০৬:২১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
                       

মহাযাত্রা রিভিউ: নাজিম উদ দৌলা রচিত অসাধারণ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার

মু. মিজানুর রহমান মিজান
  • প্রকাশ: ১২:৩৪:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ ২০২১
  • / ১১৬৫ বার পড়া হয়েছে

মহাযাত্রা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসের প্রচ্ছদ। ডিজাইনার: আবুল ফাতাহ। প্রকাশক: রোদেলা প্রকাশনী।


Google News
বিশ্লেষণ-এর সর্বশেষ নিবন্ধ পড়তে গুগল নিউজে যোগ দিন

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এবং স্বল্পমূল্যে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

নাজিম উদ দৌলা রচিত ‘মহাযাত্রা’ সাইকোলজিক্যাল উপন্যাসটির পর্যালোচনা বা রিভিউয়ের আগে বলে নিতে চাই- আমি সাধারণত মুক্তশৈলী বা ফ্রি-স্টাইলে বই এবং সিনেমার পর্যালোচনা করতেই পছন্দ করি। এর আগে দৈনিক ইত্তেফাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা থেকে শুরু করে বেশ কিছু বই ও সিনেমার রিভিউ আমি ফ্রি-স্টাইলেই করেছি। তবে এখন একটু ফরমুলা মেইনটেইন করেই রিভিউ করতে চেষ্টা করছি, আমি জানি না কেমন হবে এটি। কথা না বাড়িয়ে এবার সরাসরি ‘মহাযাত্রা’র রিভিউয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাক। তবে আপনি কাঠামোবদ্ধ বা ফরমুলা পর্যালোচনা এবং মুক্তশৈলী বা ফ্রি-স্টাইলের পর্যালোচনা সম্পর্কে জানুন এখানে ক্লিক করে।

নাজিম-উদ-দৌলা রচিত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাস ‘মহাযাত্রা’

মহাযাত্রা, নাজিম উদ দৌলার লেখা একটি পাঠকপ্রিয় উপন্যাস। বাইশটি অধ্যায়ে লিখিত এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়, আদী প্রকাশন থেকে। পরিবর্তিতে রোদেলা প্রকাশনী থেকে এই বইটি দ্বিতীয়বারের মতো প্রকাশ হয় ২০১৮ সালে। তৃতীয়বারের মতো ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনী নতুন মোড়কে প্রকাশ করা হয় ‘মহাযাত্রা’। ‘মহাযাত্রা’ হলো একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। বইটির দ্বিতীয় প্রচ্ছদটি করেছেন আবুল ফাতাহ।

একনজরে ‘মহাযাত্রা’

নাজিম-উদ-দৌলা রচিত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসটিতে দেখা যায় একের পর এক খুন হয়ে চলেছে কোনো এক অদৃশ্য সাইকোপ্যাথের ইশারায়। এই খুনকে একটি খেলার সাথে তুলনা করেছে সেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকা সাইকোপ্যাথ। আর এই খেলাটির নামই ‘মহাযাত্রা’। এই মহাযাত্রা নামক খেলাটি খেলা হয়ে থাকে একেকটি খবরের কাগজ থেকে কেটে রাখা একেকটি অংশের ওপর ভিত্তি করে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবিদ, যার শরীরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্র্যাকার; আর সেই ট্র্যাকারের মাধ্যমে অদৃশ্য হয়ে থাকা সাইকোপ্যাথ সারাক্ষণ আবিদকে নিজের নজরে রাখতে পারে এবং আবিদকে শুনতেও পারে। অবশ্য এই আবিদ নামটি এই চরিত্রের আসল নাম নয়, এটি ছদ্মনাম। এখানে পারভিন নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। মহাযাত্রা উপন্যাসটি শুধু একটি খুনের গল্প নয়, জনাব নাজিম এখানে তুলে এনেছেন শহরের বস্তি এলাকায় বসবাস করা মানুষের জীবন, কর্পোরেট সমাজের একাংশ; তিনি এখানে বলে গিয়েছেন সংসার, প্রেম, প্রতারণা ও লালসা ও প্রতিশোধের গল্প। এখানে বড়ো মাপের কয়েকটি বড়ো প্রশ্ন হলো- ‘সাইকোপ্যাথ কে?’, ‘পারভিন এখানে কেন গুরুত্বপূর্ণ?’, ‘আবিদের খুনি হয়ে ওঠার পেছনের গল্প কী?’ আর আরেকটি প্রশ্ন হলো- ‘গল্পের শেষ কোথায়?’

‘মহাযাত্রা’ আমার কাছে যেমন

প্রথমেই বলি, আমি ফিকশন পড়ার চেয়ে দেখতে পছন্দ করি। স্বাভাবিকভাবেই আমার পড়া উপন্যাস খুব বেশি নয়। আমি নাজিম উদ দৌলার লেখা এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসটি যদি না পড়ে পর্দায় দেখতে পারতাম তাহলে বেশি খুশি হতাম। মহাযাত্রা নামের এই উপন্যাসটি চাইলে আগেই পড়তে পারতাম কিন্তু আগ্রহ জন্মেনি। এবার যখন দেখলাম এই উপন্যাসটির প্রচ্ছদে পরিবর্তন এসেছে তখনই এটি পড়ার আগ্রহ জাগলো।

যখন পড়া শুরু করি তখন কয়েকটা পাতা যেতে না যেতেই আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে যাই। কারণ আমি যা পড়ছিলাম তা বেশ গতানুগতিক ধরনের মনে হয়েছে এবং এ পর্যন্ত আমার দেখা অনেক সিনেমাতেই এরকম দৃশ্য দেখেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম, এ উপন্যাসটি তেমন নয় যেমন আমি খুঁজি বা বৃত্তের বাইরের কোনো গল্প এটি নয়। তবু একটু জোর করেই পড়া চালিয়ে গেলাম। পরক্ষণেই সামনে এলো শরহরের বস্তি এলাকার জীবনচিত্র। বস্তি এলাকা তথা সমাজে বসবাস করা খুবই কম আয়ের মানুষের জীবনকে নাজিম উদ দৌলা এত সুন্দরভাবে অঙ্কন করেছেন যে আমি আর এটাকে সরিয়ে রাখার চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি। কিছু অংশে তো যে কেউ আবেগি হয়েও যেতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস রাখি। নাজিম সাহেব ফরমুলা মেনেই এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারটি লিখে থাকলেও নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনকে খুব কাছ থেকে তুলে এনেছেন যা এই উপন্যাসটির সবচেয়ে ভালো ও আকর্ষণীয় দিক। উপন্যাসটি পড়ার মাঝপথে যখন লেখকের কাছে আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করি তাঁর লেখনিতে ফুটে ওঠা স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে তখন তিনি আমাকে জানান যে, সে এই অবস্থা খুবই কাছ থেকেই দেখেছেন। এই একই কথা তিনি পাঠকদের উদ্দেশে বইয়ের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন।

এই উপন্যাসটি মূল গল্পের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, একের পর এক খুন করে যাচ্ছে একজন। এই খুনি যাদেরকে খুন করে তাঁরাও আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে খুন করেছে। লেখক এই এ প্রধান দিকটি নিখুঁতভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কাটা দিয়ে কাটা তোলার গল্প। যতই সামনে এগোই, ততই ভালো লাগতে থাকে। এখানে যা কিছু টুইস্ট আছে তা আমার কাছে বোধগম্যই ছিল এই গল্পটি শেষ পর্যন্ত পড়ার পর আমার ভালো লেগেছে সত্যি, কিন্তু আমি বলতে পারি না যে, এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসটি অন্যতম সেরা একটি থ্রিলার উপন্যাস। অন্যতম সেরা না হলেও যে, পাঠক নিরাশ হবেন তেমনও নয়। আমি আবারও বলছি, উপন্যাসটি একটি ফরমুলা উপন্যাস বা কোনো না কোনো মাধ্যম থেকে ইনস্পায়ার্ড হলেও পাঠকের ভালো লাগবে।

‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসের নাম কেন ‘মহাযাত্রা’?

বর্তমান সময়ের অন্যতম জপ্রিয় থ্রিলার লেখক নাজিম উদ দৌলা রচিত ‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসটির নাম করণ নিয়ে যে-কোনো পাঠকই আন্দাজ করতে পারবেন কিছুটা। আমরা জানি, মহাযাত্রা মানে মৃত্যুকেই বোঝানো হয়ে থাকে। তবে এ উপন্যাসে শুধু মৃতুকে বোঝানোর জন্যই লেখক এই বিশেষ শব্দের প্রয়োগ করেননি। এখানে এক প্রকারের ‘লাইভ গেম শো’ রয়েছে যার নামও মহাযাত্রা। আর বাকিটা বোঝার জন্য যদি কোনো পাঠক উৎসাহীয়ে থাকেন তাহলে সে বইটি পড়ুক, আমি চাই। এখানে বলা উচিৎ ‘মহাযাত্রা’ নামটি শুধু নামের জন্যই নয়, এর সার্থকতা অবশ্যই খুঁজে পাওয়া গিয়েছে এখানে।

‘মহাযাত্রা’য় বানান সমস্যা

নাজিম উদ দৌলাকে একজন বানান সচেতন লেখক হিসেবেই পেয়েছি তাঁর লেখা এই ‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসে। তবে তিনি কিছু বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানকে এড়িয়ে গিয়ে প্রচলিত বানানকেই বড়ো করে দেখেছেন। পাশাপাশি বেশ কয়েক জায়গায় বানানের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। ত্রুটি যা আছে তার পরিমাণ খুবই কম এবং তা নিয়ে পাঠক হিসেবে নেতিবাচক প্রুতিক্রিয়া ব্যক্ত না করাই ভালো।

‘মহাযাত্রা’র প্রচ্ছদ

আমি উপরের দিকেই বলেছি, বইটি প্রথম প্রকাশের সময় যে প্রচ্ছদটি ছিল সে প্রচ্ছদটি বাদ দিয়ে নতুন এই প্রচ্ছদে বইটি আনার কারণেই আমি ‘মহাযাত্রা’ পড়তে আগ্রহী হই। যদিও প্রচ্ছদশিল্পি আবুল ফাতাহর বানানো এ প্রচ্ছদটি আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। ম্যানিপুলেশন বাদ দিয়ে ডিজাইনের ক্ষেত্রে আরেকটু খেয়াল করা উচিৎ ছিল বলে আমি মনে করি। সফটকপিতে প্রচ্ছদটি যতটা জীবন্ত লাগে, তার পঞ্চাশভাগও হার্ডকপিতে লাগে না। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আমার মন্তব্য হলো, এতটা ম্যানিপুলেটেড প্রচ্ছদ আমার পছন্দ নয়। জনাব আবুল ফাতাহ, প্রচ্ছদের উলটো দিকে বেশ কিছু ‘পেপার কাটিং’ সেঁটে দিয়েছেন যা কনসেপ্ট বিবেচনায় গ্রহণপযোগ্য কিন্তু আপনি যদি বইটি সম্পূর্ণ পড়ে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন- এখানে যে ‘পেপার-কাটিং’ ট্যাগ করে দেওয়া হয়েছে তার সাথে গল্পের সম্পর্ক নেই। অবশ্য আগের প্রচ্ছদটিও এরকম আইডিয়ার ওপরেই ডিজাইন করা ছিল, পার্থক্য শুধু রঙের খেলায়। প্রচ্ছদশিল্পি চাইলেই আরও ভালো করে কাজটি করতে পারতেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘যদি আমার এই প্রচ্ছদটি ভালো না লেগেই থাকে তাহলে এই প্রচ্ছদের কারণে আমার ‘মহাযাত্রা পড়ার আগ্রহ কেন জেগেছিল?’ সহজ উত্তর, যেহেতু বইটির প্রচ্ছদকে নতুন করে ডিজাইন করা হয়েছে সেহেতু আমি ধরেই নিয়েছিলাম এখানে এমন কিছু আছে যা পূর্বের প্রচ্ছদে মিসিং ছিল। আর আমি প্রচ্ছদটির কনসেপ্ট নিয়ে নেতিবাচক অবস্থানে নই; এখানে আবুল ফাতাহ তাঁর দারূন একটি কনসেপ্টকে দারুণভাবে এক্সিকিউট করতে পারেননি। আবুল ফাতাহর প্রচ্ছদ ডিজাইন সম্পর্কে আমি জানি, তিনি বরাবরই ভালো কাজ করে থাকেন কিন্তু এটি বুঝতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারিনি যে, এই প্রচ্ছদটিতে তিনি নিজের স্বাক্ষর কেন রাখতে পারেননি।

‘মহাযাত্রা’ নিয়ে শেষ কথা

ফরমুলা মেনে ‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসটি রচিত হলেও লেখক নাজিম উদ দৌলা এখানে নিজের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। আন্ডাররেটড এই উপন্যাসটির লেখক খুব ভালো করেই পাঠকের আবেগকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছেন। আমি জানি না। বাংলাদেশে আর কে ভালো সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখে থাকেন কিন্তু আমি যদি এটাকে আমার দেখা বেশ কিছু বিদেশি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ফিল্মের সাথে তুলনা করি তাহলে এই ‘মহাযাত্রা’র গল্প এবং এর বিন্যাস বেশ উন্নত মানেরই বলতে হবে। এ গল্পে ভালো ফিল্ম হতে পারে, তবে সেটা বাংলাদেশি কারও হাতে নয়। ‘মহাযাত্রা’ ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলাদেশে।

নামমহাযাত্রা
লেখকনাজিম উদ দৌলা
ধরনউপন্যাস (সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার)
প্রকাশকালপ্রথম প্রকাশ: ২০১৬, দ্বিতীয় প্রকাশ: ২০১৮ তৃতীয় প্রকাশ: ২০২১
প্রকাশকপ্রথম: আদী প্রকাশন, দ্বিতীয় ও তৃতীয়: রোদেলা প্রকাশনী (বর্তমান)
প্রচ্ছদশিল্পিশাহরিয়ার রাকিন (প্রথম, ২০১৮) এবং আবুল ফাতাহ (দ্বিতীয়, ২০২১)
অনলাইন পরিবেশকরকমারি ডট কম, বই বাজার ডট কম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার তথ্য সংরক্ষিত রাখুন

লেখকতথ্য

মু. মিজানুর রহমান মিজান

মু. মিজানুর রহমান মিজান একজন স্বাধীন শিক্ষামূলক লেখক। তিনি শিক্ষা গবেষণায় বেশ আগ্রহী। যৌথভাবে কিছু গবেষণায়ও অংশ নিয়েছেন।

বিশেষ শর্তসাপেক্ষে এই ওয়েবসাইটটি সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিকট বিক্রি করা হবে।

মহাযাত্রা রিভিউ: নাজিম উদ দৌলা রচিত অসাধারণ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার

প্রকাশ: ১২:৩৪:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ মার্চ ২০২১

নাজিম উদ দৌলা রচিত ‘মহাযাত্রা’ সাইকোলজিক্যাল উপন্যাসটির পর্যালোচনা বা রিভিউয়ের আগে বলে নিতে চাই- আমি সাধারণত মুক্তশৈলী বা ফ্রি-স্টাইলে বই এবং সিনেমার পর্যালোচনা করতেই পছন্দ করি। এর আগে দৈনিক ইত্তেফাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা থেকে শুরু করে বেশ কিছু বই ও সিনেমার রিভিউ আমি ফ্রি-স্টাইলেই করেছি। তবে এখন একটু ফরমুলা মেইনটেইন করেই রিভিউ করতে চেষ্টা করছি, আমি জানি না কেমন হবে এটি। কথা না বাড়িয়ে এবার সরাসরি ‘মহাযাত্রা’র রিভিউয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া যাক। তবে আপনি কাঠামোবদ্ধ বা ফরমুলা পর্যালোচনা এবং মুক্তশৈলী বা ফ্রি-স্টাইলের পর্যালোচনা সম্পর্কে জানুন এখানে ক্লিক করে।

নাজিম-উদ-দৌলা রচিত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাস ‘মহাযাত্রা’

মহাযাত্রা, নাজিম উদ দৌলার লেখা একটি পাঠকপ্রিয় উপন্যাস। বাইশটি অধ্যায়ে লিখিত এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়, আদী প্রকাশন থেকে। পরিবর্তিতে রোদেলা প্রকাশনী থেকে এই বইটি দ্বিতীয়বারের মতো প্রকাশ হয় ২০১৮ সালে। তৃতীয়বারের মতো ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলায় রোদেলা প্রকাশনী নতুন মোড়কে প্রকাশ করা হয় ‘মহাযাত্রা’। ‘মহাযাত্রা’ হলো একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। বইটির দ্বিতীয় প্রচ্ছদটি করেছেন আবুল ফাতাহ।

একনজরে ‘মহাযাত্রা’

নাজিম-উদ-দৌলা রচিত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসটিতে দেখা যায় একের পর এক খুন হয়ে চলেছে কোনো এক অদৃশ্য সাইকোপ্যাথের ইশারায়। এই খুনকে একটি খেলার সাথে তুলনা করেছে সেই কেন্দ্রীয় চরিত্রে থাকা সাইকোপ্যাথ। আর এই খেলাটির নামই ‘মহাযাত্রা’। এই মহাযাত্রা নামক খেলাটি খেলা হয়ে থাকে একেকটি খবরের কাগজ থেকে কেটে রাখা একেকটি অংশের ওপর ভিত্তি করে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবিদ, যার শরীরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ট্র্যাকার; আর সেই ট্র্যাকারের মাধ্যমে অদৃশ্য হয়ে থাকা সাইকোপ্যাথ সারাক্ষণ আবিদকে নিজের নজরে রাখতে পারে এবং আবিদকে শুনতেও পারে। অবশ্য এই আবিদ নামটি এই চরিত্রের আসল নাম নয়, এটি ছদ্মনাম। এখানে পারভিন নামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। মহাযাত্রা উপন্যাসটি শুধু একটি খুনের গল্প নয়, জনাব নাজিম এখানে তুলে এনেছেন শহরের বস্তি এলাকায় বসবাস করা মানুষের জীবন, কর্পোরেট সমাজের একাংশ; তিনি এখানে বলে গিয়েছেন সংসার, প্রেম, প্রতারণা ও লালসা ও প্রতিশোধের গল্প। এখানে বড়ো মাপের কয়েকটি বড়ো প্রশ্ন হলো- ‘সাইকোপ্যাথ কে?’, ‘পারভিন এখানে কেন গুরুত্বপূর্ণ?’, ‘আবিদের খুনি হয়ে ওঠার পেছনের গল্প কী?’ আর আরেকটি প্রশ্ন হলো- ‘গল্পের শেষ কোথায়?’

‘মহাযাত্রা’ আমার কাছে যেমন

প্রথমেই বলি, আমি ফিকশন পড়ার চেয়ে দেখতে পছন্দ করি। স্বাভাবিকভাবেই আমার পড়া উপন্যাস খুব বেশি নয়। আমি নাজিম উদ দৌলার লেখা এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসটি যদি না পড়ে পর্দায় দেখতে পারতাম তাহলে বেশি খুশি হতাম। মহাযাত্রা নামের এই উপন্যাসটি চাইলে আগেই পড়তে পারতাম কিন্তু আগ্রহ জন্মেনি। এবার যখন দেখলাম এই উপন্যাসটির প্রচ্ছদে পরিবর্তন এসেছে তখনই এটি পড়ার আগ্রহ জাগলো।

যখন পড়া শুরু করি তখন কয়েকটা পাতা যেতে না যেতেই আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে যাই। কারণ আমি যা পড়ছিলাম তা বেশ গতানুগতিক ধরনের মনে হয়েছে এবং এ পর্যন্ত আমার দেখা অনেক সিনেমাতেই এরকম দৃশ্য দেখেছি। আমি বুঝতে পারছিলাম, এ উপন্যাসটি তেমন নয় যেমন আমি খুঁজি বা বৃত্তের বাইরের কোনো গল্প এটি নয়। তবু একটু জোর করেই পড়া চালিয়ে গেলাম। পরক্ষণেই সামনে এলো শরহরের বস্তি এলাকার জীবনচিত্র। বস্তি এলাকা তথা সমাজে বসবাস করা খুবই কম আয়ের মানুষের জীবনকে নাজিম উদ দৌলা এত সুন্দরভাবে অঙ্কন করেছেন যে আমি আর এটাকে সরিয়ে রাখার চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছি। কিছু অংশে তো যে কেউ আবেগি হয়েও যেতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস রাখি। নাজিম সাহেব ফরমুলা মেনেই এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারটি লিখে থাকলেও নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনকে খুব কাছ থেকে তুলে এনেছেন যা এই উপন্যাসটির সবচেয়ে ভালো ও আকর্ষণীয় দিক। উপন্যাসটি পড়ার মাঝপথে যখন লেখকের কাছে আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করি তাঁর লেখনিতে ফুটে ওঠা স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনচিত্র নিয়ে তখন তিনি আমাকে জানান যে, সে এই অবস্থা খুবই কাছ থেকেই দেখেছেন। এই একই কথা তিনি পাঠকদের উদ্দেশে বইয়ের শুরুতেই উল্লেখ করেছেন।

এই উপন্যাসটি মূল গল্পের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, একের পর এক খুন করে যাচ্ছে একজন। এই খুনি যাদেরকে খুন করে তাঁরাও আবার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে খুন করেছে। লেখক এই এ প্রধান দিকটি নিখুঁতভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কাটা দিয়ে কাটা তোলার গল্প। যতই সামনে এগোই, ততই ভালো লাগতে থাকে। এখানে যা কিছু টুইস্ট আছে তা আমার কাছে বোধগম্যই ছিল এই গল্পটি শেষ পর্যন্ত পড়ার পর আমার ভালো লেগেছে সত্যি, কিন্তু আমি বলতে পারি না যে, এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার উপন্যাসটি অন্যতম সেরা একটি থ্রিলার উপন্যাস। অন্যতম সেরা না হলেও যে, পাঠক নিরাশ হবেন তেমনও নয়। আমি আবারও বলছি, উপন্যাসটি একটি ফরমুলা উপন্যাস বা কোনো না কোনো মাধ্যম থেকে ইনস্পায়ার্ড হলেও পাঠকের ভালো লাগবে।

‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসের নাম কেন ‘মহাযাত্রা’?

বর্তমান সময়ের অন্যতম জপ্রিয় থ্রিলার লেখক নাজিম উদ দৌলা রচিত ‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসটির নাম করণ নিয়ে যে-কোনো পাঠকই আন্দাজ করতে পারবেন কিছুটা। আমরা জানি, মহাযাত্রা মানে মৃত্যুকেই বোঝানো হয়ে থাকে। তবে এ উপন্যাসে শুধু মৃতুকে বোঝানোর জন্যই লেখক এই বিশেষ শব্দের প্রয়োগ করেননি। এখানে এক প্রকারের ‘লাইভ গেম শো’ রয়েছে যার নামও মহাযাত্রা। আর বাকিটা বোঝার জন্য যদি কোনো পাঠক উৎসাহীয়ে থাকেন তাহলে সে বইটি পড়ুক, আমি চাই। এখানে বলা উচিৎ ‘মহাযাত্রা’ নামটি শুধু নামের জন্যই নয়, এর সার্থকতা অবশ্যই খুঁজে পাওয়া গিয়েছে এখানে।

‘মহাযাত্রা’য় বানান সমস্যা

নাজিম উদ দৌলাকে একজন বানান সচেতন লেখক হিসেবেই পেয়েছি তাঁর লেখা এই ‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসে। তবে তিনি কিছু বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানকে এড়িয়ে গিয়ে প্রচলিত বানানকেই বড়ো করে দেখেছেন। পাশাপাশি বেশ কয়েক জায়গায় বানানের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। ত্রুটি যা আছে তার পরিমাণ খুবই কম এবং তা নিয়ে পাঠক হিসেবে নেতিবাচক প্রুতিক্রিয়া ব্যক্ত না করাই ভালো।

‘মহাযাত্রা’র প্রচ্ছদ

আমি উপরের দিকেই বলেছি, বইটি প্রথম প্রকাশের সময় যে প্রচ্ছদটি ছিল সে প্রচ্ছদটি বাদ দিয়ে নতুন এই প্রচ্ছদে বইটি আনার কারণেই আমি ‘মহাযাত্রা’ পড়তে আগ্রহী হই। যদিও প্রচ্ছদশিল্পি আবুল ফাতাহর বানানো এ প্রচ্ছদটি আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। ম্যানিপুলেশন বাদ দিয়ে ডিজাইনের ক্ষেত্রে আরেকটু খেয়াল করা উচিৎ ছিল বলে আমি মনে করি। সফটকপিতে প্রচ্ছদটি যতটা জীবন্ত লাগে, তার পঞ্চাশভাগও হার্ডকপিতে লাগে না। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে আমার মন্তব্য হলো, এতটা ম্যানিপুলেটেড প্রচ্ছদ আমার পছন্দ নয়। জনাব আবুল ফাতাহ, প্রচ্ছদের উলটো দিকে বেশ কিছু ‘পেপার কাটিং’ সেঁটে দিয়েছেন যা কনসেপ্ট বিবেচনায় গ্রহণপযোগ্য কিন্তু আপনি যদি বইটি সম্পূর্ণ পড়ে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন- এখানে যে ‘পেপার-কাটিং’ ট্যাগ করে দেওয়া হয়েছে তার সাথে গল্পের সম্পর্ক নেই। অবশ্য আগের প্রচ্ছদটিও এরকম আইডিয়ার ওপরেই ডিজাইন করা ছিল, পার্থক্য শুধু রঙের খেলায়। প্রচ্ছদশিল্পি চাইলেই আরও ভালো করে কাজটি করতে পারতেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, ‘যদি আমার এই প্রচ্ছদটি ভালো না লেগেই থাকে তাহলে এই প্রচ্ছদের কারণে আমার ‘মহাযাত্রা পড়ার আগ্রহ কেন জেগেছিল?’ সহজ উত্তর, যেহেতু বইটির প্রচ্ছদকে নতুন করে ডিজাইন করা হয়েছে সেহেতু আমি ধরেই নিয়েছিলাম এখানে এমন কিছু আছে যা পূর্বের প্রচ্ছদে মিসিং ছিল। আর আমি প্রচ্ছদটির কনসেপ্ট নিয়ে নেতিবাচক অবস্থানে নই; এখানে আবুল ফাতাহ তাঁর দারূন একটি কনসেপ্টকে দারুণভাবে এক্সিকিউট করতে পারেননি। আবুল ফাতাহর প্রচ্ছদ ডিজাইন সম্পর্কে আমি জানি, তিনি বরাবরই ভালো কাজ করে থাকেন কিন্তু এটি বুঝতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারিনি যে, এই প্রচ্ছদটিতে তিনি নিজের স্বাক্ষর কেন রাখতে পারেননি।

‘মহাযাত্রা’ নিয়ে শেষ কথা

ফরমুলা মেনে ‘মহাযাত্রা’ উপন্যাসটি রচিত হলেও লেখক নাজিম উদ দৌলা এখানে নিজের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছেন। আন্ডাররেটড এই উপন্যাসটির লেখক খুব ভালো করেই পাঠকের আবেগকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছেন। আমি জানি না। বাংলাদেশে আর কে ভালো সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখে থাকেন কিন্তু আমি যদি এটাকে আমার দেখা বেশ কিছু বিদেশি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ফিল্মের সাথে তুলনা করি তাহলে এই ‘মহাযাত্রা’র গল্প এবং এর বিন্যাস বেশ উন্নত মানেরই বলতে হবে। এ গল্পে ভালো ফিল্ম হতে পারে, তবে সেটা বাংলাদেশি কারও হাতে নয়। ‘মহাযাত্রা’ ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলাদেশে।

নামমহাযাত্রা
লেখকনাজিম উদ দৌলা
ধরনউপন্যাস (সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার)
প্রকাশকালপ্রথম প্রকাশ: ২০১৬, দ্বিতীয় প্রকাশ: ২০১৮ তৃতীয় প্রকাশ: ২০২১
প্রকাশকপ্রথম: আদী প্রকাশন, দ্বিতীয় ও তৃতীয়: রোদেলা প্রকাশনী (বর্তমান)
প্রচ্ছদশিল্পিশাহরিয়ার রাকিন (প্রথম, ২০১৮) এবং আবুল ফাতাহ (দ্বিতীয়, ২০২১)
অনলাইন পরিবেশকরকমারি ডট কম, বই বাজার ডট কম ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম।