অ্যালিনা মোর্স মাত্র ৯ বছর বয়সেই সফল উদ্যোক্তা
- প্রকাশ: ০৮:০০:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৯ মার্চ ২০২১
- / ৭৪০ বার পড়া হয়েছে
অন্ট্রাপ্রেনর, যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কিত একটি প্রভাবশালী ম্যাগাজিন, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে মেক্সিকো, রাশিয়া, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিলিপাইন্স এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বিভিন্ন দেশেও বেশ জনপ্রিয়। এই ম্যাগাজিনেরই প্রচ্ছদে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল মাত্র ৯ বছরের এক শিশু যা ছিল অন্ট্রাপ্রেনরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন। মেয়েটির নাম অ্যালিনা মোর্স। উন্নত দেশগুলতে দেখা যায় অনেকেই কম বয়সে ব্যাবসায়-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন কিন্তু অনেকের মতেই এই অ্যালিনা মোর্সই হলো বিশ্বের ইতিহাসে সবথেকে কম বয়সী সফল উদ্যোক্তা যার হাত ধরে চিনি বিহীন ললিপপ ‘জলিপপ’ নাম ধারণ করে পৌঁছে যায় ভোক্তাদের কাছে।
অ্যালিনা মোর্স মাত্র ৯ বছর বয়সেই সফল উদ্যোক্তা
অ্যালিনা মোর্স কে?
অ্যালিনা মোর্স একজন আমেরিকান সফল উদ্যোক্তা। তাকে সবথেকে কম বয়সী সফল উদ্যোক্তা হিসেবে ধরা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের উলভারিনে ২০০৫ সালের মে মাসে জন্ম নেওয়া মেয়েটি ২০১৪ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে লিকুইড ওটিসি এলএলসি (জলিক্যান্ডি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সে এখন (২০২১) একটি স্কুলের শিক্ষার্থী।
অ্যালিনা মোর্স কীভাবে শিশুকালেই উদ্যোক্তা হলো?
২০১৪ সালের কথা। ৯ বছরের স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী অ্যালিনা মোর্স একদিন বাবার সাথে কোন এক বিষ্ময়কর জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিল। অ্যালিনা মোর্স ও তার বাবার সাথে আরও একজন ছিলেন সেই যাত্রায়। সাথে ছিলেন একজন পথ নির্দেশক (গাইড)। তারা হাটছিল, এমতাবস্থায় তাদের সামনে এসে ধরা দেন একজন চকলেট বিক্রেতা। গাইড অ্যালিনার কাছে জানতে চাইলেন যে, সে চকলেট বা সাকার/ললিপপ খেতে চায় কি না। ললিপপ হলো কাঠিযুক্ত চুষে খাওয়া যায় এমন শিশুপ্রিয় মিছরি। গাইড যখন অ্যালিনার কাছে ললিপপ খাবার ইচ্ছের ব্যাপারে জানতে চাইলেন তখন তা শুনে বাবা অ্যালিনাকে নিষেধ করলেন এবং শান্ত আদর মাখা স্বরে বুঝিয়ে বললেন, ‘মিছরি খাওয়া তোমার জন্য উচিত্ হবে না কারণ চিনি দাঁতের জন্য অনেক ক্ষতিকর’। কথাটি সোজা গিয়ে বিচক্ষণ কন্যা এলিনা মোর্সের মগজে টোকা দিয়ে ভাবনায় ফেলে দেয়। বাবা তাকে কেন বারণ করল? বাবা কী সত্যি বলেছে কিনা, এটিতো অনেক সুস্বাদু, শিশুদেরও অনেক প্রিয় তবে বাবা এমনটা কেন বলছে?
ফিরে আসার মুহুর্তে মেয়েটা গাড়িতে বাবাকে প্রশ্ন করে ফেলে যে, ‘ড্যাড, তুমি তো বলেছ ললিপপ ক্ষতিকর কিন্তু এত স্বাদের জিনিসটি একটু ভিন্নভাবে তাঁরা বানাতে পারতেন না?’ বাবা সহজ উত্তর দিলেন, ‘মিছরিতে চিনি থাকবেই, চিনি ছাড়া এটা বানানো সম্ভব নয়’। কিন্তু অ্যালিনা আবার বললো ‘ড্যাড, একটু ভেবে দেখো না ওটার স্বাদ ঠিক রেখে ক্ষতিকর উপাদান বাদ দিয়ে বানানো সম্ভব কি না। এই বিচক্ষণ প্রশ্নট এবং আইডিয়াটি বাবাকেও বেশ ভাবিয়ে তোলে। মেয়েটির ইচ্ছে ছিল সে ভিন্ন উপাদান দিয়ে একই রকম একটি সাকার বা ললিপপ বানাবে যা কারো উপকার বৈ ক্ষতি করবে না আর মা-বাবারাও এই মিছরি বা ক্যান্ডিটি তাদের শিশু সন্তানদের হাতে তুলে দিতেও আপত্তি করবে না। ফলে বাচ্চারাও তাদের আবদারকৃত বস্তুটি পেয়ে বেশ কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। সত্যি কথা হলো। সে ওই মিছরি খুবই পছন্দ করত এবং কিছুতেই না খাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারত না। যার কারণে এই ভিন্নধর্মি আইডিয়া মাথায় আসলো। কিন্তু তখনই কি সে বা তার বাবা জানতো যে এই আইডিয়াই একদিন এতটা উঁচুতে নিয়ে আসবে?
এরপর অ্যালিনা যখনই কোনো দোকানে যেত তখনই সেখানে জিজ্ঞেস করত যে, সেখানে চিনি বিহীন ললিপপ বা চুষে খাওয়ার মিছরি আছে কি না যদি না থাকে তাহলে জানতে চায়, কেউ তার মতো করে এরকম চিনি বিহীন ললিপপ চায় কি না। অ্যালিনার বাবা মা যখনই দেখলেন সন্তান চিনি বিহীন ললিপপের প্রতি খুবই আগ্রহী হয়ে পড়ছে। তখন তাঁরাও এবার গুরুত্ব দিলেন এবং মেয়েকে সাহায্য করা শুরু করলেন। মেয়েকে তাঁরা বিভিন্ন ডেন্টিস্টদের কাছে গেলে, গেলেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শকের কাছে, সাথে ইন্টারনেট তো ছিলই। এভাবেই বাবা, মা ও ছোট্ট অ্যালিনা নিজেদের প্রয়োজনে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করে।
কিছুদিনের মাথায় সে বাবা-মায়ের সহযগিতায় প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দেয়। অ্যালিনা মিশিগান ব্লুমফিল্ড পাহাড়ে অবস্থিত স্কচ এলিমেন্টারি পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী। সে পড়াশোনায়ও খুব মনযোগী থাকার কারণে ললিপপ নিয়ে কাজ করার জন্য স্কুলের সময় বাদ দিয়ে বাকি সময়কে তিনটি ভাগে ভাগ করে নেয়।
ভাগ ১: ললিপপ নিয়ে কাজ করার জন্য
ভাগ ২: পড়াশোনার জন্য
ভাগ ৩: ছোটো বোন লোলার সাথে খেলা করার অন্যসব কিছুর জন্য।
অ্যালিনা পরামর্শকদের থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভর করে বাবা ও মাকে নিয়ে তার পছন্দের ফল আঙ্গুর ও কমলাসহ বিভন্ন রকম ফলের ফ্লেভার কীভাবে ললিপপে ব্যবহার করা যায় তা পরীক্ষামূলক প্রচেষ্ঠায় সফল হয়।
নামকরণ
পরীক্ষামূলকভাবে বানানো ললিপপগুলো থেকে প্রথম দিকে যাদেরকে স্বাদ পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয় তাঁদের মধ্যে একজন ছিল লোলা, অর্থাৎ অ্যালিনা মোর্সের ছোটো বোন। বলা হয়ে থাকে প্রথমেই খেতে দেওয়া লোলাকে। লোলারও ললিপপ খুব পছন্দ। লোলার অনেক মিছরি বা ললিপপ মুখে নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। লোলা তখনও ঠিক করে উচ্চারণ শিখে উঠতে না পারায় এই ললিপপকে সে উচ্চারণ করলো ‘জলিপপ’। ‘জলিপপ’ শব্দটি অ্যালিনার খুব পছন্দও হলো। নতুন এই বিশেষ ললিপপটির প্রোডাক্ট নাম হিসেবে সে নির্বাচন করে ‘জলিপপ’। কোম্পানির নাম হলো লিকুইড ওটিসি এলএলসি যার ব্র্যান্ড নাম ‘জলিপপ্স’
প্রচারণার প্রথম দিক ও ব্যাবসায়ের শুরু
নিজের পরিবারের সদস্যরা যখন এই জলিপপের স্বাদ গ্রহণ করে সন্তুষ্ট হলো তখন আশেপাশে থাকা লোকজনের কাছে বিতরণ করা শুরু করলো। অ্যালিনা মোর্স তার বন্ধু ও নিকটাত্মীয়দের কাছে প্রচার করে। বন্ধু ও নিকটাত্মিয়রা এর খুব প্রশংসা করে যা অ্যালিনা মোর্স ও তার পরিবারের জলিপপ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। সকলের প্রশংসা ও শুভ কামনা নিয়ে আরও বেশ কিছু জলিপপ বানিয়ে আকর্ষণীয় প্যাকেটের মাধ্যমে ভোক্তা আকর্ষণের জন্য কয়েকটি পাইকারি বাজারে এবং খুচরা দোকানে ছেড়ে দেওয়া হয়। নতুন বাজারে আশা বিশেষ রকমের পদ্ধতি অবল্পম্বন করে বানানো জলিপপ ভোক্তারাও বেশ ভালো ভাবেই লুফে নিয়েছে। এরপর বাবাকে সাথে নিয়ে পণ্যের প্রচারেরর জন্য বিভিন্ন প্রচারণামূলক কর্মসূচির আয়োজন করে এবং আরও কিছু খাবারের পাইকারি বাজারে ও বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারদের নিকট স্যাম্পল সহ বিক্রি করে। বর্তমানে জলিপপ্স আমেরিকার একটি মাল্টি-মিলিয়োনিয়ার-কোম্পানি।
পণ্য
অ্যালিনা মোর্সের উদ্ভাবিত এবং উৎপাদিত ক্যান্ডিই এখন আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বিক্রিত ক্যান্ডি। তাঁর ক্যান্ডিগুলো যেসব নামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তা হলো- জলিক্যান্ডি (ZolliCandy), জলিপপ্স (Zollipops), জলি ড্রপ্স (Zolli Drops), জ্যাফি ট্যাফি (Zaffi Taffy), জলি ক্যারামেলজ (Zolli Caramelz)।
কোথায় বিক্রি হয়?
স্থানীয় বিভিন্ন দোকান ও বিশ্বের মাথাতোলা ই-কমার্স ওয়েবসাইটে। এটা এখন আমেরিকার বাইরে অনেক দেশেই পাওয়া যায়। চাইলে আপনিও জলিপপ্সের পণ্য বিক্রি করতে পারেন, এর জন্য প্রাথমিকভাবে একটি অনলাইন ফরম পূরণ করতে হবে।
গণমাধ্যমে গুরুত্ব ও হোয়াইট হাউসের আমন্ত্রণ
অ্যালিনা মোর্সের এই উদ্ভাবনীর গল্প চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে অনেক খ্যাতি অর্জন করে যা ২০১৫ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সাথেই প্রচার করা হয়। পুরস্কারস্বরূপ এই মেয়েটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে সম্মানিত জায়গা দুইবার হোয়াইট হাউসেও আমন্ত্রণ পেয়েছিল তৎকালীন ফার্স্টলেডি মিশেল ওবামা কর্তৃক।
জলিস মিলিয়ন স্মাইলস ইনিশিয়েটিভ
আমেরিকাতে শিশুদের দাঁতক্ষয় রোগ একটি অন্যতম এনডেমিক যার বিরুদ্ধে লড়াই করছে অ্যালিনা মোর্সের প্রতিষ্ঠান।
সফল মানুষের কাছ থেকেই শোনা যায় যে, যদি কেউ সফল হতে চায় তাহলে তা যেকোনো ভাবেই সম্ভব, তবে দরকার শুধুই ইচ্ছে শক্তি ও সঠিক পথে থাপে থাপে চলতে থাকা। এখানে যুক্তি আছে। কিন্তু যারা সফল হতে পারেনি তাঁদের মধ্যেও এমন অনেক আছেন যারা সফল মানুষদের কথামত ঠিক পথেই হেঁটেছেন। কিন্তু আপনি যদি অ্যালিনা মোর্সের কথা ভাবেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, এখানে পরিশ্রমের চেয়ে যা রয়েছে তা হলো একটি সুন্দর, অদ্বিতীয় এবং জনকল্যানকর একটি আইডিয়া। ছোট্ট একটি মেয়ে কি এমন পরিশ্রম করতে পারে? বা সে কি নিজে থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে বিভিন্ন পরামর্শকের কাছে গিয়েছে? না, এখানে মূলত অ্যালিনার আইডিয়াকে শ্রদ্ধা করে ওর বাবা ও মা সাহস জুগিয়েছে ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত বন্দবস্ত করেছে। ওর বাবা এখনো পথ প্রদর্শকের ভূমিকায় সফল উদ্যোক্তা অ্যলিনা মোর্সের সাথে। জানা যায়, চিন্তার শুরু থেকেই মেয়েটির মাথায় ব্যবসায়ীক মনোভাব কাজ করত এবং কীভাবে একে বাস্তবে রুপ দেয়া যায় সে লক্ষ্যে কাজ করত তবে কখনোই উদ্বীগ্ন হয়নি বা এক বারের জন্য ব্যর্থতার চিন্তা ভর করেনি যা তাকে শতভাগ নম্বর পেয়ে একজন খাঁটি উদ্যোক্তা হিসেবে সবার কাছে নিজের পরিচয় দিতে পেরেছে।