ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কেড়ে নিতে পারে দৃষ্টিশক্তি
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হলো (ডিআর) ডায়াবেটিস রোগের সবচেয়ে সাধারণ জটিলতা। এটি চোখের সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলির রোগ হিসেবে স্বীকৃত। এই রোগটির চিকিৎসা এখনও চ্যালেঞ্জিং। যেহেতু ভাস্কুলার এন্ডোথেলিয়াল গ্রোথ ফ্যাক্টর বা ভেইজেফ (VEGF) এই রোগের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত, তাই অ্যান্টি-ভেইজেফ থেরাপির আবির্ভাব ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এছাড়াও, সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে লেজার ফটোকোয়াগুলেশন এবং প্রদাহরোধী থেরাপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এসব জনপ্রিয় চিকিৎসা হলেও এদের রয়েছে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও নানা অসুবিধা। তাই, বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে অনেক বিজ্ঞানী বিভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োগকেও পরামর্শ দিয়েছেন।
- প্রকাশ: ০৭:৫৭:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
- / ৫২০ বার পড়া হয়েছে
ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি বিপাকীয় রোগ। এই রোগে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখও, বিশেষকরে চোখের নিউরোসংবেদনশীল রেটিনা। রেটিনার রক্তবাহী ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নামক একটি রোগ হয়, যা ছিনিয়ে নিতে পারে আমাদের দৃষ্টিশক্তি। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে রেটিনার অংশে সরু রক্তনালিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এক প্রকার তরলের ক্ষরণ শুরু হয়। এর কারণেই দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে রক্তনালিকাগুলিতে রক্ত চলাচলের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। ফলে, রেটিনার বিভিন্ন অংশে ঠিকমতো অক্সিজেন পৌঁছতে না পেরে চোখের ভিট্রিয়াস গহ্ববরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এই অবস্থাকে বলা হয় ভিট্রিয়াস হেমারেজ। এর থেকে অন্ধত্ব আসতে পারে। চোখের যেসব অসুখের কারণে চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তার অন্যতম।
বিশ্বব্যাপী, ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাদুর্ভাব অনুমান করা হয় ২৭%, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর বর্তমান প্রকোপ প্রায় ৩৫%। জনসংখ্যা-ভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণায়/সমীক্ষায় বাংলাদেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে রেটিনোপ্যাথি প্রাদুর্ভাবের হার দেখা গিয়েছে ৫০.৬% (রুমানা আহমেদ প্রমুখ, ২০১২), ৩৩% (মুকিত এম প্রমুখ, ২০১৯) এবং ১৮.৮% (২০২৩)। শেষোক্ত গবেষণাটি বাংলাদেশের ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে বিআইএইচএস জেনারেল হাসপাতালের বহির্বিভাগের ৪৮৯ জন টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর ওপর পরিচালিত হয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রকারভেদ
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির দুটি প্রধান ধরন রয়েছে, যেমন নন-প্রলিফেরেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (NPDR) এবং প্রলিফেরেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (PDR), যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির একটি গুরুতর রূপ। এনপিডিআর ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে রেটিনার রক্তনালিকাগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে, দেখা যায় রেটিনায় রক্তসংবহনে (ভাস্কুলার) ব্যাপ্তিযোগ্যতা, মাইক্রোএনিউরিজম (রক্তনালির স্থানীয়ভাবে স্ফীত হওয়া) গঠন এবং চোখের ভিতরে রক্তরস ও রক্তক্ষরণ। এই অবস্থায়, নিউরোসংবেদনশীল রেটিনার অ্যাট্রোফি (রেটিনার অবক্ষয় ঘটা) এবং ইস্কেমিয়া (রক্ত সরবরাহের বাধাগ্রস্ততা) এর কারণে গুরুতর দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পায়। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির অগ্রিম পর্যায় হচ্ছে ‘পিডিআর’, যেখানে দেখা যায় রেটিনা স্তরের ইনফ্রাক্ট (রক্তপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় চোখের স্ট্রোক), অস্বাভাবিক নতুন রক্তনালিকা প্রসারণ, নতুন রক্তনালিগুলির ভঙ্গুরতা এবং চোখের ভিতরে রক্তপাত (ভিট্রিয়াস হেমোরেজ), যার ফলে রেটিনার বিচ্ছিন্নতা (রেটিনাল ডিটাচমেন্ট) এবং রক্তক্ষরণ দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির জন্য প্রধান যে ফ্যাক্টরটি দায়ী:
ডায়াবেটিস
সব ধরনের ডায়াবেটিস (টাইপ ১, টাইপ ২) রোগেই দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার ঝুঁকি বাড়ে। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ঝুঁকির কারণ হলো স্বাভাবিকেতর গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশ ও অগ্রগতি সম্পর্কিত যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, HbA1c (হিমোগ্লোবিন এ১সি) যত বেশি হ্রাস করা সম্ভব, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশ অবরোধ করার সম্ভাবনাও তত বেশি। অন্যথায়, LALES (লস এঞ্জেলেস ল্যাটিনো আই স্টাডি, ২০০৭) গবেষণায় দেখা গেছে এক শতাংশ HbA1c বৃদ্ধি বাইশ শতাংশ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বৃদ্ধির সমতুল্য (ভার্মা আর প্রমুখ, অপথ্যালমোলজি ১১৪, ২০০৭)।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি একটি মাইক্রোভাসকুলার রোগ (মাইক্রোভাস্কুলোপ্যাথি) হিসেবে স্বীকৃত, অর্থাৎ রেটিনার রক্তনালিকাগুলির সার্বিক ক্ষতি এই রোগটিতে মূল ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়। সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলি রেটিনায় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে সাহায্য করে। রক্তনালিকাগুলির বর্ধিত ব্যাপ্তিযোগ্যতার পাশাপাশি দেখা যায় রক্ত-রেটিনা প্রতিবন্ধক (BRB/বিআরবি)-এর ভাঙ্গন এবং রেটিনার স্নায়ুকোষ (নিউরন), এন্ডোথেলীয় কোষ ও পেরিসাইটের অ্যাপোপটোটিক মৃত্যু, সাথে মাইক্রোএনিউরিজম ও নিউক্লিয়াস-বিহীন অকোষীয় রক্তনালিকার উপস্থিতি। উল্লেখ্য, অভ্যন্তরীণ বিআরবি রেটিনার রক্তনালিকাগুলির এন্ডোথেলীয় কোষের জটিল টাইট সংযোগ দ্বারা তৈরি; আর, বহিঃস্থ প্রতিবন্ধক হিসাবে ধরা হয় আরপিই/RPE কোষ স্তরকে।
একাধিক বিপাকীয় পাথওয়ে ডায়াবেটিস-প্ররোচিত রক্তনালিকাগুলির ক্ষতির সাথে জড়িত, যার মধ্যে রয়েছে পলিওল পাথওয়ে (সর্বিটল তৈরির মাধ্যমে গ্লুকোজ থেকে ফ্রুকটোজে রূপান্তর), অ্যাডভান্সড গ্লাইকেশন এন্ড প্রোডাক্ট (AGE/এজিই, অর্থাৎ অতিরিক্ত গ্লুকোজ-সংযুক্ত প্রোটিন ও চর্বির উপস্থিতি) জমা হওয়া, (মূলত অতিরিক্ত ডায়াসিলগ্লিসেরলের কারণে) প্রোটিন কাইনেজ সি/PKC (বিশেষকরে β1/2 আইসোফর্ম) সক্রিয়করণ এবং হেক্সোসামিন বায়োসিন্থেটিক পাথওয়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হেক্সোসামিন বায়োসিন্থেটিক পাথওয়ে (HBP) হলো গ্লুকোজ বা গ্লুটামিন উৎস থেকে সংশ্লেষিত একটি নিউক্লিওটাইড চিনি ‘ইউরিডিন ডাইফসফেট-এন-এসিটিল গ্লুকোসামিন (UDP-GlcNAc)’, যা প্রোটিন, লিপিড এবং নিউক্লিক অ্যাসিডগুলিকে পরিবর্তন করে। ইনসুলিন-সিগন্যালিং-পাথওয়ের বিভিন্ন প্রোটিনের অতিরিক্ত এসিটিলগ্লুকোসামিন (O-GlcNAc, একটি অলিগোস্যাকারাইড)সংযুক্ত পরিবর্তনও বৃদ্ধি করে ইনসুলিন প্রতিরোধ, মৃত্যু হয় রক্তনালিকোষ ও পেরিসাইটগুলির, বিনষ্ট হয় এন্ডোথেলীয়-কোষের অখণ্ডতা, সাথে দেখা দেয় নতুন রক্তনালিকার আবির্ভাব (নিওভাসকুলারাইজেশন) এবং স্নায়ুঅবক্ষয় (নিউরোডিজেনারেশন), যেগুলি সবই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে অবদান রাখে।
যেহেতু, পেরিসাইটগুলি রক্তনালিকার জন্য কাঠামোগত সহায়তা প্রদান করে, তাই তাদের ক্ষতির ফলে রক্তনালির প্রাচীরের স্থানীয়ভাবে স্ফীত (মাইক্রোএনিউরিজম) হতে দেখা যায়, যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রথম দিকের ক্লিনিকাল লক্ষণ। ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে কেন পেরিসাইট হারিয়ে যায় তা স্পষ্ট না হলেও একটি অনুমান হলো যে, বিষাক্ত সরবিটল এবং এজিই-যৌগ পেরিসাইটগুলিতে জমা হয়। পেরিসাইট এবং এন্ডোথেলীয় কোষের ক্ষতির ফলে স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালনে বাধা বা রেটিনাল ইস্কেমিয়া হয়, যা হাইপোক্সিয়া (কম অক্সিজেন পারফিউশন)কে প্ররোচিত করে। রেটিনাল ইস্কেমিয়া, সাথে হাইপোক্সিয়া-ইনডিউসিবল ফ্যাক্টর 1 (HIF-1/এইচআইএফ-১আল্ফ়া) সক্রিয় হওয়ার মাধ্যমে এবং ফসফোলাইপেজ A2 এর বেড়ে যাওয়ার কারণে ভাস্কুলার এন্ডোথেলীয় গ্রোথ ফ্যাক্টর (VEGF/ভেইজেফ)-এর সংশ্লেষণও বৃদ্ধি পায়। ভেইজেফ হলো একটি সংকেতবাহী গ্রোথ ফ্যাক্টর বা প্রোটিন, যা টিস্যুতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য বিদ্যমান রক্তনালি থেকে নতুন রক্তনালিকা সৃষ্টি করে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় নিওভাসকুলারাইজেশন। প্রলিফেরেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এবং ডায়াবেটিক ম্যাকুলার এডিমা (DME/ডিএমই) এর অগ্রগতির সাথে জড়িত ভেইজেফ হচ্ছে একটি মূল এঞ্জিওজেনিক ফ্যাক্টর, যা অক্লুডিন এবং জোনুলা অক্লুডেন্স-১ (ZO-1) এর মতো টাইট-জংশন-প্রোটিনের ফসফোরিলেশনকে প্ররোচিত করে ভাস্কুলার ব্যাপ্তিযোগ্যতা বৃদ্ধি করে বলে মনে করা হয়।
প্লাসেন্টাল গ্রোথ ফ্যাক্টর (PlGF/পিএলজিএফ), ভেইজেফ, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর-আল্ফ়া (TNF-α), ক্যালিক্রেইন-কাইনিন সিস্টেম এবং পরিবর্তিত O-GlcNAc সিগন্যালিং-সহ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণ হিসেবে বেশ কিছু জৈবিক পাথওয়ে জড়িত রয়েছে। পিএলজিএফ-এর নিজস্ব একটি ভূমিকাও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পিএলজিএফ-নকআউট (PlGF−/−) ডায়াবেটিক ইঁদুরের রেটিনাতে ডায়াবেটিস-উদ্দীপিত এইচআইএফ-১আল্ফ়া–ভেইজেফ পাথওয়েতে জড়িত এইচআইএফ-১আল্ফ়া, ভেইজেফ, ভেইজেফ রিসেপ্টর ১-৩ এবং ফসফো–এন্ডোথেলীয় নাইট্রিক অক্সাইড সিন্থেজ এর প্রকাশ কমে যায়, কিন্তু Akt (প্রোটিন কাইনেজ বি) প্রোটিনের সংশ্লেষণ ও সক্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। বলা বাহুল্য, Akt হলো জীবনোস্তিত্বের একটি অপরিহার্য প্রোটিন/এনজাইম, যা রেটিনার কোষগুলিকে ডায়াবেটিস-সহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থেকে রক্ষা করে।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির জন্য অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর
স্থূলতা
প্রতিটি মানুষের ওজন নির্ভর করে তার উচ্চতার উপর। পূর্ণবয়স্ক মানুষের ওজনাধিক্য ও স্থূলতা নিরূপণের জন্য উচ্চতা ও ওজনের যে আনুপাতিক হার উপস্থাপন করা হয়, তাকে ‘বডি মাস ইনডেক্স’ বা সংক্ষেপে ‘বিএমআই/BMI’ বলে। এর জন্য কিলোগ্রামে শরীরের ওজন ও মিটারে শরীরের উচ্চতা নিয়ে, ওজনকে উচ্চতা দিয়ে ২ বার ভাগ করতে হয় (কেজি/মিটার২)। স্বাভাবিক বিএমআই ১৮.৫ – ২২.৯, ওজনাধিক্য বিএমআই ২৩ – ২৪.৯ এবং স্থূলতা বিএমআই ২৫ – ৩০.০ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। পরিমাপটি বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্য ঝুঁকি যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের পাশাপাশি পুষ্টির ঘাটতির পরিমাপের একটি সূচক।
বর্তমানে, বিএমআই এর পাশাপাশি কোমর ও নিতম্বের মাপের অনুপাত (WHR) দিয়েও ওজনাধিক্য ও স্থূলতা নিরূপণ করা যায়। যেহেতু পেটের অঞ্চলে চর্বি বর্ধিত স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে যুক্ত, তাই যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ, (NIH) ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশনের মতো রোগের ঝুঁকির কারণগুলি পরিমাপ করার জন্য একটি ব্যবহারিক হাতিয়ার হিসেবে এই ব্যবস্থাগুলি সুপারিশ করে, বিশেষ করে যাদের ‘বিএমআই’ পরিসীমা ৩৫ এর নিচে। নিতম্বের পরিধি (সেন্টিমিটার) দ্বারা কোমরের পরিধি (সেন্টিমিটার) ভাগ করে এই অনুপাত নির্ধারণ করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আদর্শ অনুপাতের জন্য পুরুষদের ক্ষেত্রে <০.৯ এবং মহিলাদের জন্য <০.৮ হিসেবে বিবেচিত, যেখানে একটি উচ্চ অনুপাত বিভিন্ন স্বাস্থ্য জটিলতার বর্ধিত ঝুঁকি নির্দেশ করে।
উচ্চ রক্তচাপ
গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও, উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এটি বিভিন্ন ক্লিনিকাল ট্রায়ালেও প্রমাণ মিলেছে। এছাড়াও, কিছু জনসংখ্যা-ভিত্তিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, মূলত সিস্টোলিক রক্তচাপ ধারাবাহিকভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সাথে যুক্ত, যেখানে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপের সাথে এই রোগের কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শুধুমাত্র ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগীদের তুলনায় উচ্চ রক্তচাপসহ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রোগীদের রেটিনার দুটি গুর্রুত্বপূর্ণ স্তর (পেরিপ্যাপিলারি রেটিনা-নার্ভ ফাইবার স্তর এবং গ্যাংলিওন সেল আন্তর প্লেক্সিফর্ম) অনেক পাতলা/ক্ষয় হয়ে যায়।
টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ‘রেনিন-অ্যাঞ্জিওটেনসিন সিস্টেম (RAS)’ এর রেটিনোপ্যাথি অবরোধেও নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে, যেখানে এটি মাইক্রো/ম্যাক্রোঅ্যালবুমিনুরিয়াসহ নেফ্রোপ্যাথি এবং হৃদসংবহন রোগের ঝুঁকিও হ্রাস করতে দেখা গিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে উচ্চ রক্তচাপ-বিরোধী ওষুধ, যেমন এঞ্জিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম (এসিই) প্রতিরোধক বা এঞ্জিওটেনসিন II রিসেপ্টর (AT1R) অ্যান্টাগোনিস্টগুলি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির অগ্রগতিকে ধীর করার যথেষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে হাইপারটেনসিভ রোগীদের রক্তচাপ হ্রাস করাই হচ্ছে মূল একটি বিষয়।
রক্তমেদাধিক্য বা হাইপারলিপিডেমিয়া
হাইপারলিপিডেমিয়াকে সংজ্ঞায়িত করা হয় যখন রক্তে, উচ্চ-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (HDL-C/এইচডিএল) কম থাকে এবং কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (LDL-C/এলডিএল), ট্রাইগ্লিসারাইড ও খুব কম-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল (VLDL-C/ভি-এলডিএল) বেশি থাকে। এধরনের অস্বাভাবিকতা বা ভারসাম্যহীনতাকে কখনো ডিসলিপিডেমিয়া-ও বলা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত লিপিডের উপস্থিতি, বিশেষ করে অক্সিডাইজড এলডিএল কোলেস্টেরল, অক্সিডেটিভ স্ট্রেসকে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও, ডায়াবেটিস রোগীদের মোট কোলেস্টেরলের মাত্রাও বেশি পাওয়া যায়। রক্তের এই অবস্থাটি দেহের কার্ডিও-বিপাকীয় সমস্যাগুলির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত, যেমন স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ এবং করোনারি হৃদরোগ। ডায়াবেটিস এবং হাইপারলিপিডেমিয়া উভয়ই স্বাধীনভাবে ও যৌথ/সিনারজিস্টিকভাবে এন্ডোথেলীয় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাকে বিনষ্ট করে। সম্প্রতি, হাইপারলিপিডেমিয়াকেও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। লিপিড-হ্রাসকারী চিকিৎসা, বিশেষ করে স্ট্যাটিন এবং ফাইব্রেট ব্যবহার করে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি কমানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ভি-এলডিএল এবং এলডিএল কণার মধ্যে থাকা প্রধান অ্যাপোলাইপোপ্রোটিন-বি (Apo-B) এথেরোস্ক্লেরোসিস এবং করোনারি রোগ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। উল্লেখ্য, বর্ধিত এলডিএল Apo-B এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং সেরাম ApoB নিজেই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির তীব্রতার সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে বলেও নিশ্চিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে, ApoBকে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ বায়োমার্কার হিসেবে ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে, বর্ধিত ApoA1 রক্তে বর্ধিত এইচডিএল এর উপস্থিতিকে প্রমাণ করে।
জীবনধারা
ডায়াবেটিস ও রেটিনোপ্যাথি প্রতিরোধে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস-আক্রান্ত মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের খাদ্যতালিকায় ‘লং-চেইন এন-৩ পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড’ (PUFA, যেমন ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, কমপক্ষে ৫০০ মিলিগ্রাম/দিন) গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়, যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির আপেক্ষিক ঝুঁকি ৪৮% হ্রাস করে। এই ফ্যাটি অ্যাসিডটি যেকোনো তেলযুক্ত মাছে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। একাধিক রিসেপ্টরের মধ্যে, PPAR-γ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থেরাপিউটিক লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত; কারণ এই রিসেপ্টরটি ওমেগা-৩ দ্বারা উদ্দীপিত হয়, যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে PUFA-মধ্যস্থ উপকার হতে পারে। এছাড়া, PUFA-এর ব্যবহার টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে প্রবাহমান ইনসুলিন এবং এলডিএল/এইচডিএল অনুপাতও কমাতে পারে।
এটি এখন প্রমাণিত যে, পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশকে বাধা দেয়। এখানে উল্লেখ্য, চোখের ভিটামিন ডি স্থানীয়ভাবেই উৎপাদিত, সক্রিয় এবং নিয়ন্ত্রিত হয়। প্রকৃতপক্ষে, ভিটামিন ডি৩ তৈরিতে যেসব এনজাইম প্রয়োজন তার সবগুলিই সংশ্লেষিত হয় চোখে। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ১-আল্ফ়া,২৫-ডাইহাইড্রোক্সিভিটামিন ডি৩ (সক্রিয় ভিটামিন ডি৩ হরমোন) অ্যাঞ্জিওজেনেসিস প্রক্রিয়াকে বাধা দেয় এবং এই প্রভাবটি মধ্যস্থতা করে ভিটামিন ডি রিসেপ্টর, নিউক্লীয় রিসেপ্টর পরিবারের একটি ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর।
এছাড়া, অন্যান্য ভিটামিন যথা ‘ভিটামিন এ’ দৃষ্টিগত প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য এবং এটি রোডোপসিন রঞ্জক প্রোটিনের একটি প্রধান উপাদান। তাই, ‘ভিটামিন এ’ বা ক্যারোটিনয়েডের উৎস, যেমন পালং শাক, ব্রকলি, গাজর বা মিষ্টি আলুযুক্ত খাবার নিয়মিত খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ভিটামিন বি১ (থায়ামিন) একটি শক্তিশালী মুক্ত র্যাডিক্যাল স্ক্যাভেঞ্জার যা পলিওল পাথওয়ে সক্রিয়করণকে বাধা দেয়; এবং ‘ভিটামিন সি’ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির বিকাশের বিরুদ্ধেও একটি প্রতিরক্ষামূলক উপাদান হিসেবে কাজ করে ।
এছাড়া, ধুমপান পরিহার এবং নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি হওয়ার ঝুঁকি কমায়। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বিকাশের আরেকটি সম্ভাব্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে অতিবেগুনী বি বিকিরণ যা রেটিনাল পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম (RPE)কে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
চিকিৎসা ব্যবস্থা
চোখে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি ও এডিমা নিরূপণের জন্য প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় প্রধানত অপটিক্যাল কোহেরেন্স টমোগ্রাফি (OCT/ওসিটি)। ওসিটি হলো একটি নন-ইনভেসিভ উচ্চ-রেজোলিউশন সম্পন্ন ক্রস-সেকশনাল ইমেজিং, যা চোখের রেটিনার (রেটিনা এবং অপটিক স্নায়ুর স্তরগুলির) ছবি তৈরি করতে প্রতিফলিত একটি কম-পাওয়ার লেজার/আলোক তরঙ্গ ব্যবহার করে (ছবি ৩ক দেখুন: ছবিটি নেওয়া হয়েছে লেখকের ডান রেটিনা থেকে; ৩ক ও ৩খ ছবি দুটির মধ্যে সামঞ্জস্যতা খুঁজুন)। এই প্রযুক্তিটি টিস্যুর যথাস্থানে (in situ) এবং বাস্তব সময়ে (in real-time) মাইক্রোন স্কেলে রেটিনার স্তরগুলির পুরুত্ব পরিমাপ করতে সাহায্য করে। এটি ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত রেটিনোপ্যাথি ও ম্যাকুলার এডিমা, গ্লুকোমা এবং বয়স-জনিত ম্যাকুলার অবক্ষয়ের মতো রোগ নির্ণয় এবং পরিচালনা করতে ব্যবহার করা হয়। এসব চোখের রোগ অন্ধত্বের প্রধান কারণ। ১৯৯১ সালে, এই ইমেজিং পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন মাস্যাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি-র গবেষকবৃন্দ ডেভিড হুয়াং (সে সময়ের ছাত্র), জেমস ফুজিমোটো এবং এরিক সোয়ানসন।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির যেকোনো চিকিৎসার লক্ষ্য হলো এই রোগের অগ্রগতিকে ধীর বা বন্ধ করা। ডায়েট, শারীরিক অনুশীলন এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা রোগের অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।
ফার্মাকোথেরাপি
ডায়াবেটিসের কারণে ভেইজেফ প্রোটিনটির বর্ধিত প্রকাশ রেটিনোপ্যাথির, বিশেষ করে প্রলিফারেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত। অ্যান্টি-ভেইজেফ থেরাপির আবির্ভাব ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। চোখের পিছনে নতুন রক্তনালি তৈরি হওয়া রোধ করতে অ্যান্টি-ভেইজেফ এন্টিবডি নামক ওষুধের (ইন্ট্রাভিট্রিয়াল) ইনজেকশন সরাসরি চোখে প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ)-অনুমোদিত প্রচলিত অ্যান্টি-ভেইজেফ ওষুধের মধ্যে রয়েছে র্যার্নিবিজুমাব (লুসেন্টিস, জেনেনটেক), এফলিবারসেপ্ট (আইলিয়া, রিজেনেরন) এবং বেভাসিজুমাব (অ্যাভাসটিন, Roche)। বর্তমানে, অ্যান্টি-ভেইজেফ ছাড়াও অন্যান্য অ্যান্টি-এনজিওজেনিক ওষুধও ম্যাকুলার এডিমা রোগীদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়, যেমন অ্যান্টি-প্লেটলেট-ডেরাইভড গ্রোথ ফ্যাক্টর এবং অ্যান্টি-বি-ফাইব্রোব্লাস্ট গ্রোথ ফ্যাক্টর। শেষের এজেন্টগুলি প্রয়োগ করেও ভালো ফল পাওয়া গিয়েছে। তবে, অ্যান্টি-ভেইজেফসহ এসব থেরাপির কিছু সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিকূল প্রভাব রয়েছে। যেমন, এই এজেন্টগুলি দীর্ঘস্থায়ী না হওয়ার কারণে, এদের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে মাসিক বা দ্বিমাসিক ইনজেকশন প্রয়োজন। এছাড়া, ঘন ঘন ইন্ট্রাভিট্রিয়াল ইনজেকশন নেওয়ার ফলে এন্ডোফথালমাইটিস (একুয়াস এবং ভিট্রিয়াস তরলের প্রদাহ)এর মত বিরল প্রতিকূল প্রভাবও দেখা দিতে পারে।
সম্প্রতি, আরও তিনটি নতুন অ্যান্টিবডি- ব্রোলুসিজুমাব (নোভার্টিস), ফ্যারিসিমাব (Roche) এবং KSI-301 (কোডাক সাইয়েন্স, ইঙ্ক) প্রতিশ্রুতিশীল আন্টি-ভেইজেফ ওষুধ এফডিএ কর্তৃক অনুমোদন পেয়েছে, যা ডিএমই, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি এবং ম্যাকুলার অবক্ষয় নিয়ন্ত্রণ করে। VEGF-A ব্লক করে ব্রোলুসিজুমাব রক্তনালিগুলির বৃদ্ধি হ্রাস করে এবং ফুটো ও ফোলা (ডিএমই) রক্তনালিগুলিকে সারিয়ে তোলে। ফ্যারিসিমাব হলো প্রথম দ্বি-নির্দিষ্ট মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি যা ভেইজেফ এবং অ্যাঞ্জিওপোয়েটিন ২ উভয়কেই টার্গেট/লক্ষ্য করে। এখানে বলা প্রয়োজন যে, উল্লিখিত এন্টিবডিগুলির অধিকাংশই বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার থেরাপিতেও ব্যবহৃত হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, রেনিন-এঞ্জিওটেনসিন সিস্টেমের ‘এসিই’ এনজাইমকে দমন বা AT1R রিসেপ্টর-নির্ভর পাথওয়ের অবরোধ এন্ডোথেলীয় কোষ দ্বারা ভেইজেফ এর প্রকাশ অনেকাংশে কমিয়ে দেয়, যা চোখে নিওভাস্কুলারাইজেশনকে প্রতিরোধ করে। তবে, AT1R রিসেপ্টর ছাড়াও রেনিন-এঞ্জিওটেনসিন সিস্টেমের আরও একটি রিসেপ্টর অর্থাৎ প্রো-রেনিন রিসেপ্টর (PRR) ভেইজেফ অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মাইক্রো-আরএনএ (miRNA) আবিষ্কারের সাথে, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নন-প্রোটিন-কোডিং আরএনএগুলিও ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত জটিলতায় নতুন অবদান রাখতে শুরু করেছে। আমার একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, নির্দিষ্ট মাইক্রো-আরএনএ কর্তৃক AT1R ও PRR উভয়কে দমন করে ডায়াবেটিস-প্ররোচিত ভেইজেফ প্রোটিনের প্রকাশকে অধিকতর কমিয়ে ফেলে (হক, রাশিদুল, মলিক্যুলার ভিশন, ২১, ২০১৫; ২৩, ২০১৭)। ফলে, নিওভাস্কুলারাইজেশন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়। অন্যান্য গবেষণাতেও দেখা গিয়েছে যে, বেশ কিছু মাইক্রো-আরএনএ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সংঘটন এবং বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লেজার ফটোকোয়াগুলেশন
যদিও অ্যান্টি-ভেইজেফ থেরাপি ক্রমবর্ধমানভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি চিকিৎসার প্রধান ভিত্তি হয়ে উঠেছে, তথাপি লেজার থেরাপি এখনও একটি সহায়ক চিকিৎসা বা রেসকিউ থেরাপি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই থেরাপির মাধ্যমে লেজারের তাপ ব্যবহার করে রেটিনায় অস্বাভাবিক, ফুটো হওয়া রক্তনালিগুলিকে সিল/বন্ধ করা হয়। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির কারণে দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি কমাতে এই চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফটোকোয়াগুলেশনের সময় দুটি পদ্ধতির একটি ব্যবহার করা যেতে পারে: ১) ফোকাল ফটোকোয়াগুলেশন- ফোকাল ট্রিটমেন্ট রেটিনার একটি ছোট অংশে, সাধারণত ম্যাকুলার কাছাকাছি নির্দিষ্ট ফুটো হওয়া রক্তনালিগুলিকে সিল করতে ব্যবহৃত হয়। এটি ননপ্রোলিফেরেটিভ রেটিনোপ্যাথির কারণে ম্যাকুলার এডিমার জন্য হারানো দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে; ২) স্ক্যাটার (প্যান-রেটিনাল) ফটোকোয়াগুলেশন- রেটিনার বিস্তীর্ণ এলাকায় বিকশিত নতুন অস্বাভাবিক রক্তনালিগুলির বৃদ্ধিকে ধীর করতে স্ক্যাটার ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করা হয়। এটি প্রলিফারেটিভ রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই চিকিৎসা ব্যবহারে রোগীদের কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। লেজার তাপের কারণে রেটিনার কিছু অংশ পুড়ে কিছুটা স্থায়ী দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করতে পারে। ফলে কেন্দ্রীয় ও পার্শ্বীয় দৃষ্টিশক্তির মৃদু ক্ষতি হতে পারে। ভবিষ্যতে, লেজার প্রযুক্তির উন্নয়নগুলি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসায় লেজার ফটোকোয়াগুলেশনের সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
প্রদাহরোধী থেরাপি: ইন্ট্রাভিট্রিয়াল স্টেরয়েড
ইন্ট্রাভিট্রিয়াল কর্টিকোস্টেরয়েডগুলি ডিএমই-এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে অ্যান্টি-ভেইজেফ থেরাপির প্রতিক্রিয়ার অভাব রয়েছে। সক্রিয় অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট হিসেবে, কর্টিকোস্টেরয়েডগুলি ভেইজেফ, টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর-আল্ফ়া, ইন্টারলিউকিন-১বিটা, লিউকোস্টেসিস এবং টাইট-জাংশন প্রোটিনের ফসফোরিলেশনসহ ডিএমই ও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সাথে জড়িত মধ্যস্থতাকারীদের দমন করে। বর্তমানে, ডিএমই চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ইন্ট্রাভিট্রিয়াল কর্টিকোস্টেরয়েডগুলির মধ্যে রয়েছে ট্রায়ামসিনোলোন অ্যাসিটোনাইড, এফডিএ-অনুমোদিত ডেক্সামেথাসোন ইন্ট্রাভিট্রিয়াল ইমপ্লান্ট এবং ফ্লুওসিনোলোন অ্যাসিটোনাইড ইন্ট্রাভিট্রিয়াল ইমপ্লান্ট। তবে, এর গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা গিয়েছে চোখে ছানি পড়া এবং চোখের চাপ (আইওপি) বেড়ে যাবার প্রবণতা। কিছু ননস্টেরয়েড অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এজেন্টও রয়েছে, যা ডিএমই ও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির চিকিৎসার জন্য এফডিএ দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি হলো নেপাফেনাক (নেভানাক, অ্যালকন)।
চোখের অস্ত্রোপচার
ভিট্রেক্টমি হলো এক ধরনের চোখের সার্জারি, যার মাধ্যমে কিছু ভিট্রিয়াস অপসারণ করে রক্তকে পরিষ্কার করা হয়, যাতে করে অনেকটা স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। পোস্টেরিয়র ভিট্রিয়াস ডিটাচমেন্ট (পিভিডি), রেটিনাস্তরের স্থানচ্যুত হওয়া (রেটিনাল ডিটাচমেন্ট) বা ভিট্রিয়াস হেমোরেজ হলে ভিট্রেক্টমির প্রয়োজন হয়। ভিট্রিয়াস হলো একটি জেলের মতো পদার্থ যা চোখের মাঝখানের অংশকে ভরাট করে। এই পদ্ধতির কিছু ঝুঁকিও আছে, যেমন সংক্রমণ, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, চোখে উচ্চ চাপ, এবং অস্ত্রোপচারের কারণে নতুনভাবে রেটিনাবিচ্ছিন্নতা বা লেন্সের ক্ষতি।
শেষকথা
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রেটিনার সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলির একটি রোগ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া, প্রদাহ এবং রেটিনার স্নায়ুঅবক্ষয় ভিন্নভাবেও ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এ যাবৎ, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির থেরাপিউটিক চিকিৎসা হিসেবে ইন্ট্রাভিট্রিয়াল অ্যান্টি-ভেইজেফ এজেন্টগুলি ডিএমই এবং পিডিআর-এর জন্য বেশ জনপ্রিয় থেরাপি হলেও, চোখের ভিতরে এর ঘন ঘন ইনজেকশন, রোগীদের আর্থিক বোঝা এবং তাদের ক্রমশ নিস্পৃহতার কারণে অ্যান্টি-ভেইজেফ ওষুধের ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়েছে। তবে, লেজার ফটোকোয়াগুলেশন এবং ইন্ট্রাভিট্রিয়াল কর্টিকোস্টেরয়েডগুলি এখনও যথেষ্ট সহায়ক চিকিৎসা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির নিয়ন্ত্রণে বিকল্প পদ্ধতি হিসেবেও অনেক বিজ্ঞানী মাইক্রো-আরএনএ প্রযুক্তির প্রয়োগকেও পরামর্শ দিয়েছেন। এসব ক্ষুদ্র-আরএনএগুলি ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সাথে জড়িত BDNF, PPAR‐α, VEGF, CREB প্রোটিনগুলির প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে।
যাইহোক, উল্লিখিত এসব চিকিৎসা শুধুমাত্র ক্রমাগত অবক্ষয়জনিত রোগকে বিলম্বিত বা প্রতিরোধ করতে পারে। এক্ষেত্রে, স্টেম সেল-ভিত্তিক গবেষণা এবং ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির থেরাপিউটিক সম্ভাবনা রোগীদের জন্য নিঃসন্দেহে আশার আলো দেখাচ্ছে। ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিতে, যার মধ্যে প্লুরিপোটেন্ট স্টেম (iPS) কোষ, রেটিনার পিগমেন্ট এপিথেলীয় কোষ, অস্থি মজ্জা মেসেনকাইমাল স্টেম সেল এবং এন্ডোথেলীয় প্রোজেনিটর কোষগুলির ব্যবহারে প্রমাণ মিলেছে যে, এসব থেরাপি নিউরোভাসকুলার ক্ষতি প্রতিরোধ এবং রেটিনা-পুনর্জন্মের এক কার্যকর বিকল্প হতে পারে। তবে, স্টেম কোষের ভিন্নতা, কোষ বিতরণ, এবং ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুতে স্টেম কোষের কার্যকর প্রতিস্থাপন হচ্ছে এক প্রধান চ্যালেঞ্জ।