০৮:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং নিয়ে এ কি জগাখিচুড়ি কাণ্ড!

শুধু ওয়েবসাইটের উপর ভিত্তিক করে এবং পরিচিত শিক্ষকদের মতামতের উপর র‍্যাংকিং নির্ভর করছে, এটি আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনো মেসেজ দিচ্ছে না। 
মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশ: ০১:২২:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪
  • / ৪৯ বার পড়া হয়েছে

মাছুম বিল্লাহ


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

বিশ্বায়নের যুগে র‍্যাংকিং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশ্ববিদ্যলয়কে পরিচিত করে তোলে। এই র‌্যাঙ্কিং শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি মুল্যবান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পদ্ধতিগত মূল্যায়ণ, যেমন উচ্চশিক্ষার গুণগত মান, গবেষণা আউটপুট এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসহ বিভিন্ন মানদন্ডের ভিত্তিতে র‍্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও দুর্বলতাগুলোক দৃশ্যমান করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহরু বলেছিলেন, ‘দেশ ভাল হয় যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাল হয়। ’ইউজিসির পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশে বর্তামনে ৫৩টি পাবলিক, ৩টি আন্তর্জাতিক ও ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার সাধারন, প্রকৌশল, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মেডিকেল, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সংযুক্ত বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। এদের মধ্যে শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়, কয়েকটি আছ অর্ধশতবর্ষী। এগুলোর মধ্যে কোনটির অবস্থা কেমন, পড়াশুনার মান কি ইত্যাদি জানা প্রয়োজন। তাই প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিং সেটি হতে পারে দেশের অভ্যন্তরে, হতে পারে দক্ষিন এশিয়া কিংবা পুরো এশিয়া এমনকি গোটা পৃথিবীতে। 

লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন ৫ টি মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে র‍্যাংকিং প্রকাশ করে। যেমন—শিক্ষা, গবেষণা, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম অর্থাৎ শিল্পের সাথে গবেষণাকর্মের বাণিজ্যিকীকরণ। টাইম হায়ার এডুকেশনের নিয়ম অনুযায়ী  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যাচাই করা হয় দুটি বিষয় লক্ষ করে। শিক্ষার মান ও গবেষণার মান। ৩০ শতাংশ প্রতিমান থাকে শিক্ষার মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার অর্থ, সংখ্যা ও মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার প্রভাবে, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে বিদেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিদেশে গবেষণায় আর ২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে দেশের গবেষণা অনুদান নিয়ে। বিশ্ববিখ্যাত কোয়াককুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং ৯টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেগুলো হলোপ্রতিষ্ঠানের খ্যাতি, নিয়োগকর্তাদের খ্যাতি, শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক প্রতি গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন, বিদেশি শিক্ষকের সংখ্যা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাফল্য এবং সাসটেইনেবিলিটি। প্রতিটি সূচকে স্কোর থাকে ১০০ অর্থাৎ সর্বমোট ৯০০মার্কের গড় মান হিসাব করে সর্বোচ্চ অর্জিত মানের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিং করা হয়।  কিউএস-এর নিয়ম অনুযায়ী ৪০ শতাংশ পয়েন্ট থাকে শিক্ষার মানে, ১০ শতাংশ থাকে নিয়োগদাতাদের মতামতে, ২০ শতাংশ থাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে, ২০ শতাংশ থাকে গবেষণার সাইটেশনে, ৫শতাংশ থাকে বিদেশী শিক্ষকে এবং ৫ শতাংশ থাকে বিদেশি শিক্ষার্থীতে। 

স্পেনের মাদ্রিদ ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষনা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্স র‍্যাংকিং প্রধান্য দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের কনটেন্ট, শীর্ষ গবেষক এবং সেরা গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশনের উপর। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ৫০ শতাংশ, টপ সাইটেড গবেষকের ১০ শতাংশ এবং টপ সাইটেড প্রবন্ধ ৪০ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির সূচক চারটি, যথা—শিক্ষা, নিয়োগযোগ্যতা, যোগ্য শিক্ষকদের সংখ্যা, ও গবেষণা (আউটপুট, উচ্চমানের প্রকাশনা, গবেষণার প্রভাব ও সাইটেশন) শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্্েরর র‌্যাঙ্কিং ২০২৪ এ দেশ সেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চতুর্থ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের সেরা ১৭০ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থান ১৬তম। জানুয়াির ২০২৪এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১১ হাজার ৩৯৪টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিং-২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম সংষ্করণের প্রতিবেদন। প্রথম হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণ পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারন, অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ভূমিকা বিবেচনা করে স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্স। ২০০৪খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে আসছে। প্রতি বছর জানুয়ারি ও জুলাই মাসে তারা এটি প্রকাশ করে। 

এসব রেটিং একটু খেয়াল করে দেখলে বুঝা যায় যে, প্রথম দশ-বারটি ছাড়া বাকীগুলোর রেটিংয়ের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যাকে ৭০০ বলা হচ্ছে , অন্যরেটিংযে সেটি হচ্ছে ১৫০০-এর পরে। আজ যে ২০০০ তমের মধ্যে স্থান পায়নি, পরের মাসে বা মাস দু’য়েক পরে দেখা যায় সেটিই প্রথম। এ কি এক জগাখিচুড়ি কান্ড! কিসের ভিত্তিতে এ রকম ব্যবধান এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলো কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কাছেই অতটা স্পষ্ট নয় যা স্পষ্ট করা উচিত। ফলে এতসব র‌্যাঙ্কিং এর আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে কারন কেউ ভালভাবে কিছু বুঝতে পারছেনা। সাধারন মানুষেরও কিন্তু একটি রেটিং আছে। তারাও বুঝেন যে, বুয়েটের পড়াশুনা বাংলাদেশের অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত, তারা প্রায় স্বীকার করবেন যে, নর্থ সাউথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউল্যাব অনেক এগিয়ে আছে। তারা সবাই জানেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক সংখ্যা অনেক বেশি, এখানে ভর্তি হলে শিক্ষার্থীরা এমনেিতই অনেক কিছু জানে পরিবেশের কারনে তবে রাজনীতির আখড়া এবং বর্তমানকালের শিক্ষার্থীরা এই রাজনীতি করে কোন ধরনের সুনাম কুড়াতে পারছেনা, দুর্নাম ছাড়া। এ ধরনের রেটিং কিন্তু সাধারণ্যে প্রচলিত। 

এই রেটিং দিয়ে কি হয় বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এতে কিছু যায় আসে? বিশাল উন্মুক্ত ক্যাম্পাস, নামমাত্র বেতন, বিশাল বিশাল হল, লাইব্রেরি, শিক্ষকরা ক্লাস নেন আর না নেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করুক আর না করুক, ছাত্র সংগঠনগুলো এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ক্যাম্পাসে থাকতে দিক আর না দিক, শিক্ষকরা পড়াশুনা না করিয়ে পার্টির গুণগান করুক আর ভিসি সরাসরি সরকারি পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করুক আর নাই করুক মেধাবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সেগুলোতে ভর্তি হতে হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি নিজেদের মান বজায় রাখার নিমিত্তে ও কোয়ালিটির সাথে কম্প্রেমাইজ না করার জন্য নিজেদের অস্তিত্ব নিজেরাই ঘোষণা করছে। তাতে বাইরের কেউ সেখানে কোন সিল লাগাক আর না লাগাক তাতে কিছু যায় আসেনা। 

এখন বাংলাদেশের ১১৪ টির কমবেশি  প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার বিষয় আছে কারণ মালিকেরা এত মূলধন খাটিয়ে যদি লাভ না পান তাহলে কীভাবে চালাবেন এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান? এসব থিউরির উপর ভিত্তি করে কেউ কেউ র‍্যাংকিং-এর পেছনে ছুটছেন। মান রক্ষা করার চেষ্টায় নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতে পড়ে যায় বিপদে কারণ কম টিউশন ফিতে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এগিয়ে থাকে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারা র‍্যাংকিং স্থান করে নেয়ার মাধ্যমে আন্তার্জাতিক শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে ব্যস্ত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই র‍্যাংকিং-এর পেছনে যত অর্থ ব্যয় করে তারা সেটি না করে যদি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে অর্থ ব্যয় করতো তাহলে ঢের ভাল হতো। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান, পাশ করা শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আনতর্জাতিক পর্যায়ে কোথায় কোথায় আছেন— মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ন। বাকীগুলো গৌণ। গবেষণার ক্ষেত্রের দিকে তাকালে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী গবেষণা ও অবদান হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখানকার শিক্ষকগন যা গবেষণা করেন তা দেশের সরাসরি কাজে লাগে। তারা শস্য, ফল, শাক-সবজী, মাছ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাদের শিক্ষার্থীরাই বি আর আর আই-নামক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করে কৃষিতে সরাসরি অবদান রাখছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আর কোন তুলনা হওয়ার কথা নয় অথচ দেখা যায় এ বিশ্ববিদ্যালয়টি র‌্যাঙ্কিং-এ কোথাও নেই। তাছাড়া বুয়েটের শিক্ষকগন জাতীয় ও অন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভূত অবদান রাখেন। তবে, এখানকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের চেয়ে বিদেশে অবদান বেশি রাখেন। তারা দেশে কিছুই করতে পারেন না, করার সুযোগও তেমন নেই কিন্তু বিদেশে গিয়ে আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও গবেষণায় প্রচুর এগিয়ে আছেন। আমরা তাদেরকে দেশে রাখার খুব আগ্রহও দেখাই না, তাই তারা বিদেশে চলে যান। 

ঢাকা বিশ্ববিদালয়কে যদি ধরি তাহলে বিসিএস ক্যাডার উৎপাদনে এগিয়ে। এখন এটি কোনো র‍্যাংকিং-এর মান? এছাড়াও যদি ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মারামারি কথায় আসি তাহলেও র‍্যাংকিং এটি এগিয়ে থাকবে। কাগুজে গবেষণায় যদি আসি যা দেশ ও জাতির সরাসরি খুব একটা কাজে লাগেনা সেটি তো নামমাত্র যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই করেন প্রমোশনের জন্য কিন্তু ঐসব গবেষণা তো মানুষের খুব একটা বা বলতে গেলে সাধারন মানুষের কোন কাজেই আসেনা,শুধুমাত্র একজন শিক্ষক তার নামের আগে ড. লাগাতে পারেন এতটুকু ছাড়া। 

যদি শিক্ষা ক্যাডার বা শিক্ষা প্রশাসনের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিং-এ এগিয়ে থাকবে।  প্রতিপক্ষ শিক্ষার্থীকে দ্রুত হল ও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার দৌঁড়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই পারদর্শী তবে চ্ট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইদানিং কালে এই র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকবে। রাজশাহীও এই র‌্যাংকিংয়ে আগ্রগামী থাকবে বাকীগুলোর মধ্যে কোন প্রতিযোগিতাও নেই, কোন নড়াচড়াও নেই। আর বুয়েটের পর রুয়েট, চুয়েট, ও কুয়েট এগিয়ে থাকবে ইদানিং মারামারির জন্য। 

ইউজিসি ও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল মিলে একটি স্টান্ডার্ড তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবজেকটিভ র‌্যাংকিং করার প্রয়োজন ছিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য, একটি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এবং অন্যটি জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। তবে আমাদের ইউজিসি একবার প্রচেষ্টা নিয়েছিল কিন্তু দেশের সেরা দশটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের তালিকাও প্রকাশ করেছিল যা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ইউজিসি এ কাজে মোটেই সক্ষম নয়। আবার নতুন করে ইউজিসি আগ্রহ প্রকাশ করছে বিষয়টিতে হাত দেয়ার। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মান নির্ধারন করতো গুটিকয়েক জার্ণাল দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্ণালের সংখ্যা বেড়েছে। এসব জার্ণালে গবেষণা প্রবন্ধ ছাপাতে অপেক্ষা করতে হয়, অর্থের ব্যাপার আছে। আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই যথাযথ বা মানসম্মত পিএইচডি প্রোগ্রাম চালাচ্ছেনা বা তাদের মূল বিষয় পিএইচডি পড়ানো নয় সেখানে গবেষণায় আমাদের দেশে খুব বেশি পয়েন্ট পাবেনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো এ ধরনের প্রোগ্রামের এখনও অনুমোদন নেই, চিন্তাভাবনা চলছে। কাজেই সেগুলো র‌্যাঙ্কিং-য়ে আগাবেনা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কি র‌্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে প্রথম হয়েছে নাকি ভাল ছিল বলেই তাদের বাদ দিয়ে র‌্যাঙ্কিং হয়না?মূলত প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল শিক্ষক ও গবেষক। কেবল শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলেনা। সেটি হতে পারে একটি স্নাতক কলেজ। কেবল গবেষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয়না, সেটি হতে পারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান। খেলার মাঠ দিয়ে পড়াশুনা হয় না, এয়ারকন্ডিশন দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের মান তৈরি হয়না। এমআইটির মতো বিশ্ববিদ্যালয় এখনো সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার অভিভাবকদিবস পালন করে যেখানে যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-কোনো অনুষ্ঠানে আসে এবং জানতে পারে কী হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

মৌলিক ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রকাশনার সংখ্যা এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের যথাযথ সাইটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। গবেষণা যত সমসাময়িক ও মৌলিক হবে, প্রকাশনা তত ভালো জার্নালে হবে এবং সাইটেশন তত বেশি হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ গবেষণা পিয়ার রিভিউবিহীন দুর্বল প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত হয়, যেগুলো গুণগত মানের জার্নালে সাইটেশন হয়না বললেই চলে। ফলে এসব গবেষণালব্ধ প্রকাশনা দ্বারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংঙ্কিংযে সাইটেশন অংশে স্কোর অর্জনে পিছিয়ে থাকে। শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির একটি নিয়ামক। বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষার মানদন্ডে ন্যূনতম শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত থাকা উচিত ১:২০। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই অনুপাত ১:৩৫-১:৫০ এর মধ্যে। ফলে ক্লাসের চাপ, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি মানসম্পন্ন উপায়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়না। কাজেই প্রথমে প্রয়োজন ইউজিসির র‌্যাঙ্কিং যেটি হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাহলে দুর-দূরান্তে বসে, শুধুমাত্র কিছু পরিচিত শিক্ষকের মতামত আর ওয়েবসাইটে তথ্য দেখে র‌্যাঙ্কিং আসারেই আমাদের অর্থবহ কোন মেসেজ দিচ্ছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং তো দু’মাস চারমাসের বিষয় নয়, এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অথচ আমরা দেখছি এক প্রতিষ্ঠান একটি র‌্যাঙ্কিংয়ের ফল প্রকাশ করার কয়েকদিন আর একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ফল প্রকাশ করে। এতে সবাই বিভ্রান্ত হয় এবং র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জিত হয়না। 

অনেকেই বলছেন র‍্যাংকিং উন্নত বিশ্বের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালানোর একটি পদ্ধতি।  এগুলোর অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বাণিজ্যিক। তারা র‍্যাংকিং-এর মাধ্যমে উপার্জন করে। একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম কিউ এস র‍্যাংকিং-এর বার্ষিক আয় ৭৫ মিলিয়ন ডলার। আর টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার। র‍্যাংকিং-এর যে সব মানদন্ড তা সব ওয়েবসাইটে থাকে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর, সরেজমিনে কোনো প্রদর্শন বা ডাটা কালেকশন বা ইন্টারভিউ হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে র‍্যাংকিং কীভাবে হয়? শুধু ওয়েবসাইটের উপর ভিত্তিক করে এবং পরিচিত শিক্ষকদের মতামতের উপর র‍্যাংকিং নির্ভর করছে, এটি আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনো মেসেজ দিচ্ছে না। 

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক এবং প্রেসিডেন্ট: ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)। সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর- ভাব বাংলাদেশ এবং শিক্ষা বিশেষজ্ঞ -ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। ইমেইল: [email protected]

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

শুধু ওয়েবসাইটের উপর ভিত্তিক করে এবং পরিচিত শিক্ষকদের মতামতের উপর র‍্যাংকিং নির্ভর করছে, এটি আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনো মেসেজ দিচ্ছে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং নিয়ে এ কি জগাখিচুড়ি কাণ্ড!

প্রকাশ: ০১:২২:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪

বিশ্বায়নের যুগে র‍্যাংকিং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিশ্ববিদ্যলয়কে পরিচিত করে তোলে। এই র‌্যাঙ্কিং শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি মুল্যবান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পদ্ধতিগত মূল্যায়ণ, যেমন উচ্চশিক্ষার গুণগত মান, গবেষণা আউটপুট এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসহ বিভিন্ন মানদন্ডের ভিত্তিতে র‍্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের শক্তি ও দুর্বলতাগুলোক দৃশ্যমান করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহর লাল নেহরু বলেছিলেন, ‘দেশ ভাল হয় যদি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাল হয়। ’ইউজিসির পরিসংখ্যানে দেখা যায় দেশে বর্তামনে ৫৩টি পাবলিক, ৩টি আন্তর্জাতিক ও ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবার সাধারন, প্রকৌশল, কৃষি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, মেডিকেল, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে সংযুক্ত বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। এদের মধ্যে শতবর্ষী বিশ্ববিদ্যালয়, কয়েকটি আছ অর্ধশতবর্ষী। এগুলোর মধ্যে কোনটির অবস্থা কেমন, পড়াশুনার মান কি ইত্যাদি জানা প্রয়োজন। তাই প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিং সেটি হতে পারে দেশের অভ্যন্তরে, হতে পারে দক্ষিন এশিয়া কিংবা পুরো এশিয়া এমনকি গোটা পৃথিবীতে। 

লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন ৫ টি মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে র‍্যাংকিং প্রকাশ করে। যেমন—শিক্ষা, গবেষণা, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকাম অর্থাৎ শিল্পের সাথে গবেষণাকর্মের বাণিজ্যিকীকরণ। টাইম হায়ার এডুকেশনের নিয়ম অনুযায়ী  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যাচাই করা হয় দুটি বিষয় লক্ষ করে। শিক্ষার মান ও গবেষণার মান। ৩০ শতাংশ প্রতিমান থাকে শিক্ষার মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার অর্থ, সংখ্যা ও মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার প্রভাবে, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে বিদেশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিদেশে গবেষণায় আর ২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে দেশের গবেষণা অনুদান নিয়ে। বিশ্ববিখ্যাত কোয়াককুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাংকিং ৯টি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেগুলো হলোপ্রতিষ্ঠানের খ্যাতি, নিয়োগকর্তাদের খ্যাতি, শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক প্রতি গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশন, বিদেশি শিক্ষকের সংখ্যা, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাফল্য এবং সাসটেইনেবিলিটি। প্রতিটি সূচকে স্কোর থাকে ১০০ অর্থাৎ সর্বমোট ৯০০মার্কের গড় মান হিসাব করে সর্বোচ্চ অর্জিত মানের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিং করা হয়।  কিউএস-এর নিয়ম অনুযায়ী ৪০ শতাংশ পয়েন্ট থাকে শিক্ষার মানে, ১০ শতাংশ থাকে নিয়োগদাতাদের মতামতে, ২০ শতাংশ থাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে, ২০ শতাংশ থাকে গবেষণার সাইটেশনে, ৫শতাংশ থাকে বিদেশী শিক্ষকে এবং ৫ শতাংশ থাকে বিদেশি শিক্ষার্থীতে। 

স্পেনের মাদ্রিদ ভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষনা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্স র‍্যাংকিং প্রধান্য দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইটের কনটেন্ট, শীর্ষ গবেষক এবং সেরা গবেষণা প্রবন্ধের সাইটেশনের উপর। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইটের কনটেন্ট ৫০ শতাংশ, টপ সাইটেড গবেষকের ১০ শতাংশ এবং টপ সাইটেড প্রবন্ধ ৪০ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির সূচক চারটি, যথা—শিক্ষা, নিয়োগযোগ্যতা, যোগ্য শিক্ষকদের সংখ্যা, ও গবেষণা (আউটপুট, উচ্চমানের প্রকাশনা, গবেষণার প্রভাব ও সাইটেশন) শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্্েরর র‌্যাঙ্কিং ২০২৪ এ দেশ সেরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চতুর্থ মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের সেরা ১৭০ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থান ১৬তম। জানুয়াির ২০২৪এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১১ হাজার ৩৯৪টি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিং-২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম সংষ্করণের প্রতিবেদন। প্রথম হয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, তৃতীয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণ পদ্ধতি, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রভাব, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারন, অর্থনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ভূমিকা বিবেচনা করে স্পেনের মাদ্রিদভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিক্স। ২০০৪খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে আসছে। প্রতি বছর জানুয়ারি ও জুলাই মাসে তারা এটি প্রকাশ করে। 

এসব রেটিং একটু খেয়াল করে দেখলে বুঝা যায় যে, প্রথম দশ-বারটি ছাড়া বাকীগুলোর রেটিংয়ের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয় যাকে ৭০০ বলা হচ্ছে , অন্যরেটিংযে সেটি হচ্ছে ১৫০০-এর পরে। আজ যে ২০০০ তমের মধ্যে স্থান পায়নি, পরের মাসে বা মাস দু’য়েক পরে দেখা যায় সেটিই প্রথম। এ কি এক জগাখিচুড়ি কান্ড! কিসের ভিত্তিতে এ রকম ব্যবধান এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলো কিন্তু শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের কাছেই অতটা স্পষ্ট নয় যা স্পষ্ট করা উচিত। ফলে এতসব র‌্যাঙ্কিং এর আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছে কারন কেউ ভালভাবে কিছু বুঝতে পারছেনা। সাধারন মানুষেরও কিন্তু একটি রেটিং আছে। তারাও বুঝেন যে, বুয়েটের পড়াশুনা বাংলাদেশের অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত, তারা প্রায় স্বীকার করবেন যে, নর্থ সাউথ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ইউল্যাব অনেক এগিয়ে আছে। তারা সবাই জানেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক সংখ্যা অনেক বেশি, এখানে ভর্তি হলে শিক্ষার্থীরা এমনেিতই অনেক কিছু জানে পরিবেশের কারনে তবে রাজনীতির আখড়া এবং বর্তমানকালের শিক্ষার্থীরা এই রাজনীতি করে কোন ধরনের সুনাম কুড়াতে পারছেনা, দুর্নাম ছাড়া। এ ধরনের রেটিং কিন্তু সাধারণ্যে প্রচলিত। 

এই রেটিং দিয়ে কি হয় বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এতে কিছু যায় আসে? বিশাল উন্মুক্ত ক্যাম্পাস, নামমাত্র বেতন, বিশাল বিশাল হল, লাইব্রেরি, শিক্ষকরা ক্লাস নেন আর না নেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করুক আর না করুক, ছাত্র সংগঠনগুলো এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ক্যাম্পাসে থাকতে দিক আর না দিক, শিক্ষকরা পড়াশুনা না করিয়ে পার্টির গুণগান করুক আর ভিসি সরাসরি সরকারি পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করুক আর নাই করুক মেধাবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সেগুলোতে ভর্তি হতে হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি নিজেদের মান বজায় রাখার নিমিত্তে ও কোয়ালিটির সাথে কম্প্রেমাইজ না করার জন্য নিজেদের অস্তিত্ব নিজেরাই ঘোষণা করছে। তাতে বাইরের কেউ সেখানে কোন সিল লাগাক আর না লাগাক তাতে কিছু যায় আসেনা। 

এখন বাংলাদেশের ১১৪ টির কমবেশি  প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার বিষয় আছে কারণ মালিকেরা এত মূলধন খাটিয়ে যদি লাভ না পান তাহলে কীভাবে চালাবেন এসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান? এসব থিউরির উপর ভিত্তি করে কেউ কেউ র‍্যাংকিং-এর পেছনে ছুটছেন। মান রক্ষা করার চেষ্টায় নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতে পড়ে যায় বিপদে কারণ কম টিউশন ফিতে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এগিয়ে থাকে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তারা র‍্যাংকিং স্থান করে নেয়ার মাধ্যমে আন্তার্জাতিক শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে ব্যস্ত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই র‍্যাংকিং-এর পেছনে যত অর্থ ব্যয় করে তারা সেটি না করে যদি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মানোন্নয়নে অর্থ ব্যয় করতো তাহলে ঢের ভাল হতো। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান, পাশ করা শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আনতর্জাতিক পর্যায়ে কোথায় কোথায় আছেন— মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ন। বাকীগুলো গৌণ। গবেষণার ক্ষেত্রের দিকে তাকালে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী গবেষণা ও অবদান হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখানকার শিক্ষকগন যা গবেষণা করেন তা দেশের সরাসরি কাজে লাগে। তারা শস্য, ফল, শাক-সবজী, মাছ ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তাদের শিক্ষার্থীরাই বি আর আর আই-নামক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করে কৃষিতে সরাসরি অবদান রাখছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আর কোন তুলনা হওয়ার কথা নয় অথচ দেখা যায় এ বিশ্ববিদ্যালয়টি র‌্যাঙ্কিং-এ কোথাও নেই। তাছাড়া বুয়েটের শিক্ষকগন জাতীয় ও অন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভূত অবদান রাখেন। তবে, এখানকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের চেয়ে বিদেশে অবদান বেশি রাখেন। তারা দেশে কিছুই করতে পারেন না, করার সুযোগও তেমন নেই কিন্তু বিদেশে গিয়ে আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও গবেষণায় প্রচুর এগিয়ে আছেন। আমরা তাদেরকে দেশে রাখার খুব আগ্রহও দেখাই না, তাই তারা বিদেশে চলে যান। 

ঢাকা বিশ্ববিদালয়কে যদি ধরি তাহলে বিসিএস ক্যাডার উৎপাদনে এগিয়ে। এখন এটি কোনো র‍্যাংকিং-এর মান? এছাড়াও যদি ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীন ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মারামারি কথায় আসি তাহলেও র‍্যাংকিং এটি এগিয়ে থাকবে। কাগুজে গবেষণায় যদি আসি যা দেশ ও জাতির সরাসরি খুব একটা কাজে লাগেনা সেটি তো নামমাত্র যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই করেন প্রমোশনের জন্য কিন্তু ঐসব গবেষণা তো মানুষের খুব একটা বা বলতে গেলে সাধারন মানুষের কোন কাজেই আসেনা,শুধুমাত্র একজন শিক্ষক তার নামের আগে ড. লাগাতে পারেন এতটুকু ছাড়া। 

যদি শিক্ষা ক্যাডার বা শিক্ষা প্রশাসনের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিং-এ এগিয়ে থাকবে।  প্রতিপক্ষ শিক্ষার্থীকে দ্রুত হল ও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করার দৌঁড়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ই পারদর্শী তবে চ্ট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইদানিং কালে এই র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকবে। রাজশাহীও এই র‌্যাংকিংয়ে আগ্রগামী থাকবে বাকীগুলোর মধ্যে কোন প্রতিযোগিতাও নেই, কোন নড়াচড়াও নেই। আর বুয়েটের পর রুয়েট, চুয়েট, ও কুয়েট এগিয়ে থাকবে ইদানিং মারামারির জন্য। 

ইউজিসি ও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল মিলে একটি স্টান্ডার্ড তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবজেকটিভ র‌্যাংকিং করার প্রয়োজন ছিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য, একটি টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এবং অন্যটি জেনারেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য। তবে আমাদের ইউজিসি একবার প্রচেষ্টা নিয়েছিল কিন্তু দেশের সেরা দশটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ের তালিকাও প্রকাশ করেছিল যা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে যে, ইউজিসি এ কাজে মোটেই সক্ষম নয়। আবার নতুন করে ইউজিসি আগ্রহ প্রকাশ করছে বিষয়টিতে হাত দেয়ার। আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার মান নির্ধারন করতো গুটিকয়েক জার্ণাল দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্ণালের সংখ্যা বেড়েছে। এসব জার্ণালে গবেষণা প্রবন্ধ ছাপাতে অপেক্ষা করতে হয়, অর্থের ব্যাপার আছে। আমাদের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই যথাযথ বা মানসম্মত পিএইচডি প্রোগ্রাম চালাচ্ছেনা বা তাদের মূল বিষয় পিএইচডি পড়ানো নয় সেখানে গবেষণায় আমাদের দেশে খুব বেশি পয়েন্ট পাবেনা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো এ ধরনের প্রোগ্রামের এখনও অনুমোদন নেই, চিন্তাভাবনা চলছে। কাজেই সেগুলো র‌্যাঙ্কিং-য়ে আগাবেনা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কি র‌্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে প্রথম হয়েছে নাকি ভাল ছিল বলেই তাদের বাদ দিয়ে র‌্যাঙ্কিং হয়না?মূলত প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল শিক্ষক ও গবেষক। কেবল শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চলেনা। সেটি হতে পারে একটি স্নাতক কলেজ। কেবল গবেষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয়না, সেটি হতে পারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান। খেলার মাঠ দিয়ে পড়াশুনা হয় না, এয়ারকন্ডিশন দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের মান তৈরি হয়না। এমআইটির মতো বিশ্ববিদ্যালয় এখনো সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার অভিভাবকদিবস পালন করে যেখানে যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-কোনো অনুষ্ঠানে আসে এবং জানতে পারে কী হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

মৌলিক ও গুণগত মানসম্পন্ন প্রকাশনার সংখ্যা এবং প্রকাশিত প্রবন্ধের যথাযথ সাইটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। গবেষণা যত সমসাময়িক ও মৌলিক হবে, প্রকাশনা তত ভালো জার্নালে হবে এবং সাইটেশন তত বেশি হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ গবেষণা পিয়ার রিভিউবিহীন দুর্বল প্রিডেটরি জার্নালে প্রকাশিত হয়, যেগুলো গুণগত মানের জার্নালে সাইটেশন হয়না বললেই চলে। ফলে এসব গবেষণালব্ধ প্রকাশনা দ্বারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাংঙ্কিংযে সাইটেশন অংশে স্কোর অর্জনে পিছিয়ে থাকে। শিক্ষার্থী সংখ্যা, শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতির একটি নিয়ামক। বৈশ্বিকভাবে উচ্চশিক্ষার মানদন্ডে ন্যূনতম শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত থাকা উচিত ১:২০। কিন্তু আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই অনুপাত ১:৩৫-১:৫০ এর মধ্যে। ফলে ক্লাসের চাপ, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি মানসম্পন্ন উপায়ে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়না। কাজেই প্রথমে প্রয়োজন ইউজিসির র‌্যাঙ্কিং যেটি হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাহলে দুর-দূরান্তে বসে, শুধুমাত্র কিছু পরিচিত শিক্ষকের মতামত আর ওয়েবসাইটে তথ্য দেখে র‌্যাঙ্কিং আসারেই আমাদের অর্থবহ কোন মেসেজ দিচ্ছেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং তো দু’মাস চারমাসের বিষয় নয়, এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। অথচ আমরা দেখছি এক প্রতিষ্ঠান একটি র‌্যাঙ্কিংয়ের ফল প্রকাশ করার কয়েকদিন আর একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ফল প্রকাশ করে। এতে সবাই বিভ্রান্ত হয় এবং র‌্যাঙ্কিংয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জিত হয়না। 

অনেকেই বলছেন র‍্যাংকিং উন্নত বিশ্বের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলো থেকে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালানোর একটি পদ্ধতি।  এগুলোর অধিকাংশেরই মূল উদ্দেশ্য কিন্তু বাণিজ্যিক। তারা র‍্যাংকিং-এর মাধ্যমে উপার্জন করে। একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম কিউ এস র‍্যাংকিং-এর বার্ষিক আয় ৭৫ মিলিয়ন ডলার। আর টাইমস হায়ার এডুকেশন প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার। র‍্যাংকিং-এর যে সব মানদন্ড তা সব ওয়েবসাইটে থাকে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর, সরেজমিনে কোনো প্রদর্শন বা ডাটা কালেকশন বা ইন্টারভিউ হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে র‍্যাংকিং কীভাবে হয়? শুধু ওয়েবসাইটের উপর ভিত্তিক করে এবং পরিচিত শিক্ষকদের মতামতের উপর র‍্যাংকিং নির্ভর করছে, এটি আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনো মেসেজ দিচ্ছে না।