্ষ্যই কার্যকরী করা হয়। তাই জ্ঞান ও বোধ অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনে প্রয়োগ ও দক্ষতার দিকেও পাঠক্রমের যথেষ্ট নজর থাকে। পাঠক্রমে শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা সংক্রান্ত যাবতীয় পদ্ধতির ক্রমান্বয়ে উন্নতি পরিলক্ষিত হয় বলা হয়। পাঠক্রমের মধ্যদিয়েই শিক্ষা দর্শনের উপযুক্ত প্রতিচ্ছবি শিক্ষাঙ্গনে পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষার্থী এই পাঠক্রম দ্বারা শিক্ষকের সাহায্যে শিক্ষাঙ্গনে যেমন ভবিষ্যতে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে তেমনই উপযুক্ত মানুষ হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী হলো শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাধিক সজীব উপাদান। শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রে থাকে ছাত্র তাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক ও বিদ্যালয় এর যাবতীয় কার্যাবলী আবর্তিত হয়। বৈদিক শিক্ষায় বা প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থাই শিক্ষার্থী ছিল কেবলমাত্র শ্রোতা, কিন্তু দিনে দিনে শিক্ষার্থীকে কর্মক্ষম ও সক্রিয় করে তোলার যাবতীয় উপাদান শিক্ষাব্যবস্থায় আমদানি করা হয়েছে। আর তাই প্রকৃতির মাঝে শিক্ষা, হাতে-কলমে শিক্ষা বা সক্রিয়তা ভিত্তিক শিক্ষা ক্রমে ক্রমে প্রসার লাভ করেছে।
শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিটি প্রচ্ছদে শিক্ষার্থীর মনে ও চিন্তাই যদি সুস্থির শিক্ষা দর্শনের ছাপ পরিলক্ষিত না হয় তবে শিক্ষার্থীর যে সামাজিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটে তা শিক্ষা এবং সমাজ উভয়ের পক্ষে ক্ষতিকর। জ্ঞানের প্রতি জিজ্ঞাসা বা জ্ঞানের পিপাসা সত্যানুসন্ধান এগুলো দর্শনের মূল লক্ষ্য। শিক্ষার্থীর মনে এই লক্ষ্য গুলি স্থাপিত করা একান্ত প্রয়োজন। উপযুক্ত শিক্ষা দর্শন তাই একজন শিক্ষার্থীকে যেমন ভবিষ্যৎ জীবনে কর্মের অনুসন্ধানে সাহায্য করে, তার পাশাপাশি জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে বাস্তব ধারণা তাকে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপযোগী করে তোলে। এখানেই শিক্ষা দর্শন এর উপযোগিতা।
মূল্যবোধ, নীতিশিক্ষা, জীবনবোধ, কর্মক্ষমতার পাশাপাশি বিজ্ঞান, সাহিত্য, অঙ্ক, ইতিহাস-ভূগোল, অঙ্কন ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থী নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শেখে। শিক্ষার্থীর ভেতরকার যে লুকিয়ে থাকা জ্ঞান জিজ্ঞাসা তা বাস্তবে পরিস্ফুটিত হয় তাই শিক্ষাঙ্গনে অসমর্থ শিক্ষার্থী ও একটু পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের প্রতি যে মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা ফুটে ওঠে তার পরিস্ফূরণ ঘটে শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হিসাবে।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে শিক্ষাব্যবস্থার উপযুক্ত লক্ষ্য ও উন্নতি সাধনের জন্য শিক্ষার যথার্থ বাস্তব প্রয়োগের জন্য শিক্ষাদর্শন অনস্বীকার্য। তাই দর্শনের অন্যান্য শাখার থেকেও দর্শনের শিক্ষাদর্শন শাখার উপযোগিতা ও ব্যবহার বর্তমানে সর্বাধিক। এই শিক্ষা দর্শনের লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর সার্বিক বিকাশ যা শিক্ষার লক্ষ্য তাকেই বাস্তবে সুচিন্তিত মতামতের দ্বারা দিশা স্থাপন করান।
ভারতীয় শিক্ষাদর্শন আসলে কেমন দর্শন?
ভারতীয় শিক্ষা দর্শন সম্পর্কে জানার আগে আমাদের ভারতীয় দর্শনের ভিত্তি অর্থাৎ বেদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বেদ বৈদিক যুগে মূলত আর্যদের দ্বারা বিভিন্ন মনিষীদের অর্জিত জ্ঞান, উপলব্ধি মূলত দার্শনিক চিন্তা ভাবনার ভিত্তিতে আকরগ্রন্থ বলা যায়। বেদের মূলত চারটি ভাগ ঋক্, সাম, যজু ও অথর্ব। মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ এই দুটি অংশের সমন্বয়ে বেদ গঠিত। মন্ত্রের যে সমন্বয় বা সমষ্টি তাকে সংহিতা নাম দেওয়া হয়েছে। আর বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনা বা যজ্ঞ, পূজা-পার্বণ প্রভৃতির জন্য যে নিয়ম লেখা আছে তাকে ব্রাহ্মণ নাম দেওয়া হয়েছে। জীবনের শেষ ভাগ শান্তিময় জীবন তার কথা বলা আছে আরণ্যকে। আর আরণ্যক তথা বেদের সংশোধন পরিসমাপ্তি সমষ্টি একে উপনিষদ নাম দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও আমরা মীমাংসা এবং বেদান্ত বলে দুটি গ্রন্থের কথা পাবো। মীমাংসা সাধারণত প্রথাগত ধারণাগুলো অর্থাৎ ধর্মীয় উপাচার সম্পর্কে বলা আছে। আর বেদান্ত সেখানে কিছু আধ্যাত্মিক উপলব্ধির কথা বলা আছে। ভারতীয় দর্শন বা ভারতীয় শিক্ষা দর্শন এর সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বুঝতে গেলে আমাদের প্রথম যে বিষয়গুলির কথা মাথায় রাখতে হবে সেটা হচ্ছে দর্শন যে শব্দটি এটি একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে প্রত্যক্ষভাবে দেখা। দর্শন শব্দের অর্থ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের থেকে ভারতীয় দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর।
পাশ্চাত্য দর্শনে বৌদ্ধিক উপলব্ধির কথা জোর দিয়ে বলা হলেও ভারতীয় দর্শনে আত্মার উপলব্ধির উপরে সর্বাধিক জোর দেওয়া হয়েছে। যার মূলগত অর্থ হচ্ছে সত্য এবং বুদ্ধি এই দুটির প্রত্যক্ষ অবলোকন বা দর্শন। ভারতীয় দর্শন কে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একটি হচ্ছে আস্তিক দর্শন আরেকটি হচ্ছে নাস্তিক দর্শন।
আস্তিক দর্শন দু’প্রকার একটি হচ্ছে বেদ নির্ভর দর্শন, আরেকটি হচ্ছে বেদ নিরপেক্ষ দর্শন, এখানে বেদের পরোক্ষ প্রভাব বর্তমান। নাস্তিক দর্শনে বেদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো প্রভাবই বর্তমান নেই। বৈদিক দর্শনের মধ্যে মীমাংসা এবং বেদান্ত এই দু’প্রকার দর্শন পরে। আর বেদ নিরপেক্ষ দর্শনের মধ্যে সাংখ্য, যোগ, ন্যায় ও বৈশেষিকা এই দর্শনগুলো পরে। নাস্তিক দর্শনের মধ্যে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন পড়ে। পরবর্তীকালে যে সমস্ত দর্শনগুলো এসেছে সেগুলি এসমস্ত দর্শনের সমন্বয়েই গঠিত।
ভারতীয় দর্শনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো নিম্নরূপ—
- প্রত্যক্ষ উপলব্ধি: বৈদিক যুগে বিভিন্ন ঋষি মনীষীরা তাদের প্রতিদিনকার বাস্তব উপলব্ধি থেকে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করতেন। জীবনের প্রকৃতি, জন্ম, মৃত্যু এবং বিভিন্ন জাগতিক ও মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য ও তার সত্য অনুসন্ধান করার জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোই ছিল একমাত্র পথ। প্রতিটি দর্শনেই গুরুর বাস্তব উপলব্ধি দ্বারা জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
- চার্বাক: চার্বাক দর্শন ছাড়া প্রতিটি দর্শনেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। ঈশ্বরের অস্তিত্ববাদ ভারতীয় দর্শনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বৈদিক দর্শনের পাশাপাশি জৈন ও বৌদ্ধ এই দর্শনগুলোতেও অস্তিত্ব সরাসরি স্বীকার করা হয়েছে।
- সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক: ভারতীয় দর্শনের প্রত্যেকটি ধারা একই সাথে এগিয়ে গেলেও এদের মধ্যে সুস্থির পার্থক্য এবং সুন্দর সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বর্তমান। একে অপরের উত্তরণের পথে কখনো বাধা সৃষ্টি করেনি। আবার ভিন্ন ভিন্ন দর্শন বা মত অবলম্বনকারী মানুষদের মধ্য প্রত্যক্ষ কোনো সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।
- যুক্তিনির্ভর: প্রত্যেক দর্শন মতে যুক্তিনির্ভরতা একটা মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। যুক্তির দ্বারা বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করে পৃথিবীর বিভিন্ন সমস্যা ও জীবনবোধকে ব্যাখ্যা করার মাধ্যম হিসেবে দর্শনকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
- আত্মার অস্তিত্ব: ভারতীয় দর্শনে আত্মার অস্তিত্ব বরাবরই বিদ্যমান। এখানে আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের জন্য আত্মাকে একটি চরম পর্যায়ে উন্নীত করার উদ্দেশ্যে জীবনের লক্ষ্য অর্জিত হয়।
- অজ্ঞতাই দুঃখের কারণ: ভারতীয় দর্শনে চার্বাক দর্শন ছাড়া সব ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে যে, মানুষের অজ্ঞতাই হলো মানুষের দুঃখের কারণ। এই দুঃখ তিন রকম হতে পারে—একটি আধ্যাত্মিক, একটি আধিভৌতিক, আরেকটি আধিদৈবিক। মানুষের উপলব্ধি শ্রবণ, মনন ও নিদ্বিধায়াসন দ্বারা। জাগতিক চাওয়া-পাওয়া বা বন্ধন থেকে মুক্তির ঘটনাকে মোক্ষলাভ বলা হয়েছে।
- ঔদার্য: ভারতীয় দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ভারতীয় দর্শন উদার মানসিকতার ধারক ও বাহক।
- আত্মোপলব্ধি: যেকোনো দর্শনের মতো ভারতীয় দর্শনেও আত্ম-উপলব্ধিকে গুরুত্বপূর্ণ।
- ঘটনাই মূখ্য: দর্শন মতে কার্যকারণ সম্পর্ক পৃথিবীর সমস্ত ঘটনার মুখ্য কারণ। যদি কোনো ঘটনা ঘটে জানতে হবে তার একটি কারণ আছে। তবে ফলের আশা করে কর্ম করা ঠিক নয়। ভারতীয় দর্শনের আরেকটি প্রধান উপাদান হলো নীতিবোধ ও মূল্যবোধের উপর এখানে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।
- সম্যক উপলব্ধি: ভারতীয় দর্শন মতে অজ্ঞতা বা কোনো বিষয় সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি না থাকলে মানুষ দুঃখ কষ্টের শিকার হয়। এবং এই দুঃখ-কষ্টের থেকে তাকে বের হতে গেলে প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে তাকে কোনোো বিষয় সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে হবে।
- পুনর্জন্মে বিশ্বাস: ভারতীয় দর্শন পুনর্জন্ম মতে বিশ্বাসী অর্থাৎ মানুষ এজনমে যেমন কাজ করে যাবে পরজন্মে সেই কাজের ফলস্বরূপ তার জন্ম নিতে হবে।
- আত্মার চরম মুক্তি: ভারতীয় দর্শনের গভীরতা সুনিবিড়। মানুষের স্বাভাবিক জীবন ধারণ থেকে তার আত্মার চরম মুক্তি বা অজানা সমস্ত তথ্যের সত্য উদ্ঘাটন এসবের মধ্যেই নিহিত আছে ভারতীয় দর্শনের মূল্যবোধ।
- মোক্ষ: ভারতীয় দর্শন মতে মানুষের যে গুনগুলি বা চাওয়া-পাওয়াগুলো থাকে সেগুলি হচ্ছে অর্থ, কাম, ধর্ম এবং মোক্ষ। ধর্ম ও মোক্ষের আত্মিক মূল্য বর্তমান, আর বাস্তবিক মূল্য অর্থ ও কামের বর্তমান।
আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন যার নেতৃত্বে ছিলেন ডেলর ১৮৯৬ সালে শিক্ষা সংক্রান্ত যে রিপোর্টটি পেশ করেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে শিক্ষার মূলত চারটি স্তম্ভ আছে প্রথমত learning to know দ্বিতীয়তঃ learning টুডু তৃতীয়তঃ learning to লিভটুগেদার চতুর্থত learning to be। ভারতীয় দর্শনে এই বিষয়গুলি কেই মূলত উল্লেখ করা হয়েছে জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, সহযোগ ও আত্মানমরিদ্ধি।
প্রমা ও অপ্রমা
ভারতীয় দর্শনের মুল বক্তব্যগুলিকে অান্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বসহ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী জ্ঞান দু’রকমের প্রমা ও অপ্রমা। ভারতীয় দর্শনে বৈধ জ্ঞানকে প্রমা বলা হয় যা অনুভব ও স্মৃতি দ্বারা গঠিত হয়। আর অপ্রমা—সমস্যা, ভ্রম ও যুক্তির সমন্বয়ে গঠিত হয়।
ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী জ্ঞানের ধারণা নির্মাণ এর ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে ন্যায় তত্ত্বের কথা আলোচনা করব। ন্যায় তত্বের উদ্ভাবক ঋষি গৌতম। বাস্তব সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান অর্জন এবং সঠিক চিন্তা এই দুটি হলো ঋষি গৌতমের ন্যায় তত্ত্বের ভিত্তি।
বাস্তবতার নিরিখে ক্ষেত্রে বহুবস্তুবাদী বাস্তবতাকে স্বীকার করে। বাস্তবতার আধার হিসেবে যে বস্তুগুলোকে এখানে ধরা হয়েছে তা হলো পৃথিবী, অপ, তেজ, বায়ু, আকাশ, কাল, দিক, আত্মা, মন। এই তত্ত্ব মতে জ্ঞানের উৎসগুলো হলো উপলব্ধি, অনুমান, তুলনা ও পরীক্ষণ। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো দ্বারা তাৎক্ষণিক জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াকে উপলব্ধি বলে। উপলব্ধি দুই প্রকার একটি লৌকিক অপরটি অলৌকিক। বাক্য ও মানস বা মন দ্বারা যে উপলব্ধি অর্জিত হয় তাকে লৌকিক উপলব্ধি বলে। নির্বিকল্প, সবিকল্প এবং প্রত্যয় অভিজ্ঞতা দ্বারা লৌকিক উপলব্ধি অর্জিত হয়। প্রত্যক্ষ সংযোগ ছাড়া নির্বিকল্প এবং প্রত্যক্ষ সংযোগ দ্বারা সবিকল্প অর্জিত হয়। কোনো বিষয়ের ভাষাগত অর্থ উদ্ধারকে প্রত্যয়াভিজ্ঞা বলে। আর সাধারণভাবে অপ্রচলিত মাধ্যম দ্বারা অর্জিত উপলব্ধিকে অলৌকিক উপলব্ধি বলে। সামান্য লক্ষণ, জন লক্ষণ ও যোগজা দ্বারা এটি অর্জিত হয়। জ্ঞান অর্জনের পর যে বিশেষ বোধ অর্জিত হয় তাকে অনুমান বলে। কারণ অনু শব্দের অর্থ হচ্ছে আগে এবং মান শব্দের অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। ঋষি গৌতম এর মতে, অনুমান তিন রকমের পুরাভাত, শেষাভাত, সময়তদ্রষ্টা। তুলনা বা সামান্যীকরণ পদ্ধতিতে পুরাভাত, বাতিলকরণ প্রক্রিয়ায় শেষাভাত, অন্তরের সমর্থনে সময়তদ্রষ্টা অর্জিত হয়। এই দর্শন মতে নিজের উপলব্ধিকে স্বার্থ এবং অপরের উপলব্ধিকে পরার্থ বলা হয়। তুলনা পর্বের শেষে সাক্ষ্য বা শব্দ যেটা আসলে verbal knowledge তা অর্জিত হয়। এটি দু’রকমের দ্রষ্টা ও অদ্রষ্টা। এই দর্শন মতে শিক্ষার লক্ষ্য হলো— অনুমান, যুক্তি তর্ক প্রভৃতি বিষয়ে সক্ষমতা অর্জন, সৃজনশীল চিন্তন, সঠিক বোধের দ্বারা মূল্যবোধ অর্জন করা, বাস্তব বস্তুর সঙ্গে জ্ঞানকে একত্রিত করা, যথার্থ জ্ঞান ও বাস্তবোচিত জ্ঞানকে একত্রিত করা। ন্যায় তত্ত্বমতে পাঠক্রম সব সময় জীবনের মূল্যবোধ এবং বাস্তব ধারণা নির্ভর হওয়া প্রয়োজন। বস্তু ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত উপলব্ধি দ্বারাই পৃথিবীকে জানা সম্ভব। এই দর্শন মতে শিক্ষক যে পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দান করবেন তা মূলত বক্তৃতা পদ্ধতি, আলোচনামূলক পদ্ধতি এবং সংশ্লেষ ও বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতিতে হওয়া উচিত।
সাংখ্য দর্শন
ভারতীয় দর্শনের আরেকটি অনন্য ধারা হলো সাংখ্য দর্শন। সাংখ্য দর্শনের উদ্ভাবক মহাঋষি কপিল। তার মতে ইহজগৎ পুরুষ ও প্রকৃতি এই দ্বৈত সত্ত্বা দ্বারা গঠিত। পুরুষ ও প্রকৃতির সমন্বয়ে মহৎ বা বুদ্ধি বা অহংকারের সৃষ্টি হয়। অহংকার তিন ধরনেরঃ সত্য, রজঃ এবং তমঃ। মন, বোধ ও শারীরবৃত্তীয় অঙ্গ সঞ্চালন দ্বারা জ্ঞান অর্জিত হয়। ইহজগতের সচেতন সত্তাকে পুরুষ এবং অসচেতন সত্ত্বাকে প্রকৃতি বলা হয়। তারা মহৎ বা বুদ্ধি দ্বারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। পঞ্চভূত কে তমঃ এবং গুণগুলোকে রজঃ বলা হয়। ইহজাগতিক ঘটনাসমূহের কারণ হলো পুরুষ এবং তার বাস্তব বা প্রত্যক্ষ ফল হলো প্রকৃতি। এই প্রকৃতি দ্বারাই বহুবিধ ও গুণাবলী বাস্তবে প্রকাশিত হয়। জ্ঞানের উৎস হলো উপলব্ধি, অনুমান ও আক্ষরিক পরীক্ষণীয় বস্তু সামগ্রী। যথার্থ জ্ঞান উদ্দেশ্য বা প্রমতা, বিধেয় বা প্রমেয়া ও জ্ঞানের উৎস অর্থাৎ প্রমাণ এই তিনের সমন্বয়ে গঠিত হয়। উপলব্ধি দু’রকমের আলোচনা এবং বিবেচনা। বিশ্লেষণ সংশ্লেষণ বা কোনো তথ্যকে মনে মনে অনুধাবন করে বিবেচনা বা বস্তুর প্রত্যক্ষ ধারণা করা হয়। আর বস্তুর সরাসরি অনুধাবন কে আলোচনা বলা হয়। অনুমান দু’রকমের বিতঃও অবিতঃ। চিরন্তন হ্যা বোধক প্রতিজ্ঞা দ্বারা বিত কে শনাক্ত করা হয়। চিরন্তন না-বোধক প্রতিজ্ঞা দ্বারা অবিতঃ কে শনাক্ত করা হয়। পূর্ব পর্যবেক্ষণ দ্বারা যে বিত লাভ হয় তাকে পুরাভাত বলে। বর্তমান বাস্তব অভিজ্ঞতা দ্বারা যে বিত অর্জিত হয় তাকে সময়তদ্রষ্টা বলে। অবিতা কে কখনো কখনো শেষাভাত বলা হয়। এই দর্শন মতে প্রমাণ বা শব্দ হিসাবে লৌকিক ও বৈদিক সমস্ত শ্রুতি ও বেদ নির্ভর লেখাগুলিকে ধরা হয়ে থাকে। আত্ম অনুভূতি এই দর্শন মতে জ্ঞান অর্জনের প্রধান উৎস। বৌধিক উৎকর্ষ বৃদ্ধি সংবেদন অঙ্গের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি বৃদ্ধি এই দর্শন মতে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য।
পরিশেষে বলা যায় এই দর্শন মতে quality of life অর্থাৎ জীবনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি শিক্ষার লক্ষ্য।
যোগ (ইয়োগা)
পরবর্তী ভারতীয় দার্শনিক মতবাদটি হলো যোগ। ঋষি পতঞ্জলি এর প্রবক্তা। সাংখ্য দর্শনের সঙ্গে এর বহুবিধ মিল আছে। বলা ভাল সাংখ্যদর্শনের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ হলো যোগ। এই দর্শন মতে উপলব্ধি দু’রকমের নির্বিকল্প ও সবিকল্প। কোনো বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা কে নির্বিকল্প বলে, এরপর যে মানসিক বিশ্লেষণ চলে তাকে সবিকল্প বলে।
২৫ টি উপাদান দ্বারা মানুষের জ্ঞান অর্জিত হয় এই দর্শন মতে তা ধরা হয়। এই ২৫ টি বিষয়ের মধ্যে প্রকৃতি, মহৎ, অহংকার, মন, ইন্দ্রিয়, পাঁচটি তন্মন্ত্র বা বাহ্যিক উপাদান এবং পাঁচটি gross এলিমেন্ট বা মূল উপাদান এবং পুরুষ আছে। পুরুষ, প্রকৃতি এবং ঈশ্বর মিলে মহৎ বা বুদ্ধি তৈরি হয়। ইন্দ্রিয়, অঙ্গ ও মন দ্বারা অহংকার বা জ্ঞান অর্জিত হয়। এই অর্জিত জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ তন্মন্ত্র বা বাহ্যিক উপাদানের মাধ্যমে ঘটে। এই দর্শন মতে জ্ঞানের উৎসগুলো হলো মন, ইন্দ্রিয়, চালন অঙ্গ। মানসিক বিশ্লেষণ দ্বারা নিজেকে মডিফাই বা উৎকর্ষ বিধান করাই হলো শিক্ষার উদ্দেশ্য। এভাবেই অর্জিত হয় সঠিক জ্ঞান বা প্রমা। তৎপরতা বা প্রয়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি এই দর্শনের মূল নীতি। দৈহিক উন্নতি ও মানসিক প্রগতি যোগ দর্শন এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আত্ম-উপলব্ধি শিক্ষার শেষ লক্ষ্য। নীতি প্রশিক্ষণ মানসিক ও শারীরিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির কর্মশালা শিক্ষার একটি মাধ্যম হিসেবে এ ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়। activities বা সক্রিয়তা মূলক কর্মসূচির মাধ্যমে পাঠদান এক্ষেত্রে শিক্ষাদানের প্রধান পন্থা।
চার্বাক দর্শন
ভারতীয় দর্শনের একটি ভিন্নতর ধারা হলো চার্বাক দর্শন। চার্বাক দর্শন বেদনির্ভর দর্শন নয়। এই দর্শনের স্রষ্টা বৃহস্পতি। এই দর্শনে জ্ঞানতত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্দ্রিয় দ্বারা বাস্তব বা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি এই দর্শন মতে জ্ঞানের একমাত্র উৎস। জ্ঞান অর্জনে অনুমান, কথ্য প্রবচন, তুলনা প্রভৃতির কোনোো ভূমিকা নেই। ইন্দ্রিয় দ্বারা বাস্তব উপলব্ধি একমাত্র প্রকৃত জ্ঞানের উৎস। অন্য উৎসগুলি সুপরিকল্পিতভাবে যুক্তি দ্বারা পরীক্ষিত হওয়া বাধ্যতামূলক। দর্শন মতে মহাবিশ্বের উৎপত্তির কারণ ব্যাখ্যায় পার্থিব বস্তু, বাস্তব যুক্তির অবতারণা করা হয়। কোনো কাল্পনিক বা অবাস্তব সত্তা যেমন ঈশ্বর, কর্মফল, পুনর্জন্ম ইত্যাদির অস্তিত্ব এই দর্শন বিশ্বাস করে না। এই দর্শনের মূল বৈচিত্র হলো এটি ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না কারণ ঈশ্বরকে বাস্তবে ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করা যায় না। চার্বাকপন্থীদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায় ভগবানের উৎস যদি না থাকে তবে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা কে বা এই মহাজগতের সৃষ্টিকর্তা কে? তবে তার উত্তর হিসেবে তারা বলে থাকেন যে পৃথিবী বা এই মহাবিশ্ব চারটি মূল উপাদান দ্বারা গঠিত উপাদানগুলো হলো বায়ু, জল, আগুন এবং পৃথিবী। এই দর্শন মতে চারটি ভুতে সমগ্র মহাবিশ্ব গঠিত। মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পূর্ণ একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। ঈশ্বরের মতো তারা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। তাদের মতে চেতনা বা সংজ্ঞা এই চারটি ভুতের সঠিক অনুপাতে মিশ্রণ দ্বারাই অর্জিত হয়।
যেহেতু আত্মায় বিশ্বাস করেনা সুতরাং তারা মুক্তির কথাও ভাবে না। জীবন একটি, এখানে পুনর্জন্মের কোনো অস্তিত্ব নেই। একজন্মেই তারা বিশ্বাস করে সার্বিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ ভোগ করে যাওয়াই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য। এই ভোগ সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার নিজের উপরে। ভারতীয় দর্শনসমূহের যে মূল বৈশিষ্ট্য ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এই চারটি বিষয়ের উপরে পুরুষার্থ নির্ভর করে, কিন্তু চার্বাক দর্শন মতে কেবলমাত্র কাম এবং অর্থের ভূমিকা বর্তমান। পরবর্তিকালে কোনো কোনো চার্বাক দার্শনিক ধর্মকে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছেন। চার্বাক দার্শনিকেরা একটু অন্যভাবে মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। এই ভিন্নতর ভোগ নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য অধিকাংশ দার্শনিকেরাই তাদের মতকে গ্রহণযোগ্যতা দেননি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে চার্বাক দর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়, যেমন বর্তমানকালে বিগ ব্যাং তত্ত্ব দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে যে যান্ত্রিক উপায়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশেষিকা দর্শন
বৈশেষিকা দর্শনের প্রবক্তা হলেন কণাদ। ন্যায় দর্শনের সঙ্গে এই দর্শনের অনেক মিল আছে। এই দর্শন মতে অজ্ঞতাই দুঃখের কারণ। বাস্তব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জনই দুঃখ থেকে মুক্তির পথ। এই দর্শন মতে জ্ঞানের উৎস হলো উপলব্ধি ও অনুমান। লৌকিক উপলব্ধি সাধারণ মাধ্যম দ্বারা অর্জিত হয়, মাধ্যমগুলির বাস্তবতা আছে। যখন অপ্রচলিত মাধ্যম দ্বারা উপলব্ধি অর্জিত হয় তাকে অলৌকিক উপলব্ধি বলে এটি আত্মা বা বোধ দ্বারা অর্জন করা হয়। লৌকিক উপলব্ধি 6 রকমেরঃ দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শ, স্বাদ, ঘ্রাণ ও আভ্যন্তরীণ বা মানসিক। অলৌকিক উপলব্ধি সামান্য লক্ষণ, জনলক্ষণ ও যোগজা দ্বারা অর্জিত হয়। এই বিষয়গুলি ন্যায়দর্শনে আলোচিত হয়েছে। অনুমান পর্যায়ে কারণ অনুসন্ধানকে হেতু বা পক্ষ বলে এই কারণের সঙ্গে সার্বজনীন সত্যতার সম্পর্ক স্থাপনকে সাধ্য বলে। বোধকে বা যে জ্ঞান অর্জন হয় তাকে সাধনা বলে।
অনুমান দ্বারা যে যুক্তিনির্ভর জ্ঞান অর্জিত হয় বা বোধ অর্জিত হয় তাকে ব্যপ্তি বলে। মধ্যম ও মুখ্যের সঙ্গে সম্পর্ক সর্বদা অপরিবর্তনশীল এবং শর্ত নিরপেক্ষ হবে। এক্ষেত্রে পক্ষ গৌণ, সাধ্য মুখ্য এবং সাধনা মধ্যম পদ। ব্যাপ্তি দু’রকমের যথা স্বার্থ ও পরার্থ।
অদ্বৈত দর্শন
ভারতীয় দর্শনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ অদ্বৈত বেদান্ত। দ্বৈত শব্দের অর্থ এখানে দুটি ভিন্ন সত্ত্বা উদ্দেশ্য ও বিধেয়, আত্মা ও ব্রহ্ম। অদ্বৈত শব্দের অর্থ হলো অভিন্নতা অর্থাৎ আত্মা ও পরম ব্রহ্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উপনিষদ অনুসারে আত্মার মধ্যেই পরমাত্মা বা পরমাত্মার মধ্যে আত্মা একাত্ম হয়ে থাকে। অদ্বৈত দর্শন মতে আত্মা ও পরমাত্মার কোনো মূল পার্থক্য নেই। জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যক্তির মধ্যে ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। পঞ্চভূতে শক্তি নিহিত হয়ে মায়া বা ভ্রমের সাহায্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তৈরি করে। পারস্পরিক তুলনার মধ্যে মায়ার যেমন অস্তিত্ব আছে কিন্তু অসীম থেকে চিন্তা-ভাবনা করলে এই মায়ার কোনো বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই। আর এই মায়ার জন্যই ব্যক্তির মধ্যে তৈরি হয় ইগো, কালগত পার্থক্য, অজ্ঞতা, ভ্রম, ইচ্ছা ও কর্মগত প্রভেদ। আত্মপ্রত্যয় দ্বারা আত্মা আদি ও অকৃত্রিম সত্ত্বাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। আর এভাবেই আত্ম অনুভূতির মাধ্যমে মোক্ষলাভ সম্ভব হয়। এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় অমোঘ সত্য ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। জগতের বহুত্ববাদের যে ভুল ধারণা তা দূর করার প্রধান পথ ব্রহ্মজ্ঞান অর্জন। অনেকে মনে করেন অদ্বৈত বেদান্তের স্রষ্টা শংকরাচার্য। এর বহু আগেই উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র বা ভাগবত গীতা প্রভৃতি গ্রন্থে অদ্বৈতবাদের কথা বলা আছে। যজ্ঞবাল্ক, উদ্দালক আরুণি, অষ্টবক্র, গৌড়পদ প্রমুখ ব্যক্তিরা অদ্বৈত বেদান্তের কথা বলে গেছেন বহু আগেই।
শঙ্করাচার্য্য যুক্তি ও পুঁথিগত ধারণার ভিত্তিতে অদ্বৈত মতবাদকে সুদৃঢ় করেছেন। অদ্বৈতবাদ অনুসারে জ্ঞানার্জন ছটি প্রমাণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রমাণগুলি হলো উপলব্ধি, অনুমান, উপমান বা তুলনা, শব্দ, অর্থপত্তি ও অনুপলব্ধি। শংকর উপলব্ধি, অনুমান ও শব্দের উপরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। লিখিত গ্রন্থ হিসাবে বেদকে শব্দ হিসেবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সঠিক জ্ঞান বা অস্তিত্বের তিনটি মাত্রা বর্তমান পরমার্থিক বা পরম সত্য, জাগতিক সত্য প্রতিভাষিক সত্ত্বা। কারণ বা যুক্তি নির্ধারণ ছাড়া জ্ঞান অর্জন ক্ষতিকর। কিন্তু কারণ বা যুক্তির থেকেও এখানে অনুভব বা অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। স্পষ্টতই অদ্বৈত বেদান্ত মতে আত্মার উপলব্ধি জ্ঞানার্জনের সঠিক পথ। জ্ঞানের লক্ষ্য এখানে ব্যক্তির ভিতর লুকিয়ে থাকা পরমাত্মার প্রকাশ ঘটানো মাত্র। শিখন পদ্ধতি বক্তৃতামুলক। বাহ্যিক উপলব্ধির তুলনায় আন্তরিক বা অন্তরের উপলব্ধি এবং অন্তরের উৎকর্ষ সাধনই এখানে শিক্ষার মূল লক্ষ্য। বিশিষ্ট অদ্বৈত বেদান্ত হিন্দু দর্শনের বেদান্ত শাখার একটি অদ্বৈতবাদী উপশাখা; রামানুজ এই মতবাদের প্রধান প্রবক্তা। বিশিষ্ট অদ্বৈত বেদান্তের মতে জগত, জীবাত্মা ব্রহ্ম থেকে ভিন্ন হলেও ব্রহ্ম’ থেকেই উদ্ভূত এবং সূর্যের সঙ্গে সূর্য রশ্মির যে সম্পর্ক ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের ও জীবাত্মার ও সেই সম্পর্ক্। জগত ও ব্রহ্ম এক হয়েও রূপে অনেক। প্রস্থানত্রয়ী নামে পরিচিত গ্রন্থ ত্রয় যথা উপনিষদ, ভগবত গীতা ও ব্রহ্মসূত্র বিশিষ্টাদ্বৈত মতবাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ, এগুলি বেদান্তের অন্যান্য শাখার ও প্রধান গ্রন্থ হওয়ায় বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদী গ্রন্থগুলোর বক্তব্য উক্ত মতের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ব্যাখ্যা করেন। বিশিষ্ট অদ্বৈত বেদান্তের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই মতবাদ আদি শঙ্কিরাচার্য্য’র মায়াবাদকে খন্ডন করে। শঙ্করাচার্য্য জগতকে মায়া আখ্যা দিয়ে তাকে মিথ্যা বলেছিলেন। রামানুজের মতে জগতও যেহেতু ব্রহ্মের সৃষ্টি তাই তা মিথ্যা হতে পারে না। জাগতিক মাধ্যমে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষকরণ বিশিষ্ট অদ্বৈত মতে জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান লক্ষ্য। এই দর্শন মতে জ্ঞান অর্জিত হয় উপলব্ধি, বাস্তবিক অনুমান ও স্বতঃ লব্ধ ব্রহ্ম জ্ঞান দ্বারা। যদি বাস্তব ও অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে কোনো সেতুবন্ধন না থাকে তবে বাস্তব জ্ঞান সংশয়ে পরিণত হবেই। এই দর্শনে এই মতবাদকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে নেয়া হয়েছেয়্। শঙ্করের মতে ব্যবহারিক সত্য ও পরমার্থিক সত্যের মধ্যে কোনো সেতুবন্ধন নেই। রামানুজ এই ধারণাকে পরিবর্তন করেন বাস্তব অনুধাবন বিজ্ঞান ও দর্শনের সমন্বয়ে সঠিক জ্ঞান অর্জিত হয়। এই সমন্বয় মানুষের মধ্যে ব্রহ্মের অস্তিত্ব উপলব্ধিতে নিয়ে আসে। ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা ও ব্রহ্ম অনুভবের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে অর্জিত জ্ঞান সর্বদা বাস্তবকে নির্ভর করে অর্জিত হয়।
সত্য হলো জ্ঞানের অন্যতম প্রধান শর্ত। তাই ব্রহ্মকে উপলব্ধির জন্য ধর্ম ভূত, জ্ঞান এবং সমস্ত রকম যুক্তিনির্ভর নিয়ম পৃথক সিদ্ধ বিশেষণ এবং ব্যাকরণ গত নিয়ম যথা সমানাধিকরণ বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি তথা সৎকার্য বাদ প্রভৃতির একত্রীকরণ করেন। এই দর্শন মতে যদি জ্ঞান অবিদ্যা দ্বারা অর্জিত হয় এবং কর্ম দ্বারা পৃথক পথে চালিত হয় তবে তা খারাপ। জ্ঞান অর্জন ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক সাধারণ-অসাধারণ, আধিভৌতিক সমস্ত সত্তাকে একত্রিত করে অতিপ্রাকৃত চেতনা অর্জন করা উচিত। কর্ম বা অবিদ্যা থেকে জ্ঞান মুক্ত হলে তা মানুষকে ব্রহ্ম’ অনুভবে দিকে ধাবিত করে। সঠিক জ্ঞানের দ্বারাই তখন মানুষের মধ্যে বিচারবোধ তৈরি হয়। কর্ম এবং বাহ্যিক জগতের সঙ্গে মতের আদান-প্রদানের দ্বারা জ্ঞান অর্জনের দিকে ধাবিত হয়। উদ্দেশ্য ও বিধেয় এই দুজনের সহ-সম্পর্ক দ্বারা জ্ঞান তৈরি হয় আমরা আমরা চিত্ত অস্তিত্ব এই দুইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন সম্ভব এটা ধরতে পারি।